জোনাকিরা ভীড় করেছে পর্ব ১৬

0
903

#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-১৬
#সিফাতী সাদিকা সিতু

মেঘলা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আদিবের দিকে।আদিবের এমন আচরণ বোধগম্য হলো না।কি করতে চাইছে আদিব,রাগ নাকি অভিমান?
মেঘলা বিছানায় উঠে বসলো।লাইট বন্ধ করবে কি করবে না ভেবে পেল না।সে বন্ধ না করেই শুয়ে পরলো।বড্ড অসস্তি হচ্ছে তার।আদিবের ঘরে আছে সে অথচ আদিব কোনো কথা বলছে না।আশ্চর্য! এমন আচরণের মানেটা কি,তাকে শাস্তি দিচ্ছে?খুব তো পাগল হয়েছিলো মেঘলা যখন ফয়সালকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো।এখন কতো ভাব দেখাচ্ছে তাকে!যেন বিয়ে করে উদ্ধার করেছে তাকে,হু।মেঘলা একবার পাশ ফিরে তাকালো নিচে।আদিব যেমন ভাবে শুয়েছে ঠিক তেমন ভাবেই আছে,নড়াচড়াও করছে না।ঘুমিয়ে গেছে কিনা বুঝতে পারছে না।একবার দেখবে কি সে?না থাক,তার এতো কি দরকার দেখার?বরং ভালোই হলো সে এতোক্ষণ ভাবছিলো আদিব তাকে একের পর এক দোষারোপ করে অস্থির করে তুলবে কিন্তু না বেচারা তো নীরবে ভাব দেখিয়ে চলছে।সেও দেখতে চায় কত ভাব হয়েছে আদিবের। একটুপর নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে গেল মেঘলা।এতটা সাবলীল কিভাবে হলো সে?আদিবের সাথে সম্পর্কটা যেন এক লহমায় সহজ হয়ে গেছে।কবুল শব্দটার এতো জোড়!মেঘলা যতই ভালবাসুক না কেন সে কখনো আদিবের সাথে সহজ হতে পারেনি অথচ আজ কতো কি ভাবছে!আর সেই ভাবনায় অধিকার বোধ স্পষ্ট। মেঘলা নীরবে হাসলো।এতো সুখ সুখ অনুভূতি কেন হচ্ছে তার,আগে তো কখনো এমন হয়নি?উফফ!অনেক ভেবে ফেলেছে আর কিছু ভাববে না।ঘুমোনোর চেষ্টা করলো সে।আরেকবার পাশ ফিরে আদিবের দিকে তাকালো সে, একি অবস্থায় আদিবকে দেখে মনে মনে ভাবলো নিশ্চয়ই মেঝের সাথে জয়েন্ট লেগে গেছে ছেলেটার তা না হলে কেউ এভাবে শুয়ে থাকতে পারে একদম না নড়ে!মেঘলা মুখ ভেংচি দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পরলো।জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘলা নীরব হয়ে যাওয়ার পর আদিব উঠে বসলো।মেঘলার দিকে তাকিয়ে হাসলো।খুব সাবধানে উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করলো।ধীর পায়ে মেঘলা কাছে এগোলো।শাড়ি পড়া এলোমেলো চুলের মেয়েটাকে নিজের বিছানায় শোয়া দেখলো মন ভরে। আজ সে পরিপূর্ণ, মেঘলা শুধু তার মন জুড়ে নয় এখন ঘর জুড়েও বিরাজ করবে।মেঘলার কপালে একটা সুক্ষ্ম ভাঁজ পরেছে।আদিবের হাসি পেল খুব।মেঘলা যে এতক্ষণ মনে মনে বকবক করছে করছে তা সবটাই বুঝতে পেরেছে সে।আদিব একটু ঝুঁকে এসে মেঘলার ভাঁজ পরা কপালে নিজের অধর স্পর্শ করলো,সাথে তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো।এ কান্না যে বড় আনন্দের।কতশত অপেক্ষার প্রহর সে কাটিয়ে তা শুধু সেই জানে।মেঘলার বিয়ে অন্য কারো সাথে হয়ে যাচ্ছিলো!এই কথাটা ভাবতেই তার বুক কেপে উঠে।আজ যদি তার ঘরের জায়গায় মেঘলা ফয়সালের ঘরে থাকতো?সে জন্যই সে খুব কঠিন শাস্তি দেবে সে মেঘলাকে।প্রচন্ড অভিমান জমেছে মনে।মেঘলা এবার বুঝবে কাউকে ভালবেসে দূরে থাকার কষ্টটা কেমন?অবশ্য তার নতুন বউকে বেশি কষ্টও দিতে পারবে না সে।তাই খুব সাবধানে মেঘলার হাতে একটা আংটি পরিয়ে দিলো।বাসর ঘরে বউকে নাকি গিফ্ট করতে হয় তা না হলে দেখা যাবে এই নিয়ে সংসারে অশান্তি হবে।এখন লজ্জায় বলতে না পারলেও দেখা যাবে কয়েক বছর পর তার বাচ্চা কাচ্চা কে শুনিয়ে বলবে,তোর কিপটা বাপ আমায় বাসর রাতে কোনো উপহার দেয়নি!ঠিক তার মা যেমন তার বাবার নানান কীর্তি শোনায় রাগের সময়।নিজের এমন লাগামহীন ভাবনায় আদিব মনে মনে একচোট হেসে নিলো।আচ্ছা এখন মেঘলাকে ডেকে বলবে,চলো আমরা আমাদের বাচ্চা কাচ্চার নাম ঠিক করি!মেঘলার রিয়াকশন কেমন হতো তখন?আদিব নিজের মাথায় হালকা চাপড় দিলো।খুশিতে কি উল্টা পাল্টা ভাবছে সে এসব?আদিব আবার ফিরে গেল নিজের জায়গায় কিন্তু মন টানছে বিছানায়।না সে কিছুতেই ঘুমোবে না মেঘলার সাথে!শাস্তি দেবে সে মেঘলাকে কঠিন শাস্তি। আদিব শুয়ে পরলো। দেখলো,তার দিক থেকে মেঘলার পিঠের পাশ শুধু দেখা যাচ্ছে। পিঠ দেখে কি করবে সে।তার তো দরকার ওই চাঁদ মুখটা দেখা।আস্তে পা টিপে টিপে বিছানার অন্যপাশের কাছটায় গিয়ে কাঁথা বিছিয়ে নিয়ে মেঘলার মুখের পানে তাকিয়ে শুয়ে পরলো।আহা!কত শান্তি।প্রতিদিন এই মুখটা ঘুমানোর আগে এবং ঘুম থেকে উঠে দেখতে পারলে আর কিছুই চায় না সে।তবে আবার মনঃক্ষুণ্ন হলো তার।মেঘলা পাশ ফিরে শুলো অন্যপাশ হয়ে।আদিব আবার পা টিপে টিপে আগের জায়গায় এসে শুয়ে পরলো। বাসর রাতটা বেশ জমে গেছে মনে হলো তার।কেমন যে এডভেঞ্চার ফিল হচ্ছে যা মন্দ লাগছে না।বাসর রাতে তো ঘুমোতে নেই তাই সে এভাবেই কাটাবে।এত মজা করে তার আগে কেউ বাসর রাত কাটিয়েছে বলে মনে হয়না।সে সারারাত একদিন থেকে অন্যদিক করেই কাটিয়ে দিলো।মেঘলা যতবার পাশ ফিরেছে আদিব ততোবার কাঁথা বালিশ নিয়ে পা টিপে টিপে সে পাশেই শুয়েছে।বেশ মজা পেয়েছে সে।তবে সে কি জানে বিছানায় ঘুমের ভান ধরে থাকা মেঘলা সমস্ত কিছু উপভোগ করছিলো!মেঘলা তো গুনেও ফেলেছে সে কতবার পাশ ফিরেছে!খুব তো ভাব দেখানো হচ্ছিলো তাকে এখন থেকে সেও দেখিয়ে দেবে, হু।দুজনের এমন লুকোচুরি খুনশুটি দিয়ে রাত কাবার হয়ে গেল।

