Child_Of_Night Part-25

0
1351

#Child_Of_Night
Writer : Tanjima Islam

_________________[25]____________________
`
`
`
`
`
মাত্রই ডায়াবেটিস হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছে নীরা’র বাবা-মা। বাইরে থেকে ব্রেকফাস্ট করে এসেছে। নীরা’র বাবা মুহিদুল প্রেসক্রিপশন আর মেডিসিন গুলো নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসল।

হটাৎ করেই ডায়াবেটিস বেড়ে গেছে তার। শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই। নীরা’র মা টিভি অন করে কিচেনে গিয়ে ঢুকল। বেলা একটা বাজে, এখন তাকে দুপুরের রান্না করতে হবে।

ফ্রিজ থেকে কেটে রাখা সব্জির বক্স বের করে স্টোভ জ্বালিয়ে দিল। বাসায় দুজনে থাকে তাই, রান্নাবান্নার প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র সে আগে আগে কেটেকুটে বক্সে করে রেখে দেয়।

আজ দুপুরে সে সবজি, মাছ ঝোল আর ডাউল রান্না করবে। হসপিটালে যাওয়ার আগেই রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে গেছিলো। স্টোভ জ্বালিয়ে প্যান বসিয়ে তাতে অলিভ অয়েল ঢেলে দিল নাজনীন। এরমধ্যেই নীরা’র বাবা’র ডাক শোনা গেলো,

—–” নাজনীন! শিগগিরই এদিকে এসো!

নীরা’র মা বুঝে পেলো না, লোকটার হটাৎ কি হল যে এভাবে উচ্চস্বরে ডাকছে!? আবার শরীর খারাপ করল না তো! সে স্টোভ বন্ধ করে দ্রুত পায়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখল, নীরা’র বাবা টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও তাকালো টিভি স্ক্রিনে। নীরাসহ তিনটে ছেলেমেয়ের ছবি দেখাচ্ছে, “জার্মানিতে মিউনিখ ফেরিঙ্গাসি লেকের একটি পুরাতন কটেজে অমীমাংসিত দূর্ঘটনা।

নীরা হক নামে এক বাঙালি এবং মরিসন ওরফে মরিস নামে দুই যুবক যুবতীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে মিউনিখ পুলিশ। কটেজ থেকে সোফিয়া নামের একটি মেয়ের মরদেহ উদ্ধার।

খবরটা শোনা মাত্রই ধপ করে ফ্লোরে পড়ে গেলো নাজনীন। মুহিদুল দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে স্ত্রীকে ধরে তুলল। হাত পা ছেড়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েছে সে। মুহিদুল কোনোরকমে তাকে তুলে সোফায় নিয়ে বসালো।

—–” নীরা! আমার নীরা! আমি বারবার বলেছিলাম, ফিরে আয় মা! শোনেনি! আমার কথা শোনেনি! নীরা মা আমার!!

হতবিহ্বল হয়ে চেচাচ্ছে নাজনীন। মুহিদুল তাকে কিভাবে সামলাবে ভেবে পাচ্ছেনা। সে নিজেই ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে।

____________________________
`
`
`
`
`
`
`
`
জ্ঞান ফিরেছে নীরা’র। আস্তে-ধীরে চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারছেনা। চোখের পাতা এত ভারি লাগছে যেন পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে তার চোখের ওপর।

মাথাটাও ভীষণ ব্যাথা করছে। সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। হাত-পা নাড়াতে পারছেনা একটুও। চারপাশে কি অসহ্য নীরাবতা! কোথায় আছে সে এখন!? আদৌ কি বেচে আছে নাকি মরে গেছে!?

মরে গেলে তো কবর দেয়, এই ভীন দেশে কি তাকে কবর দিয়েছে নাকি কফিনে পুরে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছে!? নীরা’র আকাশপাতাল ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে একটা মেয়ে কন্ঠঃ কানে এলো,

—–” ডক্টর! মিস নীরা’র জ্ঞান ফিরেছে!

