#Child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam
__________________[17]_________________
কেপে উঠল নীরা। ওরহানের দিকে একবার অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখল, ওরহানে চোখে স্পষ্ট ক্রোধ দেখা যাচ্ছে। নীরা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে চেচিয়ে উঠলো,
—–” একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে মারতে এত জল্পনাকল্পনা কিসের!? কি পাপ করেছে মিলিয়ান!? আপনারা কি করতে চাচ্ছেন ওর সাথে!!?
ওরহান চোয়াল শক্ত করে বলল, ” যাকে তুমি নিষ্পাপ বাচ্চা বলছো, সে শয়তান লামিয়া’র পুত্র মিলিয়ান।
নীরা হতবাক হয়ে ওরহানের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলল ওরহান? মিলিয়ান কার ছেলে? সে কি ভুল শুনলো!? ওরহান এবারও তার মন পড়ে নিল বোধহয়। নীরার হতবিহ্বল দৃষ্টি দেখে সে শান্ত অথচ গমগমে গলায় বলে উঠল,
—–” না তুমি ভুল শোনো নি। মিলিয়ান তোমার বা তোমার বোনের কেউ না।
—–” চুপ করুন!
চেচিয়ে উঠলো নীরা। ওরহানের একেকটা কথা তার কলিজা ছিড়ে দিচ্ছে। সে কিছুতেই মানতে পারছেনা যে, মিলিয়ান তার বোনের ছেলে না। বরং একটা শয়তানের ছেলে! নীরা ওরহানের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
—–” আপনি এসব বানোয়াট কথা বলে আমাকে মিলিয়ানের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন তাই না!? তাহলে শুনে রাখুন, মিলিয়ানের যদি কিছু হয় আমি আপনাকে ছাড়বো না!
নীরার চোখেমুখে স্পষ্ট ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছে ওরহান। নীরা তাকে অবিশ্বাস করছে, অথচ সে তো নীরা’কে বাচাতেই এসব করল।
—–” তুমি জার্মানিতে আসার পর মীরা তোমাকে নিজের বাসায় না রেখে ভার্সিটির ডর্মে কেন রেখেছিলো?
ওরহানের এমন প্রশ্নে বেশ অবাক হয়ে গেছে নীরা। সে কিভাবে জানে যে সে আপন বোনের বাসা থাকতেও ভার্সিটির ডর্মে থেকেছে? পরক্ষণেই আবার মনে পড়ল ওরহানের জন্য এসব জানা তো কোনো ব্যাপারই না। নীরা’কে চুপ থাকতে দেখে ওরহান মৃদু হেসে বলল,
—–” কারণ মীরা তোমাকে সত্যিটা জানাতে চায়নি। সে নিজেই সত্যিটা জানার পর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলো। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দে পড়ে বেশ কয়েকবার সুইসাইড এটেম্পট করতে গিয়েও বেচে গেছিলো সে। কিন্তু অবশেষে সফল হয়েছে!
মীরা সুইসাইড করেছে শুনে আরেক দফা আঁতকে উঠল নীরা। তার বোন কোন সত্যি জেনে নিজের জীবন নিজেই কেড়ে নিল? কোন সে সত্যি!? নীরা এবার কাপা কাপা গলায় বলল,
—–” তাহলে আমাকে লেখা চিঠিটা আপুর সুইসাইড নোট ছিলো!
—–” বারবার সুইসাইড এটেম্পট করতে চাওয়া একটা মানুষ কি এত সুন্দর করে গুছিয়ে সুইসাইড নোট লিখতে পারে!? হয়তো বড় জোর সুইসাইড এর কারণ লেখে আর নিজের জীবনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে যায়।
—–” কি বলতে চাচ্ছেন আপনি!?
ওরহানের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীরা। মনে হচ্ছে সে আরও ভয়ানক কিছু বলতে চলেছে।
—–” চিঠিটা মিলিয়ান লিখেছিলো।
সাথেসাথেই ধপ করে সোফার ধারে পড়ে গেলো নীরা। মিলিয়ান চিঠি লিখেছে এর মানে কি!? সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে তার কাছে। এটা তো সত্যি যে মিলিয়ানের হাবভাব কথাবার্তা তাকে প্রথম থেকেই বেশ ভাবাতো। একটা ছোট্ট বাচ্চা কিভাবে সবকিছুতে এতটা ত্রুটিহীন হতে পারে!
ওরহান দ্রুত নিচু হয়ে নীরা’কে কোলে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। নীরা’কে দেখে খুব অসহায় লাগছে তার। কিন্তু সেও বা কি করবে, যা সত্যি তা তো আর চাইলেও মিথ্যে বানানো যাবে না। নয়তো সে নীরার জন্য সেসব তিক্ত সত্যি গুলোকেও মিথ্যে বানিয়ে দিতো।
—–” আমাকে সবটা খুলে বলুন প্লিজ। মিলিয়ানকে দেখার পর আমার নিজেরও ওকে নিয়ে অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসতো। সেসব নিয়ে আমি আপনাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি। আপনি কিচ্ছু বলেন নি। প্লিজ বলুন, কি হয়েছিলো আমার আপুর সাথে? আর মিলিয়ান তাহলে কে!?
নীরার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়ায় তাকিয়ে থাকতে পারছেনা ওরহান। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সে নীরার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত অন্যদিকে তাকালো।
—–” লিওকে বিয়ে করার পর মীরা’র সাথে তোমার বাবা-মা আর যোগাযোগ রাখেনি। তারা হয়তো ভেবেছিলো মীরা নিজের ভুল বুঝতে পেরে লিওকে ছেড়ে ফিরে যাবে। কিন্তু মীরা ছিলো খুবই সেন্সিটিভ মাইন্ড এর। বাবা-মায়ের সাথে কন্টাক্ট অফ হতেই সে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে।
সে না পারতো লিওকে ছাড়তে আর না পারতো বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাকতে। মীরা’কে নিয়ে লিও’ও ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। পরে সে মীরার মাইন্ড ফ্রেশ করতে ট্রাভেল করার ডিসিশন নেয়।
ওরহান একটু থেমে আবার বলল, ” লিও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছে। পাশাপাশি একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করতো। তো একবার মিশরে ঘুরতে গিয়ে তারা একটা হোটেল এ ওঠে। কিন্তু সেখানকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে লিও’র আর ঘুম হয়না।
সে ভ্রমনের সেই এক সপ্তাহে দিনের বেলা মীরার সাথে ঘুরে বেড়াতো আর গভীর রাতে আবারও সেসব জায়গা ঘুরতে বের হতো। সারাদিন ঘুরেফিরে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে এক ঘুমেই রাত পার করে দিতো মীরা। আর সেই সময়ে মিশরের সেইসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুটিয়ে দেখতো লিও। গভীর রাতে সেসব জায়গায় যাওয়া নিষেধ থাকলেও লিও সেখানকার সিকিউরিটি গার্ডদের টাকাপয়সা দিয়ে লুকিয়ে ঢুকতো।
নীরা গভীর মনোযোগ দিয়ে ওরহানের কথা গুলো শুনছে। ওরহান মাঝেমধ্যে থেমে আবার বলতে লাগল, ” তো এক রাতে সে একটা ধাতুনির্মিত বাক্স খুটিয়ে দেখছিলো। বাক্সের গায়ে হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা! লিও সেটা অনুবাদ করে পড়ার চেষ্টা করছে এমন সময় একটা রিনরিনে মেয়েলি কন্ঠঃ পেয়ে সে চমকে উঠল। দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে দেখল, এক অসম্ভব সুন্দরী আবেদনময়ী নারী দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে মাত্র হাত কয়েক দূরে। তার পরনের পোশাক এতটাই পাতলা যে শরীরের প্রতিটি ভাজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লিও কিংকর্তব্যবিমূড় এর মতো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
—–“কে তুমি?
মেয়েটা রিনরিনে কন্ঠে বলল, ” চলতে চলতে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?
—–“এতো রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছো?
মেয়েটা ততক্ষণে লিওর একেবারে কাছে চলে এসেছে। লিও আবিষ্টের মতো তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এবার একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে নিজের পরনের পোশাক খুলে ফেলল। হতবাক হয়ে গেলো লিও। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অতিব আবেদনময়ী নারীকে দেখে যেন তার শরীরেও সুখের উদ্বেগ জেগে উঠেছে। মুহুর্তেই সেও বিবস্ত্র হয়ে গেলো। সে নিজে হয়নি। মেয়েটিই করেছে। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে দুজনেই মত্ত হয়ে উঠল আদিমখেলায়।
নীরার সারা শরীর কাপছে, ওরহান সেদিকে লক্ষ্য করে থেমে গেলো। মনে হচ্ছে নীরা আর শুনতে চাচ্ছে না। অবশ্য নিজের বোনের স্বামীর এমন অপ্রীতিকর ঘটনা কে বা শুনতে চাইবে। পরক্ষণেই নীরা তার ভাবনার সুতো ছিড়ে বলল,
—–” তারপর!?
ওরহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগল, ” রাত পেরিয়ে ভোর নামার আগে লিও’র হুস ফিরল। হুস ফিরে দেখল সেখানে সে ব্যাতিত আর কেউ নেই। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে গতরাতের সেই মেয়েটাকে খুজতে লাগল। কোথায় গেলো মেয়েটা? লিও এবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল, সে এখনও বিবস্ত্র অবস্থায় মাটিতে শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করল লিও। কিন্তু ক্লান্তিতে তার শরীর যেন ভেঙে আসছে। গলার কাছে একটা টনটনে ব্যাথা। হাত বুলিয়ে দেখল শুকনো রক্ত লেগে আছে। ভাবল মাটিতে শুয়ে থাকায় হয়তো কোনো পোকামাকড়ে কামড়েছে। লিও কোনোরকমে কাপড়চোপড় পরে জিনিসপত্র নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
রুমে ঢুকে দেখল মীরা তখনও ঘুম। লিও একেবারে গোসল সেরে বেডে এসে শুয়ে পড়ল। বাকি রাতটুকু লিওর আর ঘুম এলো না। বিবাহিত হয়ে পরনারীর সাথে রাত্রিযাপন করে সে প্রচন্ড অনুতাপে ভুগতে লাগল। পরদিন সারাবেলা সে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যায় ঘুম ভেঙে দেখল মীরা ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে। লিও আড়মোড়া ভেঙে উঠে বলল,
—–” কি ব্যাপার এখন এসব গোছাচ্ছো কেন?
—–” বাহ, আজ রাত এগারোটায় যে আমাদের জার্মানি ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট তা ভুলে গেছো?
—–” ওহ।
সে রাতেই মিশর থেকে ফিরে এলো লিও আর মীরা। সাথে লিও বয়ে নিয়ে এলো একরাশ অনুতাপ। সে রাতের ঘটনা মনে পড়লে সে মীরার সাথে চোখ মেলাতে পারতো না। এমনকি স্বপ্নেও সেই আবেদনময়ী নারীকে দেখতে পেতো। দেখতো সে প্রায়ই রাতে তাদের শোবার ঘরে ঢুকে একইভাবে সেই রাতের মতো আদিমখেলায় মত্ত হয়ে উঠতো। এভাবে যতদিন গড়াতে লাগল, লিওর সুঠাম সুন্দর শরীর ক্রমশ পাংশুটে বিবর্ন হতে লাগল।
একপর্যায়ে লিও বুঝতে পারলো, সে স্বপ্ন দেখছে না। বাস্তবিকই সেই মেয়েটা তার ঘরে ঢুকে তার সাথে রাত্রি যাপন করে। যে ছিলো এক রক্তচোষা পিশাচিনী ‘লামিয়া’। তার উদ্দেশ্য হল, মানব জাতীর পুরুষের সাথে মিলিত হয়ে নিজের বংশবৃদ্ধি করা। কিন্তু লামিয়ার সন্তান গুলো তার মতো রক্তচোষা নয়। তারা হয় মানুষ আর পিশাচের মিলনে সৃষ্ট একেকটা ভয়ংকর শয়তান। যাদের উদ্দেশ্য শুধুই মানুষের মাঝে প্রবেশ করে তাদের হত্যা করা।
এরমধ্যেই লিও একদিন জানতে পারল যে সে বাবা হতে চলেছে। এতবড় খুশির খবর পেয়েও সে যেন খুশি হতে পারলো না। তার মন প্রাণ জুড়ে তখন সেই নিশি রাতের আবেদনময়ী লামিয়া’র বাস। সে কিছুতেই মীরা বা তার অনাগত সন্তানকে মেনে নিতে পারছিলো না। ঠিক এই সুযোগটাই নেয় লামিয়া। সে তার গর্ভে লিও’র সন্তান ধারণ করে। আর লিওকে বলে সে যেন মীরার বাচ্চার সাথে তার বাচ্চা পালটে নেয়। লিও তার কথা মতো মীরার ডেলিভারির পর মীরা আর লামিয়া’র বাচ্চা পালটে দেয় আর মীরা’র বাচ্চাকে নিজে হত্যা করে।
একটানা বলে একটু থামল ওরহান। নীরার দিকে তাকিয়ে দেখল, নীরার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ওরহানের দিকে। ওরহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরার পাশে বসে পড়ল।
—–” আমার বোনটার সাথে কত কিছু ঘটে গেছে অথচ সে কিচ্ছু বলেনি আমাদের!
নীরার গলা কাপছে। অনেক বড় একটা শক খেয়েছে সে। ওরহান ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা’কে সত্যিটা বলা তার উচিৎ হয়নি। কিন্তু তার ভীষণ হালকা লাগছে। যেন কতবড় একটা বোঝা আঁটকে ছিলো তার মধ্যে এতদিন। কিন্তু এখন, অজানা এক স্বস্তি পাচ্ছে সে। নীরা কিছু একটা ভেবে বলল,
—–” কিন্তু এসবে মিলিয়ানের দোষটা কোথায়? ও তো কারোর ক্ষতি করেনি। তাহলে আপনারা কেন ওকে আঁটকে রেখেছেন?
—–” মিলিয়ান এখনও জানেনা সে কে। নিজের অশুভ শক্তির ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই তার। কিন্তু যেদিন ও জানতে পারবে, সেদিন ওকে থামানো অসম্ভব হয়ে যাবে!
__________________[চলবে]________________