“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
১০.
মৃদুমন্দ বাতাসের আনাগোনা। বেশ নামি-দামি একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে রোদসী। মোবাইলে আরেকবার চোখ বুলাতেই বোধগম্য হলো, এখানে পৌঁছানোর বিশ মিনিট পাড় হয়েছে। কিন্তু যার আশায় এখানে বসে আছে সে ব্যাক্তির নামগন্ধও নেই। নাম টামও তো কিছু জানেনা। জেদ করে ছবিও দেখেনি। নাম্বারও নেই, যে কল করে জিজ্ঞেস করবে। নাহলে, মেয়েটার যে পরিমাণ মেজাজ গরম এতক্ষণে উল্টো পাল্টা কান্ড ঘটিয়ে দিতো। নেহাৎ এখানে অনেক মানুষ আছে। বিরক্ত হয়ে মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রল করতে নিলেই কোথায় থেকে একটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে সামনের সিটে বসে তাড়াতাড়ি বলে,
‘সরি সরি, একচুয়েলি রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। তাই দেরি হয়ে গেছে। ‘
রোদসী ভালো করে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালো। সিট থেকে উঠে গেলো। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। চোখ দুটো টলমলে হয়ে গেছে।
বুকের ভিতরটায় তীব্র ঢিপঢিপ আওয়াজে ভরে উঠলো। রোদসী কোনোমতে বলল,
‘ সায়াম ভাইয়া, আপনি! ‘
সায়াম চমকে তাকালো। প্রথমে অচেনা লাগলেও এখন পুরোপুরি চিনতে পারলো। অতিরিক্ত মাত্রায়
অবাক হয়ে গেলো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো, খড়ির মতো চিকনচাকন হাস্যজ্জল কিশোরীটি এখন চশমায় পূর্ণ যুবতী। চেহারায়ও কী বিরাট পরিবর্তন! সে সামলে বলল,
‘রোদ তুমি! ‘
রোদসী তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গেলো সেখানে থেকে। দ্রুত পদচারণে রিকশায় উঠে বসলো। পেছনে থেকে সায়াম বারবার ডাকছে। সেসব কিছু কানে না এলেও, একটা বাক্য মস্তিষ্কে ধাক্কা দিলো,
‘রোদ, ভাইয়া তাঁর কাজের জন্য অনুতপ্ত। তুমি যেওনা, শোনো আমার..’
চোখ বন্ধ করে খিঁচে রইলো রোদসী। কেন অতীত হানা দিলো বর্তমানে! তাঁর জীবন তো বেশ চলছে। লাশের মতো অনুভূতিহীন। তবুও কেনো?
দরজা খোলা পেয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো রোদসী ৷ কেয়া ও মনিরুল হোসেন দুজনেই ওর অপেক্ষায় বসে ছিলেন। রোদসীর মুখের মেয়ে তাকিয়ে ভড়কে গেলেন। কেয়া কাছে এসে কিছু বলার আগেই রোদসী উচ্চস্বরে বলল,
‘তোমাদের উপর যদি আমি এতোই বোঝা হই, তাহলে আগে কেনো বললে না! তাহলে আমি আর তোমাদের কষ্ট বাড়াতাম না অন্তত। আমাকে বিদায় করতে এতোই উঠেপড়ে লেগেছো যে ছেলের ব্যাপারে কিছু না জেনেই বিয়ে দিতে চাও! ‘
কেয়া ও মনিরুল দুজন দুজনের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিলেন৷ মনিরুল হোসেন চিন্তিত মুখে বললেন,
‘কী হয়েছে তোমার? এসব কী বলছো? রায়হান যথেষ্ট ভালো ছেলে। ‘
রোদসীর গলা ভেঙে এসেছে। কোনোরকম কান্না গলায় আঁটকে বলল,
‘তোমার ভালো পাত্রের পুরো নাম জানো কী? ‘
‘হ্যা, রায়হান আহমেদ। ‘
‘আর ডাকনাম? ‘
‘বাসায় কী বলে ডাকে আমি কী করে জানবো! অফিসে এই নামেই পরিচিত। কিন্তু হয়েছেটা কী?’
