#Child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam
___________________[20]__________________
গল্ফ পার্ক রোড পেরিয়ে মেইন টাউনে ঢুকেছে ওরহানের গাড়ি। স্লো স্পিডে ড্রাইভ করছে ওরহান। নীরা গাড়ির ডিজিটাল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল একটা চুয়াল্লিশ বাজে। তার ফ্লাইট দুইটায়। এর মানে মিলিয়ানকে কাছাকাছিই কোথাও রাখা হয়েছে।
—–” আপু বলেছিলো তার নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে। কখনো সে তার এক্স হাসব্যান্ড এর ছবি তো দূর, নামও উচ্চারণ করেনি আমার কাছে। আপনি কি জানেন, লিও এখন কোথায়?
উত্তর না দিয়ে আপনমনে ড্রাইভ করছে ওরহান। মনে হচ্ছে সে অন্যকিছু নিয়ে ভাবছে। মেইন টাউন থেকে বেরিয়ে গাড়ি আবারও একটা নির্জন রাস্তায় এলো। রাস্তার দুপাশে লম্বা লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। তার নিচ দিয়ে বয়ে চলা একটা প্রশস্ত হ্রদ দেখা যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে যতই এগোচ্ছে হ্রদটাও যেন পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে তাদের সাথে।
—–” মিলিয়ানের তখন দেড় বছর বয়স। নিশুতি এক রাতে অদ্ভুত কিছু শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে যায় মীরা’র। শব্দটা ড্রয়িংরুম থেকে আসছিলো। সে পাশ ফিরে দেখল, লিও বেডে নেই। লিওকে বেডে না দেখতে পেয়ে ভাবল, হয়তো সে ড্রয়িংরুমে কিছু করছে। কারণ, ঘুম না এলে লিও প্রায়ই রাতে জেগে প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করতো। কিন্তু পরক্ষণেই মীরা’র ধারণা পালটে যায় এক অচেনা নারী কন্ঠে কামুকতাপূর্ণ অশ্লীল শব্দোচ্চারণ শুনে। সে প্রবল দ্বিধা দ্বন্দ নিয়ে বেড থেকে নেমে রুমের ভেজিয়ে দেওয়া দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনও সেই অশ্লীল শব্দ গুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো। না চাইতেও দরজার ফাক দিয়ে ড্রয়িংরুমে উঁকি দিতেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো মীরা’র। সে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলো না যে, তার একমাত্র ভালোবাসা কি না অন্য এক নারীর সাথে মিলে শারীরিক সুখ মেটাচ্ছে! মুহুর্তের জন্য হতবাক হয়ে পড়ল সে। সহ্যশক্তি লোপ পেলো তার। সে হতবিহ্বল হয়ে ছুটে গেল কিচেনের দিকে। কিচেন থেকে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে, সোফায় লিওকে জড়িয়ে শুয়ে থাকা সেই নগ্ন মেয়েটার পিঠ বরাবর গেথে দিল। তীব্র ক্রোধে তখন অন্ধ হয়ে গেছিলো মীরা। কিন্তু মেয়েটার বদলে যখন লিওর মরণার্তনাদ শুনতে পেলো, তার ভেতর থেকে সব রাগ যেন কর্পূরের মতো উড়ে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখল, সেই মেয়ে না বরং লিওর বুকে ছুরি গেথে দিয়েছে সে। লিও’র বুক চিরে ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা বইছে। মীরা চাপা আর্তনাদ করে উঠল। সে তো মেয়েটাকে মেরেছে, তাহলে? মীরা দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রয়িংরুমের চারপাশে তাকালো। কিন্তু পুরো রুমে সে আর লিও ব্যতীত তৃতীয় কেউ ছিলো না!
—–” লিওকে আপু খুন করেছে!?
ওরহানের কথা শেষ হতে না হতেই নীরা হতবুদ্ধি হয়ে বলল। ওরহান আচমকা ব্রেক চেপে গাড়ি দাড় করিয়ে দেখল, নীরা বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
—–” লিওকে পরনারীর সাথে দেখে তার উপর থেকে সমস্ত আবেগ ভালবাসা ফিকে হয়ে গেছিলো মীরা’র। নিজ হাতে লিওকে খুন করার পর অপরাধবোধে ভোগা যেমন তেমন, সে এক অজানা আতংকে ভুগতে লাগল। পুলিশি ঝামেলা থেকে বাচতে সে সকাল হতেই লিওর শেষকৃত্যের কাজ সম্পন্ন করে ফেলল। কিন্তু তার মনে যে অজানা আতংক ছিলো, তা মাত্র কয়েকদিনেই স্পষ্ট হয়ে গেছিলো তার সামনে। সে রাতে কোনো সাধারণ মেয়ে নয় বরং এক অমিত শক্তিশালী পিশাচীনির সাথে সঙ্গমে লিপ্ত ছিলো তার স্বামী। আর মিলিয়ান যাকে সে নিজের সন্তান ভাবতো, সে আর কেউ নয় সেই পিশাচীনি লামিয়ার সন্তান।
কয়েক মুহুর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নীরা। তার মন বলছে, সামনে ভয়ানক বিপদ অপেক্ষা করছে। যে বিপদ তাকেও মীরা’র মতো চিরতরে শেষ করে দেবে।
—–” মিলিয়ানকে জাস্ট এক ঝলক দেখেই চলে আসবে।
বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো ওরহান। নীরা সম্বিৎ ফিরে দেখল জংগলের মাঝে একটা হ্রদের ধারে দাড়িয়ে আছে গাড়িটা। নীরা দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
—–” কোথায় মিলিয়ান?
হ্রদের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা একটি শতাব্দী প্রাচীন কটেজ এর দিকে তাকিয়ে আছে ওরহান। নীরা সেদিকে তাকিয়ে বলল,
—–” এখানে?
—–” হুম, চলো।
নীরা’র বাম হাতটা নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে দ্রুত পায়ে কটেজের বারান্দায় এসে দাড়ালো ওরহান। ওক কাঠের মজবুত দরজায় ঝোলানো লোহার আংটা দিয়ে দরজায় নক করল।
দরজায় ঝোলানো আংটা দেখে সী সাইডে ওরহানের সেই কাঠের বাড়িটার কথা মনে পড়ল নীরা’র। সেই দরজাতেও হুবুহু এমনই আংটা ঝোলানো ছিলো। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল এক মধ্যবয়সী মহিলা। তাকে দেখা মাত্রই নীরা চিনতে পারলো।
ওরহানের বাসায় এই মহিলাই সেদিন দরজা খুলেছিলো। তার মানে এই মহিলাও নিশ্চয়ই এদেরই একজন! নীরা অনেক চেষ্টা করেও মহিলাটার নাম মনে করতে পারলো না।
—–” স্বাগতম মিস নীরা!
মহিলার ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপাত্মক হাসি ফুটে উঠেছে। নীরা কোনো উত্তর দিলো না। ওরহান মহিলাকে ইশারায় কিছু বলতেই মহিলাটা নীরা’কে বলল,
—–” আমার সাথে আসুন, নীরা।
নীরা একবার ওরহানের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই মহিলাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো।
_______________________________
ফেরিঙ্গাসি লেক এর পাড়ে এসে দাড়ালো মরিসের গাড়ি। সামনেই একটা পুরনো আমলের কটেজের সামনে সেই কালো গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। সোফিয়া গাড়ি থেকে নেমে এসে বিরক্ত হয়ে বলল,
—–” কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। নীরা’কে দেখে মনে হয়নি সে কোনো বিপদে আছে। দিব্যি লোকটার সাথে করে লেকের পাড়ে কটেজে বেড়াতে এসেছে সে।
সোফিয়া একটু থেমে আবার বলল, ” আমার তো মনে হচ্ছে নীরা আমাদের নিয়ে কোনো প্রাঙ্ক করছে।
মরিস তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশটায় একবার নজর বুলিয়ে নিল। খোলামেলা মনোরম পরিবেশ ফেরিঙ্গাসি লেক। এখানে মানুষ ভ্যাকেশন কাটাতে আসে। এবার তারও মনে হচ্ছে সোফিয়ার কথাই ঠিক।
নীরা তাদেরকে বোকা বানিয়েছে। প্রথমে কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। পরে আচমকা ফোন দিয়ে বলে সে নাকি খুব বিপদে আছে। তারপর থেকে ফোন অফ।
আর এখন, সে গাড়িতে করে একটা লোকের সাথে কখনও গল্ফ পার্ক আবার কখনো ফেরিঙ্গাসি লেক এ ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীরা’র এমন আচরণে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল মরিস। গাড়িতে উঠে সীট বেল্ট বাধতে বাধতে সোফিয়ার উদ্দেশ্যে চেচিয়ে উঠলো ,
—–” সোফি! এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নীরা’র মজার বস্তু হতে না চাইলে এসে গাড়িতে ওঠ!
—–” মানে কি!? এখন আবার কোথায় যাবো!?
—–” রেগেন্সবুর্গ।
সোফিয়া একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরে কটেজের দিকে তাকালো। মরিস আবার হাক ছাড়ল। সোফিয়া ঘুরে এসে সীটে বসে সীট বেল্ট বাধতে গিয়ে দেখল, কটেজের বারান্দায় একটা লম্বাচওড়া সুদর্শন যুবক পায়চারি করছে। মরিস গাড়ি ঘুরাবে ঠিক তখনই সোফিয়া কন্ঠঃ নিচু করে চেচিয়ে উঠলো,
—–” মরিস ওয়েট ওয়েট। এটা তো সেই লোকটা!
—–” মানে? কোনটা কোন লোক?
মরিস সোফিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো। কটেজের বারান্দায় পায়চারি করতে থাকা যুবকটাকে দেখে মনে করার চেষ্টা করলো, সে আগে কখনো তাকে দেখেছে কি না। কিন্তু সে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না।
—–” আরে! তোর বার্থডে পার্টিতে দেখেছিলাম। কিন্তু সে এখানে কি করছে? নীরার সাথে কি সম্পর্ক তার!?
আবারও মরিসের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। তার মনে অজানা ভয় জমাট বাধছে। লোকটা কে? সেইই কি নীরা’র বিপদের কারণ!?
_____________________________
সাপের মতো পেচানো সিড়ি বেয়ে সন্তর্পনে নামছে নীরা। সিড়িতে লাইটের কোনো ব্যবস্থা আছে বলে মনে হচ্ছে না। কি ভীষণ ঘুটঘুটে অন্ধকার!
যেন আলোময় পৃথিবী ছেড়ে কোনো মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করেছে সে। কয়েক ধাপ পরপর ছোট্ট খোপ খোপ জানালা। সেই খোপ দিয়ে বাইরের আলো ভেতরের অন্ধকারে মিশে ক্ষীণ আলো ছড়াচ্ছে।
ভদ্রমহিলা সেই ক্ষীণ আলোতেই তরতর করে সিড়ি বেয়ে নেমে চলেছে। নীরা তাকে অনুসরণ করে নামছে ঠিকই। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই সিড়ির বোধহয় কোনো শেষ নেই। নেমেই চলেছে শুধু।
হটাৎ করে খেয়াল করল নিচে অনেক দূর পর্যন্ত আর কোনো খোপ দেখা যাচ্ছে না। মানে সামনে আরও নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবতে চলেছে সে! আর সেই অন্ধকারেই আঁটকে রাখা হয়েছে তার ছোট্ট মিলিয়ানকে!!
