রহস্যের_কুয়াশা☠️ পর্ব_১৬

রহস্যের_কুয়াশা☠️
পর্ব_১৬
#হাফসা_ইরিন_রাথি
সেইদিনের পর থেকে প্রতিদিনই পাগলের বেশে তন্ময়ীর পাড়ে ইহান বসে থাকতো শুধু একটিবার রাজকন্যা রিদ,খাদিজাতুল রিদকে দেখার জন্য। ইহানের কাছে রিদ একটা অন্যরকম নেশা হয়ে যায় একসময়,একটা অভ্যাসে পরিনত হয় রিদ। ইহান এই রিদ নামক নেশা বা অভ্যাসে পড়ে গিয়ে ওর বাবার কথা ভুলেই গিয়েছিল।আসলে জ্বীনরাজ্য একটা একক রাজ্য কিন্তু রাজা সেলিয়াস,আহাম সহ আরো কিছু লোক বিদ্রোহ করে রাজ্য থেকে চলে গিয়ে রাজ্যের কিছু অংশ অধিকার করে তাতেই স্থায়ীভাবে থাকতে আরম্ভ করে আর স্বাধীনতা ঘোষণা করে।তাদের দলে অনেক রাজ কর্মচারী ও পরামর্শদাতা রাও যোগ দেয় ধীরে ধীরে।আর এভাবেই ইহান একজন রাজপুত্র হিসেবে বেড়ে উঠেছিল আর নিজেকে রাজপুত্রই জেনেছিল।রাজা সোলাইমান ছিলেন অনেক ধৈর্যশীল আর শান্ত স্বভাবের লোক।তিনি কোনো সিদ্ধান্ত খুব বিচক্ষণতার সাথে নিতেন।আর এর প্রমাণ হলো ছেলেদের সিংহাসনে না বসিয়ে তার সুযোগ্য কন্যা খাদিজাতুল রিদকে সিংহাসনে বসানো।আসলে রাজার ২ পুত্রই ছিল রাজা হওয়ার অযোগ্য।কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন নি তার পুত্রদের সুশিক্ষারও অভাব রয়েছে।তাদের রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কারণে তারা খুবই ক্ষেপে যায় এবং বিদ্রোহীদের দলে ভিড়ে যায়।রাজা খুবই হতাশ হলেন আর দুঃখ পেলেন ছেলেদের এই কাজে।তার পুত্ররা ছড়াতে থাকে যে রাজামশাই ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছেন,তার মধ্যে অপরাধ আর পাপাচার বাসা বেঁধেছে কারণ তিনি ইসলামী বিধান না মেনে সিংহাসন শুধুমাত্র তার কন্যার নামেই দিয়েছেন।আসলে রাজা মশাই চাইছিলেন এই দুর্যোগের মুহূর্তটা যাতে রাজকন্যা রিদ তার বিচক্ষণ হাতে সামলিয়ে নেয় আর দুর্যোগ শেষ হলেই তিনি সবার মাঝে ভাগ করে দিতেন শাসনভার।কিন্তু তার পুত্ররা তার কথাকে মিথ্যে ছল ভেবে রাজ্য ছেড়ে দেয় এবং অলিভার আর আহামের দলে যোগ দেয়।রাজকন্যার বয়স তখন ছিল ১৭,তার ভাইরা তার থেকে বয়সে যদিও বড় ছিল কিন্তু ছিল দুটোই অপদার্থ।এভাবেই চলতে থাকে আর আস্তে আস্তে রাজ্যের অনেকে রাজপুত্রদের কথায় বিশ্বাস করে রাজার বিশ্বস্ততা ত্যাগ করে।কিন্তু তবু রাজকন্যা ছিল রাজ্যের রত্ন স্বরূপ,তিনি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার রাজ্যের প্রতি হওয়া আক্রমনগুলো বেশ বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলের মাধ্যমে দৃঢ় হাতে প্রতিহত করেন।
