মন_পাড়ায়
পর্ব_৪৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
পিছনে ফিরেই থমকে গেল সে। লোকটাকে দেখেই যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
প্রভা এক পা পিছিয়ে গেল সাথে সাথে। মুহূর্তে ভয়ে সে কুঁকড়ে গেল। তার সামনে দাঁড়ানো রাহান। যে তার জীবনে নিয়ে এসেছিলো ভয়ের তুফান। এই লোকটার কারণে আজও সে শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারে না। তার বুকের ভেতর বিশাল অংশ জুড়ে আছে তার করণীয় এর ভয়।
রাহান হেসে বলল,
“আরে এই দেখি আমাদের প্রভা ভাবি। তো কেমন আছেন ভাবি?”
প্রভার শরীরটা ঘিনঘিন করে উঠলো রাহানের কথা শুনেই। সে মাথা নামিয়ে সেখান থেকে যেতে নিলেই রাহান আবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরে ভাবি যাচ্ছেন কেন? এতদিন পর দেখা হলো আর খোঁজ খবর না নিলেই চলে যাবেন? আর একটা প্রশ্ন ছিলো আপনার কাছে, আপনি তখন আপনার পবিত্রতা দেখাতে যেয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দিলেন আর ক’দিন আগে শুনি আপনিই বিনয়ের প্রিয় বন্ধুকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছেন। বুঝলাম না আমার মধ্যে কী কমতি ছিলো?”
রাহান আবার প্রভার দিকে ঝুঁকে বলল,
“আপনি শুধু শুধু সারাজীবনের ভেজালে ফাঁসলেন। আমাকে বললে আমি তো বিয়ে ছাড়াই আপনাকে স্বামীর ভালোবাসা এবং সুখ দুটোই দিতে পারতাম। সাথে আপনার খরচও উঠাতে পারতাম। অবশ্য আপনি চাইলে এখনো চান্স আছে। একরাতের জন্য আসুন আপনার সকল ইচ্ছা পূরণ করে দিব।”
প্রভা ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকালো রাহানের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনার মতো জঘন্য মানুষ আমি সারাজীবনে দেখি নি।”
“আরে আপনার স্বামী আছিল না? সরি আগের স্বামী ওকে দেখেন নি না’কি? আমি আপনার সাথে যা করেছি ও সব জানতো। মারতেও আসছিলো কিন্তু যখন ওর আর নূহার পরকীয়ার কথাটা সবাইকে জানানোর কথাটা বললাম তখনই ওর রূপ পালটে গেল। এত আদবের সাথে কথা বলতে শুরু করলো কী বলব! এত খারাপ তো আমিও না। আমার বউকে কেউ ছুঁলে তো ওইখানে খুন করে ফেলতাম আর বিনয়…..”
সেখানে থেমেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আবার বলল,
“বিশ্বাস করেন আপনি অনেক বড় ভুল করলেন। এর থেকে ভালো আমার কাছেই এসে পরতেন। আরও ভালো ভাবে রাখতাম। অবশ্য বিনয়কে আর কয়টা ধমক দিলেই আপনাকে আমার বিছানাতেও এনে দিয়ে যেত। ড্যাম ইট, তখন এই কথা মাথায়ই আসে নি। অর্ক ভিতরের খোঁজ নেওয়া উচিত তাই না?”
প্রভার দেহের শিরায় শিরায় রাগে জ্বলছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আশেপাশে শুধু অর্কের পরিচিত মানুষ আছে বলে, নাহয় এইখানে কতগুলো থাপ্পড় মারতাম আপনাকে। আপনি মানুষ নামে একটা কলঙ্ক। নিজের স্ত্রীর সম্মানের এত খেয়াল আর অন্য স্ত্রীর সাথে এত জঘন্য ভাষায় কথা বলছেন?”
“আরে ওর জন্য কার খেয়াল আছে? ওর কিছু হলে আমার ইজ্জতে দাগ পরবে তাই খেয়াল রাখতে হয়। আর আমার সম্পত্তিতে কেউ হাত দিবে এইটা আমি হতে দিব না’কি?”
“আমিও কার সাথে কথা বলে নিজের মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছি? সে নিজের স্ত্রীকে তার সম্পত্তি মনে করে? ছিঃ।”
প্রভা সেখান থেকে যেতে নিলেই দেখে অর্ক এসেছে পড়েছে। সে জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি আঁকলো। অর্ক এসে বলল,
“ঠিক আছ তুমি?”
প্রভা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
প্রভার পিছন থেকে রাহান বলল,
“আরে অর্ক কেমন আছিস?”
