মন_পাড়ায় পর্ব_৪৭

মন_পাড়ায়
পর্ব_৪৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

আজ আকাশে মেঘ জমা। কোনো নক্ষত্রের নেই দেখা। সৈকত ছাদের বর্ডারে পা মেলে বসে নিচের দিকে তাকালো। এতক্ষণ সে ওই মেঘভর্তি আকাশটার দিকেই নয়ন গেঁথে রেখেছিলো। ছয়তলা থেকে নিচে দেখে সবকিছুই ভীষণ ক্ষুদ্র লাগছিল। মুহূর্তে পিছন থেকে তার শার্টের কলার ধরে কেউ টান দিলো। সে বুঝতে পারলো না কী হলো? বোঝার আগেই সে নিচের পরে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখে ইকবাল দাঁড়ানো তার সামনে। সে ইকবালের এমন কান্ডে বিস্ময়ে কিছু বলতে নিবে এর আগেই ইকবাল তাকে লাথি মেরে বলল,
“শালারপুত তুই ওইখানে কী করতাসিলি? মরার শখ জাগছে না’কি তোর? এত শখ হইলে আমাকে কইতি আমিই লাথি ঘুষি মেরে মাইরা ফেলতাম তোরে একবারে।”
সৈকত ইকবালের কথার আগা মাথা কিছু বুঝল না।

সৈকত তার মা’কে নিয়ে আজ সোজা ইকবালের বাসায় এসেছে। এত রাতে অন্যকোথাও এর কথা তার মাথাতেও আসে নি। ঘরে এসে তাদের দেখে যেন ঘরে আয়োজন শুরু হয়েছে। যেন রাজা-বাদশা কেউ এসেছে তাদের ঘরে। অথচ সে যখন সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলে তখন তার মনে কালো মেঘ জমেছিলো যে তারা এখন তাদের রাখতেও চাইবে না। আসলে তো তাদের অস্তিত্ব মাহমুদ সাহেব বাদে কিছুই না। যদি তারা তাদের রাখতে না চায় তাহলেও সে বিস্মিত হতো না। শুধু একরাত থাকতে চাইত। পকেটে পাঁচশো ত্রিশ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার পর সে তার মা’কে নিয়ে কোথায় যাবে তা তার মাথায় এলো না। ছোট থেকে মা’য়ের পরিবারের কাওকে সে দেখেও নি যে তাদের কাছে এই মুশকিল সময়ে ছুটে যাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। ইকবালের বাবা একদম আনুগত্যের সুরে বলে,
“বাবা আমি তোমার বাবার বা তোমার পরিবারের যতটা সম্মান করি তার থেকে কোটি কোটি গুণ বেশি সম্মান করি তোমার। তুমি মাহমুদ স্যারের ছেলে থাকা বা না থাকায় আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা তোমাকে কখনো এইজন্য সম্মান বা আদর করি নি যে তুমি মাহমুদ স্যারের ছেলে বরংচ আমরা মাহমুদ সাহেবকে এইজন্য সম্মান করেছি যে তুমি তার ছেলে। টাকা দিয়ে সম্মান কেনা যায় না বাবা। আজ আমার সম্পূর্ণ পরিবার শুরু তোমার জন্য সুখে আছে। তুমি আজ আমাদের বাসায় থাকতে এসেছ এইটা আমাদের ভাগ্য। এইটা তোমার বাসা। তুমি সারাজীবন আমাদের সাথে থাকলেও আমরা তোমার দায় শোধ করতে পারব না।”
তার বাবার সমান একটি মানুষকে এইভাবে বলতে দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলো সৈকত৷ সে কিছু বলে নি আর। ইকবালের মা তার মা’কে আরও বলেন,
“আপা আপনাকে দেখার ইচ্ছা ছিলো আমার। এমন একটা ছেলেকে জন্ম দেওয়ার মতো মা’কে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছিলো আমার। কিন্তু সামর্থের কারণে কখনো দেখা করি নি। আজ আপনারা আমাদের এই ছোট বাসাতে এসেছে এইটা আমাদের অনেক বড় ভাগ্য।”
বলেই এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না তিনি। ইকবালের মআ আর বোন তো এমন তড়িঘড়ি শুরু করে যেন বিয়ে চলছে। সে রান্না করা শুরু করলো বিরিয়ানি, মুরগির মাংস আর কত কী!
এইসব দেখে সৈকত বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে এসে পড়লো। ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো তার। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো তার বড় ভাইয়ের তার কাছে হাত জোর করাটা আরেকবার ঝিনুকের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো। এই দুটো দৃশ্য মনে করতেই যেন বুকের ভেতর ছাড়খার হয়ে যাচ্ছিলো তার। দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল এই অনুভূতিটা সে। কিন্তু পারবে না। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে তার প্রিয় দুটো মানুষের অসহায়তা। তাই একটু বসেছিলো ছাদের কোণে। এখানেও শান্তি নেই। ইকবালের এমন কান্ডে সে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সে উঠে দাঁড়িয়ে দুইহাত থেকে বালু ঝেরে নেয়।