ইহান,ওয়াহেদুল ইহান ছিল আহামের একমাত্র পুত্র।আহাম ছেলেবেলা থেকেই তার পুত্রকে সব সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল তাই ইহান কেবলমাত্র তার বাবাকেই বিশ্বাস করতো।কিন্তু যখন রিদের উপর সে নজর রাখার জন্য আসে তখন সে আস্তে আস্তে রিদের প্রেমে ডুবে যেতে থাকে, ইহানের ভালোবাসা ওকে মানসিকভাবে এতটাই শক্তিশালী করতে পেরেছিল যে ও চোখ বন্ধ করেই রিদকে বিশ্বাস করতে পারতো যেনো রিদ যা করছে সব ঠিক,সব কল্যাণকর।এদিকে রাজা আহাম প্রতীক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যায় অথচ পুত্রের কাছ থেকে কোনো সংবাদ পান না।সে শুধু বলে আরেকটু সময় চাই।তাই তিনি একটা চর পাঠিয়ে রাজপুত্রের খবর নিতে শুরু করলেন।
রাজকন্যা ইতিমধ্যে বুঝে গেছে যে এই লোকটা পাগল না কেবলমাত্র ভান করে থাকে পাগলের,ছদ্মবেশী।রাজপুত্রকে রাজপ্রাসাদে ধরে আনা হয়।এবং সে জানায় যে সে রাজা আহামের পুত্র।রাজপুত্রের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়,তাকে আটকে রাখা হয় কিন্তু এতকিছুও তার কাছে তুচ্ছ মনে হতো যখন রাজকন্যা দিনশেষে একবার কয়েদখানায় এসে তার সম্মক্ষিন হতো,তার কাছ থেকে গোপন তথ্য বের করতে।কিন্তু কোনো লাভ হতো না কারণ ইহান সত্যিই ওর বাবার বিদ্রোহের ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল।রাজকন্যা ওকে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করে করেও ব্যার্থ হচ্ছিলেন, ইহান কিছু তো বলতই না উল্টে শুধু তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসতো।রাজকন্যা ভেবে কুল পেতো না যে কিভাবে এতো চাবুক মারার পরেও একটা ছেলে এভাবে প্রেমময় হাসতে পারে!কিন্তু সে কিছুই না বলে গম্ভীর মুখে চলে যেতো।
চর আহামকে খবর দেয় যে রাজপুত্র এতদিনে কিছুই করেনি শুধু বসে থেকে রাজকন্যাকে দেখে গেছে পাগল সেজে।রাজকন্যা তাকে বন্ধী করেছে এবং সে এখন কয়েদে আছে।আহাম এই কথা শুনে খুব চিন্তিত ও রেগে গেলেন।তিনি রাজপুত্রকে ছাড়ানোর ব্যাবস্থা করলেন রাজপ্রাসাদের একজন বিশ্বস্ত চরের মাধ্যমে যে কিনা রাজপ্রাসাদে থেকে সব ধরনের খবর দেয় ওদের।আর সেই চর আর কেউ ছিল না,ছিল বৃদ্ধ সেনাপতির পুত্র সাঈদ। সাঈদ রাতের অন্ধকারে রাজপুত্রকে পালাতে বললেন আর সব ব্যাবস্থা সে করে দিবে সেটাও বললো কিন্তু ইহান যেতে চাইলো না।কারণ এখানে থেকে সে প্রতিদিন রাজকন্যাকে দেখতে পেতো কিন্তু চলে গেলে আর সেটা সম্ভব না। সাঈদ ওকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে পালাতে রাজি করলো। সাঈদ বললো,
–আপনি না গেলে আপনার বাবা এই রাজ্য আক্রমণ করবেন,তখন নিশ্চয়ই রাজকন্যার অনেক সমস্যায় পড়তে হবে,আপনি কি সেটাই চান?
