#child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam
__________________[15]___________________
রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে দূর থেকে কয়েকটা হুতোম প্যাঁচার ডাক ভেসে এলো। ড্রাইভারের কোনো হদিস নেই। নীরা মিলিয়ানকে বলল,
—–“তুমি একটু বসো। আমি এক্ষুনি আসছি।
নীরা যেই না বের হতে যাবে মিলিয়ান তার হাত খামছে বলল, ” মাম্মাম! যেয়োনা প্লিজ।
মিলিয়ানকে ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। নীরা কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। এখানে এভাবে বসে থাকলেও তো চলবেনা। সে ড্রাইভিং পারেনা। নাহলে সে নিজেই ড্রাইভ করে চলে যেতো।
কিন্তু তাকে এখন ড্রাইভারকে ডেকে আনতে হবে। হয়তো সে আশেপাশে কোথাও প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেছে। নীরা মিলিয়ানের দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
—–“যাই হয়ে যাক। ট্যাক্সি থেকে বের হবে না। মাম্মাম যাবে আর আসবে।
নীরা আর দেরি না করে ট্যাক্সির দরজা লাগিয়ে সামনে চলে গেলো। মিলিয়ান ভীতসন্ত্রস্ত অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
—–” ওরা এসে গেছে। আশেপাশেই আছে আমাদের।
গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাস্তায় পড়ে থাকা কাঠের গুড়ি গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে, কতগুলো মরা লাশ পড়ে আছে। নীরা ধীর পায়ে সামনে এগোতে এগোতে হাক ছাড়ল,
—–“ড্রাইভার!
চারপাশের ঘনকালো জংগলের মাঝে হারিয়ে গেলো সেই শব্দ। কিন্তু প্রতিত্তোরে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। নীরা আবারও হাক ছাড়ল,
—–“ড্রাইভার!!
নীরার ডাক থেমে যেতে না যেতেই দ্বিগুণ নিস্তব্ধতা নেমে এলো চারিদিকে। থমথমে পরিবেশে ভূতের মতো দাড়িয়ে রইলো নীরা। বাতাসে হটাৎ সোদা একটা গন্ধ ভেসে এলো। ধীরে ধীরে প্রকট হতে লাগল সেই গন্ধ।
নীরা নাক চেপে আবার যেই না হাক ছাড়বে, ঠিক তখনই সা করে এক ঝাক বাদুড় উড়ে এলো নীরার দিকে। আচমকা এতগুলো বাদুড় দেখে আঁতকে উঠল নীরা। বাদুড় গুলো নীরার থেকে কিছুটা উচ্চতায় চক্রাকারে উড়তে লাগল।
নীরা হাত নেড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু বাদুড় গুলো সেই একইভাবে তাকে ঘিরে উড়ে বেড়াচ্ছে। নীরা খেয়াল করলো সেই প্রকট সোদা গন্ধটা এই বাদুড় গুলোর থেকেই আসছে। ধীরে ধীরে বাদুড় গুলো আরও কাছে আসতে লাগলে তাদের চুনির মতো রক্তলাল চোখ জোড়া দেখে আরেক দফা চমকে উঠল সে।
বাদুড়ের চোখ কি লাল হয় নাকি! এদের আকৃতি এতো বড়ও হয়!? নীরার আকাশপাতাল ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মুহুর্তেই বাদুড় গুলো হামলে পড়ল নীরার ওপর। নীরা ছাড়া পাবার জন্য হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই সে বাদুড় গুলোকে সরাতে পারছেনা।
শরীরে অজস্র আঁচড় অনুভব হচ্ছে তার। যেন কেউ ধারালো কাচের টুকরো ঢেলে দিয়েছে তার সারা শরীরে। নীরা ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে একপর্যায়ে সজোরে চিতকার করে উঠল। তার গগন বিদারী চিতকার ছড়িয়ে পড়ল পুরো এলাকা জুড়ে।
মুহুর্তেই একটা দমকা হাওয়া এসে লাগতেই বাদুড় গুলো ছিটকে পড়ল এদিক সেদিক। একটা বেগুনি আলোকরশ্মি চোখে এসে লাগল। নীরা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল তার চারপাশে একটা আবছায়া বেগুনি আলোকরশ্মি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি এটা? কোথা থেকেই বা আসছে এই আলো?
নীরা ক্ষনিকের জন্য ভেবে নিল, সে তো এখন হাইওয়েতে দাড়িয়ে ছিলো। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে ছিলো সে। তাহলে এটা কোথায়? সে কি স্বপ্ন দেখছে!? কিন্তু কিসের স্বপ্ন! মাত্রই তো এক ঝাক বাদুড়ের আক্রমণের শিকার হয়েছিলো সে। নীরা এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই বাদুড় গুলোকে খুজতে লাগল।
শরীরের প্রতিটি স্থানে সুচ ফোটার মতো তীক্ষ্ণ ব্যাথা। ধীরে ধীরে সেই বেগুনি আলোকরশ্মি ফ্যাকাসে হতে লাগল। ফ্যাকাশে বেগুনি আলো ভেদ করে এগিয়ে এলো এক সুপুরুষ “ওরহান”
নীরার সমস্ত ব্যাথা কষ্ট মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেলো। দু’হাত প্রশস্ত করে নীরা ঝাপিয়ে পড়ল ওরহানের বুকে। ওরহান তার বলিষ্ঠ বাহুতে নীরা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
—–“তুমি ঠিক আছো?