ইকবাল আবারও বলল,
“বল শালা তুই মরতে গিয়েছিলি কোন দুঃখে। এতটুকু কথায় কেউ মরতে যায়? তোর মাথায়ও কেমন করে এলো এই ভাবনা। তোর কিছু হলে আমার, আন্টির আর ঝিনুকের…..”
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বেই কানের নিচে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সৈকত। আর বলে,
“তোকে এত ভবিষ্যতবাণী করতে বলে কে? শুধু শুধু বসে তারা দেখতাসিলাম মরতে যাই নাই। গাঁধার ঘরের গাঁধা। আমাকে কী এত নরম মনে হয় যে সুসাইড করে বসব? রামছাগল একটা।”
বলে আবারও যেয়ে আগের জায়গায় বসলো। তবে এইবার উল্টো ঘুরে।
ইকবালও তার পাশে এসে বসলো। সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তুই যদি কাঁদতে চাস আমার কাঁধ আছে তোর জন্য।”
“সে কাঁধ ধরেই ধাক্কা দিয়ে এইখান থেকে ফালায় দিব তোকে।”
ইকবাল হেসে তার হাত সরিয়ে বলল,
“তুই এত স্বাভাবিক ব্যবহার করছিস অথচ তোর কন্ঠে বিষণ্ণতার আভাস স্পষ্ট পাচ্ছি।”
“আমার জীবন এমন কেন রে? সুখ আসে তবে হাওয়ার মতো। ছুঁয়ে চলে যায়।” আবার ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ আমার অস্তিত্বটাও মিশে গেল? কে আমি? আমার পরিচয়টা কী? যে পরিচয় ছিলো আজ তাও নেই।”
“তুই সৈকত। আর এটাই তোর অস্তিত্ব। এমন নয় যে তুই তোর বাপের নামে জীবন চালিয়েছিস তাই নয় কী? তোকে আশেপাশের লোকেরা মাহমুদ সাহেবের ছেলে বলে চিনে না। সৈকত বলে চিনে।”
“হুঁ।”
“তুই এমন কেন রে? সবাইকে নিয়ে ভাবিস অথচ দিনশেষে তোর প্রাপ্তির সংখ্যাটা সেই শূন্য। যে ভাইটার জন্য তুই এতকিছু করছি। সে আজ তোর মুখের উপর বলে দিলো তুই তার পর। জ্যোতির বাবা না’কি পলিটিক্স -এ? অর্থাৎ তোর পড়া শেষ হওয়ার পর তোর রিপোর্টার বা এডিটর হিসেবে চাকরি পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। তুই আমাকে কখনো বলিস নি কিন্তু আমিও এতটুকু জানি তুই সব ঝুঁকি নিয়ে শুধুমাত্র জ্যোতির সাথে জড়িয়েছিস যেন অর্ক ভাই আর প্রভা ভাবির জীবনটা গুছিয়ে দিতে পারিস কিন্তু এতে তোর ভবিষ্যতে কত বড় ঝুঁকি আসছে তাও তুই জানতি। তুই এইসব বাদ দিয়ে ঝিনুক ভাবির সাথে সংসার করতে পারতি। কিন্তু না তুই উনাদের কথা ভেবেছিস। বিশেষ করে অর্ক ভাইয়ার। তুই যত যা বলিস তুই আর আমি দুইজনে জানিবতুই উনাকে কত ভালোবাসিস। তুই সবাইকে এত ভালোবাসিস। কিন্তু কেন? অবশেষে সে মানুষগুলোই তোকে কষ্ট দেয়।”
“সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে রে। আফসোস করছে। আমি নিশ্চিত কাঁদবেও। আমার ভাই সহজে কারও জন্য কাঁদে না জানিস? কিন্তু আমি তো জানি আজ সে কাঁদবে। তবে বলে ভুল করে নি। এতবছর যে মিথ্যা অন্ধকারে বাঁচছিলাম আজ সে মিথ্যা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলাম।”
ইকবাল কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল নীরাকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে। সে হাঁপিয়ে বলল,
“তোরা এইখানে কীসের প্রেম পিরীতি করোস?”
ইকবাল বলল,
“পিরীত করার মতো তো কাউকে পাই না। তুই এখন আইসোস না, আয় একটু প্রেম করি।”
“শালা লুইচ্চা।”
সৈকত হেসে দিলো দুইজনের কথোপকথন শুনে। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“এখানে কী করিস?”
“এই লুইচ্চা থেকে তোর কাহিনী শুনে আসলাম শুনে ঘর থেকে যেমনে তেমনে পালায়া আসলাম তোকে সান্ত্বনা দিতে।”
“পালিয়ে আসছিস?”
“আরে কইস না। আব্বা আম্মা ঘুমাইছে। ছোট ভাইরে তিনশো টাকা ঘুষ দিয়ে আসলাম। কোক আনছি৷ চল আজ কোক পার্টি করব।”
নীরা কোক দুইজনকে দিয়ে নিযে একটা নিয়ে প্রথম প্রশ্নটা সৈকতের দিকে ছুঁড়ে মারলো,
“তুই আসলে ঝিনুককে তালাক দিবি?”
“হ্যাঁ।” নির্দ্বিধায় উওর দিলো সৈকত।
“তোর মনে হয় তুই বা ঝিনুক কেউ সুখে থাকবি এই সিদ্ধান্তে।”
“ও তো এই সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে নিয়েছে। আমি শুধু সিলটা মেরে আসলাম ওর সিদ্ধান্তে। এটা ওর আর আমার দুইজনের জন্যই ভালো। জীবনে শুধু ভালোবাসাটাই সব না, শান্তিটাই সব। কাউকে তুমি ভালোবাসো তোমার শান্তির জন্য। তার সাথে থেকে তুমি হাজারো কষ্ট পাও, সে কষ্টেও এক শান্তি থাকে। শান্তিটা হলো সে মানুষটা তোমার। যেদিন সে শান্তিটা অশান্তিতে পরিণত হয় তখন সে ভালোবাসাটাও তোমার দম আটকে দেয়ার মতো হয়ে যায়। আর যে অশান্তির সবচেয়ে বড় বিষয়বস্তু হলো অবিশ্বাস। কোনো সম্পর্কে ভালোবাসা না থেকেও যদি বিশ্বাসটুকু থাকে তাহলে তাতেও শান্তি থাকে। আমার দম আটকে আসে ঝিনুকের অবিশ্বাস সহ্য করে। বুকের ভেতরটা শূন্য লাগে। সহ্য হয় না। আর এখন তো আরও আমার জীবনে গ্রহণ করতে পারব না। কোথায় যাব, কী করব, কোথায় থাকব কিছু জানি না। এই অনিশ্চিত জীবনে ওকে জড়িয়ে ওর জীবনটাও অনিশ্চিত করতে চাই না।”

নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি ঝরে পড়ার অবকাশ।
.
.
অর্ক বারান্দার এক কোণায় বসে আছে। নিজেকে নিস্তেজ লাগছে তার। এই নির্জন রাতে আকাশের মেঘগুলোকে দেখছে সে। আজ যেন তার জীবনটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। জীবনে থাকা প্রিয় মানুষগুলোকে যেন নতুন করে চিনতে পারলো সে আজ। এতটা বছর ধরে এক পট্টি লাগিয়ে রেখেছিলো যেন সে চোখে। এত কিছু হয়ে গেল তার জীবনে সে একটি বিষয়ও ধরতে পারলো না? এতটা অধম সে?

তার বাবা স্বীকার করেছে যে সে রোমা বেগমের গায়ে হাত তুলেছেন, তাকে বৈশ্যা পর্যন্ত বলেছেন। আর এতে তার বিন্দু পরিমাণ আফসোস নেই। আর সেই বাবার অন্ধের মতো ভক্ত ছিলো সে। বাবার প্রতিটি কথাই যেন সঠিক এবং তার বিরুদ্ধে সকল কথা বেঠিক। সে বাবার পাশ নিয়ে নিজের ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করলো। এতটা নির্বোধ সে নিজেই জানতো না। নির্বোধই তো, নাহয় তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তার সাথে এমন বেঈমানী করে? তার ফিয়ান্সে এমন বেঈমানী করতে পারতো? সে অন্ধবিশ্বাস করে পারতো তার প্রভাকে এতটা কষ্ট দিতে? এতকিছু চললো তার জীবনে অথচ কিছুই টের পেল না সে? কেমন মানুষ সে?

