লাল_ছাতি
২য়_পর্ব
খাওয়া শেষে সবাই যখন গল্পের আসর বসালো তখন নূর খেয়াল করলো রিদওয়ান এবং পারমীতা উভয়ই নেই। নূরের মনে কৌতুহল জন্মালো। তাদের খুজতে খুজতে নূর পৌছালো নিজের বেড রুমের বাহিরে। দরজাটা হালকা ভেজানো। বুকটা অহেতুক কারণেই ধরফর করছে নূরের। কেনো যেনো খুব কাঁপছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে দরজাটা খুললো নূর। দরজা খুলতেই যা দেখলো তাতে নূরের মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। রিদওয়ান পারমীতাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নূরের হাত পা যেনো অসাড় হয়ে আসছে। রিদওয়ান এবং পারমীতাকে এমন অবস্থায় দেখবে কল্পনাতেও ভাবে নি সে। অজান্তেই মুখ ফসকে অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে এলো, “রিদওয়ান” নূরের কন্ঠে কানে আসতেই রিদওয়ান পেছনে তাকায়। পারমীতা এখনো তার বুকে লেপ্টে আছে। রিদওয়ানের কাতর দৃষ্টি এবং চিন্তিত মুখশ্রী নূরের চোখ এড়ালো না। রিদওয়ান ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“নূর, তাড়াতাড়ি আসো। পারমীতা সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।”
নূরের মাথা কাজ করছে না। কি সত্যি কি মিথ্যে তার বিচার করাটা এতোটা কঠিন হবে জানা ছিলো না নূরের, তবুও মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পা চালিয়ে ভেতরে ভেতরে প্রবেশ করে সে। নিষ্প্রভ কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে পারমীতার?”
“জানা নেই, ওর শরীরটা নাকি ভালো লাগছিলো না। তুমি তখন রান্নাঘরে ছিলে, তাই আমি ওকে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিলাম। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। তুমি একটু হেল্প করো প্লিজ”
রিদওয়ান প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তার আতঙ্কের কারণটি বুঝতে পারলো না নূর। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো সে। এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করলো রিদওয়ানকে। পারমীতা সত্যি সেন্সলেন্স হয়ে গিয়েছে। তাকে কোনোমতে বিছানায় শোয়ালো তারা। রিদওয়ানদের বিল্ডিং এ একজন ডাক্তার থাকেন। নাম নাজিম উদ্দিন। নাজিম সাহেব হার্টের ডাক্তার, রিদওয়ানদের বাসার তিনতালায় থাকে সে। রিদওয়ান ছুটে গিয়ে নাজিম সাহেবকে ডেকে আনে। নাজিম সাহেব পারমীতার পর্যবেক্ষণ করছেন। আর রুমের এক কোনে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। হুট করে এমন একটা ঘাটনা ঘটবে সেতা যেনো কেউ কল্পনা করে নি। সবার মাঝে নূর শুধু রিদওয়ানকেই দেখে যাচ্ছে। তাকে চিন্তিত লাগছে, সামান্য বেহুশ হবার জন্য এতো কিসের চিন্তা, সেই সূত্র ভেবে পাচ্ছে না নূর। মিনিট বিশেক পর্যবেক্ষনের পর নাজিম সাহেব খানিকটা প্রসন্নমুখে বলেন,
“আমার মনে হচ্ছে উনি প্রেগন্যান্ট। উনার গার্ডিয়ান কে আছেন?”
নাজিম সাহেবের কথাটা যেনো কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না। অফিসের মানুষের মাঝে একটা কানাগোসা শুরু হলো। তাদের কাছে এই খবরটা যেনো অষ্টম আশচর্যের ব্যাপার। রিদওয়ান এগিয়ে গেলো নাজিম সাহেবের কাছে, বললো,
“এখানে ওর গার্ডিয়ান কেউ নেই, আমি ওর কলিগ আর আমার ওয়াইফ ওর ফ্রেন্ড। আপনি আমাদের বলতে পারেন।”
“দেখো রিদওয়ান, আমি তো হার্টের ডাক্তার কিন্তু আমার এযাম্পসন ভুল হবে না আশা করি। তবুও বলবো, তোমরা উনার গার্ডিয়ানকে বলবে একটা টেস্ট করে গাইনি ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে নিতে। আমি আসি কেমন!”
