জোনাকিরা ভীড় করেছে পর্ব ১১

0
841

#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-১১
#সিফাতী সাদিকা সিতু

মোমেনা বেগমের ঘরে পর পর দুবার যেন বজ্রপাত হলো।তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার অগোচরে এতকিছু ঘটে গেছে।নিজের ছেলেটাও না জানিয়ে বিয়ে করেছে।তার অনুমতির প্রয়োজন মনে না করে নিজেই বউকে ঘরে তুলেছে।এখন, যাদের এতোদিন ধরে আশ্রয় দিয়েছেন,তিন বেলা বিনা খরচে খাওয়াচ্ছেন তারাই আজ ছোবল মারার পায়তারা করছে?দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছেন।তা না হলে এতগুলো ঘটনার কিছুই জানেন না কেন তিনি?মালিহা বেগমের সাহস দেখে অবাক হয়ে গেছেন। নামে অসুস্থ, কাজে তো নয়!তিনি এদের দুই মা,মেয়ের শেষ দেখে ছাড়বেন বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন। তবে সামনে আনোয়ার সাহেব আর দিলারা বেগম বসে থাকায় মুখের অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ পেতে দিলেন না।বরং বেশি ভালোমানুষি দেখালেন।

দেখুন ভাবী আমার আর কি বলার আছে?মেঘলার মা তো বলেই দিলো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করা আছে মেঘলার।এখন, আপনাদের ছেলেকে সেটা বুঝিয়ে বলুন।জোর করে তো বিয়ে হয়না?মেঘলা হয়ত আদিবকে পছন্দ করে না।ফয়সালের সাথে বিয়েতে ওর নিশ্চয়ই মত ছিলো, তা না হলে আজকালকার যুগে ছেলে মেয়েদের বিয়ে কি না জানিয়ে ঠিক করা যায়?

আনোয়ার সাহেব কিছুই বললেন না।মনে হচ্ছে তার বুকের ব্যাথাটা বেড়ে যাচ্ছে। ছেলেটাকে কি জবাব দিবেন?

মালিহা বেগমও ভাবীর কথার জবাবে কিছুই বললেন না।মেঘলার যে এ বিয়ে সম্পর্কে কিছুই জানা নেই না তা আনোয়ার সাহেবের সামনে বলাটা বোকামি হবে।

আনোয়ার সাহেব তবু বললেন,আমাদের একবার মেঘলার সাথে কথা বলা প্রয়োজন ছিলো।আমরা জানতাম আদিবকে সেও ভালবাসে, হয়ত সেটা কখনো প্রকাশ করেনি।আমরা ভেবেছি ছেলেমেয়ে দুটো যখন নিজেদের মনের কথা নিজেরাই বুঝতে পারছে না তখন আমরা বড়রাই একটু এগিয়ে আসি।আমার ছেলেটা খুব ভালবাসে মেঘলাকে।ও চেয়েছে মেঘলার পড়াশোনা শেষ হোক তারপর বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। কিন্তু আমি নিজেই এসেছি প্রস্তাব নিয়ে অনেক ভেবে চিন্তে, কারণ আজ যা হলো ঠিক সেটারই ভয় করেছিলাম। তাই হলো,তবুও আপনাকে একবার ভেবে দেখতে বলবো আপা,বিয়ে এখনো হয়ে যায়নি।আপনি একটু ভাবুন,মেয়ের মন বোঝার চেষ্টা করুন।আপনার মেয়ে খুব ভালো থাকবে আমাদের কাছে।এরপরও যদি মেঘলা রাজি থাকে বা আপনার মনে হয় আদিব মেঘলার যোগ্য নয় তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।আজ আসি আপা,যদি কিছু সমস্যা হয় আমাদের জানাবেন।

মোমেনা বেগম ভদ্রতার খাতিরে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন ওনাদের।

মালিহা বেগম ভেবে পাচ্ছেন না মেঘলা কোনো ছেলেকে ভালবাসতে পারে বলে!বিয়েটা ঠিক করে ভুল কিছু করেন নি তাহলে।

মোমেনা বেগম মালিহা বেগমকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন মনে মনে।হিরে রেখে কাঁচের পেছনে দৌড়াচ্ছে বোকার মতন।মেঘলার কপাল ভালো তাই ওমন একটা পরিবার নিজে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।আর এরা মা, মেয়ে কিনা ওই ফয়সালেই মেতে আছে।মনিরার জন্য এমন প্রস্তাব এলে লুফে নিতেন তিনি।অবশ্য ভালই হয়েছে,মেঘলার ওতো ভালো ঘরে বিয়ে না হয়ে।তিনি মনে মনে প্রস্তুতি নিলেন মালিহা বেগমের সাথে এক চোট ঝগড়া করার।

মেঘলা বাড়িতে ঢুকে মামির চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ভাবলো,মারুফের বউয়ের সাথে মামির বোধহয় লেগেছে আবার।কিন্তু ঘরে ঢুকে মাকে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে গেল।

তাড়াতাড়ি করে মায়ের কাছে গিয়ে জানতে চাইলো, কি হয়েছে আম্মা?

মালিহা বেগম জোরে চড় বসিয়ে দিলেন মেঘলার গালে।মেঘলা এমন কান্ডে হতবাক হয়ে গেল।কিছুই বুঝতে পারছে না সে।মালিহা বেগম ঝাঁজের সাথে বললেন, একদম কথা বলতে আসবি না আমার সাথে, যা তোর আদিবের কাছে,এক কাজ কর আমায় মেরে ফ্যাল তুই,তাহলেই তোর সব ঝামেলা মিটে যাবে।

মেঘলা হতবাক হয়ে রইলো। আদিবের কথা হঠাৎ এভাবে উঠলো কেন?তাছাড়া আম্মাই বা তাকে মারলো কেন?

ও আম্মা এসব কি বলছো তুমি, কাঁদছো কেন?মাহিম কোথায়,তুমি জানো ও কারও কান্না দেখতে পারে না,ঘরে কই মাহিম?

মালিহা বেগমের এতক্ষণে খেয়াল হলো ছেলের কথা।মাহিম ছোট থেকেই কারো কান্না দেখতে পারে না।ভয় পেয়ে যায়,সেবার মোমেনা বেগমের বাবা মারা যাওয়ায় মোমেনা বেগম চিৎকার করে কাঁদছিলেন,মাহিম খুব ভয় পেয়ে বাড়ির পেছনের ছোট অন্ধকার খুপরিতে গিয়ে বসেছিলো।অটিস্টিক শিশুদের এরকম সমস্যা হয় যে কোনো বিষয় নিয়ে।মেঘলা খুঁজে পেল না মাহিমকে।সারাবাড়িতে দেখলো,পাশের ঘরে দেখলো,কোথাও নেই।মালিহা বেগমের কান্না আরও বেড়ে গেল।মেঘলারও পাগল প্রায় অবস্থা হলো।মারুফ বের হলো মেঘলার সাথে মাহিমকে খুঁজতে।

আদিব হাসপাতাল থেকে বের হলো মাহিমকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে।দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো খুব,যদি মাহিমের বড় কিছু হয়ে যায়?তবে খুব বেশি কিছু হয়নি,পায়ের হাড় ভেঙে গেছে শুধু । তবুও তো কষ্ট এই ছেলেটার জন্য।ভাগ্য ভালো মাহিমকে দেখতে পেয়েছিলো বাজারের কাছে।ছেলেটা একা এতদূর কেন,কিভাবে এসেছে ভেবে পায় না সে।মেঘলার তো পরিক্ষা ছিল আজ, নিশ্চয়ই মোমেনা বা কেউ খারাপ ব্যবহার করেছিলো তা না হলে মাহিম একা বেড়োয় না কোথাও।মেঘলার মা তো ছিলো বাসায়, তাহলে?আদিব মাহিমকে ট্যাক্সিতে বসিয়ে রেখে ওষুধ কিনলো।তখনই দেখলো মেঘলা আর মারুফ দৌড়ে তার দিকে আসছে।মেঘলারা বাজারে গিয়ে শুনতে পেয়েছে মাহিম একটা রিকশার সাথে ধাক্কা লেগে পরে গিয়েছে।আদিব মাহিমকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে।মেঘলা যেন সস্তি পেয়েছে আদিবের নামটা শুনে।মাহিমের কিছু হতে দেবে না আদিব সেটা মেঘলার খুব ভালো ভাবে জানা আছে।

২৫.
আনোয়ারা জোর করে আমরিনকে আবার নিয়ে এসেছেন সাথে করে।আমরিন তো আসতেই চাইছিলো না।আনোয়ার জানেন,আমরিনের না আসার কারণ যে আনাফ তা তিনি খুব ভালো ভাবেই জানেন। তাই তো আমরিনকে বলেছেন,আনাফকে তিনি ইচ্ছে মতো বকবেন,এমনকি কান ধরে ওঠবস করাবেন।আমরিন তো সেই রকমের খুশি।সে আনাফ ভাই এর কান ধরা দেখবে!এ যেন বিশ্বের সুন্দরতম এক দৃশ্য! কিন্তু আসার পর থেকে আনাফের দেখাই পাওয়া যায়নি।আনাফ এখনো বাসায় ফেরেনি।এই সুযোগে সে আনাফের সমস্ত ঘরটা ঘেটে ফেলেছে। ফুপিকে বলেছে ঘর গুছিয়ে দেবে কিন্তু সে গুছিয়ে দেয়ার নাম করে গোয়েন্দাগিরী করেছে।প্রথমে আনাফের বিছানাটা উল্টে পাল্টে দেখেছে এরপর ঠিকঠাক করে রেখেছে।সমস্ত বই পত্র ঘাটাঘাটি করে দেখলো, কোনো ডাইরি ফাইরি কিছু পেল না।আর পাবেই বা কি করে?আনাফের মতো ছেলের গোপন ডাইরি থাকতেই পারেনা!আমরিন বেড সাইড টেবিলটা ঘাটতে গিয়ে একটা ছবির খাম দেখতে পেল।প্রচুর আগ্রহ নিয়ে দেখতে ধরতেই কোথা যেন আনাফ এসে দ্রুত কেড়ে নিলো। আনাফকে দেখে সে ভয়ে জমে গেল।

তুই আমার ঘরে কি করছিস?