এতক্ষণে নিশ্চিত হয়েছে নীরা, সে বেচে আছে। কিন্তু কোথায়? হসপিটালে!? বহুকষ্টে চোখ মেলে তাকালো নীরা। কি ভীষণ আলো চারিদিকে! সে কি হসপিটালে না কি খোলা আকাশের নীচে কোথাও পড়ে আছে!?

আজগুবি চিন্তাভাবনা আসছে মাথায়! ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসতেই দেখল, সে একটা কেবিনের বেডে শুয়ে আছে। গলা অব্দি আকাশি রঙের চাদর টেনে দেয়া। হাতে ক্যানোলা লাগানো, নাকে অক্সিজেন মাস্ক দেয়া।

উঠে বসার চেষ্টা করল নীরা। কিন্তু উঠতেই পারলো না। এরমধ্যেই ডক্টর আর নার্স এসে কেবিনে ঢুকলো। নিজেদের মধ্যে কিসব বলতে বলতে নীরার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলল নার্স।

মাস্ক খোলার সাথেসাথে কিছুটা অস্বস্তি হতে লাগল নীরা’র। ডক্টর তাকে চেকাপ করছে আর নার্সটা একটা ফাইলে যেন কিসব লিখছে। তাদের কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেনা নীরা। কেমন যেন অস্পষ্ট শব্দ!

—–” মিস নীরা! এখন কেমন লাগছে?

এতক্ষণে স্পষ্ট শুনতে পেলো নীরা। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। কেমন যেন জড়তা কাজ করছে তার ভেতর। ডক্টর আবার জিজ্ঞেস করল, এবারও কিছু বলল না সে। ডক্টর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—–” আচ্ছা আপনি এখন বিশ্রাম নিন। বিকালে আসবো আপনাকে দেখতে।

ডক্টর চলে গেলো। নার্স ফাইল দেখে দেখে কিছু মেডিসিন নিয়ে খাইয়ে দিল নীরা’কে। নীরা ও চুপচাপ খেয়ে নিল। একটু পর নার্স একটা ট্রেতে কোয়েলের স্যুপ আর এক গ্লাস মাল্টার জ্যুস নিয়ে এলো। নীরা’র পায়ের ওপর ট্রেটা রেখে বলল,

—–” ব্রেকফাস্ট করে নিন।

বেডের পাশে একটা বাটন দেখিয়ে বলল, ” আর, কোনো প্রয়োজন হলে এই অ্যালার্ট বাটনে ট্যাপ করবেন।

প্রতিত্তোরে নীরা মাথা দুলিয়ে আচ্ছা জানালো। চলে গেলো নার্স। চুপচাপ বসে রইলো নীরা। শরীরের ব্যথাটা কমে গেছে কিন্তু মাথাব্যথাটা এখনও যায়নি। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।

নার্স মেয়েটা এলে ওকে বলবে চুলটা আঁচড়ে উচু করে খোপা বেধে দিতে। ট্রেতে নাস্তার পাশে নিউজ পেপার রাখা। নীরা এক ঢোক জ্যুস খেয়ে পেপারটা হাতে নিল।

পেপারে চোখ বুলাতে বুলাতে একটা খবরে চোখ আঁটকে গেলো তার। বড়বড় অক্ষরে লেখা,” মিউনিখ ফেরিঙ্গাসি লেকের একটি পুরাতন কটেজে অমীমাংসিত দূর্ঘটনা।

নীরা আর মরিস নামে রেগেন্সবূর্গ বাসী দুই যুবক যুবতীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। সোফিয়া নামের একটি মেয়ের মরদেহ উদ্ধার।

বিস্তারিত পড়তে লাগল নীরা, ” বহু পুরাতন কটেজটি ফেরিঙ্গাসি লেকের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনার দিন দুপুরে মরিসন ওরফে মরিস নামের যুবকটির ফোন থেকে মিউনিখ পুলিশ এর কাছে একটা ফোন আসে। ফোনে সে সাহায্য চেয়ে লোকেশন পাঠায়।

সাথেসাথেই মিউনিখ পুলিশ রওনা হয় কটেজটির উদ্দেশ্যে। সেই তিন যুবক যুবতী ব্যতীত আর কারও সন্ধান পায়নি পুলিশ। কিন্তু কটেজের বাইরে যে দুটি গাড়ি পাওয়া গেছে, তার একটি ভিক্টিম মরিস এর এবং অন্যটি ওরহান উজুন নামে কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তির।

