#Child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam
_________________[24]____________________
দিনের আলো ফুরিয়ে গিয়ে রেগেন্সবূর্গের বুকে রাত নেমেছে।
রাস্তাঘাট ঢেকে গেছে তুষারপাতের পুরু আস্তরণে। ল্যাম্পপোস্ট এর হলদেটে আলোয় ঝাপসা হয়ে উঠেছে প্রকৃতি।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে, পর্দা সরিয়ে কাচের জানালা ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে আছে হেনা। থেকে থেকে ভারি নিঃশ্বাস ফেলছে সে।
রবার্ট একটা ট্রেতে ডিনার রেডি করে টি-টেবিলের ওপর রাখল।
হেনার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। সে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে তুষারপাত দেখছে। রবার্ট মুখোমুখি একটা সোফায় বসে বলল,
—–” সারাটাদিন কিচ্ছু খাওনি। এবার অন্তত মুখে কিছু দাও।
হেনা কোনো উত্তর দিলো না। সে জেনে বেচে থেকেও মরে গেছে। জীবন্ত লাশ হয়ে আছে মাত্র।
রাত দশটা বাজে। শীতের রাত যেন শেষই হতে চায় না। আর দিন তো দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে যায়।
রবার্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিভি অন করল। কাল সকালেই হেনা’কে ব্রেম এ রেখে আসতে হবে।
নয়তো সে এভাবে থাকতে থাকতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।
রবার্ট এর ভাবনায় ছেদ পড়ল টিভি স্ক্রিনে নীরা’র ছবি দেখে! নীরা’কে হটাৎ টিভিতে দেখাচ্ছে কেন?
রবার্ট টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিল। নিচে দিয়ে হেডলাইন যাচ্ছে, “মিউনিখ ফেরিঙ্গাসি লেকের একটি পুরাতন কটেজে অমীমাংসিত দূর্ঘটনা।
নীরা হক আর মরিসন ওরফে মরিস নামে রেগেন্সবূর্গবাসী দুই যুবক যুবতীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছে মিউনিখ পুলিশ। কটেজ থেকে সোফিয়া নামের একটি মেয়ের মরদেহ উদ্ধার।
হেনা এতক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো। হটাৎ নীরা’র নাম শুনে চকিতে টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল, তিনটা ছেলেমেয়ের ছবি দেখাচ্ছে।
তাদের মধ্যে নীরা একজন! হেনা কিছুটা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল,
—–” নীরা!?
রবার্ট স্ত্রীর কথা শুনে স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হেনার দিকে তাকালো।
সেও তার মতো অবাক হয়েছে। অবশ্য অবাক হওয়ারই কথা।
নীরা এমন একটা ঘটনায় কিভাবে জড়ালো!? কি হয়েছিলো তাদের সাথে!? নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে রবার্ট এর মাথায়।
_____________________________
|
|
|
|
|
ঘড়ির কাটায় রাত এগারোটা দশ বাজে। মিউনিখ সেন্ট্রাল হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে নীরা আর মরিসকে।
সোফিয়ার বডি নিয়ে ফরেনসিক তদন্তের কাজ চলছে। ডক্টর জোনাস মরিস আর নীরা’র ফুল বডি টেস্ট করতে দিয়ে কেসটার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ফ্রেডরিককে কল দিলো।
ফ্রেডরিক তার ফোর্স নিয়ে সেই কটেজটার আশপাশ ও ভেতরে সব জায়গায় তল্লাশি চালাচ্ছে।
কিন্তু নীরা, মরিস আর সোফিয়াকে উদ্ধার করার পর আহত বা নিহত আর কাউকেই খুজে পাচ্ছেনা তারা।
সম্পূর্ণ লেক এরিয়া রেস্ট্রিকটেড করে দেওয়া হয়েছে। প্রফেশনাল ডাইভারদের দিয়ে পুরো লেকে খোজ চালাচ্ছে পুলিশ।
ভিক্টিমদের মধ্যে মরিস আর সোফিয়ার পরিবারে খবর দেয়া হয়েছে।
কিন্তু নীরা এখানকার অস্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় এবং তার পরিবার অন্য দেশে থাকায় তাদেরকে খবর পাঠাতে পারেনি।
মিডিয়া ঘিরে আছে পুরো লেক এরিয়া জুড়ে। এমন অদ্ভুত অমীমাংসিত ঘটনায় পুরো মিউনিখ বাসির মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
হটাৎ ফোনের রিংটোন পেয়ে ফ্রেডরিক ফোনস্ক্রিনে তাকালো।
ডক্টর জোনাস কল দিয়েছে। সে দ্রুত কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেলো,
—–” হ্যালো অফিসার!