৩৫.
আমরিনের আজ, কেন যেন ঘুম আসছে না!ভাইয়ের বিয়ের খুশিতে কি ঘুম উবে গেছে?বিছানায় শুয়ে থাকতে মোটেও ইচ্ছে করছে না।সারাঘর ময় পায়চারি করলো কিছুক্ষণ। জেগে থাকার কারণে খিদেও লেগেছে। তাই রান্নাঘরের দিকে এগোলো।ফ্রিজে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য। কিন্তু রান্নাঘরে এসে অবাক হয়ে গেল আনাফকে দেখতে পেয়ে।দ্রুত আড়াল হয়ে পরলো আনাফ যাতে না দেখতে পায়।সে দেখতে চায় আনাফ কি করছে?

আনাফ খুব সাবধানে কাজ করছে যাতে শব্দ বেশি না হয়।সবাই জেগে গেলে লজ্জায় পরতে হবে।রাতে যে তার খিদে পায় সেটা আনোয়ারা জানেন।তাই রাতে আনাফের রুমে কিছু খাবার রাখেন অথবা আনাফ শুকনো খাবার এনে রাখে। ভাইয়ের বাসায় এসে তার মা ছেলের কথা ভুলেই গেছে।আনাফের খিদে পেয়েছে তাই সে চুপিচুপি রান্নাঘরে এসে নুডলস বানাচ্ছে। ছেলে হয়ে এই একটা জিনিসই সে ভাল পারে বানাতে।

আমরিন পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ালো আনাফের পেছনে।চট করে বললো,চুরি করে খাবার খেতে এসেছো আনাফ ভাই?

