#Ragging_To_Loving__2
#পর্বঃ- ৫০
#রিধিরা_নূর
দুপাশে নিস্তব্ধতা। নীরবে কেটে গেল কিছু মূহুর্ত। শীতের রেশ কেটে বসন্তের আগমন হলো। তবুও মৃদুমন্দ বাতাসে হালকা শীত করছে। নূর রাখছি বলে ফোন কেটে দিল। আফরান ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
আফরান — হায়! কবে যে তোমার এই লালিমা মাখা মুখটা স্বচক্ষে দেখে বিমোহিত হব।
.
নূর মুচকি হেসে ফোনের গ্যালারিতে দেখছে বিগত কিছু দিনের ছবি। বিগত এই কয়দিনে আফরানের সঙ্গে মধুর স্মৃতি তৈরি করেছে। সেদিন আসার পথে আনমনে নূর প্রশ্ন করে বসে আফরানকে।
_______________________________
নূর — আচ্ছা আমাদের কি লাভ ম্যারিজ নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারিজ? আমাদের পুচ্চু পুচ্চি যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে কি বলব?
ভাবনা জগৎ থেকে বেরিয়ে আচমকা আফরানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে নিঃশব্দে হাসছে। নূর নিজের মাথায় চাপড় দিল। পরক্ষণে আফরানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে বিজ্ঞদের ন্যায় কিছু ভাবছে।
আফরান — উমম। লাভ্যারেঞ্জ ম্যারিজ।
নূর — এ্যাহহহ! এটা আবার কেমন ম্যারিজ? (হতভম্ব হয়ে)
আফরান — লাভ তো আগে থেকেই ছিল। কিন্তু প্রেম হয়নি অবশ্য। প্রেম বাদেই পারিবারিক ভাবে বিয়ের আয়োজন হয়। তাই লাভ এবং অ্যারেঞ্জ দুটো মিলেই লাভ্যারেঞ্জ।
বলে আফরান হো হো করে হেসে উঠল। কিন্তু দৃষ্টি রাস্তার উপর। এই মূহুর্তে নূরের আশ্চর্যচকিত চেহারাটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু ড্রাইভিং করায় পারছে না। মনে মনে তার চেহারার প্রতিক্রিয়া ভেবে আরেক দফা হাসলো।
নূরের বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। গাড়ি থেকে না নেমেই আফরানকে ডেকে সেলফি তুলল।
নূর — আমাদের প্রথম ডেইটের স্মৃতি।
আফরান — ডেইট? তোমার এটা ডেইট মনে হয়। পাঁচ মিনিটও ভালো করে আলাপ হলো না আমাদের মধ্যে। শুধু খিটখিট করলে৷ আর বাই দ্যা ওয়ে। এর আগেও তুমি আমি একসাথে গিয়েছিলাম।
আফরানের প্রথম কথাগুলো শুনে নূরের রাগ হলেও বিচক্ষণে ভ্রু কুচকে তাকাল।
নূর — একসাথে? কবে?