“জ্বী আংকেল।”
নাজিম সাহেব চলে গেলে পরিবেশটা শান্ত হয়ে যায়। সবার থমথমে মুখে পরিবেশটা আরোও অস্বস্তিতে ভরে উঠলো। পারমিতা প্রেগন্যান্ট এই কথাটা একটা নীরবতা বাড়িয়ে দিলো। কারণ পারমীতার এখনো বিয়ে হয় নি। অফিসের মানুষ অন্তত তাই জানে। পারমীতা এখনো ঘুমে, নাজিম সাহেব একতা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছেন। তাই সে না উঠা অবধি এই ঘটনার কোনো সুরাহা হবে না। কেনো যেনো পারমীতার গর্ভবতী হবার খবরটা শুনতেই নূরের দৃষ্টি রিদওয়ানের উপর গেলো। এক অজানা ভয়ের উপস্থিতি মনে ত্রাশ তৈরি করলো, আহত মনটা প্রার্থনায় লেগে গেলো যেনো তার চিন্তা ভুল হয়। না চাইতেই সকল কুচিন্তার ঢেউ তার শান্ত মনকে বারেবারে উত্তেজিত করে তুলছে। ইচ্ছে হচ্ছে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে রিদওয়ানকে,
“পারমীতার সাথে তার কিসের লুকোচুরি”
কিন্তু সে থেমে যায় এই ভেবে যদি সে ভুল হয় তবে চিরটাকাল রিদওয়ানের সামনে ছোট হয়ে যাবে সে। ভালোবাসার মানুষের অনীহার পাত্র হতে চায় না নূর। দ্বিধার এক অসীম জালে জড়িয়ে যাচ্ছে সে, চাইলেও এই জাল কেটে বের হবার উপায় পাচ্ছে না। রিদওয়ান সবাইকে নিয়ে বসার ঘরে গেলো। সবার হতাবাক মুখশ্রীতে হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু করতে পারছে না। রিদওয়ান সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“কেউ এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন পারমীতাকে করবে না, এ নিয়ে কোনো গসিপ ও হোক সেটা আমি চাই না। আমার মনে হয় আমি সবাইকে ক্লিয়ার করতে পেরেছি।”
রিদওয়ানের কন্ঠের কাঠিন্য সবার কৌতুহল একেবারেই দমন করে দিলো। রিজবি স্বর খাঁদে এনে বললো,
“কিন্তু রিদওয়ান ভাই, ওকে কে জানাবে এই নিউজ টা?”
“নূর জানাবে, ওর বান্ধবী সে। নূরের কাছ থেকে জানলে আমার মনে হয় না পারমীতা খুব একটা অস্বস্তিবোধ করবে।“
রিদওয়ানকে ঠিক কি বলা উচিত জানা নেই নূরের, লোকটার তল পাওয়া বড়ই ভার। যদি সাধারণ ভাবে দেখা হয় রিদওয়ান কেবল ই পারমীতাকে সাহায্য করছে একজন কলিগ হিসেবে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, অথচ অপর দিকে গুটি মেলালে ঘোর রহস্যের চোরাবালিতে ঢুবে যাচ্ছে নূর। কেনো রাতে পারমীতা রিদওয়ানকে ফোন দিয়েছে, কেনো রিদওয়ান এতোটা ঘাবড়ে গিয়েছিলো রাতে, কেনো তাদের দরজা ভিজিয়ে রাখা ছিলো! অনেক প্রশ্ন, নূরের নিজেকে হিন্ন মনোভাবের একটা পোকা মনে হচ্ছে, যে কারণে অকারণে তার স্বামীকে সন্দেহ করছে। কিন্তু কোনোভাবেই এই সন্দেহের বীজটা উপড়ে ফেলতে পারছে না।
পারমীতার ঘুম ভাঙ্গলো দু ঘন্টা পর। শরীরটা খুব দূর্বল। পাশে নূর বসে আছে। নূরকে দেখেই ঝটপট উঠে বসে পারমীতা। তার মুখখানা শুকনো হয়ে আছে। লম্বা মুখখানা আরেকটু লম্বা লাগছে। নুর তার পেছনে একটা বালিশ দিলো। পারমীতা মাথা নত করেই বসে আছে। কোনো কথা নেই তার মুখে। নূর খানিকটা ইতস্তত করছে কিভাবে কথাটা শুরু করবে সেটা ভেবে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তারপর বললো,
“এটা কিভাবে হলো পারমীতা?”