কাঁধে কারও স্পর্শ পাওয়ায় মুখ তুলে তাকায় অর্ক৷ প্রভার হাতে খাবারের প্লেট দেখতেই সে বলে,
“প্রভা ভালো লাগছে না।”
“এমন করেন না। সন্ধ্যা থেকে কিছু খান নি।”
“তোমার মনে হয় আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে? এত…. এতকিছু হয়ে গেল আজ এক রাতে। আমার এত রাগ কেন প্রভা? দেখো না আমি রাগে তোমার সাথে অন্যায় করলাম আর আজ সৈকতের সাথে।”
অর্ক নিজের দুইগালে পরপর তিনটা থাপ্পড় মেরে বলল,
“রাগে ভাবি না কেন আমি? কেন?”
প্রভা সাথে সাথে হাতের প্লেটটা রেখে অর্কের দুইগালে হাত রেখে বলল,
“যা হয়েছে তা আমরা তো আর পাল্টাতে পারব না। তবে সব ঠিক করার চেষ্টা করতে পারব। তাই না?”
ভেজা অর্কের কন্ঠ,
“কিছু ঠিক হবে না প্রভা। আমি সব নষ্ট করে দিয়েছি।”
প্রভা হাঁটু গেড়ে বসে অর্ককে জড়িয়ে ধরলো। তার মাথাটা কাঁধে রেখে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“পৃথিবীতে সব কিছুর কারণ থাকে একটা। নিশ্চয়ই আজকের দিনেরও বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে সম্ভবত।”
“আমি আমার আপন মানুষদের নতুন চেহেরা দেখলাম আজ আর সৈকত থেকে তার পরিচয়টাই ছিনিয়ে নিলাম। কী কারণ থাকতে পারে এর পিছনে?”
“যে অন্যের প্রতি আপনার ভুল ধারণা ভেঙেছে, সবার সত্য জানতে পেরেছেন। আর কে বলল সৈকতের পরিচয় হারিয়ে গেছে? নিজের পরিচয়টাই আসল পরিচয়। বাপ দাদার পরিচয়ে নিজেকে ঢেকে দিলে তা নিজের হয় না। এই’যে যেমন আপনি নিজে নিজের পরিচয় তৈরি করলেন তেমন সৈকতও করবে। আমার বিশ্বাস, ও শুধু নিজের জন্য না ওর স্বপ্নের জন্যও এক নতুন পরিচয় তৈরি করবে৷ যা ওর সাথে সাথে হাজারো মানুষের পরিচয় হবে।”
অর্ক মাথা তুলে তাকালো। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“স্বপ্ন?”
“সৈকতের স্বপ্ন আছে যে সে অসহায় মানুষদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখাবে এবং একদিন এই সমাজ থেকে অন্যায় শেষ হয়ে যাবে।”
অর্ক গর্বিত ভঙ্গিতে হাসলো আর বলল,
“অনেক বড় হয়ে গেছে আমার ভাইটা।”
প্রভা হেসে অর্কের নাক টেনে বলল,
“আর আপনি ছোট। অদিন খাবারের সময় এভাবে কাঁদে।”
অর্ক সাথে সাথে প্রভার কোমর জড়িয়ে ধরে। খুব কাছে টেনে নিয়ে এক কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“তুমি আজ আমার পাশে না থাকলে বোধহয় আমি নিশ্বাস বন্ধ করে মারাই যেতাম প্রভা।”
কথাটা শুনতেই প্রভার বুক কেঁপে উঠলো। এই কথাটা যে সে ভাবতেও পারে না।
প্রভা আর কিছু বলল না।
অর্ক অন্যহাত দিয়ে প্রভার হাতটা শক্ত করে ধরলো। যেন একটু ছাড় দিলেই পালিয়ে যাবে তার প্রভা নামক পাখিটা।
ঝুম বৃষ্টির আগমন ঘটল। ভিজিয়ে দিলো বারান্দার দুতো নর-নারীকে৷ অথচ তারা কেউ-ই নড়লো না।
.
.
এক সাপ্তাহ পর,
প্রভা তার মা’কে কল দিলো। ঝিনুককে সে বাসায় পাঠানোর চিন্তা আছে তার৷ ঝিনুক আজকাল তার রুম থেকেও বের হয় না তেমন। না ভার্সিটিতে যায়, না ঠিক মতো খায়। রাতে ওর রুমে যেয়ে উঁকি মারলো যেমন দেখে বসে আছে তেমন ফজরের নামাজেরও পরও দেখে জেগে আছে। কথা বলতে গেলে কথাও বলে না মেয়েটা। সংসারটা করতে না চেয়েও কখন যে ভালোবাসার মায়াজালে ফেঁসে গেল হয়তো নিজেই জানে না মেয়েটা।

