বেখেয়ালি মনে পর্ব-২২

0
608

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-২২
.
.
কারো হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙে ইনানের। চোখ মেলে রাবেয়া হককে দেখতে পায় সে। মাকে দেখেই শোয়া থেকে উঠে আধশোয়া হয়ে বসে। চোখ ফুলে আছে ওর।

তা দেখে রাবেয়া হক জিজ্ঞেস করে,
– কাল রাতেও ঘুমাস নি, না?
মায়ের কথায় মৃদু হাসে ইনান। বলে,
– এর কারণ তো তোমার অজানা নয় মা। আর এখন তো তাকে সবসময় চোখের সামনে দেখতে হয়। যা একদম আমার সহ্য হয় না।

ইনানের কথার জবাব দিতে রাবেয়া হক বলে,
– প্রিয়ার ঢাকায় কাজ ছিলো তাই আসতে চেয়েছে। আর আমিও মুখের উপর বারণ করতে পারিনি।
– কিন্তু মা! ওর তো ঢাকায় আরো রিলেটিভ আছে।
– হ্যাঁ আছে, কিন্তু এখন ওরা দেশের বাহিরে। ঢাকায় থাকলে তো প্রিয়া এখানে আসতো না।

রাবেয়া হকের কথা শুনে ইনান হেসে ফেলে। তাচ্ছিল্য সুরে বলে,
– প্রিয়া একথা বললো, আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে? আসলেই মা তুমি বড্ড ভালো, সহজ-সরল মনের একজন মানুষ। তাই এসব তুমি বুঝবে না। ওর উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার কাছে ফিরে আসা। তাই নানারকম বাহানা দিয়ে এখন সে আমার কাছে ফিরতে চাচ্ছে।

– ফিরে আসতে চাচ্ছে তাহলে তো ভালো কথা। তুই ও তো ওকে পছন্দ করতি, তাহলে এখন সমস্যাটা কোথায়?

রাবেয়া হকের কথায় ইনান রেগে গিয়ে বলে,
– আমি পছন্দ করতাম, কিন্তু এখন তো আর করিনা। আর এখন আমি ঘৃণা করি। প্লিজ মা এসব কথা আর আমার সামনে বলবেনা। আর পারলে তাড়াতাড়ি বিদায় করো ওকে এখান থেকে।

রাবেয়া হক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– কিন্তু আর কতোকাল তুই এভাবে থাকবি? এবার তো একটা বিয়ে কর। বড় হয়েছিস তো।

– মা! এসব কথা বাদ দেবে? তুমি জানো না, আমি বিয়ে করছি না কেন? তুমি ভুলে গেছো তোমার ছেলের অতীত?
ধমকের সুরে কথাটা বলল ইনান।

রাবেয়া হক শীতল গলায় বলে,
– শান্ত হ। এবার আর তোর অতীত তোর জীবনে কাল হয়ে আসবেনা। তুই যাকেই পছন্দ করবি তাকে সবার আগে তোর অতীতটা জানিয়ে দিবি। দেখবি সে নিজেই এই সমস্যা টা দূর করে ফেলবে। গতবার প্রিয়ার ফ্যামিলির কাছে অতীতটা লুকিয়ে আমরা যে ভুল করেছি এবার আর তা করবো না।
আর আমি এক্ষুনি তোকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছি না। তোর যখন মনে হবে তুই বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কটায় জড়াতে পারবি, তখন-ই আমরা তোর বিয়ের কথা ভাববো।

কথাগুলো বলেই রাবেয়া হক ইনানের রুম থেকে প্রস্থান করেন।

সকাল সকাল বিয়ের কথা শুনে ইনানের মেজাজ বিগড়ে যায়। বেডের উপর থেকে একটা বালিশ ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে শাওয়ার নিতে চলে যায় সে।

__________________________________________________________

টিফিন পিরিয়ডে ত্রয়ী বসে আছে জেসিয়ার পাশে। মনে তার আকাশ পরিমাণ বিষন্নতা। আর কতদিন সময় লাগবে উনাকে নিজের করে পেতে?
এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে ত্রয়ীর হৃদয় মন্দিরে।

ত্রয়ীর নীরবতা দেখে জেসিয়া বলে,
– খুব বেশি-ই ভালোবেসে ফেলেছিস তাকে তাই না?
আনমনে জবাব দেয় সে,
– হুম অসহ্যরকম!

