#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
পর্বঃ১৭
দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।
দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব ।
বাঁধন-বিহীন সেই, যে বাঁধন অকারণ।
মায়াবন বিহারীনি!…
বরাবরের মত পছন্দের গানটি ঠোটে উচ্চারিত হচ্ছে বিভার। দীর্ঘ বালির স্তরের মাঝে উচ্ছাসিত সমুদ্র! কি অপুরুপ দৃশ্য! সমুদ্রে এখন চঞ্চলা ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। ঢেউ গুলো আস্তে আস্তে সমুদ্রের তীরে এসে আছড়ে পরছে। আর সেই আছড়ে পরা ঢেউ গুলোতে যে যার মত জলকেলিতে ব্যাস্ত। ঢেউ গুলো সব পায়ে এসে ঠেকছে। এমন একটা মুহুর্ত যেন অন্যরকম ভাবনায় মত্ত করছে। জলরাশিগুলোর ছোয়াঁয় কিছুটা শিহরণ বয়েগেল শরীরে। সেসব কিছুকে তোয়াক্কা না করে সমুদ্রের তীরে কিছুটা হেটে যেতে লাগল বিভা। তার পিছন পিছন ফাইয়াজ যে কখন দৌড়ে চলে এলো বুঝতেই পারেনি সে। দৌড়াতে দৌড়াতে বেচারা যেন হাপিঁয়ে উঠেছে।
হাপিঁয়ে উঠা গলায় বলে উঠল –
–” আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে চুপিচুপি চলে এলেন এখানে। এই কাজটা কিন্তু ঠিক করেননি!”
বিভা ভ্রু কুচকে তাকাতেই, ফাইয়াজ বলে উঠল।
-“না মানে আমাকে কিন্তু বলে ছিলেন আপনি আমাকে বন্ধু ভাবেন। বন্ধু হিসেবে কি আমাকে নিয়ে ভাবার দরকার ছিল না? আমাকে ডেকে আনার দরকার ছিল না?”
বিভা ফাইয়াজের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে ফিরে তাকালো। ফাইয়াজৈর হঠাৎ মনে হলো সে তো ভুলেই গিয়েছিল বিভা তাকে বন্ধুত্বের কথা বললে ও এখন ও বিশ্বস্ত বন্ধুর স্থানে জায়গা দেয়নি। হাটতে হাটতে কিছুদূর যেতেই আবার পিছন ফিরে দেখল বিভা সামনে দাড়িয়ে থাকা দম্পতিদের দিকে চেয়ে আছে। যারা নিজেদের মধ্যে খুব সুন্দর সময় কাটাতে ব্যাস্ত। কোলে প্রায় সাত আটমাসের বাচ্চাটাকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে মহিলাটি, পাশেই তাঁর স্বামী তাকে পানিতে ভিজিয়ে দিচ্ছে আছড়ে পরা ঢেউ থেকে। কোলে থাকা বাচ্চাটি খিলখিল করে হেসে দিচ্ছে। বিভা সেই মুহূর্তটা উপভোগ করছে প্রাণ ভরে। ফাইয়াজের ও এতক্ষণে নজর পরল দৃশ্যটি। ফাইয়াজ আবার সামনে এগিয়ে গেল।
বিভার সামনে দাড়িয়ে বলল-
–” খুব সুন্দর একটা পরিবার না? বাবা-মা আর ছোট্ট একটা সদস্য। মনে হয় না আপনার ও এমন একটা পরিবার থাকতো। খুব করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না? মনে হয় না আবার বিশ্বাস করে একজনের বুকে আত্মসমর্পণ করতে?”
–” করতে তো ইচ্ছে হয়, ভিষণ রকম ইচ্ছে হয় তবে সব ইচ্ছেরা যে পূর্ণতা পায় না!”
–” চেষ্টা করলেই হয়। যদি বলি আজ এমন দিনেই আমি আপনার কাছে আপনার সেই ইচ্ছের একটা অংশ হিসেবে নিজেকে চাই। আপনার কাছে আমি আমাকে তুলে ধরতে চাই। আপনার বন্ধু হিসেবে নয়, জীবন সঙ্গী হিসেবে চাই।
বন্ধুত্বের সম্পর্কে সব সময় ভালো যায় না ফাটল ধরে যায়।
কখনও বা সেই সম্পর্ক খুব বেশি বিশ্বস্ততার হয় না।
কিন্তু জীবন সঙ্গীদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকে। একজন একজনের গভীরতায় ডুবে থাকে। হাজারো ঝড় ঝাপটায় সঙ্গীনি বা সঙ্গীর হাত ছাড়তে চায় না সহজে। আমি ও ঠিক তেমন ভাবেই চাই। উত্তরটা আমার চাই বিভাবতী!”
–” পারবেন বিরহ ব্যাথায় জ্বলতে থাকা হৃদয়টাকে প্রশান্তিময় করতে? পারবেন রাতের পর রাত অশ্রুভেজা চোখগুলোকে ঘুমের দেশে নিয়ে যেতে?”
–” অবশ্যই, একবার শুধু হাতটা ধরে দেখুন!”
মনের মাঝে সংকোচটা অনেক আগেই কেটে গিয়েছিল।
সেই সংকোচটা শুধু ভাঙ্গার একটা সময় খুজেঁছিল বিভা।
আজ সেটাও সে দূর করে দিল। অপর দুটো হাতের উপর নিজের হাতটা রেখে দিল। জীবনকে আরেকটা সুযোগ নাহয় দিয়েই দিল। ভুলগুলো শোধরানোর সময় হয়তো হাতে নেই কিন্তু নতুন করে জীবনের নতুন অধ্যায় তো তৈরী করা যায়? বিভার হাত জোড়া খুব শক্ত করে ধরল ফাইয়াজ। অনেক সাধনা করেও অনেকে তাদের পছন্দের মানুষের হাত ধরতে পারেনা। ফাইয়াজের মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি। বিভা ফাইয়াজের মুখের হাসি দেখেই অবাক হলো এতটা খুশী ও কেউ হয়?শুনেছে ছেলেরা সব সময় নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে এবং একান্ত নিজের করেই চায়। তার শরীরে অন্য কারো স্পর্শ ছিল সে সেটা কখনোই মেনে নিবে না। খুব সহজে ফাইয়াজ সেই কঠিন আর কঠোর কথার বাহিরে গিয়ে এত সহজে কি করে মেনে নিল? আর মানলোই বা কিভাবে?
এতটা সহজ আর স্বাভাবিক ভাবে কেউ মেনে নেয়?
বিভা ফাইয়াজের হাত থেকে নিজের হাতটা সরাতে চাইলে ফাইয়াজ বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিল।
দুজনের মধ্যে কিছুটা নিরবতা চলছে। এই নিরবতার অবসান ঘটিয়ে ফাইয়াজ বলে উঠল-
–” জানেন, আমার বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পরেছিল তখন মাকে দেখতাম হাসপাতালের বেডের পাশে বসে তজবী নিয়ে কানের সামনে আয়াত উচ্চারণ করতো আর মাঝে মাঝে ফু ফু দিত। বাবার সেই কঠিন মুহুর্তে ও মা আশাহত হোননি সব সময় তাকে সুস্থ রাখতে ভালো ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ডাক্তারদের প্রতি বিশ্বাসটা শেষ সময় ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি রাত দিন লাগিয়ে বাবার সামনে পরে থাকতেন। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম মায়ের এসব দেখে। মা সব সময় বলতেন বাবার মত এমন ভালোবাসার মানুষ তিনি কখনোই পাবেন না। মায়ের মতে বাবার মনটা ছিল খুব নরম আমার মত নয় একদম নরম আর সরল প্রকৃতির। খুব বেশি ভালোবাসতেন আমার মাকে। মা বলতেন বাবার ভালোবাসাটা ছিল অন্যদের থেকে অনেকটা আলাদা বাবা কখনও মুখ ফুটে হাজার বার নয় কাজ আর কর্মেই ভালোবাসা জিনিসটা শিখিয়ে ছিলেন। যেখানে অন্যরা হয়তো মুখেই ফাকা বুলি ছুড়তেন। বাবা যখন মারা যায় তখন মাকে নানার বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হলো বিয়ের জন্য। পাত্র যখন ঠিক করা হচ্ছিল তখন মা আমাদের বুকে টেনে চিৎকার করে বলেছিলেন –
–” আমাকে বিয়ে দিতে হলে ফাইয়াজের বাবাকেই আবার নিয়ে আসতে হবে! ওর বাবাকে ছাড়া আমি আর অন্য পুরুষকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবো না!
জীবনে যদি কোন পুরুষ আসে তাহলে সেই একমাত্র ভাগ্যবান পুরুষ! দুনিয়া জুড়ে হাজার মানুষ আসবে কিন্তু একজন গভীর থেকে গভীরে আগলে রাখা মানুষ কখনই আসবে না!” বাবার রেখে যাওয়া কন্সট্রাকশন সাইটের সেই কোম্পানি চালিয়ে আজ অবধি মা আমাদের পাশে ছিলেন। তখন থেকেই ভেবেনিলাম যদি কখনও কাউকে নিজের মত করে পাই। যার সঙ্গে নিজের মনের অনুভূতি গুলোকে নিজের মত করে সাজাতে পারি সেই মানুষকেই নিজের জীবনের অংশ করে তুলবো। পেয়েছি ও ঠিক তেমনই একজন ভালোবাসার মানুষ। হয়তো বড্ড দেরী করে, ভুলটা হয়তো অজান্তেই আপনি করে বসেছেন কিন্তু
শোধরানোর কাজটা আমাকেই করতে হবে! কারন আপনার ভুলটা ভুল হলেও আপনাকে পেয়ে হারিয়ে ফেলেটা আমার জীবনের সবছেয়ে বড় ভুল হবে বিভাবতী!
বিভার শরীরে হালকা ঝাকুনি দিয়ে উঠল। ভুল করল সে আর তা শুধরে দিবে আরেকজন? ফাইয়াজ আরেকটু অবাক করে বলল-
–” আপনার প্রতিটা বসন্তে মনে, শিহরণে, ভালো লাগায় কাছে আসায় আমি থাকতে চাই। ঠিক যেমন করে আপনি আপনার ভালোবাসা গুলো সাধারণ মানুষের জন্য জমিয়ে রাখেন আমি শুধু বলবো তার থেকে ও একটু বেশি করে আমায় ভালোবাসুন আর একটু ভরসা রাখুন।”
–” এতটা জটিল করে কেউ কখনও আমার কাছে ভালোবাসা চায়নি!”
–” এতটা গভীর করে আজ অবধি কোন মেয়ের প্রেমে ও পরিনি।
আপনিই প্রথম আপনিই শেষ!
আপনাতেই শ্বাস আপনাতেই বাস!”
–” বাহ! দারুন, এমন কবি কবি ভাব নিয়ে বসলে প্রেসক্রিপশনে ঔষধের বদলে কবিতা লেখা হয়ে যাবে।
লোকে বলবে পাগল ডাক্তার!”
–” আমি পাগল হইতে প্রস্তুত তবুও বিরহে কাঙ্গাল হইতে প্রস্তুত নই। প্রেম বিরহে কাঙ্গালের মত ঘুরঘুর করতে আমি প্রস্তুত নই।”
–” একটু চুপ করুন তো, এত কথা বলতে পারেন আমার জানাই ছিল না। এখানে দাড়িঁয়ে থাকবেন নাকি? ওরা সবাই এইদিকে আসছে। ওদের কথাবার্তা কিন্তু বেশ লাগামহীন।”
–” তাতে কি? প্রেম করবো আর তীর ছুড়লে পালাই পালাই করবো? আমি কি টিনেজার নাকি? আমার একটা ভাব আছে না ডাক্তার বলে কথা একটু রোমান্টিক ডাক্তার হতেই পারি।”
–” দূর আপনাকে নিয়ে আর পারলাম না!”
–” পারা পারির কাজ বাদ দিয়ে বলুন কবে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাবো?”
চলবে।
আশাকরি বুঝতে পেরেছেন গল্প প্রায় শেষের দিকে। এই গল্প শেষ হওয়ার পর কিছুটা বিশ্রাম নিব। আর ভালো লাগেনা এইভাবে গ্যাপ দিয়ে লিখতে যখনই একটু লিখতে বসেছি মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। লেখালেখির ছয়মাস আজ প্রায়। এর মধ্যে এই গল্পেই দুমাস শেষ! অন্যগুলো নিয়মিত লিখলেও, এই গল্পটা অদ্ভুত একটা কারনে একদমই অনিয়মিত ছিল।