—–” আমার হাত ধরুন নীরা! সামনে আলো নেই।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচমকা সেই ভদ্রমহিলার ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠঃ পেয়ে গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেলো নীরা’র। সে মৃদু কাপতে কাপতে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
প্রায় সাথেসাথেই একটা বরফ শীতল হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হয়ে গেলো তার হাতটা। ঠান্ডায় জমে যেতে লাগল নীরা। যেন সে কোনো বরফখন্ডের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে।
নীরার হাত ধরে সেই অন্ধকারেই এগিয়ে চলল ভদ্রমহিলা। কিছুক্ষণ পরই অন্ধকার ভেদ করে এক টুকরো আলোর দেখা মিললো। একটা পঞ্চভুজাকৃতির কক্ষ। চারপাশের দেয়াল আর মেঝে মার্বেলখচিত।
বাইরে থেকে কোনো আলো বা বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। কক্ষের মেঝেতে বিশাল এক ফাটল দেখা যাচ্ছে। সেই ফাটলের সোজাসুজি শূন্যে ভাসছে মিলিয়ানের দেহ। তার আগাগোড়া সাদা কাপড়ে গলা অব্দি ঢেকে দেওয়া!
—–” মিলিয়ান!
নীরার করুন ডাক কক্ষের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ভদ্র মহিলা নীরা’র হাতটা হ্যাচকা টান মারতেই নীরা’র মনে হল তার হাতটা বুঝি মচকে গেছে। নীরা চিতকার করতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলো। ভদ্র মহিলা শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
—–” শব্দ করবে না। যাও দেখেই চলে এসো!
নীরা কিছু না বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। মিলিয়ানকে ঘিরে জোনাকির আলো সদৃশ এক প্রকার নীলচে-সবুজ রঙা কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই আলোয় মিলিয়ানের শুভ্র ত্বক যেন ঝিকমিক করছে।
—–” মিলিয়ান! বাবা আমার! তুমি কি শুনতে পাচ্ছো!? তোমার মাম্মাম এসেছে বাবা!
নীরা’র ফিসফিসানি শুনতে পেয়ে মনেমনে বেশ বিরক্ত হল মহিলাটা। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সে খেয়াল করছে যেন, মেয়েটা মিলিয়ানকে স্পর্শ না করে। নীরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিলিয়ানের দিকে। মিলিয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন এক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হয়তো এই ঘুমন্ত অবস্থাতেই তার প্রাণ নিয়ে নেবে ওরা। নীরা আবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকতে থাকতে হুট করেই দু’হাতে মিলিয়ানের মুখটা ধরে কেদে উঠল,
—–” আমি এসে গেছি বাবা! তোমাকে রক্ষা করবো আমি!
প্রায় সাথেসাথেই নীলচে-সবুজ রঙা আলো গুলো চক্রাকারে চারিদিকে ছিটকে গিয়ে মার্বেল খচিত দেয়ালে আছড়ে পড়লো। কক্ষটা মৃদু কেপে উঠল। আঁতকে উঠল নীরা। মহিলাটা অশ্রাব্য ভাষায় নীরা’কে গালি দিতে লাগল। তার চোখেমুখে স্পষ্ট আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
সে নীরা’কে ফেলেই পেছন ফিরে ছুটে গেল কোথাও। সেইসাথে সাথেই কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। নীরা আতংকিত চোখে কক্ষের চারিদিকে তাকিয়ে বের হওয়ার পথ খুজতে লাগল।
কিন্ত কোথাও এক চিড় ফাকও নেই বের হওয়ার। নীরা অনুভব করল মেঝের সেই ফাটলে আরও কিছু চিড় ধরছে! কিন্তু মিলিয়ান কোথায়!? শূন্যে মিলিয়ানকে দেখতে না পেয়ে আরেক দফা আঁতকে উঠল নীরা। পুরো কক্ষে শুধু সে একাই আছে। তার থেকে হাত কয়েক উঁচুতে ভেসে বেড়াচ্ছে সেই নীলচে-সবুজ রঙা আলো!
_______________[চলবে___________________