আফরান ফিক করে হেসে দিল। হাসি যেন থামছেই না। হাসির মাঝে কাঁপাস্বরে বলল,
আফরান — যখন কুত্তার দৌড়ানি খেয়েছিলে।
লজ্জায় নূর আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করল না। দৌড়ে চলে গেল।
আফরান — এই মেয়েটা ভীষণ অদ্ভুত। একেক সময় একেক রূপ। প্রথমে সাহসিকতার রূপ, এরপর ভীতু রূপ, এরপর চঞ্চল রূপ, এখন লজ্জাবতী রূপ। কখন কান্না করে, কখন রাগ করে, কখন হাসে বোঝা মুশকিল। তবুও ভালবাসি এই তার ছিড়াকে৷
_______________________________
আবারও ছবি দেখতে লাগলো। প্রতিটি দিন একেকটা স্মৃতিতে ভরপুর। আফরানের ইচ্ছে ছিল বিয়ের আগ পর্যন্ত এই কয়দিন সে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এর মতো প্রেম করবে। লুকিয়ে দেখা করা, ডেইটে যাওয়া, ঘুরাঘুরি করা। নূর কেন জানি তার কথা ফেলতে পারলো। এই ইচ্ছে গুলো তার মনেও কড়া নাড়লো।
দিন গুলো কাটলো কখনো অভিমান, কখনো খুনসুটি। হঠাৎ চোখের সামনে এলো কফিশপের ছবি। নূরের ঠোঁটের উপর কোল্ড কফির ফেনা লেগে আছে। আরেকটা ছবিতে জিব দিয়ে সেই ফেনা ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। দু’দিনের আগের ঘটনা।
_______________________________
নূর আফরান একটি কফিশপে বসল। আফরানকে দেখে দুজন তরুণী ছুটে এলো। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আফরান বেশ জয়প্রিয়তা অর্জন করেছে। সেই সুবাদে তরুণী দুটি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলো। কিন্তু নূরকে দেখে কেমন এক ভঙ্গিমা প্রকাশ করল। আফরান একান্ত সময় চেয়ে তাদের বিদায় জানালো। মেয়ে দুটি তাদের পার্শ্ববর্তী টেবিলে বসল। কোল্ড কফি মুখে দিতেই নূরের ঠোঁটের উপর ফেনা লেগে যায়। আফরান তা দেখে মুখ টিপে হাসে। কিছু না বলে নূরকে ডাকল। নূর তাকানো মাত্রই টুচুক করে ছবি তুলে নিল। ভেবেছিল নূর হয়তো রাগ করবে। কিন্তু না সে আরও বিচিত্র ভঙ্গিমা করতে লাগলো। আফরান হেসে উঠল।
মেয়ে দুটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূর আফরানের দিকে তাকিয়ে আছে৷ নূরকে পর্যবেক্ষণ করছে। শ্যামবর্ণ, হলুদ রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরিহিত। তাদের মধ্যে একজন নূরকে ব্যঙ্গ করে বিড়বিড় করে বলল,
“বানরের গলায় মুক্তার মালা”। বিড়বিড় করে বললেও পাশে হওয়ায় নূর আফরান দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পায়। আফরান কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই নূর আফরানের শার্টের কলার সরিয়ে দেখে শান্ত গলায় বলল,
নূর — না আপু মালা নেই।
আফরান সহ মেয়ে দুটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। আফরান হতচকিত হয়ে বলল,
আফরান — কি বলছ?
নূর — আপনার গলায় মালা আছে বলছে। কিন্তু কথা হলো তারা জানলো কি করে আপনি একটা বানর। আপনি তো বিলাতি বক।
আফরান চোখ দুটো বড় বড় করে নূরের দিকে তাকাল। পরক্ষণে পিছন ফিরে মেয়ে দুটির দিকে তাকাল। দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়ে দুটি অপমানিত বোধ করছে। তারা চেয়েও জবাবদিহি করতে পারছে না যে তারা আফরানকে নয় নূরকে বলেছে। অপমানে মুখ গুটিয়ে চলে গেল তারা। তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নূর ফিক করে হেসে দিল। আফরান শুধু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত লাগছে নূরের এই হাসি। একেবারে উদ্বেগহীন। নূর কি বুঝতে পারেনি মেয়েগুলো তাকে ছোট করছিল। বুঝতে না পারলেই ভালো। নাহলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। আফরান মুচকি হেসে কফি খাওয়া মনোযোগ দিল।
নূর — জানেন আমাদের কান দুটো কেন?
আফরান উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
আফরান — কেন?
নূর — এক কান দিয়ে শুনে অন্য কানে বের করার জন্য। এই দুই কানের মধ্যবর্তী মস্তিষ্ক আছে। ভালো আদেশ উপদেশ মস্তিষ্কে রেখে বাকি তুচ্ছ কথা বের করে দেওয়া উচিৎ।
আফরান বিষম খেল। অবাক চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু মুখে তার ভাবান্তর দেখাল না। পরক্ষণে আফরান ভ্রু কুচকে তাকাল।
আফরান — তাই বলে ওদের সামনে আমাকে বানর বলে অপমান করলে!
নূর — আপনাকে কোথায় অপমান করলাম? যার অপমান হওয়ার সে অপমানিত হয়ে চলে গিয়েছে। একে বলে কোল্ডএট্যাক অর্থাৎ শীতল আক্রমণ। কিছু না করেই অনেক কিছু করে ফেলেছি।
নূর চোখ টিপি দিল। আফরান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আসলেই মেয়েটা অদ্ভুত। নূর শান্ত গলায় আবারও বলল,
নূর — মেয়েগুলো ভুল বলেনি। আসলেই তো তাই। কোথায় আপনি। দেখতে হ্যান্ডসাম। এখন আপনি একজন নামকরা কণ্ঠশিল্পী। আপনি চাইলে যেকোনো রূপবতী মেয়েকে জীবনসঙ্গী করতে পারতেন। তাহলে আমাকে কেন? আমার গায়ের বর্ণ চাপা। এই যে দেখুন, আপনি সাদা বকের মতো। আর আমি চকোলেট কালার (হাসলো)। তাহলে কেন?
আফরান — হ্যাঁ! আমি যেকোনো রূপবতী মেয়েকে জীবনসঙ্গী করতে পারতাম। কিন্তু আমার মন যে অনেক আগেই এক মায়াবতী কেড়ে নিয়েছিল। ভীষণ মায়া রয়েছে তার মধ্যে। কোমলতা পূর্ণ চেহারা, কৃষ্ণবর্ণের মায়াভরা দুটি চোখ, রণচণ্ডীর ন্যায় খাড়া নাক, কাঁচির মতো ক্যাচক্যাচ করা ঠোঁট। মায়াপূর্ণ এই মায়াবী চেহারার মায়ার বাঁধনে আটকে গিয়েছি। তাই আর মনে হয় নি কোন রূপবতীকে জীবনসঙ্গী করতে। সেই মায়াবতীকে চেয়েছে এই মন।
নূর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিল আফরানের বলা প্রতিটি কথা। আফরান যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে কথাগুলো তা বেশ ভালোই জানে। কিন্তু কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছে না। প্রথমে প্রশংসা করল আবার পরক্ষণে নিন্দা করল। এখন কি লজ্জা পাবে নাকি রাগ দেখাবে বুঝতে পারছে না। শুধু আড়চোখে তাকিয়ে আছে। আফরান বুঝতে পারলো যেকোনো মূহুর্তে খিটখিট শুরু হবে। তাই সাথে সাথে কথার প্রসঙ্গ পালটে নিল। আফরান ব্যস্ত মনে কফিতে চুমুক দিল। নূর মুখ টিপে টিপে হাসছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। কীভাবে এই মানুষটাকে ভাল না বেসে থাকা যায়। অনুভূতি তো মনের গহীনে লুকায়িত ছিল। আফরান আরও আগে তার অনুভূতি প্রকাশ করলে হয়তো নূর আরও আগেই আফরানকে ভালবেসে ফেলত।
_______________________________
বিগত এই দিনে আফরান প্রতিটি মূহুর্তে জানান দিয়েছে সে নূরকে কতটা ভালবাসে। কিন্তু নূর একবারও তার অনুভূতি প্রকাশ করেনি৷ সব অনুভূতি প্রকাশ করা প্রয়োজন নাকি। বুঝে নিতে পারে না? পারে তো। কিন্তু প্রকাশ করতে অনুভূতি গুলো আরও সুন্দর হয়, আরও প্রখর হয়। তাই প্রকাশ করতে দ্বিধা কীসের? তবুও নূর পারছে না প্রকাশ করতে।
নূর বারান্দা থেকে উঠে ভেতরে চলে গেল।
.
.