বাকি লেখা আর পড়তে ইচ্ছে হল না নীরা’র। ওরহানের নামটা দেখেই তার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা ওরহান বেচে নেই।

আর মিলিয়ান! তাকে তো সে নিজে হাতে হত্যা করেছে! কি করে করতে পারলো সে? নিজ মনেই প্রশ্ন করলো নীরা। কোনো উত্তর পেলো না।

চোখ জোড়া বন্ধ করতেই মিলিয়ানের নিষ্পাপ মুখটা দেখতে পেলো। তার সোনালী চুলের রাজপুত্র মিলিয়ান! কি নিখুঁত তার সৌন্দর্য্য! তার গোল গোল নয়নে তাকিয়ে থাকা! আধো আধো স্বরে ডাকা,” মাম্মাম!

যেন মিলিয়ানের কন্ঠঃ শুনতে পেলো সে! সাথেসাথেই ধড়ফড়িয়ে উঠল নীরা। দ্রুত এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেবিনে সে একা! মিলিয়ান নেই এখানে। কোথাও নেই মিলিয়ান!

তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। সে আর কোনোদিন মিলিয়ানকে দেখতে পাবে না! মিলিয়ান আর কখনই তাকে মাম্মাম বলে ডাকবেনা! কখনও না!

হাউমাউ করে কেদে উঠল নীরা। দু’হাতে বিছানার চাদর খামছে ধরে চেচিয়ে উঠলো, ” মিলিয়ান! মিলিয়ান! বাবা আমার!

গলা ছেড়ে গগনবিদারী চিৎকার দিতে লাগল নীরা। এক ধাক্কায় ব্রেকফাস্টের ট্রে ছুড়ে মারল কেবিনের দেয়ালে। প্রায় সাথেসাথেই দু’জন নার্স এসে তাকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

—–” মিস নীরা! শান্ত হন! নীরা!

নীরা কোনো কথা শুনছে না। গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে সে চিৎকার করছে। অবস্থা বেগতিক দেখে একজন নার্স অ্যালার্ট বাটন চেপে দিল। নীরা’কে তারা সামলাতে পারছেনা!

কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন ওয়ার্ড বয় এসে নীরা’র দু’হাত আর দুই পা চেপে ধরল। নার্স একটা সিরিঞ্জ নিয়ে পুশ করল নীরার হাতের কবজিতে। শিথিল হয়ে এলো নীরা’র শরীর। ঘুম পাচ্ছে তার, ভীষণ ঘুম। মিনিট খানেকের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো নীরা।

_________________________
`
`
`
`
`
`
`
`
ডক্টর জোনাস এর ফোন পেয়ে হসপিটালে এসে উঠেছে অফিসার ফ্রেডরিক। জোনাস তার চেম্বারের মধ্যে পায়চারি করছে। ফ্রেডরিক এসে ঢুকতেই জোনাস একটা চেয়ারে তাকে বসতে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল। ফ্রেডরিক চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল,

—–” বলুন ডক্টর!

জোনাস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” মরিসের এখনও জ্ঞান ফেরেনি, ধারণা করছি সে সম্ভবত কোমায় চলে গেছে।

—–” মানে!?

উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ফ্রেডরিক। জোনাস তাকে শান্ত হতে বলে বলল,” এখনও নিশ্চিত নই। তবে ৭২ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে নিশ্চিত হবো যে সে কোমায় চলে গেছে। আর কোমা থেকে কবে বের হবে সেটা নিশ্চিত বলতে পারবো না। সেটা পেশেন্ট এর শারীরিক মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে।

একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলল ফ্রেডরিক। জোনাস পরক্ষণেই বলল,” তবে নীরা’র জ্ঞান ফিরেছে!

ফ্রেডরিক যেন আশার আলো দেখতে পেলো। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ” কি অবস্থা তার!? কিছু বলেছে!? কি হয়েছিলো কটেজে!?

মাথা নাড়ালো জোনাস। মানে সে কিছুই বলেনি। ফ্রেডরিক চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল,” আমি ওনার সাথে দেখা করতে চাই।

—–” বেশ চলুন!