অন্যদিকে সৈকতকে কত না বুঝালো প্রভা। কত দোহাই দিলো। তবুও সে এলো না। আর প্রভার মনের মধ্যে এই দুশ্চিন্তাও ভর করল যে সে আর আসবে না। কোনোমতেই আসবে না। কিন্তু অর্ককে এই কথা বলা যাবে না, নাহয় আরও অপরাধবোধ হবে তার। ভেতর দিয়ে আরও ভেঙে পরবে। এতকিছুর মধ্যে প্রভা অর্ককে জিজ্ঞেসও করে নি রাহানের কথাটা। বিনয় তার সাথে এইজন্য বিয়ে করেছে কারণ অর্ক ভালোবাসতো তাকে? কীভাবে? প্রশ্নটা সরাসরি না করতে পারায় বুকের ভেতর খুঁতখুঁত লেগেই আছে।

মা কল ধরতে সময় নিলো। কিন্তু কল ধরার সাথে সাথেই বলল,
“তোকেই কল দিতাম প্রভা।”
“কী হয়েছে মা?”
“আগে তুই বল। তুই কেন কল দিলি?”
“মা, ঝিনুককে ক’দিনের জন্য তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেই? কেমন যেন হয়ে গেছে, না কথা বলে থেকে মতো আর না……”
মা প্রভাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমিও এইজন্য কল দিয়েছিলাম। সৈকত আমাদের কল দিয়ে সব জানাল। আর ডিভোর্সের কথাও বলল।”
“ডিভোর্স!” আঁতকে উঠা কন্ঠে বলল প্রভা।
“হ্যাঁ ডিভোর্স। পরিশ তো আমায় বলেছিলো যে সৈকতের চরিত্র ভালো না। এখন দেখি ওর মা’য়েরও চরিত্রে দাগ আছে। গাছে বিষ ভরা তার ফল কী অমৃত হবে?”
“মা প্লিজ এ-সব বলো না। আমরা এখনো সম্পূর্ণ কাহিনী জানি না।”
“সে যাই হোক। ব্যাপারটা খারাপ হয় নি। সৈকতের তালাকের পর-ই আমি ঝিনুক ও পরিশের বিয়ের ব্যবস্থা করব।”
এইবার বিস্ময়ের শেষ সীমানায় প্রভা। আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে সে বলল,
“মা তুমি কী বলছে নিজে বুঝতে পারছ? ঝিনুক আমাদের বোন।”
“আপন বোন তো না। রক্তের সম্পর্ক তো নেই পরিশের সাথে। তাহলে আর কী? দেখ প্রভা তোর আর তোর বাবার কারণে আমার দুইটা বাচ্চার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। ঝিনুকের গায়ে এখন ডিভোর্সির সিল লেগে যাবে আর পরিশ নেশায় জড়িয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে। আমি মানা করেছিলাম আগেই ঝিনুকের বিয়ে না দিতে। আমার কথা শুনে কে?”
“ভাইয়া নেশায় জড়িয়েছে?”
মা’য়ের গলাটা ভিজে গেল। বলল,
“গভীর রাতে বাসায় ফিরে, সকালে উঠলেই দেখি চোখ লাল ও ফোলা। কেমন বিদঘুটে আচরণ করে বুঝাতে পারব না। ওইদিন ওর রুম পরিষ্কার করতে যেয়ে তিনটা মদের বোতল আর কয়টা প্যাকেট পেয়েছি। সাদা রঙের লবণের মতো কিছু।”
এ-সব শুনেই যেন মাথাটা ঝিম মেরে উঠে প্রভার।তার আপন সবার সাথে এই কী হচ্ছে?
সে বহু কষ্টে বলল,
“মা আমি আপাতত রাখি। আর সইতে পারছি না।”
“তুই শুনেই এই অবস্থা আর আমি নিজের চোখে নিজের ছেলেকে মরতে দেখি দিনদিন আমার কী অবস্থা হয় ভাব এবার৷ আর ঝিনুকের জন্য আগে তাও হাজারো সম্পর্ক আসতো কিন্তু তালাকের পর আর আসবে না ভালো সম্পর্ক। কে করবে ওকে বিয়ে? এর থেকে পরিশ ভালো না?”
প্রভা আর কথা শুনলো না। কলটা কেটে দিলো। তার মনে হচ্ছে তার দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। জীবনে কী এক মুহূর্তের জন্যও সুখটা অনুভব করতে পারবে না সে? অর্ককে জীবনে পেয়েও সে প্রাপ্তির সুখটুকু সে পাচ্ছে না।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৪৬ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1261139677588942/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here