#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৮
লিখা: Sidratul Muntaz
পরিবেশ ঠান্ডা, নিশ্চুপ। লাভলী মেঝেতে বসে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। তোহার চোখ থেকে দু-তিন ফোটা করে তপ্ত জল গড়াচ্ছে। সে মাথা নত করে রেখেছে। মা পড়ে যাওয়ার পরেও মাকে ধরতে যায়নি। অপরাধবোধে আড়ষ্ট হয়ে তার সারা শরীর কাঁপছে। আমীর ঠান্ডা দৃষ্টিতে সবাইকে দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় তোহাকে বলল,
” তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। ডিরেক্ট গিয়ে পায়ে ধরে বসো।”
কথাটা আমীর এমনভাবে বলল যেন কেউ বুঝতে না পারে যে সে কথা বলেছে। তোহা আমীরের কথায় ফুপিয়ে কান্না শুরু করল। মা তাকে ক্ষমা করবে তো? অপরাধের পরিমাণ যে মোটেও কম না!
লাভলী শুধু তোহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। কথা বলার শক্তিটা পর্যন্ত আয়ত্ত করতে পারছেন না। লতিফা আর পূরবী লাভলীকে উঠাতে চাইলেন। উনি উঠছেন না। পূরবী ধরে রাখল। লতিফা উঠে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় বললেন,
” তোমরা ভেতরে আসো। ঘরে আইসা বসো আগে। তারপর আস্তে-ধীরে কথা হইবো।”
আমীর চুপচাপ ঢুকল। তোহা দাঁড়িয়ে রইল। আমীর বলল,
” ভিতরে এসো তোহা।”
লতিফা সুর মিলিয়ে বলল,” হো হো আসো। ভিতরে আইসা বসো। কান্নাকাটি কইরা লাভ কি? যা হওয়ার তা তো হইয়াই গেসে। কানলে তো আর আইবো না।”
তোহা তাও চুপ করে দাড়িয়ে আছে। লতিফা হঠাৎ তোহার মুখের কাছে ঝুঁকে বললেন,” আচ্ছা, এতোদিন পর আইলি ক্যান মা? ভাইগগা গেসিলি ভালা কথা। অন্তত কইয়া যাইতি। চিঠি লেইখা যাইতি। তাইলেই তো আমগো আর পাগলের মতো খুঁজোন লাগতো না। তোর আশা ছাইড়া দিতাম। তোর মায় কেমন পাগলডার মতো হয়া গেসিল, কয়বার যে বিছানায় পরসে, ইশটোক( স্ট্রোক) করসে! জানোস ইতা?”
তোহা মুখে হাত দিয়ে ঘাবড়ানো দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর আবার হুহু করে কাঁদতে লাগল। পূরবী ছলছল চোখে বলল,
” মা, এখন এসব কথা না বললে হয়না? আগে দরজাটা বন্ধ করো। আর তোহা, তুই দয়া করে ভিতরে আয়। অনেক নাটক দেখিয়েছিস। এখন দরজার বাহিরে দাড়িয়ে পাড়া-প্রতিবেশীকেও নাটক দেখাতে হবেনা।”
তোহা ক্রন্দনরত অবস্থায় মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকল। লতিফা বললেন,
” তোমরা দুইজন ওইখানে গিয়া বসো। আমরা বুবুরে নিয়া আইতাসি। ”
আমীর চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসলো৷ পূরবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমীরের দিকে। ছেলেটার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর সবাই সব ভুলে তাকে জামাই আদর করার কাজে ব্যস্ত হবে। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষাতেই ছেলেটা নিশ্চিন্তে বসে আছে।তোহা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসহায় মুখে বলল,
” মা!”
লতিফা ধমকের মতো বললেন,” ভিত্রে গিয়া বো(বস)। আমি বুবুরে নিয়া আইতাসি।”
তোহা গুটি গুটি পায়ে গেল। সে হাত-পা জড়তায় গুটিয়ে রেখেছে। ঘাড় নিচু করে রেখেছে। কারো চোখের দিকে তাকাতেও পারছে না লজ্জায়। লতিফা মেঝেতে বসে পড়লেন। লাভলী গালে, মাথায় মালিশ করতে করতে বললেন,
” ও বুবু, বুবুগো। মনডা শক্ত করো বুবু। তুমি তো এতোদিন চাইতা মাইয়াডা ফিরা আয়ুক। সুস্থ-সবল ভাবে যেন আল্লাহ তোমার কাছে তোমার মাইয়ারে ফিরায় দেয়। চাইতা না কও? কত কানসো নামায পইড়া এই মাইয়ার লাইগা। কত পাগলামিডি করসো। এহন তো ওয় ফিরা আইসে বুবু। যেমনেই আয়ুক, মাইয়াডা আইসে। বুবু খুশি হইয়া যাও তুমি। হেগো রে আর কিছু কইয়ো না। মাফ কইরা দাও।”
লাভলী এতোক্ষণে একটা কথা বলতে সক্ষম হলেন।চোখ বন্ধ করে শক্ত চোয়ালে উচ্চারণ করলেন,
” এইভাবে ফিরে আসার চেয়ে ওর মরে যাওয়াই অনেক ভালো ছিল।”
পূরবী এই কথা শুনে কেঁদে ফেলল। তোহা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কথাটা শুনতে পায়। সাথে সাথে দৌড়ে আসে। লতিফা সামলানোর জন্য বললেন,
” এডি কয়না বুবু। আল্লাহ নারাজ অইবো। বাচ্চা মাইয়া ভুল করসে। হেরে মাফ কইরা দাও।”
তোহা মায়ের সামনে এসে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। ওর চোখ দুটো কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়েছে। পূরবী আর লাভলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তোহাকে দেখল। তোহা মুখ ভেঙে কান্না শুরু করল। মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
” আম্মু, আম্মু প্লিজ। ”
বলতে বলতে হাতজোড় করল তোহা৷ তারপর ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল,
” মাফ করে দাও। আমি ভুল করেছি আম্মু। যত ইচ্ছা শাস্তি দাও। কিন্তু আমার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না আম্মু। তোমাকে আর আব্বুকে ছাড়া আমি কোনোদিন থাকতে পারবো না।”
লাভলী সটান করে উঠে দাড়াতে গিয়ে পায়ে হোচট খেলেন। লতিফা আর পূরবী দুইদিক থেকে ধরল। লাভলী দুজনের সহযোগিতায় হেলেদুলে উঠে দাড়ান। তারপর তোহার সামনে এসে কঠিন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এলোপাতাড়ি চড় মারা শুরু করেন। লতিফা ‘ আল্লাহ,আল্লাহ’ বলে চিল্লিয়ে উঠেন। পূরবী হাত ভাজ করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। তার মতে এইটুকু তোহার প্রাপ্য। আমীর তোহাকে মার খেতে দেখে দৌড়ে আসল। তোহাকে নিজের দিকে টেনে নিল। আর লতিফা লাভলীকে থামালেন। তোহা মুখ চেপে কাঁদতে লাগল। কান্নার জোয়ার দ্বিগুণ বেড়ে গেছে তার। চুল এলোমেলো হয়েছে। নিঁখুত ফরসা গাল হয়েছে টুকটুকে লাল। লাভলী কিছুটা নিচু হয়ে হাপাতে লাগলেন। পেছন থেকে লতিফা দুই হাত ধরে রেখেছেন। ছেড়ে দিলেই লাভলী আবার তেড়ে যাবেন মেয়েকে মারতে। আমীর তোহাকে পেছনে নিয়ে লাভলীর সামনে এসে দাড়াল। নিচুগলায় বলল,
” সরি আন্টি, আমি ইন্টারফেয়ার করতে চাইনি। কিন্তু একটা কথা বলা ইম্পোর্ট্যান্ট তাই বলতে হচ্ছে।তোহা প্র্যাগনেন্ট। কথাটা হয়তো ও বলতে লজ্জায় পারবে না। তাই আমিই জানালাম। এমনিতেই ও খুব মেন্টাল প্রেশারে আছে। তার উপর আপনি যদি এভাবে..”
লতিফা আমীরকে থামিয়ে বললেন,
” হো হো বুঝছি, বুঝছি। বুবু চলো থাক, আগে মাথা ঠান্ডা করো। তারপর আবার কথা হইবো।”
লাভলী আমীরের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,
” লতু ছাড় আমাকে। নাহলে এখন সব মার তোর পিঠে পড়বে। রাগাস না। ছাড়!”
লতিফা দৃঢ়গলায় বললেন,” আমারেই মারো বুবু। তাও ভালা।”
লাভলী শরীর জোরে ঝাঁকি দিলেন। লতিফা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। লাভলী আমীরের পেছন থেকে তোহার হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসেন। তোহা মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলে চলেছে। লাভলী দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
” এই মেয়ে, একটু আগে কি বললি? আমাদের ছাড়া থাকতে পারবি না? তাহলে গেছিলি কেন? যাওয়ার সময় মনে ছিল না? থাকতেই যখন পারবি না তাহলে গেছিলি কেনো, বল!”
লাভলী একহাতে তোহার গাল টিপে ধরেন। চিৎকার করে বললেন,” গেছোস ভালো কথা এই মুখ নিয়া তাইলে ফিরা আসলি ক্যান মুখপুরি?”
লাভলী তোহাকে আরও এক দফা চড় দিতে উদ্যত হলেন। আমীর তড়িঘড়ি করে লাভলীর হাত ধরে আটকায়। তারপর তোহার সামনে এসে ওকে আড়াল করে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলল,
” প্লিজ আন্টি, এটা করবেন না। এমনিতেই ওর মনটা খুব খারাপ। এই তিনমাস শুধু কান্না ছাড়া আর কিচ্ছু করেনি মেয়েটা। আসলে আমিই ওকে পালানোর জন্য প্রেশার দিয়েছিলাম। নাহলে ও কখনো পালাতো না। আপনাদের ছেড়ে ও যেতেই চায়নি। আমি জোর করে ওকে নিয়ে গেছি। আমরা কিন্তু এখান থেকে বিদেশ চলে যাচ্ছিলাম। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ভিসাও রেডি ছিল। কিন্তু তোহা যায়নি। কারণ ও আপনাদের ছাড়া থাকতে পারবে না। খুব কান্নাকাটি করছিল। তাই আমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। বাধ্য হয়ে এ বাড়ির পাশে ফ্ল্যাট ভাড়াও নিয়েছি। সে বাসায় মাল-পত্র উঠানো শেষ। আমরা আজকেই নতুন বাসায় উঠবো। তোহা আপনাদের কাছাকাছি থাকতে চায়। ও অনেক অনুতপ্ত। আমি নিজেও খুব অনুতপ্ত। প্লিজ আমাদের ক্ষমা করে দিন, আন্টি।”
আমীর মাথা নত করে দুইহাত উপরে তুলে ক্ষমা চাইলো।পূরবীর গা জ্বলে যাচ্ছে ছেলেটার ন্যাকামো দেখে। এই ছেলের সাহস তো কম না! মা-মেয়ের মাঝখানে বামহাত ঢুকিয়ে ঢং শুরু করেছে। ইচ্ছে করছে তেড়ে গিয়ে ঠুসঠাস থাপ্পড় মেরে বলতে,” ফরমালিটি জানিস না বেটা? ও তোর বউ হওয়ার আগে লাভলী আন্টির মেয়ে হয়। মা মেয়েকে শাসন করতেই পারে৷ তুই নিষেধ করার কে? বউয়ের জন্য পিরিত উথলে পড়ে না?এতোই যখন অনুতপ্তবোধ তাহলে পালিয়েছিলি কেন? ”
আচ্ছা তোহা তো পূরবীর ছোটবোন। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে এই ছেলেটাও পূরবীর সম্পর্কে ছোট হবে। কারণ ছোটবোনের হাসব্যান্ড বয়সে বড় হলেও সম্পর্কে ছোটই হয়। তাহলে পূরবী চাইলেই আমীরকে চড় দিতে পারে। কিন্তু চড় দেওয়াটা উচিৎ হবেনা। ধমক দেওয়া যায়। সে কি ধমক দিবে একটা? না থাক, দরকার নেই।ধমক দেওয়ার জন্য বড়রা আছে। তার পাকানামি করতে হবে না। কিন্তু মন মানতে চায়না, গা জ্বলে। লাভলী চোখমুখ ডলে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন। লতিফা তখনো দুইহাতে লাভলীকে ধরে রেখেছেন। লাভলী রুক্ষ গলায় বললেন,
” সব বুঝলাম। কিন্তু তোমরা পালাবে কেন? কি এমন হয়েছিল যে পালাতে হবে? আচ্ছা তোমাদের সম্পর্কের কথা আমাদের জানালে কি হতো?তোহা কি আমার কাছে একবার এসে বলতে পারতো না যে ও তোমাকে বিয়ে করতে চায়? আমরা কি কখনো ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করেছি? এমন তো না যে আমরা তোমাকে ইচ্ছে করে মেনে নেইনি। আমরা তো জানতামই না তোমাদের সম্পর্কের কথা। একটাবার জানালে কি এমন ক্ষতি হতো? ও কেন না জানিয়ে পালিয়ে যাবে? এমনো তো না যে আমরা ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলাম। তাহলে কিসের তাগিদে পালিয়ে গেলে তোমরা?”
