প্রণয়ের_দহন
পর্ব_১৩
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
কথাটা বলেই উনি কল কেটে দিলেন। আমি জানি উনি কেনো ভিডিও কল দিতে বলছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লাসে ঢুকলাম। একা একাই ক্লাস করলাম। আমার একটা ফ্রেন্ডও আসেনি। সবগুলোই বদের দল। সুযোগ পেলেই ক্লাস ফাঁকি দেয়। ক্লাস শেষ যখন ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন একটা পরিচিত কন্ঠসর শুনে থেমে যায়।
এটা আমার বহু পরিচিত কন্ঠ। এক সময় এই কন্ঠটা শোনার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতাম। শত মন খারাপ থাকলেও এই কন্ঠটা শুনলে মন ভালো হয়ে যেতো। এখন এই কন্ঠটা শুনলে শুধু ঘৃণা হয় ঘৃণা। নিহান আমার অনেকটা কাছে চলে আসছে।
আমি হাঁটা দিলাম দাঁড়ালাম না। নিহান আমাকে ডাকছে। কিন্তু আমি সাড়া দিলাম না। হাটার স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। একসময় নিহানের সাথে না পেরে এক মতো দৌড়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে এলাম। আংকেল আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠে পড়লাম। নিহান আমাকে দাঁড়াতে বলছে। গাড়িতে ওঠতে বারণ করছে। আমি নিহানের কথা না শুনেই আংকেলকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললাম।
আমি নিহান নামক লোকটার মুখ দেখতে চাই না। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। আমি একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালাম না। দাদুর কাছে শুনেছিলাম পিছন ফিরে তাকালেই মায়া বাড়ে। মায়া বড্ড খারাপ জিনিস। কাউকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য মায়া জিনিসটাই যথেষ্ট।
কিছুক্ষণের মাঝেই বাসার সামনে গাড়ি থামল। আমিও গাড়ি থেকে নেমে বাসার ভিতর ঢুকে পড়লাম। কলিংবেল বাঁজাতেই আনহা এসে দরজা খুলে দিল। আনহা আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। বিনিময়ে আমিও আলতো হাসলাম। তারপর আনহাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। আনহা দরজা লাগিয়ে দিল।
আমি তাড়াতাড়ি রুমে চলে এলাম। নাহলে এখনি আনহা ভার্সিটিতে কী কী হয়েছে? এসব শোনার জন্য আমাকে পাগল করে দিতো। আমার এখন একদম গল্প করার ইচ্ছা নাই। নিহান মুড নষ্ট করে দিয়েছে। ব্যাগটা রেখে বোরকা খুলে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। শাওয়ার নিতে হবে প্রচুর গরম লাগছে। শাওয়ার নিলে মনটাও ফুরফুরে হয়ে যাবে।
প্রায় ৪০ মিনিট শাওয়ার নিলাম। ভেঁজা জামা কাপড়গুলো নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। কাপড়গুলো রোদে শুকাতে দিয়ে আবার ফ্ল্যাটে এলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে ফ্ল্যাটের দরজাটা হা করে খোলা। আমার স্পষ্ট মনে আছে যাওয়ার সময় আনহাকে বলে গিয়েছিলাম দরজাটা লাগিয়ে দিতে। কিন্তু এই বজ্জাত মেয়ে লাগায়নি। এক মিনিট আমি তো দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ছাদে গিয়েছিলাম। ফ্ল্যাটে আবার চুর টুর ঢুকেনি তো।
আমি তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। যাতে চুর বাইরে না যেতে পারে। ড্রয়িংরুমের প্রতি কোণা ভালো করে খোঁজলাম কাউকে পেলাম না। কিচেনটাও খোঁজে দেখলাম। তারপর প্রতিটা রুম চেইক করলাম। কিন্তু চুর খোঁজে পেলাম না। হুট করেই মনে পড়ল আমি সবার রুম চেইক করলেও নিজের রুমটায় চেইক করি নাই।
দৌড়ে রুমে গেলাম। রুমে গিয়ে বুঝলাম রুমে চুর না আসলেও টর্নেডো এসেছিল। আরিয়ানের বিছানার ওপর মাথা নিচু করে বসে আছেন। দুই হাত দিয়ে চুল ধরে টানছেন। আরিয়ানকে এই সময় বাসায় দেখে আমি কিঞ্চিত অবাক হয়েছি। উনি এতো তাড়াতাড়ি আজকে হসপিটাল থেকে চলে এলেন। এভাবে দুই হাতে দিয়ে চুল ধরে টানছেন কেনো? মাথা ব্যথা করছে? কিন্তু মাথা ব্যথা করলে রুমের জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছেন কেনো?