আনাফ প্রচন্ড ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। আমরিন তা দেখে মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে উঠলো।

আনাফ অসহায় বোধ করলো।এখন নিশ্চয়ই আমরিন তাকে পঁচাবে!ধুর আর আসবেই না মামার বাড়িতে। আসলেই আমরিন তাকে জ্বালানো শুরু করে!শুধু কি জ্বালায়,রীতিমতো মানসম্মানের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেয়।কিন্তু আনাফকে অবাক করে দিয়ে আমরিন বললো,তুমি সরে দাঁড়াও আমি বানিয়ে দিচ্ছি।

আনাফ সরছে না দেখে আমরিন বিরক্ত হয়ে তাকালো।দেখলো আনাফ হা করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।আমরিন ঠেলে সরিয়ে দিলো আনাফ কে।

এই খুকি ধাক্কা দিচ্ছিস কেন?

তা দেব না,খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?সরতে বলেছি তো।

তোকে কিছু করতে হবে না।আমি পারবো বানাতে।

আমি সেটা জানি।তবু সরো আমারও খিদে লেগেছে।চাইলে তুমি তো আর এমনি এমনি খেতে দেবে দেবে না তাই আমিও সাহায্য করি।চা খাবে আনাফ ভাই?

এখন কি তুই চা বানাবি?

হ্যাঁ, কেন খাবে না?

খাব।কিন্তু তুই এতরাতে রান্না ঘরে এসেছিস কেন?

ঘুম আসছিলো না আমার।জেগে থেকে খিদে পেয়ে গেছে তাই কিছু খেতে এসেছিলাম।

তুই তাহলে একটু দেখ আমি মাহিমকে দেখে আসি।যদি উঠে যায় ভয় পাবে।

আনাফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসে আমরিন।খুব ভালো লাগছে আজ।আনাফ ভাই এর জন্য নুডলস বানাতে নিজেকে বউ বউ মনে হচ্ছে। ইশ!এমন যদি সত্যি হতো।সে আর আনাফ ভাই বিয়ের পর রাত বিরাতে এভাবে খাবার বানাতো,একসাথে খেতে খেতে গল্প করতো!চায়ে চুমুক দিতে দিতে চন্দ্র বিলাস করতো!কতোই না ভালো হতো।

ফয়সাল বাড়ি ফিরে সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করেছে আর খুলেনি।রেবেকা বেগম ডাকাডাকি করেছে বেশ কিছুক্ষণ। ছেলের রাগ, জেদ সম্পর্কে ভালো জানেন তাই আর ঘাটান নি।তার নিজেরও মনটা খারাপ।মেঘলাকে ছেলের বউ করার কতো আশা ছিলো!মেঘলার মতো একটা ভালো মেয়েই পারতো তার ডানপিটে ছেলেটাকে সঠিক পথে আনতে।ফয়সাল মেঘলাকে পছন্দ করে এ কথা জানার পর বেশ খুশিই হয়েছিলেন।সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল ছেলেটার জন্যই।বাচ্চা মানুষ একটু কামড় দিয়েছে তার জন্য ওভাবে চড় মারতে হবে!রাগ সবসময় নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরে।স্বামী মারা যাওয়ার পর একমাত্র ছেলেকে খুব আদরে মানুষ করেছেন।শাসন করতে পারেন নি,বলতে গেলে করেনি নি।ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন।অথচ মনে কোনো শান্তি নেই।

ফয়সাল অপমানের তাড়নায় ছটফট করছে।নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।আদিবের কাছে সে আবার হেরে গেল!কেন সে এভাবে বারবার হারবে,কেন?এতোকিছু করার পরেও মেঘলাকে বিয়ে করতে পারলো না।কিন্তু এতো সহজে হেরে যাবে না সে!সে যখন শান্তিতে থাকতে পারছে না তখন আদিবকেও ভালো থাকতে দেবে না,কখনোই না।মেঘলাকেও সে দেখে নেবে। এত সহজে হাল ছাড়বে না সে।বিয়েটা না হওয়ার কারণে ফয়সালের ক্ষোভ বেড়েই চলছে।

৩৬.
সকালের নরম রোদের আঁচে ঘুম ভেঙে গেল মেঘলার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই চমকে গেল।আদিব মেঝেতে বসে বিছানায় মাথায় রেখে ঘুমাচ্ছে।মেঘলার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল।গতরাতে দুজনে লুকোচুরি করতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টেরই পায়নি।

মেঘলা বিছানায় বসে পরনের শাড়িটা ঠিকঠাক করলো।এরপর আদিবের মাথাটা ধীরে ধীরে তুলে বালিশে রাখলো।ছেলেটা কেমন দুহাত মেলে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুমোনোর ভঙ্গি দেখলেই হাসি পাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা ছেড়ে নেমে গেল ওয়াশরুমে।

চলবে…

(রিচেক করিনি, ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here