দুষ্টুমির ছলে জেসিয়া বলে,
– এই জন্যই তো এমন দেবদাস হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন। মনের কথাটা তাকে বলে দিলেই পারিস।

– ভয় হয় যদি হারিয়ে ফেলি। যদি ভালোবাসার কথা শুনে উনি আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যায়। তখন তো চোখের দেখাটাও দেখতে পারবোনা তাকে।
উদাস মনে কথাখানি বলল ত্রয়ী। কন্ঠে ভয়।

জেসিয়া দাঁত কটকট করে বলে,
– বলিস না তুই, যখন অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে, তখন সারাজীবনের জন্য দেবদাস হয়ে যাবি। এটাই তো চাচ্ছিস তুই, তাই না?
– জেসি,প্লিজ। এমন বলিস না।
– তো কি বলবো আমি? শোন্, তুই আজকে গিয়েই ইনানকে তোর মনের কথা বলবি। ঠিক আছে?
– আমি পারবো না রে।
– ওকে ফাইন, তাহলে এমন ভাবেই থাক সারাজীবন।
একথা বলেই রেগেমেগে সেখান থেকে উঠে যায় জেসিয়া। ত্রয়ী ডাকলেও আর থেমে দাঁড়ায় না।

জেসিয়ার মুখে দেবদাস কথাটা শুনে ত্রয়ীর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবদাস” উপন্যাসের দু’টো লাইন মনে পড়ে,

“দেবদাস নিজের পাতলা জামার খানিকটা ছিঁড়িয়া লইয়া, জলে ভিজাইয়া পার্বতীর কপালের উপর বাঁধিতে বাঁধিতে কহিল, ভয় কি পারু! এ আঘাত শীঘ্র সেরে যাবে- শুধু দাগ থাকবে।’’

মনে মনে ভাবে সে,
-ইশ! উনিও যদি আমার একটু আঘাতে এমন করে বলতেন। উনাকে পাওয়ার ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষায় হৃদয়ে যে এক অনন্য প্রকারের ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে, সেটাও তো বোঝেন না। এ আঘাতের যে দাগও অদৃশ্য। ভালোবেসে উপলব্ধি করে কি সেটা সারানো যায় না?
.
স্কুল ছুটির পর বাসায় না গিয়ে পাশের পার্কে গিয়ে বসে ত্রয়ী। আজ হয় এসপার না হয় ওসপার করেই ছাড়বে। আর দেরি করলে যদি সত্যি সত্যি ইনান অন্য কারো হয়ে যায় এই ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার।

হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়ে বসা থেকে। দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে বাসায় আসে। স্কুল ব্যাগ রেখে তাড়াহুড়ো করে ইনানের বাসায় যায়। কলিং বেল বাজাতেই রাবেয়া হক দরজা খুলে দেন।

ত্রয়ী কাচুমাচু হয়ে বলে,
– আন্টি, ইনান ভাইয়া বাসায় নেই?
রাবেয়া হক শুকনো কন্ঠে জবাব দেয়,
– সেই সকালে বের হয়েছে এখনো বাসায় ফেরেনি ছেলেটা।

রাবেয়া হকের কথাশুনে নিরাশ হয় ত্রয়ী। মন কুঠুরির দুয়ারটা ধপাস করে বন্ধ হয়ে যায়। ইনানের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে সে।

___________________________________________________________

সন্ধ্যায় ছাদে আসে ত্রয়ী। বিকেল থেকে হাজার বারের মতো মেইন গেইটের দিকে উঁকি দিয়েছে ইনানের জন্য। কিন্তু ইনানের কোনো হদিস পায়নি। ছাদে এসে দোলনায় বসে আকাশ দেখায় মগ্ন হয় সে। বেখেয়ালি মন বলছে, ইনান আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ছাদে আসবে।

হলোও তাই।
ত্রয়ী ছাদে আসার মিনিট পনেরো পর ইনান ছাদে আসে। ত্রয়ীকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
– আজ এ সময়ে ছাদে যে? প্রাইভেট নেই?