নুরের প্রশ্নে হু হু করে কেঁদে উঠে পারমীতা। ফর্সা মেয়েটির গাল, নাক লাল হয়ে উঠে। সুগাঢ় নজর বিষাদসিন্ধুতে প্লাবিত হয়। এক পর্যায়ে নূর তাকে জড়িয়ে ধরে। নিঃশব্দে দুজন নারী একে অপরের কষ্ট ভাগ করে নেয়, শুধু অশ্রুজলের মাধ্যমে।
নূরের হাজারো জিজ্ঞাসার পরও উত্তর দেয় না পারমীতা। অবশেষে নিজের মাঝে সকল জিজ্ঞাসাকে দমিয়ে রাখতে হয় নূরের। পারমীতাকে সাবধানে বাড়ি যাবার ব্যাবস্থা করে দিলো রিদওয়ান। মেহমানেরা আস্তে ধীরে যে যার বাসার দিকে প্রস্থান করলো। সবাই চলে গেলে রিদওয়ান নিজের রুমে এসে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে, তবুও গরম লাগছে তার। বিকেলে চা খাওয়ার বাতিক আছে রিদওয়ানের। তাই এক কাপ চা হাতে রুমে আসে নূর। আসরের আযান শোনা যাচ্ছে কিন্তু রিদওয়ান এক দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আযানের ধ্বনি কানে আসলেই রিদওয়ান নামাযে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে জামাতে তো মাঝে মাঝে ঘরে। কিন্তু সে সময় নষ্ট করে না। অথচ আজ আযান শেষ হয়ে যাবার পর ও সে শুয়ে আছে। কিছু একটা কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। চা টা বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রেখে রিদওয়ানের পাশে বসলো নূর। তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“কিছু নিয়ে কি চিন্তা করছো?”
নূরের স্পর্শ পেতেই চিন্তার সাগর থেকে বের হলো রিদওয়ান। মুচকি হাসি দিয়ে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। এই প্রথম নূরের এতোটা কাছে এসেছে সে। এতোকাল পর রিদওয়ানের এমন আচারণে শিওরে উঠে নূর। শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো একটা স্রোত বয়ে যায় নুরের। এক রাশ ভালোলাগা ঢেউ মনে বিস্তার করে। নূর পরম যত্নে চুল টেনে দিতে থাকে রিদওয়ানের। রিদওয়ানে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে ঈষৎ কম্পিত হচ্ছে প্রতিটি রন্ধ্র। রিদওয়ান তখন প্রেমঘন কন্ঠে বলে,
“ধন্যবাদ, আমাকে বিশ্বাস করার জন্য।”
রিদওয়ানের এমন কথায় অবাক হয় নূর। রিদওয়ান মুখ তুলে বলে,
“আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম জানো? পারমীতা অজ্ঞান হবার জন্য নয়, ভয়টা ছিলো তুমি আমায় অবিশ্বাস করো কিনা। এক অন্যনারীকে নিজের স্বামীর বুকে লেপ্টে থাকতে দেখাটা কারোর ই ভালো লাগার কথা নয়”
নূরের মনটা মূহুর্তেই উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো। কালো মেঘের পরদ সরে একরাশ সোনালি প্রভা উঁকি দিলো মনের ব্যালকনিতে। হাজারো প্রজাপতি উঁড়ে গেলো যেনো। নূর শান্ত গলায় বললো,
“নামায পড়বে, উঠো”
জায়নামাযে বসে মোনাজাতের সময় একটা প্রার্থনা করছিলো নূর,
“এই সন্দেহের বীজ যেনো তার মনে আর জায়গা না নেই”
এক সপ্তাহ পর,
খাওয়ার টেবিলে একসাথে রাতের খাবার খেতে বসেছিলো নুরেরা। অক্টোবর, নভেম্বর ঘুরার জন্য সবথেকে উপযোগী সময়। রিদওয়ানের কিছু ছুটি জমেও গিয়েছে। নূরের একই অবস্থা। এই উছিলায় তাদের হানিমুনটাও হয়ে যাবে। তাই ঘোরার প্রস্তাব তুললেন মিলন সাহেব। নাজমা বেগমের ও সম্মতি আছে তাতে। নূর লাজুক হাসি হাসে। সেও চায় তাদের সম্পর্কটা বন্ধত্বের সিড়ি পেড়িয়ে এগিয়ে যাক। এমন সময় রিদওয়ানের ফোনটা বেজে উঠে। সে অর্ধেক খাবারেই ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। নাজমা বেগম সরু দৃষ্টিতে রিদওয়ানের কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। মিনিট পাঁচেক বাদেও যখন রিদওয়ান আসে না। তখন তিনি নূরকে বলেন,
“যাও তো, রিদওয়ানকে বলো খেতে আসতে। ফোনে কথা পড়েও বলতে পারবে ও”
নুর মাথা নাড়িয়ে উঠে যায়। এটো হাতেই নিজের রুমে যায় সে। রিদওয়ান বারান্দায় কথা বলছে। স্বর খাঁদে নামালেও তার রাগান্বিত স্বর বোঝা যাচ্ছে। নূর বারান্দার কাছে যেতেই শুনতে পায়,
“এই বাচ্চা এবোর্ট করার কথা মাথাতেও আনবে না পারমীতা। বাচ্চাটা তোমার একার নয়…………
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। লেখার ভূল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিত দেখবেন দয়া করে এবং দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি