– আমার কাছে তোমার পরিচয় শুধু তুমি অথৈর মা, আমার স্ত্রী হবার চেষ্টা ভুলেও করবে না। আমাদের সম্পর্কটা শুধু মাত্র কাগজের। তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি পালন করে যাবো। এর চেয়ে বেশিকিছু আমার থেকে এক্সপেক্ট করবে না। কথাটা ক্লিয়ার?
– জ্বী বুঝেছি।
– তাহলে বসে না থেকে অথৈর রুমে যাও, আজ থেকে ওকে নিয়ে ওখানেই থাকবে।
– আজ রাত তো ও বাবা-মার কাছে থাকবে বলেছে, আমি এখানে
– মাথা খারাপ নাকি তোমার? ও বললো আর তুমি মেনে নিলা? দেখো শিমুল আমি বকুলের জায়গা তোমাকে কোনোদিন দিতে পারবো না,আর এটা তুমি খুবই ভালো করে জানো। এই রুমটা বকুল আর আমার তাই এখানে তুমি থাকতে পারবে না।
– আজ রাতটা নাহয় আমি বারান্দাতে থাকি, প্রথম দিন বাইরে গেলে মানুষ নানা কথা বলবে।
– তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
বলেই হিরহির করে টানতে টানতে শিমুলকে রুমের বাইরে বের করে দিলো ইফতি। মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দেওয়ার পরেও শিমুল এখনো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। আজ তার বিয়ে হয়েছে, প্রতিটা মেয়েরই এই দিনটা নিয়ে অনেক আশা থাকে, স্বপ্ন থাকে। কিন্তু শিমুলের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। কারণ ইফতির এটা দ্বিতীয় বিয়ে, শিমুলকে তার বিয়ের কারণ একমাত্র অথৈ। অথৈ এর বয়স পৌনে তিন বছর। দু মাস হয়েছে, ইফতির প্রথম স্ত্রী বকুল যে সম্পর্কে শিমুলের ছোট বোন, ক্যান্সারে মারা যায়। বকুলকে প্রচুর ভালবাসে ইফতি, চিকিৎসার কোনো কমতি রাখে নি সে। শহরের নামকরা ব্যাবসায়ীদের একজন ইফতি। যত টাকা খরচ করতে হতো সে করেছে, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু হায়াত না থাকলে কার কি করার। বকুলের মৃত্যুর পর ইফতি কেমন জানে ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। অথৈ তো দূরে থাক নিজের খেয়ালই রাখতে পারে না। তাই সিকান্দার সাহেব এবং আফসানা বেগম ঠিক করেছেন ইফতিকে দ্বিতীয় বিয়ে দিবে। কিন্তু ইফতিকে বিয়েতে রাজি করানো কম কষ্টের ছিলো না; উপর থেকে এমন মেয়ে যে অথৈ কে ভালোবাসবে খুজে পাওয়া ভার। শিমুল এমনই একটা মেয়ে, সে যেমন ভদ্র তেমনি বুঝদার। অথৈকে এমনিতেও নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, আর এই দুই মাস তাকে শিমুল ই দেখাশুনা করে আগলে রেখেছে। নিজের অংশই ভেবে যত্ন করে আসছে সে অথৈকে। অনেক ভেবে চিনতে সিকান্দার সাহেব, হারুণ সাহেবের (শিমুলের বাবা) কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখেন। হারুণ সাহেব শিমুলকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। মেয়ের অপূর্ণতা যাতে তাকে ছোট না করতে পারে,তাই মেয়েকে শিক্ষিত, মার্জিত গুণে গড়ে তুলেছেন। তিনিও চেয়েছিলেন, তার মেয়ের একটা সুখের সংসার হোক। কিন্তু মানুষের চোখে শিমুলের সকল গুণ তার অপূর্ণতার কারণে ঢাকা পড়ে যায়। তাই তার এতো লক্ষী মেয়েটার এখনো বিয়ে হলো না। ইফতির মতো এতো ভালো ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে করবে এটা ভেবেই আর আপত্তি করলেন না। আর অথৈ বকুল মারা যাবার পর থেকে শিমুলের কাছেই ছিলো, হারুণ সাহেব তাই আর অমত করেন নি।
শিমুল এতোক্ষণ ইফতির দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাত প্রচুর হওয়ায়, বাড়ির লোক সব ঘুমে। বিয়েটা খুবই সিমসাম ভাবে হয়েছে, বেশি আত্নীয় স্বজন আসে নি। তাই ইফতির এই আচরণ কারোর চোখে পড়ে নি। আর শিমুল মেয়েটাই এমন কাউকে জানতে দিবেও না। ইফতিদের ছাদটা খুবই বড়, একপাশে সব বকুলের প্রিয় ফুলের গাছ তো অপরদিকে দোলনা, অথৈর জন্য খেলার সরঞ্জাম। ছাদের কর্ণিশ ঘেরা কোমর অবধি উচু দেওয়াল, শিমুল এককোণায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখতে লাগলো। রাস্তার সোডিয়ামের বাতিগুলো এখনো জ্বলছে। কিছু গার্ড বাশি বাঁজিয়ে জানান দিচ্ছেন তারা আছেন। রাতের ঢাকার আকাশ চমৎকার লাগে শিমুলের। আবাসিক বলে গাড়িঘোড়া নেই, শান্ত পরিবেশ। আজ আকাশে মেঘ করেছে, কিন্তু বৃষ্টি হবে না। একদম শিমুলের মনের সাথে মিলে যাচ্ছে। চাপা কষ্ট মনে হানা দিচ্ছে, কিন্তু সে কাঁদবে না। সে কাঁদে না, জীবনের কিছু কষ্ট তাকে এতোটাই শক্ত করে ফেলেছে যে এখন এসব অপমান তাকে কোনোভাবেই কাঁদাতে পারবে না।