কী হয়েছে? উনি কী রেগে আছেন? কিন্তু কার ওপর? আমার ওপর? কিন্তু আমি তো রাগ করার মতো কিছু করিনি আজকে। উনার কথা অনুযায়ী ভার্সিটিতে বোরকা পড়ে গিয়েছি। উনাকে কী জিঙ্গেস করবো? হঠাৎ উনি আমার দিকে তাকালেন। উনার চোখ দেখে আমি ভয়ে আতকে ওঠলাম।
উনি যে ভীষণ রেগে আছেন সেটা উনার চোখই বলে দিচ্ছে। এখানে থাকা মানেই নিজের বিপদ। তাই এখন এখান থেকে চলে যাওয়ায় মঙ্গল। যতক্ষণ নাহ উনার রাগ কমছে ততক্ষণ উনার আশেপাশে আসা যাবে না। নাহলে সব রাগ আমার ওপর ঝাড়বেন।
উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি উল্টো ঘুরে দৌড় দিতে যাব। তখনি উনি আমার হাত চেপে ধরেন। টান দিয়ে আমাকে দরজার সাথে চেপে ধরেন। আমি ভয়ে সিটিয়ে আছি। জানি এখন আমার ওপর দিয়ে সুনামি যাবে। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
পুরোনো প্রেম জেগে ওঠছে তাই না?
মানে?
মানে বুঝতে পারছিস না? বুঝবি কী করে? এখন তো তোর দুনিয়ার কোনো কিছুই বোধগম্য হবে না। তোর লাইফে আবার তোর প্রাক্তন প্রেমিক ফিরে আসছে। তোর মস্তিষ্ক জুড়ে তো শুধুই নিহান অন্য কিছু অর্থ তো তোর মাথায় ঢুকবে না।
আপনি এসব কী আঁজে বাঁজে কথা বলছেন?
আমি আঁজে বাজে কথা বলছি না তুই আঁজে বাঁজে কাজ করছিস। ভার্সিটির নাম করে গিয়ে প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে রঙলীলা করছিস।
আপনি এখন রেগে আছেন। আপনার মাথার ঠিক নাই। কী বলছেন আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন নাহ।
আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আমি তোকে ভার্সিটিতে পড়তে পাঠিয়েছিলাম নিহানের সাথে প্রেম করতে না।
এখন আমি একদম শিউর আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনি ভাবলেন কী করে এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও আমি নিহানের সাথে প্রেম করবো। আমি তো এখন ওর মুখটা পর্যন্ত দেখতে চাই না প্রেম তো অনেক দূরের কথা।
কেনো আমার সাথে এতো নাটক করছিস? আমি তোর এসব নাটক আর সহ্য করতে পারছি না। প্রথমে ভালোবাসার নাটক করলি আর এখন নিজেকে আমার কাছে ভালো প্রমাণ করতে চাইছিস। তুই একদিন বলেছিলি আমি এক্টিং করলে অল্প দিনেই বেশ খ্যাতি অর্জন করতে পারতাম। আমার মনে হয় আমি না তুই পারতি। এতো সুন্দর এক্টিং করার জন্য নোবেল দেওয়া উচিত তোকে।
দেখুন আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।
ভুল বুঝছি না। বল না আমার ভালোবাসার মাঝে কী কমতি ছিল? তুই নিহানের এতো ভুল ক্ষমা করে দিয়ে তার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে দিলি। সব অপমান ভুলে গেলি। আমার কি দোষ ছিল। তোকে ভালোবাসাটা কী আমার দোষ? তুই কেনো আমার ফিলিংস নিয়ে এভাবে খেললি? আমার তো একটা মন আছে বল। কেনো সেই মনটা বার বার ভেঙে দিচ্ছিস? যেদিন শুনেছিলাম নিহানের সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেদিন আমার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। তবু নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। তারপর তুই আবার আমার জীবনে এলি। তোর ভালোবাসা দিয়ে আবার আমার ভাঙা মনটা জুড়া লাগালি। কিন্তু আবার তুই আমার মনটা ভেঙে দিলি।
এখন সত্যিই আফসোস হচ্ছে কেনো যে তোর সাথে আমার দেখা হলো। এখনো মনে পড়ে সেদিনের কথা যেদিন তোর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। তোর সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন তুই কাঁদা মেখে ভূত হয়েছিলি। তখন তুই নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। তোর বয়স ছিল তখন মাত্র ৭ বছর। তোর কাঁদা মাখা বাচ্চা বাচ্চা ফেইস দেখে তখনি আমার তোকে ভালো লেগে যায়। তোকে দেখে ইচ্ছে করছিল গাল দুটো টেনে দেই। তুই তখন আন্টির হাতের মার খেয়ে মাটিতে বসে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদছিল। তোর সাথে কারণে অকারণে ঝগড়া করি। সব সময় তোর আশেপাশে থাকতে চাইতাম। আস্তে আস্তে ভালো লাগাটা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। হঠাৎ একটা ঝড় এসে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিল। কারণে অকারণে তোর সাথে ঝগড়া তোদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। তুইও বড় হতে থাকিস আমিও বড় হতে থাকি। আমিও বুঝতে পারি এটা আমার শুধু ভালো লাগা না ভালোবাসা। কিন্তু ততোদিনে তোর সাথে আমার দূরত্ব বেড়ে যায়। তুই অন্য কারো প্রেমে পড়ে যাস। যেদিন শুনেছিলাম তুই নিহানকে বিয়ে করার জন্য জেদ ধরেছিস। আর আংকেল রাজি হয়ে গেছে। সেদিন আমি সারা রাত কান্না করি। ছেলেদের কাঁদতে নেই। কিন্তু প্রিয়জন হারিয়ে ছেলেরাও কাঁদে আমিও কেঁদেছিলাম চার দেওয়ালে বন্দি রুমের মাঝে। আমি সবার মতো নিজের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না। তাই হয়তো তুই আমার ভালোবাসাটা বুঝলি না। একদিন তুই ঠিকই আমার ভালোবাসাটা বুঝবি। কিন্তু সেদিন তুই আমাকে খোঁজে পাবি না। সেদিন হারিয়ে যাব তোর শহর থেকে অনেক দুরে।
কথাগুলো বলে আরিয়ান রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমি দরজা ঘেষে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ি ফ্লোরে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। কানের কাছে বার বার বাঁজছে আরিয়ানের বলা শেষ কথাগুলো। একদিন তুই ঠিকই আমার ভালোবাসাটা বুঝবি। কিন্তু সেদিন তুই আমাকে খোঁজে পাবি না। সেদিন হারিয়ে যাব তোর শহর থেকে অনেক দুরে।
চলবে……..
( গল্প দেরি করে দেওয়ার জন্য আই’ম রিয়েলি সরি। এ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন ক্লাস আর এক্সাম প্রিপারেশন সব মিলিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। গল্প লেখার সময়ই পাচ্ছি না। আপনারা এ্যাসাইনমেন্ট লিখে ৫ মিনিট সময় বের করতে পারেন না গল্প পড়ার জন্য। এতকিছু সামাল দিয়ে দুই-তিন ঘন্টা ব্যয় করে গল্প লেখাটা আমার জন্য কতটা কঠিন বিষয়। আশা করি আপনারা বুঝতে পারবেন। গল্পটা কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং।)