ত্রয়ীর কথা আটকে আসছে। বুকের ভেতর কেমন অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে। তাই সে নিশ্চুপ হয়ে আছে। ইনান আর কথা বাড়ায় না। ছাদের অন্যপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়।

মিনিট পাঁচেক পরে ত্রয়ী নীরবতা ভেঙে বলে,
– আজ প্রাইভেট নেই।
ত্রয়ীর কথা শুনে ইনান বলে,
– কাল ড্রিংক কেন করেছিলে?
– ড্রিংক?
কন্ঠে তার বিস্ময়।

– হ্যাঁ! কাল তিশান ভাইয়ার এনগেজমেন্ট পার্টিতে ড্রিংক করেছিলে। কিন্তু কেন? তোমার কাছে অন্তত আমি এটা আশা করি নি।

ত্রয়ী অবাক হয়ে যায় এমন কথায়। কখন সে ড্রিংক করলো তার মনে পড়ছে না। এনগেজমেন্ট পার্টিতে তো সে জুস খেয়ে ছিলো। তাহলে জুসে কি কিছু মেশানো ছিলো?

হঠাৎ ত্রয়ীর মনে পড়ে জুস খাওয়ার সময় ঝুমার সাথে সে কথা বলছিলো। হয়তো তখন বেখেয়ালে জুস না নিয়ে ড্রিংক নিয়েছিলো।

ত্রয়ী বলে,
– আসলে আমার কালকের কোনো কিছুই মনে পড়ছেনা। ড্রিংক করেছি এটাও মনে পড়ছেনা। শুধু মনে আছে, আমি কাল এক গ্লাস জুস খেয়েছিলাম।
ইনান ছোটো করে জবাব দেয়,
– ওহ, আচ্ছা!

ত্রয়ী আর কিছু বলতে পারছে না। এসেছিলো আজ মনের সব কথা বলবে। অথচ এমন একটা কান্ড সে কাল বাধিয়েছে, যার জন্য এখন লজ্জায় ইনানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা সে। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেছে। গলায় একদলা কথা এসেও আটকে আছে।

আপন মনে নিজেকে ধমক দিয়ে বলে সে,
– ইশ! ত্রয়ী তুই আর কোনোদিন মানুষ হবিনা। কখন কী করতে হয় তা আজ অবধি শিখে উঠতে পারলি না। কী দরকার ছিলো কাল জুস খাওয়ার? জুস তো খাস-ই নি, বরং বাজে একটা কান্ড ঘটিয়ে এসেছিস।
ধ্যাৎ, তোর বোকামির জন্য আজ এমন এক রোমান্টিক মুহুর্ত আসতে গিয়েও আবার হারিয়ে গেলো।
নিজেকে হাজারটা গালমন্দ করতে করতে ত্রয়ী ছাদ থেকে নেমে আসে।

ইনানের এমনিতেও মন ভালো নেই। তাই সেও আর কোনো কথা বাড়ায় না। রাতের অন্ধকারের সাথে নিজের জীবনের অন্ধকার গুলো মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

__________________________________________________________

রুমে এসে অনবরত পায়চারি করছে ত্রয়ী। হিমা এসে দরজায় লক করতেই ত্রয়ী দরজা খুলে দিয়ে আবার পায়চারি করতে থাকে।

ত্রয়ীকে এমন অবস্থায় দেখে হিমা জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে রে ত্রয়ী?
ত্রয়ী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
– আমি আসলেই বোকা, জানো তো হিমাপ্পা?
হিমা ত্রয়ীর কথা কিছুই বুঝতে পারছেনা।
– হঠাৎ এমন কথা বলছিস কেন? কী বোকামি করেছিস?

ত্রয়ী গম্ভীরমুখে বলে,
– তুমি জানো কাল আমি…
– কাল তুই কী?
– এক মিনিট, এক মিনিট, আচ্ছা হিমাপ্পা কাল ভাইয়ের এনগেজমেন্ট পার্টিতে কি হয়েছিলো?
হিমা অবাক হয়ে বলে,
– কী হবে?

ত্রয়ী ওর নখ কামড়াতে কামড়াতে বলে,
– কিচ্ছু হয়নি? সব ঠিক ছিলো?
হিমা কিছুক্ষন ভেবে বলল,
– ওহ,হ্যাঁ! মনে পড়েছে কাল তুই একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি। তাই নিশান ভাইয়া, ইনান আর ইফতিহা তোকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলো।

ত্রয়ী বিড়বিড় করে আওড়ায়,
– ওহ, তারমানে বাকিরা কেউ আমার কুকীর্তির কথা জানে নি? আল্লাহ মালুম।

হিমা ত্রয়ীর হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
– কিরে কী বিড়বিড় করছিস?
ত্রয়ী বোকার মতো হাসি দিয়ে বলে,
– নাহ কিচ্ছু বিড়বিড় করছি না তো।

একথা বলেই হিমার গালে একটা চুমু দিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। হিমা ত্রয়ীর এহেন কান্ডে বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here