আজ শিমুল ছাদেই কাটাবে, মায়ের সাথে কথা বলবে। শিমুলের বয়স যখন দশ বছর তার মা মারা যায়। তখন বকুলের বয়স আট বছর। শিমুলের ম্যাচুরিটি তখন থেকেই অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। বকুলকে সে কোনোদিন মায়ের কমতি হতে দেয় নি। বকুল যেমন প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল ছিলো, শিমুল ততোটাই শান্ত, চুপচাপ। হারুণ সাহেব শিমুলকে অধিক ভালোবাসার কারণটা এটাও। শিমুল কোনোদিন কাউকে নিজের মনের কষ্ট বলতো না। হারুণ সাহেব কেবল তার একমাত্র বন্ধু। বাবাকে নিজের কথাগুলো বলতে তার বেশ লাগে। এখন সেটা হবে না। তাই এখন ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের চাপা আর্তনাদ শুনাবে সে।
পূর্বের আকাশে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে৷ সারারাত ঘুমহীন কেটেছে শিমুলের। এটা কোনো বড় ব্যাপার না। জীবিকাতে ডাক্তার সে এমন নাইট ডিউটি হরহামেশা দিয়ে এসেছে। অথচ চেষ্টা করেও বোনটিকে বাঁচাতে পারে নি। বকুলকে সে মায়ের মতো ভালোবেসেছে। কোনোদিন যাতে বকুল নিজেকে একা না পায় সেটার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করেছে। তাই নিজের বিয়ে না হলেও বকুলের যাতে সুখের পথে কোনো বাধা না পড়ে সেই কাজটিই করেছে শিমুল। বাবাকে রাজি করিয়ে ইফতি এবং বকুলের চার হাত এক করেছিলো। অথচ ভাগ্য আজ তাকে বিয়ের সুখতো দিলো কিন্তু তারই ছোট বোনের হাসবেন্ড এর দ্বিতীয় স্ত্রী রুপে।
আযানের ধ্বনি বেশ আগেই শুনেছে। কিন্তু কোন রুমে যাবে বুঝতে পারছে না। ইফতি তাকে নিজের রুমে ঢুকতে দিবে না। শত কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শিমুল অথৈর রুমে গেলো। কেউ নেই ফাঁকা রুম। শিমুলকে এই সকালে অথৈর রুমে ঢুকতে দেখে আফসানা বেগমের বুঝতে বাকি রইলো না তার ছেলে শিমুলকে নিজ রুমে জায়গা দেয় নি। ছেলের এমন বেপরোয়া রুপ তার অজানা নয়। যাকে ভালোবাসবে মন উজাড় করে বাসবে। আর যাকে ভালোবাসবে না, নিজের ত্রিসীমানায় তাকে ঢুকতে দিবে না। মনে মনে ভাবতে লাগলেন,
– এই বিয়েটা দিয়ে শিমুলের জীবনে কোন আধার দেখে আনলাম নাতো। না জানি নিজের ছেলে, নাত্নির কথা ভাবতে ভাবতে শিমুলের জীবনটাই না নষ্ট করে ফেলেছি।
শিমুল নামায পড়ে, রান্না ঘরে এসে নাস্তার কাজ করতে লাগলো। শিমুল বরাবরি ঘরোয়া স্বভাবের মেয়ে, ঘরের কাজ করতে তার বেশ লাগে। আর ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর থেকে ঘরের কাজ তাকে আর হারুণ সাহেবকেই করতে হতো। তাই একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সারারাতের ঘুমহীণ যেন জানান দিচ্ছে তুমি ক্লান্ত। শিমুল তার তোয়াক্কা না করেই সব কাজ করতে লাগলো।
সকাল ৮ টা,
অথৈ উঠেই মামনিকে খুজছে। বকুল মারা যাবার পর মামুনি তার সব। কারোর কাছে দু দন্ড মেয়েটা থাকতে চায় না তার মামুনিকে লাগবে। কাল বাসর রাত ছিলো বিধায় আফসানা বেগম জোর করে নিজের কাছে রেখেছিলো। তাতে লাভ এর চেয়ে খতিটাই হয়েছে। টেবিলে খাবার সার্ভ করে দেখে অথৈকে খাবার খাইয়ে দিলো শিমুল। অথৈ এর রুমে তার সাথে খেলছিলো, আফসানা বেগম এসেছেন৷ শিমুলের মাথায় হাত রেখে বললেন,
– মা কাল ঘুম হয় নি না?
– না মা খুব ভালো ঘুম হয়েছে।
– চোখ মুখ তো অন্য কথা বলছে মা!
– ও কিছু না, নতুন জায়গা তো।
– ইফতিকে ডেকে আনো, তোমার শ্বশুর মশাই খাবার টেবিলে যাচ্ছেন
– আমি?
– এখন তুমি তার বউ, তোমার অধিকার আছে। যাও ডেকে আনো।
শ্বাশুড়ির কথায় অমত করতে পারলো না শিমুল। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো ইফতির রুমে, না জানি আর কোন অপমান তার জন্য অপেক্ষায় আছে।
চলবে
#তবু_মনে_রেখো
প্রথম পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি