না_চাইলেও_তুমি_আমার
পর্বঃ ০৩
জাহান আরা
চা নাশতার পর্ব শেষ করে সবাই বসে গল্প করছে।নিশান আর রাত্রি ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে রাত্রির খোলা চুল উড়ছে।
ছাদে উঠার পরমুহূর্তেই নিশান টান দিয়ে রাত্রির চুলের গাজরা খুলে ফেলেছে।
লজ্জায় রাঙা হয়ে রাত্রি তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। কেনো যেনো আর তাকাতে পারছে না নিশানের মুখের দিকে।
মৌনতা ভেঙে নিশান প্রথম কথা বলে,”কেমন আছো রাত্রি?”
“জ্বি ভালো আছি”
“আমি কেমন আছি তা তো জিজ্ঞেস করলে না”
রাত্রি আরো বেশি লজ্জা পেয়ে যায়।
“আমাকে তোমার পছন্দ হয়, রাত্রি?”
“জানি না”
“বিয়ে শুধু একদিনের ব্যাপার না রাত্রি, সারাজীবনের জন্য।সারাজীবন তুমি আমার সাথে এক ছাদের নিচে থাকবে,পছন্দ অপছন্দ যাই হোক আমাকে বলো রাত্রি”
রাত্রি মাথা নিঁচু করে রইলো।
“তোমার মৌনতা কি আমি সম্মতির লক্ষন বলে ধরে নিতে পারি?”
রাত্রি কথা না বলে মাথা উপর নিচ করে।
“আলহামদুলিল্লাহ,এই দিনটির জন্য আমি কতোদিন অপেক্ষা করে ছিলাম রাত্রি তুমি জানো না।নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে খাঁটি করে তুলেছি শুধু আমিরের সামনে নিজেকে যোগ্য করে তোলার জন্য,তোমাকে চাইতে আসলে যেনো আমার যোগ্যতা নেই বলে ফিরিয়ে দিতে না পারে কেউ।”
রাত্রি অবাক হয়ে তাকায় নিশানের দিকে।নিশানের কথা অবিশ্বাস্য লাগছে রাত্রির কাছে।কি বলছে নিশান এসব?
রাত্রির চোখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে দেখে নিশান আবার বলে,”তোমাকে প্রথম দেখেছি আজ থেকে ৮ বছর আগে,তখন তুমি আরো ছোট ছিলে,প্রথম যেদিন আমি এই বাসায় আসি আমিরের কাছে,দরজা তুমি খুলে দিলে,দরজা খুলেই আমাকে জিজ্ঞেস করলে,কে আপনি?
প্রথম বারের মতো সেদিনই মনে হয়েছিলো আমার এ যেনো স্বর্গের কোনো অপ্সরা।খোলা চুল,চোখে কাজল,এক চোখের নিচে লেপ্টে ছিলো কিছুটা কাজল।
আমি জবাব দিতে পারি নি,ইচ্ছে করছিলো নিজের হাতে তোমার চোখের লেপটে যাওয়া কাজল মুছে দিই।
পরক্ষণেই ভাবলাম,না শুধু আজকের জন্য না,আজীবন এই চোখের লেপটে যাওয়া কাজল আমি মুছে দিবো,সেই অধিকার আমাকে আদায় করে নিতেই হবে,যতোদিন না নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারবো ততদিন আর তোমার সামনে আসবো না।
সেদিন আমিরের সাথে কথা বলে যে গেলাম আজ ৮ বছর পর ফিরে এলাম। ”
চন্দ্র ছাদে আসে নিশান আর রাত্রি কে ডেকে নেওয়ার জন্য,এসেই একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখতে পায়।
পাঞ্জাবীর পকেট থেকে নিশান চারটি গোলাপ বের করে হাটু গেড়ে রাত্রির সামনে বসে।
চকিতেই চন্দ্রর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে,ফোন নিয়ে ভিডিও করতে শুরু করে।
নিশান অন্য পকেট থেকে চারটি গোলাপ বের করে,আটটি গোলাপ নিয়ে রাত্রিকে বলে,”আজীবন তোমার চোখের লেপটে যাওয়া কাজল মুছার দায়িত্ব কি আমাকে দিবে রাত্রি?”
রাত্রি কিছু না বলে কেঁদে দেয়,এভাবে কেউ কখনো রাত্রিকে প্রপোজ করে নি। জীবনের এই আনন্দের দিক রাত্রির কাছে এতোদিন গোপন ছিলো।
নিশান পকেট থেকে রিং বের করে রাত্রির হাতে পরিয়ে দেয়।
রাত্রি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।নিশান উঠে রাত্রির চোখ মুছে দেয়।
ভিডিও করা শেষ করে চন্দ্র হাসতে হাসতে হাততালি দিয়ে উঠে।
“আরে ছোট গিন্নি ও চলে এসেছে দেখছি!”
“ভাইয়া,আপনি যে এতোটা রোমান্টিক তা কিন্তু দেখে বুঝা যায় না। আমি তো ভাবতাম পুলিশরা আনরোমান্টিক হয়”
রাত্রি লজ্জা পেয়ে দৌড়ে নেমে যায় ছাদ থেকে।
সবাই মিলে এনগেজমেন্টের তারিখ ঠিক করে পরের শুক্রবার। তারপর বিদায় নিয়ে চলে যায় নিশানের পরিবার।
রুমে বসে চন্দ্র রাত্রি কে ভিডিও টা দেখিয়ে বারবার রাগাচ্ছে।লজ্জায় রাত্রি রাঙা হয়ে উঠছে একটু পর পর।
“শুন আপা,দুলাভাই কিন্তু ভালোই রোমান্টিক আছে,তোর কপাল ভীষণ ভালো রে”
“যা তো,বাজে কথা বলবি না”
“ইশশ এখন লজ্জা পাওয়া হচ্ছে ”
রাত্রি কিছু না বলে চুপ করে থাকে।চন্দ্র সুরমা কে ডাক দেয়।
সুরমা রুমে আসতেই ভিডিও প্লে করে সুরমার হাতে দেয় চন্দ্র।সুরমা ভিডিও টা দেখার পর রাত্রিকে আরো বেশি ক্ষেপাতে থাকে।
সুরমার এরকম নির্লজ্জ কথা শুনে রাত্রির কান লাল হয়ে উঠে। ছুটে বের হয়ে যায় রুম থেকে,নিজের রুমে ঢুকে চন্দ্র কে ডেকে বলে,”তোর কাছে আর ঘুমাবোই না আমি যা,খালি বাজে কথা তোদের,ফাজিল”
“আরে ননদিনী,এখনো তো বিয়েই হলো না,এখনই বুঝি অভ্যেস করা শুরু করছো একা থাকার,দুদিন পর তো নিশান ভাইয়ের সাথে থাকা লাগবে। ”
“তুমি বুঝতেছো না ভাবী,আমার সাথে ঘুমালে তো আর রাতে প্রেমালাপ করতে পারবে না,তাই একটা বাহানা দিয়ে চলে গেছে আপা”
দুই ননদ ভাবী হেসে কুটিকুটি হয়।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর দুই বোন দুই রুমে চলে যায়।
রাত্রি গিয়ে শুতেই ফোন বেজে উঠে রাত্রির,নিশানের কল।
শিউরে উঠে রাত্রি নিশানের নাম দেখে।
সন্ধ্যায় চন্দ্র রাত্রির ফোনে নিশানের নাম্বার সেভ করে দিয়েছে।
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কল কেটে যায়,রিসিভ করে না রাত্রি,তাকিয়ে দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে তার।
আবার কল দেয় নিশান,ভয়ে,উত্তেজনায়,আনন্দে বারবার শিউরে উঠে রাত্রি। তারপর কাঁপতে কাঁপতে কল রিসিভ করে কানের সাথে চেপে ধরে হ্যালো বলে।
ওপাশ থেকে নিশানের পুরুষালি গলার স্বর ভেসে আসে। বুকের ভিতর কিসের যেনো কাঁপন শুরু হয় রাত্রির,কেমন যেনো লাগছে তা রাত্রি বুঝতে পারছে না।২৬ বছরের জীবনে এই প্রথম রাত্রি কোনো পুরুষের সাথে কথা বলছে এভাবে,সেই মানুষের সাথে কথা বলছে যে আজীবনের জন্য রাত্রির হতে যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে।
শীত এখনো পড়তে শুরু করে নি তবু রাত্রির মনে হচ্ছে তার ভীষণ শীত লাগছে,কেমন যেনো আনন্দদায়ক ব্যথা হচ্ছে বুকের ভিতর রাত্রি বুঝতে পারছে না।
রুমের জানালা খুলে বসে আছে চন্দ্র,চাঁদনী রাত,রাস্তায় ২-১ জন মানুষ দেখা যাচ্ছে থেকে থেকে।
চাঁদের আলোয় সব স্পষ্ট।
মায়াবী রাতের এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে চন্দ্রর যেমন পুলকিত অনুভব হয়,তেমনি বুকের ভিতর চাপা কষ্ট ও অনুভব হয়।
তার জীবনের সহজ সমীকরণ আজ মেলানো যাচ্ছে না।
★
নিষাদের আজ বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
৭টার পর পলাশ,লিমন,শুভ,ময়ুখ সবাই অফিসে আসে।
পিওনের মুখে নিষাদের অবস্থা শুনে কেউ নিষাদ কে একা রেখে যেতে সাহস পায় না।
সাদেক আলী কে ডাক দেয় ময়ুখ,ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে সাদেক আলী ছুটে আসে। যেনো এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষায় ছিলো একবার ডাক পাওয়ার।
ভালো করে হাত ব্যান্ডেজ করে দেয় সাদেক আলী।নিষাদ কোনো কথা বলে না কারোর সাথে।
কথা বলাই যেনো ভুলে গেছে।
নিষাদের কেবিনে বসে সবাই গল্পগুজব করে,নিষাদ কে হালকা করে তোলার জন্য। কিন্তু নিষাদের নড়চড় নেই।
৯টার দিকে সবাই অফিস থেকে বের হয়,নিষাদকে নিয়ে যায়। সিদ্ধান্ত হয় আজ সবাই পলাশের ফ্ল্যাটে থাকবে,রাতভর মজা করবে।
নিষাদের অফিস থেকে বের হয়ে সবাই রেষ্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকে।
রেষ্টুরেন্টে আড্ডা দিতে দিতে আস্তে আস্তে নিষাদ দুইএকটা কথা বলতে শুরু করে।
আনন্দে বন্ধুদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়।
ফ্রেন্ড সার্কেলে একজন ছ্যাঁকা খেলে পুরো সার্কেল সেই ছ্যাঁকা খাওয়ার অনুভূতি পায়।
১১টার দিকে রেষ্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সবাই পলাশের বাসার উদ্দেশ্যে হাটতে থাকে।
হাটতে হাটতে নিষাদ একটু পিছনে পড়ে যায়। একা হতেই বুকের ভিতর কষ্টরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে আবার।
হাটার গতি কমে যায়।
একটু সামনে বন্ধুরা ও দাঁড়িয়ে যায় নিষাদকে সাথে না দেখে।
নিষাদ এগিয়ে যাওয়ার ইশারা দেয় তাদের,সবাই এগুতে থাকে কান সজাগ রেখে,কিছুক্ষণ পর নিষাদের পায়ের আওয়াজ থেমে যায়। সবাই পিছন ফিরে তাকায় নিষাদের দিকে,নিষাদ রাস্তা পার হয়ে ওপাশে যায় কি বিড়বিড় করতে করতে যেনো।
বন্ধুরা নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে শুনে নিষাদ আস্তে আস্তে বলছে,”কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা,পদনখে পড়ি আছে তার কতোগুলা”
নিষাদের মুখে এই উক্তি শুনে বন্ধুরা মাথা উঁচু করে উপরে তাকায়,মুহূর্তেই সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠে।
শরতের এই রাতে চাঁদের স্নিগ্ধ আলোকে যেনো হার মানাচ্ছে চন্দ্রর রূপ,কি অপরূপ লাগছে চন্দ্রকে!
নিষাদ অবাক হয়।
এই মেয়েটা তার বৌ!
মুহুর্তের জন্য সব ভুলে যায়, সব ব্যথা ভুলে যায় নিষাদ।
হঠাৎ করেই নিচে চিৎকার শুনে চন্দ্র ভয় পেয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে নিষাদের বন্ধুরা নিষাদ কে কাঁধে তুলে নিয়ে হৈহৈ করে নাঁচতেছে।
দৌড়ে রুমে ঢুকে যায় চন্দ্র,নিষাদ কে দেখেতে পাবে তা ভাবনাতেও ছিলো না চন্দ্রর।হঠাৎ করে নিষাদ কে দেখে,ভয়,আনন্দ,লজ্জা,ব্যথা সবই একসাথে চেপে ধরে চন্দ্রকে।
কেনো এসেছে নিষাদ এখানে?
চন্দ্র কে দেখতে?
কেঁপে উঠে চন্দ্র ভয়ে।
চলবে???