ইহান তখন বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যায়।সেদিন রাতেই সে নিজের রাজ্যের উদ্দেশে রওনা হলো।কিন্তু সেখানে গিয়ে সে এতো বড় সমস্যা সম্মক্ষীন হতে হবে সেটা ভাবতে পারে নি।সেদিন ইহান প্রথম বুঝতে পারলো যে ওর বাবা নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ছেলের জীবনকে অনিশ্চিতের দিকে ঠেলে দিতেও রাজি। ইহান ভেবেছিলো বাবাকে নিজের ভালোবাসার কথা জানালে তিনি ওই রাজ্যের সাথে শত্রুতা পরিহার করবেন আর এখন সে তার বাবার সম্পর্কে শোনা সব কিছুকে বিশ্বাস করতে লাগলো যেমন তিনি শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য নির্বিচারে অনেক জ্বীন মারছেন। ইহান সেখানে গিয়ে জানতে পারলো পরেরদিনই রাজা সেলিয়াসের কন্যা সাফিয়ার সাথে ওর বিয়ে হবে,বিয়ের সব বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে। ইহান তার ছোটবেলার দুই প্রাণপ্রিয় বন্ধু রিমাদ ও রোজার সাহায্যে রাজ্য থেকে পালায়,সাথে করে বন্ধুদেরও নিয়ে যায়। রিমাদ ছিল সেনাপতির পুত্র আর রোজা ছিল মন্ত্রীর কন্যা।
আবারো ওরা চলে এলো রিদ এর রাজ্যে।কিন্তু বিপত্তি যা হবার ছিল তাই হলো।রাজকন্যা কিছুতেই বিশ্বাস করছিলো না ওদের কথাবার্তা।কিন্তু ইহান যখন ওকে দস্তখত করে দিলো সে এই রাজ্যের বিরুদ্ধাচরণ কখনো করবে না উল্টে সাহায্য করবে তখন সে একটু বিশ্বাস করলো এবং ইহানের কথা অনুযায়ী সেনাপতির পুত্রকে হত্যা করা হলো,কারণ রিদেরও সাঈদকে সন্দেহ হতো। ইহান, রিমাদ আর রোজাকে কয়েদঃখানায় না রেখে অতিথিশালায় রাখা হলো কারণ ওরা রাজ্যের উপকার করেছে আর আশ্রয়প্রার্থী ছিল। রিদের পেছনে সারাক্ষণই লেগে থাকতো ইহান।এতে রিদ বিরক্ত হয়ে ওকে বললো আর এমন করলে প্রাসাদ থেকে বের করে দেবে। ইহান এর পর থেকে প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো ওকে।একদিন ভরা পূর্ণিমার রাতে ইহান রিদের রুমে গেলো।
–তুমি এই সময় আমার কক্ষে?কোনো বিশেষ প্রয়োজন?

–আমার সাথে তন্ময়ীর পাড়ে যাবে?
রিদ ওর কথা শুনে সন্দেহের দৃষ্টিতে ব্রু কুচকে তাকালো দেখে ইহান তাড়াতাড়ি করে হেসে বললো,
–না না তোমার কোনো ক্ষতি করতে আমি চেষ্টা করবো না।তুমি সাথে রক্ষী নিয়ে নাও,কোনো সমস্যা নেই।
রাজকন্যা সাথে করে ৫ জন দেহ রক্ষী নিয়ে তন্ময়ীতে গেলো ইহানের সাথে কারন তার নিজেরও বোরিং লাগছিলো প্রাসাদে একা একা।
–তুমি এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে ভাবিনি।

–আমারও একগুয়ে লাগছিলো,নাহলে আসতাম না।

–কেনো?তোমার কি কোন বন্ধু নেই নাকি?

–উহুম…..