আমীর মাথা নিচু রেখেই চাপাস্বরে বলল,
” আসলে আন্টি, তোহা ভেবেছিল আপনারা আমাকে মানবেন না।”
” কেন রিকশাচালক তুমি ?ভ্যানচালক? ট্যাক্সিচালক? তোমার বাবা কি জেলফেরত আসামী? কাউকে খুন করেছেন? তুমি কাউকে খুন করেছো?”
আমীর হতচকিত হয়ে বলল,” না!”
” তাহলে মানবো না কেন? না মানার রিজন কি? ওর কি কারণে মনে হলো যে আমরা তোমাকে মানবো না তাই পালিয়েই বিয়েটা করতে হবে?”
” আমরা যে সময়ে বিয়েটা করেছি সে সময়ে আপনারা সত্যিই মানতেন না।”
” হ্যা এটা ঠিক। আসলেই মানতাম না। আর কেন মানবো? বিয়ের বয়স হয়েছিল তখন ওর? ওর তো এখনো আঠারোই হয়নি। তাহলে কোন সাহসে বিয়ের কথা চিন্তা করে ও? তুমিই বা কোন সাহসে আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেলে? সবার আগে তোমাকে পুলিশে দেওয়া দরকার। ও না হয় ছোট কিন্তু তোমাকে তো এনাফ ম্যাচ্যুয়ারই মনে হয়। কিভাবে এমন জঘন্য কাজ করলে?আবার কোন মুখে ফিরে এসেছে?তিনমাস পর কি এটা দেখতে এসেছো আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি?”
” না আন্টি।”
লাভলী তিন আঙুল উঠিয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন,
” তিন মাস! তিনটা মাস এই সংসারের উপর, এই বাড়িটার উপর এবং আমাদের উপর কি পরিমাণ ঝড় গেছে তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না। তোহার বাবা দিশেহারার মতো শুধু মেয়েটাকে খুঁজেছে। তার দুইবার হার্টঅ্যাটাক হয়েছিল। রাতে সে ঘুমাতে পারতো না। বুকে ব্যথা হতো। আমার পাশে শুয়ে মেয়ের কথা মনে করে কাঁদতো। প্রথম টানা একমাস আমি নিজেও ঘুমাতে পারিনি। শুধু কেঁদেছি। ভেবেছিলাম মেয়েটা হয়তো ভয়ংকর কোনো বিপদে পড়েছে। ভাতের লোকমা মুখে দেওয়ার সময় আমার অন্তর কেপে উঠতো। হু হু করে কাঁদতাম আর চিন্তা করতাম আমার মেয়েটা কি খেতে পারছে?স্ট্রোক করেছিলাম হতাশায়। একটামাত্র মেয়ে আমাদের। এইভাবে ধোঁকা দিবে জানলে এতো কষ্ট করে জান ছেড়ে মানুষ করতাম না ওকে। জন্ম দেওয়ার আগেই মেরে ফেলতাম। নাহলে কেটে টুকরা টুকরা করে নদীতে ছুড়ে ফেলতাম।কম কষ্ট করিনি এই মেয়ের জন্য! তোমরা তো পালিয়ে গিয়ে সুখেই ছিলে। আর আমরা জ্যান্ত দুটো মানুষ মরা লাশের মতো বেঁচে ছিলাম৷ এর থেকে যদি ও আমাদের খুন করে যেতো তাও অনেক ভালো ছিল। আজকে তোমরা কত সুন্দর করে এসে ক্ষমা চাইছো। কিভাবে ক্ষমা করি তোমাদের? বলতে পারো? কিভাবে ক্ষমা করি?কেউ ভুল করলে সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত অপরাধ কি ক্ষমা করা যায়? তোমরা যেটা করেছো সেটা ইচ্ছাকৃত। ক্রাইম। তোমাকে আমি জীবনেও ক্ষমা করবো না আর ওকে? ও আজ থেকে আমার মেয়েই না। আমি নিঃসন্তান। ”
লাভলী কথা শেষ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তোহা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে গুমরে গুমরে কেঁদে চলেছে। লতিফা লাভলীকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে রুমে নিয়ে যান। পূরবী কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সেও চলে যায়। শুধু আমীর আর তোহা মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকে। আমীর সামনে তোহা পেছনে!