নীরা কিছু বলল না, বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে মুখ তুলে ওরহানের দিকে তাকালো। রুপোলী চাঁদের মতো চকচক করছে ওরহানের ত্বক। তার জ্বলন্ত চোখ জোড়া যেন চুনী পাথরের ন্যায় টকটকে লাল হয়ে আছে। এক ঝটকায় ওরহানকে ছেড়ে সরে এলো নীরা।
ওরহানের রক্তলাল চোখ আর সেই বাদুড় গুলোর চোখের সাথে অদ্ভুত মিল খুজে পাচ্ছে সে। তার অবচেতন মন বলছে ওরহান ওদেরই একজন। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব!? ওরহান ভাবলেশহীন ভাবে নীরার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ট্যাক্সির দিকে তাকালো। ওরহানের দৃষ্টি অনুসরণ করে নীরাও ট্যাক্সির দিকে তাকালো। নীরার মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,
—–“মিলিয়ান!
এক ছুটে ট্যাক্সির সামনে এসে দাড়ালো নীরা। কিন্তু তার আগেই ওরহান এসে ড্রাইভিং সীটে বসে পড়েছে। মিলিয়ান হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে। ভয় পাচ্ছে সে। এদিকে ওরহানকে দেখে নীরার দম যায়যায় অবস্থা। ওরহানকে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগছে তার।
ওরহান নির্লীপ্ত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা ভয়ে আতংকে মুষড়ে পড়ছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু তাকে ভয় পেলে চলবে না। তাকে পালাতে হবে। মিলিয়ানকে নিয়ে এখনই পালাতে হবে। নীরা যেই না মিলিয়ানকে কোলে নিতে হাত বাড়ালো, সেইসাথে সাথেই শুনতে পেলো পুরুষালী গমগমে কন্ঠঃ
—–“চুপচাপ সিটে বসে পড়ো।
নীরার কি হল কে জানে। অদ্ভুত একটা আচ্ছন্ন ভাব ছেয়ে গেলো তার শরীর মন জুড়ে। সম্মোহীতের মতো গাড়িতে উঠে সিটে বসে পড়ল নীরা। মিলিয়ান কোনো নড়াচড়া করছে না। সে এখনও হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে। ওরহান গাড়ি স্টার্ট দিল। অন্ধকারের বুক চিরে হাইওয়ে দিয়ে ছুটে গেল ট্যাক্সিটা।
__________________________
ভয়ংকর রাত কেটে গিয়ে রেগেন্সবুর্গে সূর্য উঠেছে। কাচের জানালা ভেদ করে আসা সূর্যের আলো মুখে এসে পড়তেই রবার্ট এর ঘুম ভেঙে গেল। সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে মেয়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল।
সারলোটের ছোট্ট শরীরটা বেডের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যেন একটা মড়া পড়ে আছে। বিবর্ন পাংশুটে মুখের চামড়ার ভেতর থেকে চোয়াল ফুটে উঠেছে। চোখ জোড়া একেবারে গর্তে ঢুকে গেছে। রবার্ট এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে গগন বিদারী চিতকার করে উঠল,
—–“সারলোট!
রবার্ট এর চিতকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল হেনা। রবার্ট মেয়ের মুখে জোরে জোরে চাপড়ে বলছে,
—–“সারলোট! চোখ খোলো সারলোট!!
হেনা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ” কি হয়েছে রবার্ট!? ত্মি এমন করছো কেন!?
—–“হেনা এক্ষুনি গিয়ে ডক্টর ডেকে আনো। যাও এক্ষুনি।
হেনা বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে। সে হতবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকাতেই থমকে গেল। কি দেখছে সে!? এ কি ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে তার মেয়ের!?
হেনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রবার্ট ছুটে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। ডক্টর এখনও আসেনি। হসপিটালের নার্সকে ডেকে এনেছে রবার্ট। নার্সও এসে সারলোটের পাংশুটে বিবর্ন চেহারা দেখে বেশ অবাক হল।
গতকাল রাতেও তো মোটামুটি ভালই ছিলো মেয়েটা। হটাৎ এ অবস্থা হল কিভাবে। নার্স সারলোট এর পার্লস চেক করে হতাশ চোখে সারলোটের মুখের দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে হাতটা সারলোটের নাকের কাছে নিয়ে গেলো সে। প্রমাদ গুনতে লাগল হেনা। প্রায় পাঁচ সাত মিনিট পর নার্স একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—–“দুঃখীত মি. পল, সারলোট আর নেই।
_______________________________
ফোনের রিংটোন পেয়ে ঘুম ভেঙে গেছে নীরার। সে চোখ মেলে দেখল, একটা অচেনা রুমের মখমলি চাদর বিছানো বেডে শুয়ে আছে সে। কোথায় এটা? নীরা শোয়া ছেড়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল।
রুমের এদিক ওদিক তাকিয়ে আর কাউকে দেখতে পেলো না। ফোনের রিংটোন বেজেই চলেছে। নীরা বেড টেবিলের ওপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখল সোফিয়া কল দিচ্ছে। নীরা রিসিভ করবে কি করবেনা ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেলো।
ফোন স্ক্রিনে সাতচল্লিশটা মিসডকল উঠে আছে। সব গুলা মায়ের কল আর সোফিয়ার। নীরা এখন কথা বলার অবস্থায় নেই। সে বেড থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সরু লম্বা করিডরের এমাথা থেকে ওমাথা কাউকে নজরে পড়লো না।
কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছেনা নীরা। ডান পাশ ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখল একটা বড় গোল বারান্দা। দেশি-বিদেশি অর্কিড সাজানো বারান্দা জুড়ে। নীরা বারান্দার গ্রিল ধরে নিচে তাকিয়ে দেখল, উঁচু প্রাচীরঘেরা একটা দোতলা বাড়ি এটা। প্রাচীরের চারপাশে বেড়ে উঠেছে বড়বড় দেবদারু গাছের ঝোপঝাড়।
সেসব ভেদ করে বাইরের রাস্তাঘাট দেখা মুশকিল। নীরা বারান্দা থেকে আবার উল্টো ফিরে করিডরে এলো। এবার সোজা গিয়ে পেচানো সিড়ি নেমে গেছে। সিড়ি বেয়ে নিচের হল ঘরে এসে দাড়ালো সে। সোফার ধারে দাড়িয়ে জানালার দিকে ফিরে কফি খাচ্ছে ওরহান। নীরা এক পা সেদিকে এগোচ্ছে তো দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। ওরহান পেছনে না তাকিয়েই বলল,
—–“আজ দুপুর দুইটায় তোমার বাংলাদেশ যাওয়ার ফ্লাইট।
নীরা কিছু বলল না। সে আসলে কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। সে কিছুক্ষণ পর থেমে থেমে বলল, ” মিলিয়ান কোথায়?
ওরহান এবার নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ” ওকে তুমি আর কখনো দেখবে না।
—–“মানে কি? কোথায় আমার মিলিয়ান!? কি করেছেন ওর সাথে!?
ওরহান ভাবলেশহীন ভাবে বলল,” গত রাতের ঘটনা ভুলে গেছো মনে হচ্ছে।
নীরার মনে পড়ল গত রাতের ঘটনা। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার! আচমকা এক ঝাক বাদুড় এসে তার উপর আক্রমণ! তারপর সেই বেগুনি আলোকরশ্মি! আর ওরহানের চোখ জোড়া! নীরা বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
—–“মিলিয়ানকে ফিরিয়ে দিন। আমি ওকে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। আর কাউকে এসব কিচ্ছু বলবোনা। আপনি প্লিজ মিলিয়ানকে ফিরিয়ে দিন।
ওরহান এবার মগটা টি-টেবিলের ওপর রেখে সোফায় গা এলিয়ে বসল। তার এমন ভাবভঙ্গির অর্থ বুঝতে পারছেনা নীরা। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের ঝড় বইছে। কিন্তু আগে তাকে মিলিয়ানকে পেতে হবে। এরপর সে যেভাবেই হোক জেনে নেবে তার সব প্রশ্নের উত্তর। ওরহান বোধহয় তার মন পড়ে নিল। সে নীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
—–“মিলিয়ানকে যা ভাবছো মিলিয়ান আসলে তা নয়। ওর আসল পরিচয় জানতে পারলে তুমি নিজেও আর ওকে চাইবে না।
—–“কি যা তা বলছেন! মিলিয়ান আমার ছেলে।
—–“তাই নাকি!?
ওরহানের চোখেমুখে স্পষ্ট বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছে। নীরা এবার রেগেমেগে বলে উঠল, ” আমি মিলিয়ানকে না নিয়ে কোত্থাও যাবো না।
ওরহান সেই একই ভঙ্গীতে বলল, ” জানো, মীরা কিভাবে মারা গেছে!?
নীরার সমস্ত রাগ উবে গেলো। কি বলতে চাইছে ওরহান। তার মানে সে সত্যিই জানে মীরার মৃত্যুর আসল কারণ!
_________________[চলবে]________________
বিঃদ্রঃ কেউ নেক্সট নেক্সট করবেন না। সময় করে লিখে পোস্ট করে দেবো। পর্বটা কেমন লেগেছে জানাবেন আশা করি