জোনাসও উঠে এলো। দুজনে বেরিয়ে এলো চেম্বার থেকে। নীরা’র কেবিনের সামনে আসতেই একজন নার্সকে দেখে জোনাস ডেকে বলল,” সিস্টার! মিস নীরা কি জেগে আছেন?

—–” না ডক্টর। আমি ওনাকে ব্রেকফাস্ট করতে দিয়ে অন্য কেবিনে গেছিলাম। হটাৎ চিৎকার চেচামেচি পেয়ে বেরিয়ে দেখি মিস নীরা চেচাচ্ছেন।

—–” মানে!?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জোনাস। নার্স আবার বলতে লাগল, ” আমরা কেউই ওনাকে সামলাতে পারছিলাম না। পরে ঘুমের মেডিসিন দিতে বাধ্য হয়েছি। আমি এখন আপনাকেই খবর দিতে যাচ্ছিলাম।

—–” আমাকে না জানিয়ে, ঘুমের মেডিসিন দিয়েছো কেন? না জানি তার শারীরিক অবস্থা কেমন ছিলো! এখন সরো সামনে থেকে!

ধমকে উঠল জোনাস। নার্স কাচুমাচু করে সামনে থেকে সরে পড়ল। হনহনিয়ে নীরা’র কেবিনে গিয়ে ঢুকল জোনাস। ফ্রেডরিক তার পিছুপিছু ছুটল। কেবিনে ঢুকে দেখল, নীরা ঘুমিয়ে আছে। চেক করল জোনাস। ফ্রেডরিক চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে আছে। জোনাস নীরা’কে চেকাপ করে বলল,

—–” মনে হচ্ছে বড়সড় একটা শক খেয়েছে মেয়েটা। আর যেহেতু ওখানে কোনো দূর্ঘটনার শিকার হয়েছিলো, ধারণা করছি সেজন্যই একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে।

—–” হুম বুঝেছি। তাহলে আপনি ওনার ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যান। কোনো উন্নতি হলে জানাবেন।

—–” ঠিকাছে অফিসার।

কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো ফ্রেডরিক। জোনাস একবার নীরা’র দিকে তাকিয়ে সেও কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।

__________________________
`
`
`
`
`
`
`
`
আশপাশটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল আন্দ্রেস। নাহ কেউ নেই। সমাধি খোড়া হয়ে গেছে আগেই। এবার লাশটাকে বস্তায় ভরতে হবে। কোদাল ফেলে সমাধিতে নেমে পড়ল আন্দ্রেস।

শাবল গেথে একটা চাপ দিতেই কফিনের ডালা খুলে গেলো। এবার শাবল ফেলে লাশ টাকে পাজকোলা করে নেওয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারলো না।

পাথরে মতো শক্ত আর ভারী হয়ে গেছে লাশটা। একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল আন্দ্রেস। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল, সকাল সাড়ে ন’টা বাজে। সকাল থেকে কিছুই খায়নি। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

কিছু একটু খেয়ে নেয়ার দরকার। কিন্তু সমাধি খুড়ে এভাবে রেখে গেলে কেউ যদি দেখে ফেলে? শেষে আরেক বিপদ হবে। আন্দ্রেস সাথে আনা ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পানির বোতল বের করল।

আপাতত পানি খেয়েই থাকতে হবে। বের হওয়ার পর নাহয় বাইরে থেকে খেয়ে নেবে। পানি খেয়ে আবার কাজে লেগে পড়ল সে। টানা আধ ঘন্টা ধরে টেনেহিঁচড়ে লাশটাকে কফিন থেকে বের করে ওপরে তুলল।

দম ভারী হয়ে আসছে আন্দ্রেসের। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। আজ তেমন কুয়াশা নেই। রোদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে সিমেট্রির ভেতরটা।

গাছের পাতায় পাতায় সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শীত চলে যাওয়ার আগাম বার্তা জানাচ্ছে প্রকৃতি।

কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠে দাড়ালো আন্দ্রেস। বেলা বাড়ছে। তাকে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে এখান থেকে বের হতে হবে। কফিনের ডালা বন্ধ করে কোদাল দিয়ে মাটি চাপা দিতে লাগল।

দশটার বেশি বাজে। সাড়ে দশটার দিকে এন্ড্রু আসবে। অবশ্য সে কোনো ঝামেলা করবে না। কিন্তু তার চিন্তা হচ্ছে, সেই মাটি খোড়ার লোক দুটো যদি কাউকে কিছু বলে দেয়!? তখন তো মহা বিপদ!

