রহস্যের কুয়াশা☠️ পর্ব–৪

রহস্যের কুয়াশা☠️
পর্ব–৪
#হাফসা ইরিন রাথি
মিলি আর ইহান পানি নিয়ে অনেকক্ষন খেলা করে এখন ওরা দ্বীপে বালি নিয়ে দুজনে আকাবুকি করছে আর খেলছে।মিলি বালি দিয়ে একটা দুর্গের বা বিল্ডিংএর মতো তৈরি করছে। ইহানও একটা কি একটা মসজিদ বানাচ্ছে। ইহান একটু পানি নিলো সমুদ্র থেকে বালি ভিজিয়ে নিতে যাতে করে বানাতে সুবিধা হয়।কিন্তু পানি ভুলক্রমে পড়ে গেলো মিলির তৈরি করতে থাকা বিল্ডিংটার গায়ে,আর যা হবার তাই হলো!বালির বিল্ডিং ধ্বসে গেলো!!
মিলি ক্রুর দৃষ্টিতে ইহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আমার এতো সুন্দর বিল্ডিংটা তুমি ভেঙ্গে দিলা??

–না আসলে……আমি তো ইচ্ছে করে….

–এ্যা……

–রিদ আমি ঠিক করে দিচ্ছি। তুমি এতো কান্নাকাটি করো কেনো সবসময়??
কিন্তু মিলি ইহানের কোনো কোথায় কর্ণপাত না করে কেদেই চলেছে। ইহান একটা মৃদু ধমক দিলো।
–চুপ,একদম কান্না করবা না।মাইর দিবো কিন্তু।
মিলি চুপ করে বসে আছে গাল ফুলিয়ে।আর ইহান মিলির তৈরি করা বিল্ডিংটা আবারো আগের মতো করে বানানোর চেষ্টা করছে।বানানো শেষ হতেই খুশি মনে মিলির দিকে তাকালো।কিন্তু একি!মাত্র একটু সময়ের ব্যবধানে ইহান মিলির দিকে তাকাতেই দেখলো মিলি ঘুমে ঢুলছে মাথাটা আরেকটু হলেই পড়ে যাবে বালিতে। ইহাণ নিজের হাতটা তরীগডি করে মিলির মাথার নিচে ধরলো যাতে ও পড়ে না যায়।সারাদিন এতো ধকলের পর একটা ৪.৫ বছরের বাচ্চা যে ৯/১০ টায় ঘুমিয়ে যাবে এটা আর আজব কি তাছাড়া প্রকৃতিটা এতটাই শান্ত আর মনোরম যে,যেকেউ ঘুমে তলিয়ে যেতে বাধ্য!
ইহান নিজের সব চিন্তার ইতি টেনে মিলিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।কিন্তু এখন এইখানে তো আর সারারাত মিলিকে রেখে কষ্ট দিতে পারেনা।কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করতে করতে অবশেষে ঠিক করলো একটা রিসোর্টে বা হোটেলে নিয়ে গেলেই হয়।মিলিকে একটা হোটেলের রুমে নিয়ে গেলো ইহান।এই রুমটা এখনো ভাড়া হয় নি তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই।বাহিরে থেকে বন্ধ আছে রুমটা। ইহান মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে,মিলির অবশ্য সেসবে খেয়াল নেই,ও আছে ঘুমের রাজ্যে।
মিলিকে একটা বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশে শুয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো ইহান।ও নিজের ঘুমন্ত রীদকে দেখছে আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এর চেয়ে শান্তির কোনো মুহূর্ত হতেই পারে হয়ত!যদিও প্রতিদিনই মিলিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ইহান নিজেই কিন্তু আজ একটু অন্যরকম লাগছে।লাগবে নাই বা কেনো?কতদিন পর আবার ঘুরতে বেরোলো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে, তাও আবার এই পরীর মতো বেশে!আগে মিলির ছোট থাকা অবস্থায় ওকে ইহান নিয়ে যেতো ঠিকই কিন্তু তখন তো মিলি কিছুই বুঝতে না শুধুই হাসতো আর হাসতো খিলখিল করে।ওর ফুকলা দাঁতের হাসি অবশ্য দেখার মতোই ছিল কিন্তু এখন আরো বেশি ভালো হয়েছে ও কথা বলতে পারায়।মিলি একা কান্না করতো যখন রাতে তখন ওকে নিয়ে কতো জায়গায়ই না ঘুরেছে ইহান ওর কান্না থামানোর জন্য!
মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওর ছোটবেলার কথাগুলো ভাবছে আর হাসি পাচ্ছে ইহানের।
••••••••••|||||||||••••••••••••
–”তোমার মেয়ের যদি ভালো চাও তাহলে আর হুজুরের স্মরনাপন্ন হইয়ো না।আর হ্যাঁ নামাজ,নামাজ কখনো বস দিও না।তোমার মেয়ে যেখানেই আছে ভালো আছে,কিন্তু খবরদার হুজুরের কাছে নিও না।নিজের মনকে মানাও যে ওকে নিয়ে আর ঐখানে যাবে না তাহলেই ওকে ফিরে পাবে।”

–দাড়ান দাড়ান যাবেন না।আমার মেয়ে!মিলি!
মালিহা বেগম ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো।এটা কি দেখলো উনি?মিলিকে নিয়ে এই পর্যন্ত যত স্বপ্ন দেখেছে সব সত্যি হয়েছে তাই এটাও যে একটা সতর্কবার্তা তা খুব ভালোই বুঝতে পারলেন উনি।মাঝরাতে স্ত্রীর কান্নার শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো জারিফ সাহেবের।
–কি হলো মালিহা??তুমি কাদছো কেনো?

–জজারিফ, আআমার মেয়ে!

–প্লিজ শান্ত হও আমরা কাল সকালেই হুজুরের কাছে যাবো।সব…

–না না কিছুতেই না।কিছুতেই যাবো না আমি হুজুরের কাছে।আমার মেয়ের ক্ষতি হবে।প্লিজ জারিফ যাবো না,প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও আমার মেয়েদের নিয়ে।

–কি হইছে তোমার মালিহা?প্লিজ এমন করিও না।কি হইছে আমায় খুলে না বললে আমি কিভাবে বুঝবো।

–আ্ আমি আবারো সেরকম স্বপ্ন দেখেছি জারিফ।একটা লোকের কোলে আমার মেয়ে ছিল।লোকটার চেহারা আমি এইবারও দেখতে পারিনি।লোকটা বলছিলো যাতে করে আমি হুজুরের কাছে না যাই,গেলে আমার মেয়ের ক্ষতি হয়ে যাবে।আর নামাজের কথাও বলেছে।যদি ওর কথা মানি তাহলে নাকি আমাদের মেয়ে ফিরে আসবে খুব শীগ্রই।
জারিফ যা লাগে করো তবুও আমার মেয়েকে আমার কাছে এনে দাও।
কাদতে কাদতে কথাগুলো বললেন মালিহা বেগম। জারিফ সাহেব উনাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু উনার চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।কি হচ্ছে,কি করণীয় তার কিছুই বুঝতে পারছেন না।স্ত্রীকে শান্ত করতে বললেন,
–তুমি কেদো না,আমরা যাবো না ঐখানে।চিন্তা করিও না।সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আপন মনে ভাবলেন কিভাবে হবে ঠিক???
•••••••||||||||||••••••••
সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাড়িতে যাবে বলে বলে বায়না ধরেছে মিলি। ইহান বুঝে না মিলি কেনো এতটা পাল্টে যায়।কখনো বাড়িতে যেতে চায় না তো কখনো যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়।মন খারাপ করে ভাবলো,
–”নিশ্চয়ই আমার রীদকে মানুষ রোগে পেয়েছে!!!”

–ইহান চলো না বাসায় যাই।আমি বাসায় যাবো। এ্যাঁ……

–রীদ কি শুরু করলে বলোতো??তোমার কি খেলনা লাগবে বলো,আমি এনে দিবো।অনেকগুলো এনে দিবো।প্লিজ কান্না করিও না।

–আমরা একবার বাসায় যাই চলো।আমি তুমি আর মিতু মিলে খেলা করবো।চলো না।
ইহান মনে মনে ভাবলো হয়ত ওর বাবা মা ওকে নিয়ে আর যাবে না হুজুরের কাছে,তাছাড়া রীদের কান্না দেখতে ওর ভালোও লাগছে না খুব কষ্ট হচ্ছে তাই বাসায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলো।বাসায় যাবার পর কোনো সমস্যা হলে সেটা পরে দেখা যাবে।
–আচ্ছা আর কাদিও না।চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি।আমি আর কখনো খেলবো না তোমার সাথে।তুমি আর মিতুই খেলিও।
চলো।
মিলি একগাল হেসে বললো,
–আমি জানি তুমি খেলবে আমার সাথে।

–কচু জানো।
নিজেই নিজের কাছে বিরক্ত হলো ইহান।সত্যিই তো প্রতিবারই রাগ করে বলে আসবে না,খেলবে না,চলে যাবে কিন্তু আবার ঠিকই চলে আসে।মাঝে মাঝেই মনে হয়,
–আচ্ছা রিদ কিভাবে পারে এমনভাবে ভুলে যেতে??
মিলি আর কিছু না বলে হাসছে ইহানের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে। ইহান মিলিকে চোখ বন্ধ করতে বললো মন খারাপ করে।মিলি জানে একটু পরেই ওর মন ভালো হয়ে যাবে,আবারো খেলবে,হাসবে তাই মন খারাপটাকে পাত্তা না দিয়েই চোখ বন্ধ করে ইহানের হাতটা ধরলো।চোখ খুলে দেখলো নিজের বিছানায় শুয়ে আছে মিতুর পাশে!বাবা মা গেলো কই??উকিঝুকি মেরে বেড রুম থেকে বের হতেই দেখলো ডাইনিং রুমে সোফায় মা বাবা চিন্তিত হয়ে বসে আছে।মিলি দৌড়ে ওদের কাছে গেলো হাসি মুখে।ওকে দেখে উনারা দুজনেই খুব খুশি আর অবাক হলেন কারণ আগেও এমন হয়েছে কিন্তু বাসায় নিজে থেকে এভাবে কখনো ফিরে আসেনি মিলি,যদিও তখন ছোট ছিল।
মালিহা বেগম মিলিকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললেন,
–কোথায় ছিলি মা তুই?কেনো এমনটা করিস বল?
মিলি ভাবলো কেমন করি আমি?? হাসি মুখে বললো,
–আমি তো ঘুরতে গিয়েছিলাম মা। ইহান আমায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরিয়েছে,সাঁতার শিখিয়েছে।অনেক অনেক মজা হয়েছে।
ইহান নামটা আরো অনেক শুনেছেন উনারা দুজনেই তাই আর অবাক হলো না।উনারা ভেবে পায় না যে কে এই ইহান?আর কেনোই বা মিলিকে নিয়ে যায় কিন্তু কোনো ক্ষতি করে না উল্টে ওর সাথে খেলা করে,ওকে খুশি রাখে!!!
–চলো এখনই আমরা হুজুরের কাছে যাবো।এর একটা বিহিত করতেই হবে।
মালিহা বেগম চমকে গিয়ে আতঙ্কিত গলায় বললেন,
–না না না কিছুতেই না।কিছুতেই আমরা আর ঐখানে যাবো না।ঐখানে গেলে আমার মেয়ের ক্ষতি হবে।

–কিন্তু এভাবে আর কতদিন মালিহা??
তার চেয়ে আমাদের একবার হুজুরের….
উনাকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়েই মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে বেড রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন মালিহা বেগম।জারিফ সাহেব অনেক ডাকাডাকি করেও লাভ না হওয়ায় তিনি হতাশা আর বিরক্তি নিয়ে আগেই অফিসের পথে পাড়ি জমালেন।উনি বুঝতে পারছেন না মালিহা কি করতে চাইছে।
মিলি আসা অব্দি এখনো ইহানকে দেখেনি। ইহান ওকে এখানে রেখেই চলে গেছে।মিলির উপর খুব রাগ হওয়ায়।মিলিকে নিয়ে মালিহা বেগম বিছানায় নিজের সামনে বসালেন।পাশেই ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট মিতু।মিলি আশেপাশে তাকিয়ে ইহানকে খুঁজছে।
–মিলি….
হঠাৎ এভাবে ডাক পড়ায় চমকে উঠলো মিলি।সামনে ওর মা বসে আছে অথচ ওর খেয়ালই নেই।মিলির মা এতক্ষণ ও কি করছিলো তা ভালো করে নিরীক্ষণ করছিলো।
–তুমি খুজছো মিলি??

–ইহান, ইহানকে খুঁজছি মা।

–কে এই ইহান??তোমার মনের ভুল সব, ইহান বলতে কেউ নেই মিলি।এই বাড়িতে আমি,তুমি,মিতু আর তোমার বাবা ছাড়া কেউ থাকেনা।

–না মা তুমি জানো না। ইহান আছে। ইহান খুব ভালো।ও আমার সাথে খেলে।

–কেমন দেখতে সে??

–ইহান খুব মিষ্টি দেখতে।জানো মা ইহান আমার চেয়ে একটু বড় হবে,কিন্তু সে এটা মানতেই চায় না।হা হা হা।
এইবার আবার আরেক চিন্তায় পড়লেন মালিহা বেগম।কারণ এতদিন ভাবতো এই ইহান হয়ত বড় কেউ যাকে উনি স্বপ্নে দেখেন কিন্তু মিলির ভাষ্যমতে ইহান ওর সমবয়শী!!
–মিলি তুমি আর কখনো ইহানের সাথে কোথাও যাবে না।মা বাবাকে ছেড়ে কেনো যাও বলোতো??আমাদের বুঝি কষ্ট হয় না?
মিলি চুপ করে মায়ের বাহুতে আটকে রইলো,ছাড়ানোর কোনো চেষ্টাই করলো না। ইহানকে ছাড়া যে ওর দিন কাটেনা, ইহানকে ছাড়া যে খেলা জমে না, ইহান যে ওর জন্মসূত্রে পাওয়া একজন সেটা কিভাবে অস্বীকার করবে?কিভাবে মাকে বুঝাবে?ও ছোটো বলেই হয়ত বুঝাতে পারছে না,কিন্তু চিন্তাগুলো মাথায় কিভাবে আসছে সেটাও বুঝা যাচ্ছ না।জন্মের পর থেকেই প্রতিটি কাজে এমনভাবে ইহান জড়িয়ে গেছে যে ওকে ছাড়া সব ফাঁকা,শূন্য,অসম্ভব হয়ে পড়ে।ওর সাহায্য ছাড়া কোনো কাজই সম্পূন্ন হয় না!!!
চলবে কি?
(অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এতো ছোটো বাচ্চা কিভাবে এমন করে ভাবতে পারে??তাদের জন্য বলছি এই গল্পটা মাত্রই শুরু হলো,মিলির এমন বড়দের মতো চিন্তা করা এটারও একটা রহস্য আছে যা গল্পের মাধ্যমেই জানতে পারবেন।
কারো কোনো অভিযোগ যদি থেকে থাকে আমার বা আমার লিখা সম্পর্কে তাহলে ভদ্রভাবে তা আমায় অবগত করবেন।কেউ বাজে কমেন্ট করবেন না প্লিজ,খারাপ লাগে খুব।
হ্যাপি রিডিং)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here