পরের দিন বেলায় নূরকে হলুদের গোসল করানো হলো। পুষ্প ছাড়া সব বান্ধবীরা নূরের বাসায় উপস্থিত হলো। পুষ্প উদাস হয়ে বসে আছে। একদিকে ভাই অন্যদিকে সখী। ভাইকে ছেড়ে যেতে পারছে না, আর বেস্টফ্রেন্ডের কাছে যেতে না পেরে মনের ভেতর কচকচ করছে।
পুষ্প — ওই বাদঁরি গুলো একসাথে জড়ো হয়ে মজা করছে। আমাকে একা ফেলে।
পুষ্প বিড়বিড় করে হাটছে। আচমকা কারো সাথে ধাক্কা লাগে। তাকিয়ে দেখে আমরিন আহিল দাঁত কেলিয়ে হাসছে। পুষ্প প্রফুল্লিত হয়ে আমরিনকে জড়িয়ে ধরল।
পুষ্প — তুই এখানে?
আমরিন — হ্যাঁ! বাকিরা নূরের বাসায়। আহিল এখানে আসছিল৷ আর তুইও একা। তাই ভাবলাম তোর কাছে চলে আসি।
পুষ্প — একমাত্র তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড। ওই ফকিন্নি গুলারে আমার বিয়েতে দাওয়াত দিব না। আমাদের প্লানিং ছিল। বান্ধবীর মধ্যে যার বিয়েই হবে আমরা একসাথে তাকে সাজাবো। তোর বিয়েতে সবাই একসঙ্গে কত আনন্দ করেছিলাম। তোকে নিজ হাতে সাজিয়ে ছিলাম। নূরকেও সাজাতে ইচ্ছে করছে। ওই ফকিন্নি মাইয়া রে কে বলছিল আমার ভাইয়ের সঙ্গে ইটিস পিটিস করতে৷ এখন আমি কোন পক্ষে যাব?
আমরিন হেসে বলল,
আমরিন — তুইও কিন্তু ওর ভাইয়ের সঙ্গে ইটিস পিটিস করছিস।
পুষ্প হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তার চেহারার ভঙ্গিমা দেখে আহিল সহ হেসে উঠল।
অন্যদিকে নূরও পুষ্প আর আমরিনকে ভীষণ মিস করছে। পার্লি সকালেই এসেছে নূরের বিয়ে উপলক্ষে।
বেশ হৈ-হুল্লোড় করে উভয় পক্ষের হলুদ কার্যক্রম এবং মেহেদী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। তবে কেউ কাউকে মিস করার সুযোগ পায়নি। ইন্টারনেট প্রযুক্তির যুগ। প্রজেক্টরে লাইভ ভিডিও দুই পক্ষের মেহেদী সন্ধ্যার অনুষ্ঠান দেখানো হলো। নূরকে দেখা মাত্রই আফরান পারছে না এক দৌড়ে নূরের কাছে ছুটে আসতে। বুকের বাপাশে হাত রেখে বলল, “হায়! এত ব্যাকুলতা নিয়ে আরও একদিন অপেক্ষা করতে হবে।” লজ্জায় নূর মিইয়ে যাচ্ছে।
.
.
নূরকে বধূরূপে সাজানো হলো। লাল টকটকে বেনারসি পরিহিত। চুল খোপা করে বেলীফুলের মালা গাঁথা। ভারি সাজ এবং অলংকারে পরিপূর্ণ বধূ লাগছে।
আচমকা বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। অচেনা সংশয় বিরাজ করছে মনে। খুব ভয় করছে৷ নূরকে কাঁপতে দেখে পার্লি তার কাঁধে হাত রাখল। নূর পিটপিট করে তাকাল। পার্লি তাকে আশ্বাস দিল।
যেকোনো মূহুর্তে বরযাত্রী উপস্থিত হতে পারে। তন্বী এসে সেই খবর জানিয়ে গেল। মূহুর্তে নূরের হৃদস্পন্দনের গতি দ্বিগুণ বেড়ে গেল। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আনন্দ বেদনার সংমিশ্রণের অনুভূতি। ভালবাসার মানুষটিকে জীবনসঙ্গী রূপে চিরতরে পাওয়ার আনন্দ, আবার আপন মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা। কোন অনুভূতি ব্যক্ত করবে ভেবে পাচ্ছে না নূর৷ নিথর হয়ে বসে আছে।
অপেক্ষার অবসান ঘটলো। হৈচৈ, নেচে গেয়ে জানান দিল বরযাত্রীর উপস্তিতির। সব চিন্তা উপেক্ষা করে আনন্দের অনুভূতিকে সায় দিল নূর৷ জীবনের এতো বড় একদিন বেদনায় নয় আনন্দে উপভোগ করতে চায়। সব কিছু উপেক্ষা করে দৌড়ে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে আফরানকে। কালকের পর তার সঙ্গে কোন কথায় হয়নি। খুব ইচ্ছে করছে আফরানকে দেখার জন্য। নূরকে অস্থির দেখে আলিফা রসিকতা করে বলল,
আলিফা — আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর তোর বর তোর কাছেই আসবে।
নূর লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। আলিফা,সিমা, পার্লি, মেহের গালে হাত দিয়ে নিচু হয়ে বসল। নিষ্পলক নূরের দিকে তাকিয়ে আছে।
সিমা — হোওও! নূর! তুই লজ্জাও পাস?