—–” হ্যাঁ বলুন ডক্টর! কোনো রিপোর্ট আছে?
—–” মরিসন আর নীরা হকের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। হয়তো কাল ভোরে নয়তো সকালে মধ্যে ফিরবে। আমি ফুল বডি টেস্ট করতে দিয়েছি। আর ডেড বডিটাকে ফরেনসিক বিভাগে পাঠিয়েছি।
—–” বেশ, ফরেনসিক রিপোর্ট কবে আসবে!?
—–” কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে নয়তো এক মাস এর মধ্যেই চলে আসবে।
—–” আচ্ছা। আর ওদের জ্ঞান ফিরলেই আমাকে জানাবেন।
—–” ওকে অফিসার।
কল কেটে দিল ফ্রেডরিক। দুপুরে একটা আননোন নম্বর থেকে কল পেয়েই লোকেশন অনুযায়ী ফোর্স পাঠিয়েছিলো সে।
কিন্তু যখন খবর পেলো যে এখানে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে, সাথেসাথেই সেও চলে এসেছিলো।
কটেজটা বেশ পুরনো। লেকের অন্যান্য কটেজে ভ্যাকেশন কাটাতে আসে অনেকেই।
কিন্তু এই কটেজটা নাকি কারো মালিকানাধীন ছিলো। তাই ভ্যাকেশন কাটাতে এখানে উঠেছিলো এমন কারো খোজ মেলেনি।
—–” স্যার! কটেজের বেসমেন্টে একটা গুপ্ত ঘর আছে। আপনি কি একটু দেখবেন?
ডিউটিরত এক সহকর্মী লুকাস এর ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল ফ্রেডরিক এর। সে চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল,
—–” হুম চলো।
কটেজের ভেতরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ফ্রেডরিক আর লুকাস।
বেসমেন্টের সিড়ি বেয়ে নেমে সরু চ্যাপেল মতো করিডরে এসে দাড়ালো তারা।
চারিদিকে স্যাতসেতে পরিবেশ। কেমন একটা সোদা গন্ধ বেসে বেড়াচ্ছে।
কিছুটা এগিয়ে মেঝেতে ডেড বডির আকৃতি সিল করা। লুকাস জায়গাটা দেখিয়ে বলল,
—–” সোফিয়া নামের মেয়েটার বডি এখানে পাওয়া গেছিলো।
—–” মেয়েটার শরীরে তো কোনো আঘাতের চিহ্নও ছিলো না। মারা গেলো কিভাবে বুঝলাম না।
—–” সেটাই ভাবার বিষয়। তবে স্যার, মেয়েটার পাশে একটা ধারালো কুড়াল পড়েছিলো। লেকের গার্ডেনার দেখে বলল, সেটা নাকি তার কুড়াল।
ফ্রেডরিক কৌতুহলী হয়ে বলল,” তারপর!? কি বলল সে? তার কুড়াল এখানে ডেড বডির পাশে কিভাবে এলো?
—–” সে নাকি দুপুরে লাঞ্চ করতে যাওয়ার আগে জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখে গেছিলো। কিন্তু ফিরে এসে দেখল, তার দুটো কুড়াল নেই!