ঘর পরিষ্কার করছি দেখতে পাচ্ছো না?সারাঘর তো ডাস্টবিন বানিয়ে রেখেছো।এই জন্যই তো তোমার শরীর এতো গন্ধ করে।

আমি যদি তোকে চড় মেরে বসি তাহলে কিন্তু তোর মুখ সারাজীবনের জন্য বাঁকা হয়ে যাবে।চিনিস আমার চড় কে?

আমরিন ভয়টাকে আসতে দিলো না মনের মধ্যে। জোর গলায় বললো,মেরেই দেখো না, ফুপি তোমার কি হাল করে?

ছোট মানুষ তো তাই ভয় পেলেই ফুপিকে ডাকে, মাকে ডাকে,হু।সে আবার আমার সাথে লাগতে আসে?সাধে কি আর খুকি ডাকি?এই তোকে যদি আর একবার আমার জিনিসে হাত দিতে দেখেছি তো এমন অবস্থা করবো সারাজীবন নুলা হয়ে থাকবি।

ও ফুপি তাড়াতাড়ি আসো গো,তোমার জানবাচ্চার হাত ভেঙে দিয়েছে আনাফ ভাই!আমরিন ডান হাত ধরে লাফাতে লাগলো আর ফুপিকে ডাকতে লাগলো।

আনাফ হা হয়ে গেছে এমন কান্ডে!সে শুধু মুখ দিয়ে বললো আর অমনি হাত ভেঙে গেল,আশ্চর্য!

আমরিনের চিৎকারে দৌড়ে আসলেন আনোয়ারা।
কি হয়েছে তোর, এমন করছিস কেন?

আমরিন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,আনাফ ভাই আমার হাতে খুব জোরে মেরেছে, মনে হয় হাতটা ভেঙে গেল গো, ফুপি!

আনোয়ারা আঁতকে উঠলেন।ওমা,সেকি কথা?আনাফ তুই ওকে মারলি কেন?

আ-আমি মারি নি, মা?

আনাফ!একদম মিথ্যা কথা বলবি না।এতো বেয়াদব হয়েছিস তুই, এই জন্যই মেয়েটা আসতে চায় না আমার কাছে।

মা আমি সত্যি ওকে মারিনি?

তাহলে তোর কি মনে হয়,আমরিন মিথ্যা বলছে?

হ্যাঁ তো।

চুপ।এতবড় হয়ে গেছে তবুও বেয়াদবি গেল না।মেয়েটা কতটা ব্যাথা পেয়েছে, বলতো?আয় তো তুই আমার সাথে, এই শয়তানটার সাথে আর কথা বলবি না।আনোয়ারা আমরিনকে টেনে নিয়ে গেলেন।আমরিন দরজার কাছে গিয়ে পেছন ফিরে এক চোখ টিপে দিলো আনাফকে।

আনাফ রাগতেও পারলো না, না কিছু বলতেও পারলো না।শুধু করুন চোখে তাকিয়ে রইলো।

২৬.
মেঘলার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।একটু আগে মারুফের বউ তাকে সবটা বলেছে।কথা গুলো শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না তার।মেয়েটা কেন তাকে মিথ্যা বলতে যাবে? কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছে মেয়েটা আসলেই অনেক ভালো।আম্মা তাকে না জানিয়ে ফয়সালের সাথে কি করে বিয়ে ঠিক করতে পারে!আম্মা কি কখনো তার মনের কথা বুঝতে পারে না?আম্মা আর মাহিমই তো সব ওর জীবনে।ওদের ভালো রাখতে পারলে সেও জীবনের প্রকৃত সুখ খুঁজে পাবে অথচ আম্মা তার বিয়ে ঠিক করে বসে আছে!নিজের জীবনের এমন পরিস্থিতির জন্যই তো মেঘলা বারবার আদিবকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।ভুবন ভরা ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলছে শুধু মাত্র আম্মা আর মাহিমের জন্য।মেঘলা ভাবতেই পারছে না আর কয়েকদিন পর তার বিয়ে!অন্যদিকে আজ আদিবের বাবা মা নিজেরাই তার বাড়িতে এসেছে।এসে অপমানিত হয়ে গেছে।এটাই কি হওয়ার ছিলো এতো উপেক্ষার পরও।এসব কিছুর জন্যই তো মেঘলা দূরে দূরে থেকেছে আদিবের থেকে।কি করে মুখ দেখাবে সে মানুষ গুলোকে!মেঘলা হঠাৎ চমকে উঠলো, এতক্ষণে নিশ্চিয়ই আদিবের কানে খবরটা চলে গেছে তার বিয়ের!মেঘলা আতঁকে উঠলো,আদিব কি করবে বা করতে পারে ভয়ে শিউরে উঠলো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here