সে যে কেন এন্ড্রুকে লোক আনতে বলেছিলো! নিজে কাউকে দুয়ে করিয়ে নিলে এখন আর দুশ্চিন্তায় পড়তে হত না। আন্দ্রেসের সাতপাঁচ চিন্তার সুতো ছিড়ে গেলো এন্ড্রুর কন্ঠঃ পেয়ে,

—–” বিশপ! আপনি এখনও যান নি!?

আন্দ্রেস না তাকিয়েই ভবিষ্যতের, ” দেখতেই তো পাচ্ছো, তো আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?

এন্ড্রু পাশে এসে দাড়ালো। লাশটা এখনও বস্তায় ভরেনি। মড়ার মতো পড়ে আছে মাটিতে। এন্ড্রু একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। জীবনে সে বহু লাশ সমাধি করতে দেখেছে, কিন্তু সমাধি খুড়ে লাশ বের করে সে এই প্রথম দেখছে।

কি ভয়ংকর লাগছে দেখতে। নিষ্প্রাণ একটা দেহ পড়ে আছে চোখের সামনে। অথচ ক’দিন আগেও দেহটা কত প্রাণোচ্ছল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো পৃথিবীর বুকে! তখনও কি সে জানতো যে, তার কৈশোর পেরোনোর আগেই প্রাণের স্পন্দন ফুরিয়ে যাবে! আবার তার সেই নিথর দেহ বের করা হবে!

—–” একা হাতে আর কত!

আন্দ্রেস এর কথা শুনে সচকিত হয়ে তাকালো এন্ড্রু। লোক টাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে তার। কিন্তু এতকিছু করার কি প্রয়োজন ভেবে পাচ্ছেনা সে।

সারলোটের মাধ্যমে কি আদৌ কিছু বের করতে পারবে বিশপ? নাকি হিতে বিপরীত হয়ে যাবে!? সমাধিতে মাটি চাপা দেওয়া শেষ। আন্দ্রেস এবার বস্তা আলগা করে লাশ টাকে ঢোকানোর চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু কিছুতেই ঢুকছেনা। উলটো বস্তা গুটিয়ে যাচ্ছে। এন্ড্রু না চাইতেও বস্তাটা দু’পাশে আলগা করে ধরল। সাথেসাথেই লাশটা ঢুকে গেলো বস্তার ভেতর। স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল আন্দ্রেস। এন্ড্রু বস্তাটা সোজা করে দড়ি দিয়ে বাধতে বাধতে বলল,

—–” বাইরে একটা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করে রেখেছি। ওটাতে করে চলে যান।

কিছুটা অবাক হল আন্দ্রেস। কিন্তু পরক্ষণেই স্মিত হাসল সে। এন্ড্রু তাকে সরাসরি সাহায্য না করলেও কাজটায় সাহায্য করছে। কাপড়চোপড় ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাড়ালো আন্দ্রেস। এন্ড্রু বস্তাটা ধরে বলল,

—–” যান ভেতরে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে আসুন। আমি বস্তাটা ট্যাক্সিতে তুলে দিচ্ছি।

আন্দ্রেসের উত্তরের অপেক্ষা না করেই গেটের দিকে এগিয়ে গেলো এন্ড্রু। আন্দ্রেস একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে গীর্জার দিকে এগিয়ে গেলো। ভেতরে বিশ্রাম কক্ষে ঢুকে দেখল টেবিলে নাস্তা সাজানো।

স্মিত হাসল আন্দ্রেস। এন্ড্রু তার জন্য নাস্তা রেডি করেছে! দেরি করলো না সে, হাত মুখ ধুয়ে কাপড় চেঞ্জ করে কোনোরকমে নাস্তা সেরে নিল। এক্সরসিজম এর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো গীর্জা থেকে।