নূর সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
নূর — কেন? আমাকে কি তোর নির্লজ্জ মনে হয়? আমার কি লজ্জা থাকতে পারে না?
মেহের — আজ পর্যন্ত তোকে লজ্জা পেতে দেখলাম না। হুটহাট মুখের উপর উত্তর দিয়ে দিস। কখনো কোন বিষয় নিয়ে লজ্জা পেতে দেখিনি। তাই আজ একটু অবাক হলাম।
পার্লি — আরে!বুঝতে হবে না। আজ নূর বধূ। আর বধূর সবচেয়ে বড় অলংকার লজ্জা। লজ্জা ছাড়া ফ্যাকাসে লাগে। এখন দেখ একটু নূরের দিকে। লাগছে না পরিপূর্ণ বধূ।
সবাই নূরের দিকে তাকাল। আসলেই অপরূপ লাগছে তাকে।
অবশেষে নূরকে সবার মাঝে নেওয়া হলো। আফরানের তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো নূরকে খুঁজছিল। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। লাল টকটকে বেনারসিতে উপস্থিত হলো তার নূর। আফরানের চোখের সামনে ভাসছে সেই ছোট্ট নূর। লাল শাড়ী মোড়ানো, মুখে মিষ্টি হাসি। তার আনন্দিতা। নূরকে মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করে তৃষ্ণার্ত চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। কিন্তু নূর মাথা তুলে তাকাচ্ছে না। তার দৃষ্টি মাটিতে স্থির। ইশ! একবার যদি সেই মায়াবী চোখে তাকাতো। বড্ড ইচ্ছে করছে দেখতে। কিন্তু নূর তাকাল না।
নূরকে আফরানের পাশে বসানো হলো। আফরান নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। বুকের বাপাশে হাত রেখে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল, “হায়! আমি জ্ঞান হারাবো, মরে যাব। বাঁচাতে পারবে না কেউ।” নূর তাকাল আফরানের দিকে। মায়াবী চোখের ধারালো দৃষ্টি আফরানের বুক চিরে ভেদ করে গেল। শুভদৃষ্টির মিলন হলো। লজ্জায় বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না নূর। কিন্তু আফরান বেহায়ার মতো নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।
ঘন্টা খানেক পর কাজী উপস্থিত হলেন। জনসম্মুখে তাদের কাবিননামা পড়া হলো। নূর আফরান দুজনে একে অপরের জীবনসঙ্গী রূপে কবুল করে নিল।
_______________________________
মধ্যরাত। আফরানের কক্ষে নূর গুটিসুটি মেরে বসে আছে আফরানের অপেক্ষায়। অচেনা সংশয় কাজ করছে মনে। ভীষণ ভয় করছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি তাকিয়ে দেখে আফরান। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর মতো আওয়াজ হচ্ছে৷ চিরচেনা আফরানকে হঠাৎই অচেনা মনে হচ্ছে। আফরান পাশে বসতেই নূর পা গুটিয়ে নিল। আফরান শান্ত গলায় বলল,
আফরান — যাও, ফেশ হয়ে আস।
নূর মাথা তুলে অবাক হয়ে তাকাল। আফরান মুচকি হাসলো।
আফরান — জানি তুমি আগে কখনো এতো সাজগোছ কর নি। অস্বস্তি লাগছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আস।
নূর আফরানের চোখে এক প্রকার উদ্রেক দেখতে পেল। যেন অধীর আগ্রহে কিছু বলতে চাই৷ তাই উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলো৷ এসে দেখে আফরান জামা পালটে সাদা পাঞ্জাবি পরল। নূরও আসমানী রঙের জামা পরিধান করল। এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল ভারী বোঝা নিয়ে বসেছিল। এক পলক আফরানের দিকে তাকাল। বিনিময়ে একটি মিষ্টি হাসি উপহার পেল। সেও মিষ্টি হাসি দিল। আফরান নূরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
আফরান — যাবে?
