Child_Of_Night Part-16

0
1528

#Child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam

___________________[16]__________________

ওরহানের চোখেমুখে স্পষ্ট বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছে। নীরা এবার রেগেমেগে বলে উঠল, ” আমি মিলিয়ানকে না নিয়ে কোত্থাও যাবো না।

ওরহান সেই একই ভঙ্গীতে বলল, ” জানো, মীরা কিভাবে মারা গেছে!?

নীরার সমস্ত রাগ উবে গেলো। কি বলতে চাইছে ওরহান। তার মানে সে সত্যিই জানে মীরার মৃত্যুর আসল কারণ!

ওরহান সোফা ছেড়ে উঠে নীরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ” মনে হচ্ছে প্রাক্টিক্যালি তোমার সাথে না ঘটলে টনক নড়বে না।

নীরা পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন মেঝে তার পা দুটো আকড়ে ধরেছে। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন অসার হয়ে যাচ্ছে তার। আস্তে আস্তে নীরার একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে ওরহান নীরার চিবুকে বাম হাতের তর্জনী বুলিয়ে বলল,

—–” যদি নিজের বা নিজের পরিবারের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালবাসা থাকে, তো ফিরে যাও। আর এতেই সবার মঙ্গল।

ওরহানের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিতে মন চাচ্ছে নীরার। কিন্তু সে অপারগ। অদৃশ্য এক শক্তি তার শরীরকে কাবু করে ফেলেছে।

ওরহান চলে গেলো। হল ঘরে একাই কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো নীরা। ওরহান চলে যাওয়ার সাথেসাথেই শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। কিন্তু সেটার রেশ কাটেনি এখনও।

নীরা বেশ কিছুক্ষণ পর সিড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে এলো। তাকে এখন ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। নয়তো সে মিলিয়ানকে হারিয়ে ফেলবে চিরতরে।

রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিল নীরা। পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিতেই একটা হিমশীতল বাতাস বয়ে গেলো তার সারা শরীর মন জুড়ে। জানালার ধারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল সে।

দুচোখের দৃষ্টি আবদ্ধ দূরের ঐ আকাশে। ইদানীং মিলিয়ান আর তাকে ঘিরে ঘটে চলা অস্বাভাবিক ঘটনা গুলোর কোনো ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারছেনা নীরা। আর ওরহানই বা কেন মিলিয়ান আর তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এর পেছনে কি উদ্দেশ্য তার?

ওরহান যে সাধারণ কেউ না তা বুঝতে বাকি নেই নীরার। যদিও ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। গতকাল সেই বেগুনি আলোকরশ্মি ভেদ করে হটাৎ ওরহানের আবির্ভাব, তার চুনী পাথরের ন্যায় জ্বলন্ত চোখ জোড়া, তারপর বিদ্যুৎ গতিতে নীরার আগেই ট্যাক্সিতে উঠে বসে থাকা সবকিছুই অস্পষ্ট।

মিলিয়ানকে বাচাতে হলে নীরা’কে আগে সবটা জানতে হবে। কে এই ওরহান? আর মিলিয়ানের সাথেই বা তার কি সম্পর্ক? নীরা প্রথম থেকে সব ভাবতে লাগল। মিলিয়ানকে যেদিন পিয়ানো ক্লাসে নিয়ে গেলো সেদিনই বুঝতে পেরেছিলো যে, ওরহানকে মিলিয়ান আগে থেকেই চেনে।

এরপর হটাৎ করে মিলিয়ানের নিখোঁজ হবার ঘটনা, ওরহানের সাথে মিলিয়ানের বাড়ি ফেরা। সেদিন ওরহান বলেছিলো নীরা নাকি তাকে কল করে মিলিয়ানকে নিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু সে আদৌ ওরহানকে কল করেছে কি না মনে নেই তার।

তাহলে কি মিলিয়ানও তার থেকে কিছু লুকিয়েছে!? কিন্তু সারলোট বলেছিলো সেদিন সকালে নাকি নীরা’কে সে একই সময় দুই জায়গায় দেখেছে। একজন রুমে ঘুমিয়ে ছিলো। অপর জন গেট খুলে মিলিয়ানকে বিদায় দিচ্ছিলো।

ভাবনার মাঝেই চমকে উঠল নীরা। সেদিন গেট এ মিলিয়ানকে সে বিদায় দেয়নি। সে রুমে ঘুমিয়েছিলো। অন্য কেউ নীরা সেজে মিলিয়ানকে যেতে বলেছে তাই মিলিয়ান গেছে। এমনকি সেই অন্য জনই ভেতর থেকে দরজা লক করে রেখেছিলো!