‘তাহলে শোনো, সে শুধু রায়হান নয় সায়ামও। সূর্যের ছোট ভাই সায়াম। ‘
মনিরুল হোসেন থমকে গেলেন। মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। আবারও এতবড় ভুল কী করে করতে যাচ্ছিলেন ভেবেই কূল কিনারা পাচ্ছেন না।
কেয়া হোসেন কেঁদে ফেললেন মুখে আঁচল গুঁজে।
রোদসী নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। দুজনে অনেক ধাক্কা দিয়েও কাজ হলো না। পাঁচ ছয় মিনিট পর রোদসী দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। হাতে কাপড় চোপড়ের ব্যাগ। চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। কেয়া হোসেন কেঁদে বললেন,
‘কোথায় যাচ্ছিস তুই? ‘
রোদসী যেতে যেতে শক্ত কন্ঠে বলল,
‘তোমাদের বোঝাটা কমাতে যাচ্ছি। ভালো থাকো এবার। ‘
‘এসব কী বলছিস তুই? নিজের বাসা ছেড়ে কই যাবি!’
‘চিন্তা করোনা,কোনো প্রেমিকের সাথে পালাচ্ছি না। ‘
কথাটা যে রোদসী তাদের দু’জনকে কটাক্ষ করে বলেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তু এসময় কেউ সেটায় গুরুত্ব দিলো না। রোদসী কাউকে সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কোথায় গেল দুজনেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন। মনিরুল হোসেন বললেন,
‘আবারও ভুল করলাম, ভালো করে খোঁজ না নিয়েই মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলাম। ‘
কেয়া হতাশ হয়ে বললেন,
‘মেয়েটা একা একা এতো জেদি হয়ে গেছে, আত্মসম্মানে একটু আঘাত লাগলেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মনে হয় না, এক মাসের আগে আর ফিরবে। ‘
শহর ভার্সিটির পরীক্ষা শেষ করে বাসায় ফিরছিলো। রোদসীকে কোথাও ব্যাগ হাতে যেতে দেখে পিছুডাক দিলো। কিন্তু রোদসী হয়তো তা শোনেনি। শহর ভ্রু কুচকে ভাবলো,’ কী হলো মেয়েটার! ‘ উপর থেকে আর্শকে নামতে দেখে শহর বলল,
‘এই আরু! এদিকে এসো। ‘
আর্শ গোমড়া মুখে এগিয়ে আসলো। শহর তাঁর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
‘কী ব্যাপার? তোমার রাগী বোন কই গেলো? ‘
‘আপু, প্রায়ই রাগ করে বাসা থেকে চলে যায়। তিন চার বছর ধরে তাই দেখছি। ‘
শহর চমকে বলল,
‘চলে যায়! কোথায়? ‘
‘মামাবাড়ি, আশরাফ ভাইয়ার কাছে। ‘
শহর অপ্রসন্ন হলো কিছুটা। গম্ভীর গলায় বলল,
‘আশরাফ কে? ‘
‘আমার বড় মামার ছেলে। সে বাড়িতে সবার চোখের মণি রোদি আপু। সারাজীবন ওখানে থাকলেও সবাই আদরে রাখবে। আশরাফ ভাইয়ার আদরের দুলালি রোদি আপু। এক মাসের আগে মনে হয় না আসবে। ‘
শহরের মুখটা কালো হয়ে গেলো। সে সামনে অগ্রসর হয়। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। বুঝতে পারলো না, অস্থিরতার কারণটা কী রোদসীর দূরে যাওয়া নাকি আশরাফ নামের ছেলেটা?
চলবে-
লেখিকা -নাঈমা হোসেন রোদসী।