নূর — কোথায়?
আফরান — আমার পৃথিবীতে।
নূর — স্যরি। আমি উগান্ডা যেতে চাই না। (ভাব নিয়ে)
বেলুনের হাওয়া বের হয়ে যাওয়ার মতো আফরানের মুখটা চুপসে গেল। চোখ দুটো সরু করে নূরের দিকে তাকাল। আফরানের চেহারার ভঙ্গিমা দেখে নূর নিজের হাসি আটকাতে পারলো না। খিলখিল করে হেসে উঠল। আফরানের হাত আঁকড়ে ধরল। আফরান হেসে নূরকে নিয়ে এগিয়ে গেল বারান্দায়।
আকাশে তারার মেলা। তার মাঝে উজ্জ্বল অর্ধ চাঁদ। অর্ধ চাঁদটাও যেন আজ পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাসে অন্যরকম ফুরতি। নূরকে মুখোমুখি দাঁড় করালো। নূর উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফরানের দিকে। আফরান আলতো করে একটি ওড়না নূরের মাথার উপর টানিয়ে দিল। নূর কপাল কুচকে তাকাল। ওড়নাটি দেখছে। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না।
আফরান — কি গো পুচ্চু পুচ্চির আম্মা। ভুলে গেলে তোমার পুচ্চু পুচ্চিকে। এই সেই তোমার পুচ্চু পুচ্চি যাকে কোলে পিঠে মানুষ থুক্কু ওড়না থেকে শাড়ি করার দায়িত্ব দিয়েছিলে।
আফরান ভ্রু নাচালো। সেই প্রথম দিনের আলাপের ঘটনা মনে পড়তেই নূর অবাক হয়ে তাকাল।
নূর — এটা তো সেই ওড়না। এতো বছর ধরে আপনি এটা রেখেছিলেন? এখনো সেই আগের মতো রয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে একেবারে নতুন।
আফরান — জানি না কেন তবে এই ওড়না খুব যত্ন করে রেখেছিলাম। হয়তো আজ তোমায় পরিয়ে দিব বলে।
নূরের চোখ দুটো ছলছল করছে৷ আফরানের কথার মাঝে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
নূর — ভালবাসি আপনাকে। ভীষণ ভালবাসি।
আফরান স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। এটার অপেক্ষায় তো ছিল। কবে নূর এই অব্যক্ত অনুভূতি ব্যক্ত করবে। আফরানের স্পর্শে নূরের সর্বাঙ্গে শিহরণ হতো। কিন্তু আজ এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করছে। সে যেন আজীবন এই বুকে ঠাই হয়ে থাকতে চাই। পারছে না বুক চিরে ভেতরে ঢুকে যেতে। আফরান তার বুকে শীতল অনুভব করল। নূরের অশ্রু জলে ভিজে গিয়েছে। বাহুডোরে আলিঙ্গন করে নিল নূরকে।
আফরান — আমিও ভালবাসি আমার আনন্দিতাকে। ভীষণ ভালবাসি।
.
.
.
(সমাপ্ত)
.
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই যাত্রায় এতটুকু পথ সাথে থাকার জন্য, এতো ভালবাসা দেওয়ার জন্য, এতো সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সকলের জন্য অবিরাম ভালবাসা রইলো। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। দোয়া কামনা করি। আল্লাহ হাফেজ। 🖤