কে ছিলো সে? আর কিভাবেই বা নীরার রূপ নিল? নাহ, আর ভাবতে পারছেনা নীরা। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। নীরা রুমের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, দেয়াল ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা বাজে। ফ্লাইট দুইটায়। হাতে মোটামুটি সময় আছে।

এরমধ্যেই তাকে এই বাড়িটায় ভালোভাবে তল্লাশি চালাতে হবে। হতে পারে এখানেই কোথাও মিলিয়ানকে আঁটকে রেখেছে। আর তা নাহলে তখন পালানোর পথ খুজতে হবে। অনেক কাজ বাকি।

__________________________

নীরা’কে যে রুমে রাখা হয়েছে সেটার সাথেই এটাচড ওয়াশরুম আছে। ওয়াশরুম দেখে নীরা ভাবল আগে গোসল করা দরকার। সারা শরীর কেমন যেন চ্যাট প্যাট করছে। বেডের পাশে নীরার লাগেজ রাখা আছে। নীরা লাগেজ খুলে এক সেট ড্রেস বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল।

শাওয়ার অন করতেই ঝমঝমিয়ে পানির ধারা বইতে লাগল নীরার সারা শরীরে। সাথেসাথেই চামড়ায় অসহ্য জ্বালাপোড়া হতে লাগল তার। গত রাতে সেই বাদুড় গুলোর আঁচড়ের ক্ষত। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি নীরা, এখন সেসব ক্ষতস্থানে পানি লেগে জ্বালা করছে।

বাদুড়ের কথা মনে পড়তেই নীরার মনে পড়ল সেদিন সী সাইড রেস্টুরেন্টে বসে ওরহানের বলা কথা গুলো। ভ্যাম্পায়ার এ বিশ্বাস, ব্রাম স্টোকারের লেখা কাউন্ট ড্রাকুলা, তারপর!

ভ্যাম্পায়ার এর সাথে বাদুড়ের একটা সংযোগ আছে। সাধারণত ভ্যাম্পায়ার রিলেটেড উপন্যাস বা মুভিতে দেখায় যে, ভ্যাম্পায়াররা বাদুড় রূপে ঘুরেবেড়ায়। এছাড়াও তারা যঅখন তখন যেকোনো প্রাণীর রূপ নিতে পারে। তাহলে কি ওরহান!

শাওয়ার অফ করে বেসিনের আয়নার সামনে এসে দাড়ালো নীরা। তার ভেজা চুল গুলো শরীরে লেপ্টে রয়েছে। নীরা চুল গুলো সরিয়ে দেখল গলায়, পিঠে, হাতে বড়বড় নখ এর আঁচড়। যদি ওরহান তেমন কিছুই হয়ে থাকে তাহলে সাধারণ একটা মানুষ হয়ে কিভাবে তার সাথে পেরে উঠবে নীরা?

নীরা গোসল সেরে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে রুমের দরজা ভেজিয়ে দেওয়া দেখে সে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেছে। সে তো রুমের দরজা লক করে রেখেছিলো। তাহলে দরজা খুলল কিভাবে!?

পরক্ষণেই মনে পড়ল সে কোথায় কার সাথে আছে। এখানে এমন কিছু ঘটা হয়তো স্বাভাবিক। নীরা আর দরজা লক করলো না। সে বুঝে গেছে ওটা লক করা আর না করা একই ব্যাপার।

সে উলটো ঘুরে দেখল টি-টেবিলের ওপর একটা ট্রেতে নাস্তা ঢেকে রাখা। নীরা ঢাকনা উঁচু করে দেখল, এক গ্লাস পানি, ব্রেড, নিউট্রেলা আর এক মগ কফি রাখা আছে।

এসব কি ওরহান রেখে গেছে? অবশ্য সে ছাড়া তো এ বাড়িতে আর কেউ নেই, তাহলে কে দেবে। ক্ষিদে না থাকা সত্ত্বেও নাস্তা সেরে নিল নীরা। না খেয়ে থাকলে সে অসুস্থ হয়ে যাবে, তখন সে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা তো দূর এখান থেকে পালাতেও পারবে না।

নাস্তা সেরে নীরা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। শূন্য করিডর বেয়ে হাটতে হাটতে উত্তর দিকের একটা রুমে এসো ঢুকল সে। রুমের মধ্যে বেশ পুরনো আমলের জিনিসপত্র রাখা। ধুলোবালির আস্তরণ জমে ধূসর হয়ে আছে রুমের ভেতরটা।

নীরা বুঝতে পারলো তার ভীষণ জোরে একটা হাচি আসতে চলেছে। হাচি দিলেই ওরহান চলে আসতে পারে। নীরা কোনোরকমে নাক মুখ চেপে রুম থেকে বেরিয়ে দরজা বাইরে থেকে লক করে দিল।

রুমটা থেকে বেরিয়ে সিড়ির মুখে আরেকটা রুমে এসে ঢুকল সে। এই রুমের ভেতর সব বাদ্যযন্ত্র সাজানো। সী সাইড এ ওরহানের বাড়িতেও এসব দেখেছিলো সে। তবে সেগুলোর তুলনায় এগুলো অনেক পুরনো। একটা মস্ত বড়ো গ্র‍্যান্ড পিয়ানো দেখে নীরা সেদিকে এগিয়ে গেলো।

পিয়ানোতে যেই না হাত ছোয়াবে, সাথেসাথেই সে হাত সরিয়ে নিল। সে পিয়ানো বা কোনো বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে জানেনা। যদি ভুলবশত চাপ খেয়ে বেজে ওঠে তখন! তাকে সব কাজ নিঃশব্দে করতে হবে।

নীরা বাদ্যযন্ত্রের রুম থেকে বেরিয়ে ওপরের সিড়ির দিকে তাকালো। এবার সে ওপরতলায় যাবে। নীরা পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে উঠতেই শুনতে পেলো, কারা যেন ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে!

সাথেসাথে থমকে গেল নীরা। বাসায় কি ওরহান ব্যতীত আরও কেউ আছে? কিন্তু তখন তো নিচে কাউকে দেখলো না! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নীরা ওপরতলার সিড়ি থেকে নেমে নিচতলার সিড়িতে এলো। ফিসফাস শব্দটা বেড়েই চলেছে।

নীরা এবার সিড়ির রেলিঙের ওপর ঝুকে নিচে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। নাহ, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বসার ঘরে আছে কেউ। নীরা খুব সন্তর্পনে পা ফেলে ফেলে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল। ধাপে ধাপে সিড়ি পেরিয়ে নিচের সিড়ির মুখে এসে সোজাসুজি বসার ঘরে উঁকি দিল সে।

ওরহানের সামনে লম্বাচওড়া হালকা পাতলা গড়ণের একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। পেছন ফিরে থাকায় মেয়েটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। পাশের সোফায় বসে আছে মধ্যবয়সী এক লোক।

মুহুর্তেই নীরার চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা দিল। এদেরকে ডেকে এখনই সব বলে দেবে নীরা। তারপর পুলিশ এনে মিলিয়ানকে উদ্ধার করবে সে। নীরা আর এক মুহুর্ত দেরি না করে দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে চেচিয়ে উঠলো,

—–” আমাদেরকে বাচান! প্লিজ হেল্প!!

নীরার কন্ঠঃ পেয়ে চমকে পেছনে ফিরল সবাই। ওরহানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাও পেছন ফিরল। দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে মেয়েটাকে দেখে আরেক দফা চমকে উঠল নীরা। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,

—–” এলিসিয়া!

এলিসিয়া স্মিত হেসে বলল, ” গুড মর্নিং মিস নীরা।

নীরা আতংকিত চোখে একবার ওরহানের দিকে তাকালো। ওরহানকে নির্বিকার দেখাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। নীরা এবার ছুটে গিয়ে এলিসিয়াকে ধরে করুন স্বরে চেচিয়ে উঠলো,

—–” মিস এলিসিয়া! আমাদেরকে বাচান।

ওরহানকে দেখিয়ে বলল,” এই লোকটা, এই লোকটা আমাকে আর মিলিয়ানকে কিডন্যাপ করেছে। প্লিজ আপনি

—–” রিল্যাক্স নীরা। ভয়ের কিচ্ছু নেই, তুমি সেইফলি দেশে ফিরে যাবে।

এলিসিয়ার কথা শুনে নীরার বাকি কথা গুলো মুখেই আঁটকে গেলো। কি বলছে সে!? তাহলে কি এলিসিয়াও এসবের মধ্যে জড়িত!? রাগে ক্ষোভে এলিসিয়ার থেকে ছিটকে সরে এলো নীরা। সোফায় বসা লোকটা উঠে ওরহানকে উদ্দেশ্য করে গমগমে গলায় বলল,

—–” এসব ঝামেলা মিটিয়ে সময়মতো পৌছে যেও।

বলেই লোকটা চলে গেলো, এলিসিয়া নীরার দিকে অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বলল, ” হ্যাভ এ সেইফ জার্নি।

এলিসিয়াও চলে গেলো লোকটার পিছুপিছু। পুরো ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেছে নীরা। এরা সবাই মিলে ভয়ানক কোনো খেলায় মেতে উঠেছে। আর নীরা সেই খেলায় দর্শক মাত্র। নীরার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ওরহান ধমক দিয়ে বলল,

” সোজা নিজের রুমে চলে যাও, দেড়টার আগে রুম থেকে এক পা-ও বাইরে বের হবে না!

মৃদু কেপে উঠল নীরা। ওরহানের দিকে একবার অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখল, ওরহানে চোখে স্পষ্ট ক্রোধ দেখা যাচ্ছে। নীরা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে চেচিয়ে উঠলো,

—–” একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে মারতে এত জল্পনাকল্পনা কিসের!? কি পাপ করেছে মিলিয়ান!? আপনারা কি করতে চাচ্ছেন ওর সাথে!!?

ওরহান এবার চোয়াল শক্ত করে বলল, ” যাকে তুমি নিষ্পাপ বাচ্চা বলছো, সে শয়তান লামিয়া’র পুত্র মিলিয়ান।

________________[চলবে]________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here