#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৩)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৫৭.
সিন্ধু ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে রোগা পাতলা সেই ছোকড়ার দিকে। তার নামটা হলো মুন্না। জমিদার এর বাগান বাড়িতে কাজ করে। ওই বদমাইশ এর সঙ্গী সাথী। বেশ কিছুদিন হলো বদমাইশ এবং তার এই সঙ্গীকে সে দেখেনি। আজ হঠাৎ কোথেকে এর উদয় হলো? সিন্ধু বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাতে তার ছোটর মধ্যে মাঝারি আকারের একটি পাথর। মুন্না একটু ঘাবড়ে গেল। এই বুঝি তাকে আক্রমণ করবে! তবে না। তেমন কিছু হয়নি। সিন্ধু বলল,
-‘তুই আমার কাছে আসলি ক্যান!’
-‘তোমার কাছে যাচ্ছিনে। আমি এখান দিয়ে হাঁটছিলুম। মাঝে তোমার দেখা। ভেবো না তোমার পিছু করি।’
-‘আমি ভেবেই নিয়েছি। তা এত্তদিন কই ছিলি? তুই না আমারে কত হুমকি ধামকি দিলি, তয় পরে তো কিচ্ছু করলিনা। ডরাইছস নাকি?’
-‘আমার তো আর কাম নাই। তোমারে ডরামু? তা শোনো! জমিদার বাবু তোমারে সেদিন ধইরা নিছিলো কী জন্যে! অপরাধ করছিলা নিশ্চয়ই বড় রকমের!’
-‘ওই! আমারে আবার কবে জমিদার ধইরা নিয়া গেছে!’
-‘ওমা! মনে নাই বুজি? এইডা মনে আছে যে আমি তোমরা ধমকা ধমকি করছি কিন্তু কেন করছি তা মনে নাই? মশকরা করতেছ নাকি?’
-‘সেদিন তো আমারে ওই বদমাইশ নিয়ে গেছিল। জমিদার তো না।’
-‘কারে বদমাইশ কও? তুমি জানো উনি কে?’
-‘কোন রাজা-বাদশাহ বল তো শুনি।’
-‘আজ্ঞে রাজা-বাদশাহ্ নয় তবে জমিদার। উনি হইলো গিয়া জমিদার শাহনেওয়াজ সরকার।’
সিন্ধু স্তব্ধ হয়ে গেল। এ সে কী শুনছে? সেই লোকটা জমিদার? ওমন একটা মানুষ জমিদার? সে জানতো জমিদার কত উদার, চরিত্র ভালো। তবে সে যারে চিনে সে তো মোটেও ভালো নয়। তবে কী এতদিন সে জমিদার সম্পর্কে যা শুনছে তা ভুল? নাকি এই ছোকরা মিথ্যা বলছে। আলবৎ মিথ্যেই বলছে।
-‘মিছা কথা কওনের আর জায়গা পাও না? ওয় জমিদার?’
-‘তা নয়তো কী? জমিদারই তো। বিশ্বাস হয়না বুজি? আচ্ছা। আগামীকাল মোড়লদের বাড়িতে সভা বসবে। বিচার সভা। সেখানে জমিদার আসবে। তখন গিয়ে দেখি নিও।’
-‘মোড়লের বিচারে জমিদার আসবে ক্যান?’
-‘সে অনেক কথা। তুমি গিয়ে দেইখে আইসো। এহন আমি গেলাম। মেলা কাম পড়ে আছে।’
মুন্না চলে গেল। সিন্ধু তখনও সেখানে ঠাই দাঁড়িয়ে। সত্যিই কে সে জমিদার শাহনেওয়াজ ছিল? সত্যিই!
৫৮.
প্রভাতের রাঙা আলোয় গ্রামবাসী ছুটে চলছে নিজ নিজ গন্তব্যে। চাষীরা সেই কোন ভোরে জমিতে চাষ করতে চলে আসে বোঝাও দায়। তবে এই শীতের সকালে সূর্যটা সবদিকে সমান দেখা যায় না। যেমন কোথাও মনে হয় সূর্যের আলো তীর্যক তো কোথাও নেই বললেই চলে। এমনিতে এই কুয়াশা কাটিয়ে পথ পার করতে আসলেই অন্যরকম মজা আছে। সিন্ধু তার চাচাতো বোনকে নিয়ে মোড়লদের বাড়িতে যাচ্ছে। অনেকখানি পথ। যেতে সময় লাগবে। তাই আগে ভাগেই রওনা হলো। দু পয়সা খরচ করে গরুর গাড়ি দিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। হেঁটে চলাচলই তার জন্য মোক্ষম। তবে তার চাচাতো বোন নয়নের কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা এত বড় পথ হেঁটে যেতে নারাজ। সিন্ধুর জোরাজুরিতেই যাচ্ছে। রতন ময়রার দোকানের মিঠাই খাওয়ার লোভ তাকে ভালোই ধরেছে। সিন্ধু সারারাত ঘুমোতে পারেনি। সে অধীর আগ্রহে আজকের দিনের সূচনার জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশেষে যখন দিনের শুরু হলো সে রীতিমত হাবিজাবি চিন্তায় অস্থির। কী হবে কে জানে!
-‘আর কত পথ আপা?’
-‘এইতো আর একটু সবুর কর। চলেই এলাম বলে।’
-‘সেই কখন থেকেই তো এক কথা বলে চলেছ। এলাম বলে! এলাম বলে!’
-‘বেশি বকলে মিঠাই পাবি না কিন্তু। তাই চুপ থাক।’
-‘পামু না ক্যান? এত পথ যে এলাম তার জন্যে কিছুটা তো দিবা নাকি!’
-‘আরো পথ চল। সত্যিই দিব। আয় জলদি পা চালা।’
মোড়লের বাড়িতে এসে সিন্ধু দেখে মোটামুটি একশর বেশি মানুষ আছে। কোন বিষয়ে বিচার সভা? নিশ্চয়ই বড় ব্যাপার। নয় এত মানুষ কিংবা জমিদারের আসার কথা না। মহিলাদের এক পাশে গিয়ে সে দাঁড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে হঠাৎ করেই একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে উপস্থিত হয় উঠোনে। সবাই সরে দাঁড়ায়। কিছু ভৃত্য এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খোলে। ভেতর থেকে নেমে আসে এক সুপুরষ। সবাই জয় জয়কার করছে। সে যে জমিদার তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সিন্ধু একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় সেই বদমাইশ লোককে নিয়েই এত হৈচৈ। সে বুঝলো এ সত্যিকারেরই জমিদার। তার এতদিনের চিন্তা চেতনা বাজে ভাবে আ’ঘা’ত প্রাপ্ত হলো।
#চলবে।