আধঘণ্টা পর জাবিদ সাহেব বাসায় ফিরেলেন। তোহা তখন নিজের ঘরে আমীরকে নিয়ে বসেছিল। আমীর নতমাথায় দুইহাত রেখে বিছানায় একসাইডে পা নামিয়ে বসেছিল। আর তোহা বিছানার অন্যপ্রান্তে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসেছিল। সে বিমর্ষ, আমীর চিন্তিত। পূরবী ঘরে ঢুকে কর্কশ গলায় বলল,
” জাবিদ আঙ্কেল এসেছে।”
তারপর ভ্রু কুচকে একবার আমীরের দিকে তাকালো আরেকবার তোহার দিকে। তারপর চলে গেল। তোহা পূরবীর কথায় ছ্যাত করে উঠে। বুকের মধ্যে কাপন ধরে যায়। চোখমুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়। বাবা তাকে ঠিক বুঝবে এই আশা নিয়ে তোহা আমীরের দিকে তাকালো। আমীর মৃদু হেসে বলল,
” যাও।”
তোহা খুশিমনে দ্রুত মাথা দুলিয়ে বলল,” এখনি যাচ্ছি।”
তোহা খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে দৌড়ে গেল বাবার ঘরে। ওর শাড়ির এলোমেলো আঁচল মেঝে হিঁচড়ে যায়। তোহার সেদিকে খেয়াল নেই। একরাশ ব্যাকুলতা নিয়ে ছুটে গেল সে। বাবার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে একটু থামল। জাবিদ সাহেব বিছানায় থম মেরে বসে আছেন। উনার দৃষ্টি দেয়ালে নিবদ্ধ। তোহা বার কয়েক শ্বাস নিল। কান্নাও আসছে আবার খুশিও লাগছে। বাবা কখনো তোহার সাথে উঁচুগলায় কথা বলেনি। কখনো একফোঁটাও বিরক্ত হোন নি তার উপর। কখনো বকা দেন নি৷ সবসময় বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন। তোহা জানে বাবা তাকে কখনো ফিরিয়ে দিতে পারবেনা। মা না বুঝলেও বাবা ঠিক বুঝবে। তোহা মুখে হাসির ঝলক ফুটিয়ে যেই না ঘরে প্রবেশ করতে যাবে ওমনি জাবিদ সাহেব ভারী কণ্ঠে বললেন,
” দাঁড়াও।”
তোহা মেঝেতে পা দিতে নিয়েও দিল না। একপায়ে দুইসেকেন্ড দাড়িয়ে থেকে পা সরিয়ে নিল। মুখ কিছুটা মলিন হয়। বাবা তো কখনো তোহাকে তুমি করে বলে না। তাহলে আজ হঠাৎ কেন? জাবিদ সাহেব আগের চেয়েও ভারী গলায় শব্দ করলেন,
” এই মুখ নিয়ে আর কখনো আমার সামনে আসবে না। যদি আসো তাহলে আমার যেন মরা মুখ দেখো।”
তোহার মাথাটা ফাঁকা হয়ে যায়। মগজে টনটন ব্যথা অনুভব হয়। বুকের বামপাশে চিনচিন করে। একটা তিক্ত যন্ত্রণা সারা বুকজুড়ে প্রবাহিত হয়ে গলায় এসে আটকে যায়। চোখ ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসে। তোহা হাউমাউ করে কেঁদে প্রশ্ন করল,
” বাবা তুমি কি আমার একটা কথাও শুনবে না?”
জাবিদ সাহেব উঠে এসে ধরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। দরজার পিঠের সাথে লেগে তোহা নাকে-মুখে ব্যথা পায়। ‘ আহ’ টাইপ শব্দ করে উঠে। তারপর লাগামহীন কান্না শুরু করল। এর চেয়ে যদি বাবা মৃত্যুদন্ড দিতো তাও এতো কষ্ট লাগতো না। আমীর পুরো ঘটনা দেখল। তারপর তোহার কাছে এসে ওর মাথাটা বুকে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” থাক, কাঁদে না।”
চলবে