অর্ক রাহানকে দেখে অনেকটা অবাক হলো। সে জানতো না অভিজিৎ এর অনুষ্ঠানে তার কোনো বন্ধু আসতে পারে। সে খুশি হবে না প্রভার জন্য চিন্তা করবে সে নিজেই বুঝতে পারলো না।
যদি আশেপাশে কোনো কটু কথা প্রভার কানে যায় তাহলে সে কষ্ট পাবে। যা অর্ক মোটেও চায় না।
সে ভেবেছিলো প্রভাকে আগের থেকে চিনে এমন কেউ এইখানে থাকবে না তাই এনেছিল সে প্রভাকে এই অনুষ্ঠানে। কিন্তু রাহানকে দেখে তার মাঝে এক ভয় ঢুকে গেল।
রাহান হেসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ব্রো এতদিন পর দেখা হওয়ায় কী চিনতে পারিস নি না’কি?”
“চিনবো না কেন? কেমন আছিস?”
“এইতো আছি কোনো রকম। ভাবির খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম। বিনয় যাওয়ার পর তো দেখাই হয় নি এইজন্য।”
অর্ককে একটু অস্বস্তিকে ভুলতে দেখা গেল। সে প্রভার দিকে তাকালো। প্রভা রাহানের কথায় কী সমস্যা হয়েছে নাকি এইটা দেখার জন্য। কিন্তু প্রভার মুখের ভঙ্গি তার চিন্তার বহির্ভূত ছিলো। কেমন রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রভা রাহানের দিকে, সাথে কিছুটা ভয় মিশ্রিত। সে বুঝতে পারলো না কিছুই।
রাহান আবারও বলল,
“ব্রো ডোন্ট ওয়ারি। আমি প্রভা ভাবির কথা কাউকে বলব না।”
অর্ক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“তুই এইখানে কীভাবে?”
“আমার বউ অভিজিৎ ভাইয়েরএর দূরের আত্নীয়। আমি তো আসতেই চাই নি। কিন্তু মনে হচ্ছে এসে ভুল করি নি। কী বলেন ভাবি?”
প্রভা ঘৃণ্য দৃষ্টিতেই তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। সে চোখ নামিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেললো। আবার অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে।”
“আমি পানি নিয়ে আসছে।”
“আমিও আপনার সাথে যাই।”
অর্ক রাহানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
“তুই অপেক্ষা কর আমি আসি।”
রাহান মাথা নাড়িয়ে সাই দিলো।
অর্ক প্রভাকে পানি দেওয়ার পর প্রভা তা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। তাকে দেখে অর্ক বলল,
“প্রভা তোমার কিছু হয়েছে?”
চকিতে প্রভা তাকাল অর্কের দিকে। সে মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে প্রথমে না বললেও পরে বলল,
“ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে। আমাকে বাসার জন্য একটা রিকশা করে দিবেন প্লিজ?”
“শরীর খারাপ লাগছে? আগে বলবে না? চলো বাসায় চলো। না একমিনিট দাঁড়াও অভিজিৎকে বলে আসি।”
অর্ক যেতে নিলেই প্রভা তার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“অস্থির হবে না। বেশি কিছু হয় নি। আমাকে শুধু রিকশায় উঠিয়ে দিলেই হবে। অর্ক কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো প্রভার দিকে। বলল,
“বেশি কথা বলবে না প্রভা। রাত কয়টা বাজে দেখেছ? আর যাওয়ার রাস্তাটাও এত সেফ না। আমি তোমাকে কী ভেবে পাঠাব? চুপচাপ এখানে দাঁড়াও আমি অভিজিৎকে বলে আসি।”
প্রভা আর কিছু বলল না। অর্ক অভিজিৎ এর সাথে দেখা করে এলো। তারপর দুইজনে বেরিয়ে পড়লো।
অর্ক জিজ্ঞেস করল,
“এইবার বলো।”
প্রভা জানালার বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। অর্কের কথা শুনে সে চকিতে তাকায় অর্কের দিলে। জিজ্ঞেস করে,
“কী বলব?”
“কী হয়েছে তোমার?”
“বলেছি তো মাথা ব্যাথা একটু।”
“তোমার বাহানা শুনতে চাই নি। জিজ্ঞেস করেছি তোমার মন এত উদাসীন কেন?”
প্রভা বাহিরের দিকে আবার তাকিয়ে বলল,
“এমন কিছু না।”
“প্রভা আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। এইবার বলবে কী হয়েছে?”
প্রভা কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
“আপনি বিশ্বাস করবেন না।”
“তোমার আমার উপর এতটুকুও বিশ্বাস নেই যে আমি তোমায় বিশ্বাস করব কী না? আমি জানি আমি অতীতে অনেক ভুল করেছি তোমায় বুঝতে কিন্তু তখন আমি তোমায় চিনতাম না তাই…….”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই প্রভা বলে উঠে,
“রাহান আমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলো।”
কথাটা শোনার সাথে সাথে গাড়িতে ব্রেক লাগালো অর্ক। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। প্রভা বলল,
“এইটা আজকের না কয়েকবছর আগের ঘটনা। এমনকি আমার দুঃস্বপ্ন ও মানসিক সমস্যার কারও এই এক ঘটনা। আমি জানি না আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন কী’না তবে আপনি জানতে চেয়েছেন দেখে বলছি।”
প্রভা সবটা খুলে বলল অর্ককে। সেদিনের কথাগুলো এবং আজকে সব কথা। বলে চুপ করে বসে রইলো। তার আশা নেই অর্ক তার কথা বিশ্বাস করবে। তবুও তার দায়িত্ব ছিলো তাই সে বলেছে।
অর্ক অনেক সময় চুপ করে ছিলো। সে কিছুই বলল না। শুধু গাড়িটা ঘুরিয়ে হাই স্পিডে চালাতে শুরু করল। প্রভা আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কী করছেন?”
উওর দিলো না অর্ক।
.
.
অন্যদিকে মাহমুদ সাহেববাসায় এসেছেন কতক্ষণ হলো। রোমা বেগম অর্থাৎ সৈকতের মা তাকে চা এনে দিলেন। সৈকতের মা তার পাশে বসে বলল,
“দিন কেমন গেল আপনার?”
“ভালোই। অর্ক ফিরেছে?”
“না একটু আগেই বের হয়েছিলো। কাজ ছিলো?”
“হ্যাঁ, ওর সাথে কথা আছে আমার। বিয়ের পাঁচ মাস হয়ে গেল এখনো দাদা হওয়ার খবরটাও পেলাম না। এতদিন কিছু বলি নি কিন্তু আর কয়দিন? বয়স হচ্ছে আমার দাদা ডাক তো শুনতে ইচ্ছা করে। ওদের সাথে খেলতে ইচ্ছা করে।”
“বিনু আর অদিন তো আপনাকে দাদাই বলে ডাকে।”
মাহমুদ সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রোমারএর দিকে। কঠিন কন্ঠে বলল,
“ওরা আমাদের রক্তের না।”
রোমা বেগম কিছু বলল না। চুপ রইলো। মাহমুদ সাহেবই আবার বলল,
“একটা খুশির খবর এনেছি।”
“কী?”
“ভাদ্রর বিয়ে ঠিক করেছি। শাহাদাত আছে না যে আমার আন্ডারে কাজ করে ওর মেয়ের সাথে। মেয়েটা ঘরে টিউশনি করতে আসে প্রায়। ভাদ্রের সাথে মাঝেমধ্যে খেলে আর খেয়ালও রাখে। আর ভাদ্রও ওর সাথে খেলতে পছন্দ করে তাই….”
রোমা বেগম কথা কেটে বললেন,
“এই খবরটা তাহলে আসলে সত্যি ছিলো?আপনি তো জানেন ভাদ্র স্বাভাবিক না। তাহলে শুধু শুধু মেয়েটার জীবন নষ্ট করছেন কেন?”
কথাটা শুনেই ভড়কে গেলেন মাহমুদ সাহেব। সে উঠে চায়ের কাপটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। উঁচু স্বরে বলল,
“তোমার সাহস তো কম নেই একতো আমার বিরুদ্ধে কথা বলছ আবার আমার ছেলেকে নিয়েও কথা বলছ?”
“না আমি এমন কিছু বলি নি। শুধু বলছি মেয়েটার জীবন নষ্ট হবে। ও অনেক পড়াশোনা করেছে। ওরও কিছু স্বপ্ন আছে। সৈকত ও অর্ক জানলে রাগ করবে ছেলে।”
“আমার ছেলে আর তোমার ছেলে এক না। আমার ছেলের মধ্যে আমার রক্ত আছে তাই নিজের বাবার কথা শুনে, বুঝে ও সম্মান করে। তোমার ছেলের মতো না ও।”
এই কথাটার উপর রোমা বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না। তার সকল কথা এই একটি কথার মাঝেই সমাপ্ত হয়ে যায়।
চলবে……
[সকাল থেকে একটা জার্নিতে ছিলাম। ভীষণ ক্লান্ত তাই যেমন তেমন করে এডিট করে দিয়েছি। তবুও ভুল থাকতে পারে। দিয়ে দিলাম, নাহয় একেবারে কাল দেওয়া লাগতো।]
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-৪৪ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1258251537877756/