বাইরে ট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এন্ড্রু। আন্দ্রেস ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে বলল,

—–” অসংখ্য ধন্যবাদ এন্ড্রু। সাবধানে থেকো।

—–” আপনিও সাবধানে থাকবেন বিশপ। আমি এদিকটা সামলে নেবো। আপনি যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসবেন।

মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো আন্দ্রেস। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। সাথেসাথেই গীর্জা এরিয়া পেরিয়ে চলে গেলো ট্যাক্সিটা। এন্ড্রু বুকে ক্রুশ একে বিশপের জন্য প্রার্থনা করল। বেলা গড়িয়েছে। তাকে প্রার্থনার জন্য যেতে হবে।

____________________________
`
`
`
`
`
`
`
অফিসের জানালার ধারে দাড়িয়ে আছে ফ্রেডরিক। একটু আগে লুকাস কিছু রিপোর্টের ফাইল দিয়ে গেছে। কিন্তু সে তাতে বিশেষ কিছু পায়নি। কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে সে।

নীরা, মরিস, সোফিয়া কেউই যে কটেজে থাকতে আসেনি তা স্পষ্ট। তাহলে কুড়াল নিয়ে বেসমেন্টের ভেতর কি করছিলো তারা!? আর সেই গুপ্ত ঘরটা, সেটাও বা কি উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিলো!?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফ্রেডরিক চেয়ারে বসে ফাইল গুলো আবার দেখতে লাগল। ভিক্টিমদের প্রত্যেকেই রেগেন্সবূর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সায়েন্স এর স্টুডেন্ট। এমনকি তারা একই শহরের বাসিন্দা।

হতে পারে ফ্রেন্ডরা মিলে ভ্যাকেশন কাটাতে এসেছিলো। তাহলে কি এটা প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার!? হয়তো দুই মেয়ের মাঝে ছেলেটাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা চলছিলো। পরে নীরা আর মরিস মিলে সোফিয়াকে হত্যা করেছে!?

পরক্ষনেই ভাবল, তাহলে মরিস কোমায় গেলো কিভাবে!? আর সোফিয়া!? তার শরীরে তো আঘাতের কোনো চিহ্নই ছিলো না! ফাইল ঘাটতে ঘাটতে ওরহান উজুন নামটাতে চোখ আঁটকে গেলো ফ্রেডরিকের।

সে ওরহানের ফাইলটা নিয়ে ওল্টাতে লাগল। ফাইল ঘেটে যেটুকু জানতে পারলো তা সংক্ষেপে এমন,

” দানিয়ুব নদীর পাশে একটা নিজস্ব একটা বাড়িতে থাকেন ওরহান উজুন। ব্যবসায়ীক কাজে সে তুরস্ক থেকে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া করে। এর পাশাপাশি ছুটিতে এলে, বাড়িতেই বিভিন্নরকম বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখায় বাচ্চাদের।

এর থেকে বেশি কিছুই জানা যায়নি। এমনকি তার সী সাইডের বাড়িটাতে খোজ নিয়েও তার কোনো খোজ মেলেনি। কোথায় গেছে কেউ জানেনা।ফাইলটা একরকম ছুড়ে মারলো ফ্রেডরিক।

এটা কোনো ইনফরমেশন হল!? লোকটার ব্যাকগ্রাউন্ড কিছুই তো স্পষ্ট লেখা নেই! নাহ, তাকেই গিয়ে একবার খোজ নিতে হবে। ফ্রেডরিক অফিস থেকে বেরিয়ে লুকাসকে বলল,” এদিকের কোনো খবর পেলে আমাকে জানিও। আমি বের হচ্ছি।

বলেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো সে। লুকাস তার পিছুপিছু এসে জিজ্ঞেস করল,” ঠিকাছে, কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন স্যার? লেক এরিয়ায় আজ যাবে না!?

ফ্রেডরিক গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিতে দিতে বলল,” আমি রেগেন্সবূর্গ যাচ্ছি। আজ রাতে নয়তো কাল সকালে ফিরে আসবো।
`
`
`
`
`
`
`
`
`
`
`
________[চলবে]_______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here