—–” দুটো!?
অবাক হয়ে বলল ফ্রেডরিক। লুকাস মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানিয়ে একটা খসে পড়া দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলল,
—–” একটা কুড়াল এখানে পড়েছিলো আর অন্যটা এই রুমের ভেতর।
লুকাসের পিছুপিছু একটা পঞ্চভুজাকৃতি কক্ষের ভেতর এসে দাড়ালো ফ্রেডরিক।
জানালা দরজাবিহীন একটা উঁচু কক্ষ। মার্বেল খচিত দেয়াল আর মেঝেতে জায়গায় জায়গায় চিড় ধরেছে।
—–” এই রুমটার কথাই বলছিলাম স্যার। এখানেই নীরা আর মরিসকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
ফ্রেডরিক দু’হাত পেছনে বেধে কক্ষটা ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো।
বাইরে থেকে আলো বাতাস প্রবেশের কোনো পথ নেই। তবুও কোত্থেকে যেন ক্ষীণ আলোকরশ্মি এসে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো কক্ষ জুড়ে। ভারি অদ্ভুত বিষয়!
এরমধ্যে আরেক সহকর্মী হেনরি এসে ঢুকল কক্ষের ভেতর। ফ্রেডরিক এর দিকে এগিয়ে এসে বলল, ” স্যার! কটেজের বাইরে যে দুটি গাড়ি পাওয়া গেছিলো, সেগুলোর একটা ভিক্টিম মরিস এর।
—–” আর অন্যটা!?
—–” ওরহান উজুন নামের এক ভদ্রলোকের গাড়ি।
সাথেসাথেই ভ্রু কুচকে তাকালো ফ্রেডরিক। এই ওরহান আবার কে!? ফ্রেডরিক কিছু বলার আগেই লুকাস জিজ্ঞেস করল,
—–” সে আবার কে!? কটেজে তো দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে ছাড়া কাউকে খুজে পাওয়া যায়নি। তাহলে তার গাড়ি এখানে কি করছে!?
ফ্রেডরিক কিছু একটা ভেবে বলল, ” হতে পারে, এদের মধ্যেই কেউ সেই লোকের গাড়ি নিয়ে এখানে এসেছিলো। মানে লোকটা এদের পরিচিত কেউ হয়তো।
একটু থেমে ফ্রেডরিক আবার হেনরিকে বলল,” লোকটা কে? কোথায় থাকে? দ্রুত খোজ নাও। আর সে যেখানেই থাকুক, আমার সামনে নিয়ে এসো।
—–” ইয়েস স্যার!
বলেই দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো হেনরি। লুকাস সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল,” স্যার! আপনার কি মনে হয়!? এত পুরনো একটা কটেজের ভেতরে বেসমেন্টে এমন একটা পঞ্চভুজাকৃতি কক্ষ কি কাজে তৈরি করা হয়েছে!?
ফ্রেডরিক কক্ষের ছাদে তাকিয়ে বলল, ” কক্ষটা এই কটেজের থেকেও বেশ পুরনো মনে হচ্ছে।
চমকে উঠল লুকাস। ফ্রেডরিক স্মিত হেসে বলল, ” হতে পারে, কক্ষটাকে লোক চক্ষুর আড়ালে রাখতেই এই কটেজ বানানো হয়েছে!
__________________________
|
|
|
|
|
রাতের আধার চিরে সূর্য উঁকি দিচ্ছে পুব আকাশে। রাস্তাঘাটে জমে থাকা শুভ্র বরফ গলে প্রকৃতি ধুয়ে যাচ্ছে।
আলো ফোটার সাথেসাথে ব্যস্ত হয়ে উঠছে নগরী। দোকানপাট খুলে নতুন দিনের কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে উঠছে দোকানীরা।
ক্রেতারা আসতে শুরু করেছে। কেউ কেউ জগিং স্যুট নিয়ে হেটে যাচ্ছে কাছাকাছি পার্কের দিকে।
সিমেট্রির বাইরে দাঁড়িয়ে নজর বুলাচ্ছে আন্দ্রেস। গতকাল সে পলদের বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেলের প্রার্থনার সময় হয়ে গেছিলো।
অল্প সময়ের মধ্যে কোনোরকমে সমাধিটা বন্ধ করেছিলো সে।
এন্ড্রুও যেন স্বস্তি পেয়েছিলো তার ফিরে আসায়। কিন্তু তার মুখে সারলোটের ব্যাপারটা জানার পর আবারও অস্বস্তিতে পড়েছে ভীষণ।
কিন্তু আন্দ্রেস এর মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে।
সে যেভাবেই হোক সারলোটের মাধ্যমে বাকিদের তথ্য বের করবেই।
তারপর কতৃপক্ষকে জানিয়ে ধ্বংস করে দেবে শয়তান গুলোকে।
সেজন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে, সঠিক সময়ের অপেক্ষা।
—–” বিশপ!? আজকের খবর দেখেছেন?
আচমকা এন্ড্রুর কন্ঠঃ পেয়ে বেশ চমকে উঠল আন্দ্রেস। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ” কিসের খবর?
—–” মিউনিখের! ওখানকার একটা লেকের কটেজে নাকি একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে!
আন্দ্রেস ব্যাপারটাতে কোনো আগ্রহ খুজে পেলো না। মনেমনে সে অন্যকিছু নিয়ে ভাবছে। এন্ড্রু আর কিছু বলার আগেই আন্দ্রেস তাকে নিয়ে সিমেট্রির ভেতর যেতে যেতে বলল,
—–” গতকাল যে দু’জনকে সমাধি খুড়তে এনেছিলে, ওরা ব্যাপারটা কাউকে বলে দেবে না তো!?
—–” বিশপ! ব্যাপারটা আজ নাহয় কাল জানাজানি হবেই। তারচেয়ে আমার মনে হয় কতৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। পরে ওনারা যেটা ভালো মনে করবেন
এন্ড্রুর আমতা-আমতা কথা শুনে আন্দ্রেস ধমকে উঠল,” এন্ড্রু! তুমি যদি আমার সাথে কাজটা না করতে চাও তো এখনই আমাকে বলে দাও। যা করার আমি নিজেই করবো। কিন্তু ব্যাপারটা যদি ঘূনাক্ষরেও কেউ টের পায় তো, তোমাকে আমি আস্তো রাখবো না বলে দিলাম।
ধমক খেয়ে কেপে উঠল এন্ড্রু। মুখটা কাচুমাচু করে বলল, ” ঠিকাছে বিশপ। আমি কাউকে বলবো না। তবে আমি সত্যিই এই ঝামেলায় জড়াতে চাইনা।
একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলল আন্দ্রেস। সে ভেবে পায়না একজন পাদ্রী হয়েও এন্ড্রু কিভাবে এতটা ভীতু প্রকৃতির হতে পারে।
লোকটা আসলেই কোনো কাজের না। এন্ড্রুকে রেখেই সিমেট্রির ভেতর চলে গেলো আন্দ্রেস।
তাকে এখন সারলোটের লাশ সমাধি থেকে সরাতে হবে। অনেক কাজ বাকি।
বিকেল হওয়ার আগেই লাশ নিয়ে সিমেট্রি থেকে চলে যেতে হবে তাকে। ঘড়ির দিকে তাকালো আন্দ্রেস, এখন ভোর ছয়টা পনেরো বাজে।
|
|
|
|
|
______________[চলবে]________________
বিঃদ্রঃ জানি পর্বটা ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিদিন দেওয়ার চেষ্টা করছি। ঠান্ডায় মাথাব্যথা করছিলো গতকাল। আজ আবার সর্দি! তাই বেশি লিখতে পারিনি। কাল ইনশাআল্লাহ বড় করে দিবো🙂