রাজকন্যা খুব ছোট ছোট করে ইহানের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলো কিন্তু তবুও ইহান দমবার পাত্র নয় সে প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল।একটু একটু করে অনেক কথা হলো দুজনের মাঝে।চাঁদের আলোয় রিদের সৌন্দর্য আরো শতগুণে বেড়ে গিয়েছিল আর তার উজ্জ্বল সোনালী চুল গুলো চাঁদের আলোয় ঝলঝল করছিলো। সেদিন ইহানের প্রতি রিদের বিশ্বাস আরো একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল।এভাবে তাদের মধ্যে একটা অলিখিত বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রিদ নিজের জীবনে যেনো একটা নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছিলো ধীরে ধীরে।আগে তার জীবনে বন্ধুত্ব,ভালোবাসা বলতে তেমন কিছুই ছিল না।কিন্তু ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা দিনদিন সে পেতে থাকে। রিমাদ আর রোজার সাথেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় আর ওরা সবাই সমবয়সিই ছিল।
ইহানের সাথে প্রতি চাঁদনী রাতেই রিদ আকাশের ছায়াতলে চাঁদের স্পর্শে কাটাতো কিন্তু এখন আর রক্ষীর প্রয়োজন মনে করতো না।ধীরে ধীরে রিদ ইহানের উপর দূর্বল হয়ে পড়লো কিন্তু তাদের এই ভালোবাসার কোনো মৌখিক প্রকাশ ছিল না,কিন্তু মনে মনে দুজনই দুজনকে ভালোবাসতো। ইহান প্রতিদিন তন্ময়ীর পাড়ের সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে একগুচ্ছ ফুল এনে রিদ এর চুলে গুজে দিতো।
এভাবেই সব ভালো চলছিল কিন্তু ভালো শুধু উপরকার রূপ ছিল প্রকৃতপক্ষে আহাম আর সেলিয়াস নতুন পরিকল্পনা করছিল।রাজকন্যা রিদ যদিও ইহানের উপর পূর্ণ বিশ্বাস করতো কিন্তু তার বাবা রাজা সোলাইমান ইহাকে বিশ্বাস করতে পারতো না।
প্রায় ২ মাস যাবৎ ইহান, রিমাদ আর রোজা জ্বীনরাজ্যে আছে কিন্তু কোনো আক্রমণ বা বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা গেলো না কিন্তু রাজকন্যা বুঝতে পেরেছিল কোনো এক বড় ঝড় আসতে চলেছে ওদের উপর।
দিনটা ছিল মঙ্গলবার। সেদিনটাও অন্যান্য দিনের মতোই রৌদ্রোজ্জ্বল ছিল কিন্তু এমন একটা ঝকঝকে দিনেই হঠাৎ খবর এলো রাজ্যের পশ্চিম–পূর্ব দিক থেকে রাজা আহাম আর রাজা সেলিয়াসের প্রায় ৩০০০০ হাজার সৈন্য আক্রমণ আর লুটতরাজ করতে করতে আসছে।তারা নাকি সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করছে,তলোয়ারের এককোপে অগণিত দুর্বল,অসহায় জ্বিনদের প্রান গেছে জানতে পেরে রাজকন্যার কোমল হৃদয় কেপে উঠলো,সে খুব রেগে গিয়ে রাজ্যের সব সৈন্যদের নিয়ে রওনা হলো রাজ্যের পশ্চিম দিকে।ওদের সৈন্য ছিল মাত্র ১০০০০ হাজারের মতো।ওদের সাথে রিমাদ, ইহান আর রোজাও যোগ দিলো।রাজা সোলাইমান কন্যাকে একাকী ডেকে পরামর্শ দিলেন ওদের উপর নির্ভর না করতে,বিশ্বাস না করতে।কিন্তু রাজকন্যা পিতার এমন কথার কোনো জবাব না দিয়ে যুদ্ধের পথে পা বাড়ালো।কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যা দেখলো তাতে তার মানসিক ভারসাম্য অনেকাংশে হারিয়ে ফেললো।পুরো প্রান্তর জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ,রক্ত আর রক্তে লাল পানির মতো ভেসে যাচ্ছে যুদ্ধ প্রান্তর।এর আগে রাজকন্যা অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও এতো মৃত্যু আর রক্তারক্তি সে দেখেনি। জ্বীনদের ইতিহাসে এমন রক্তারক্তি আর ঘটে নি।এটা ছিল জ্বীন ইতিহাসের একটা অত্যন্ত জঘন্য আর কলঙ্কিত অধ্যায়!

চলবে”””
(পরের পর্বেই শেষ হবে গল্পটা।কালকেই দিয়ে দিবো পরের পর্ব।
কেমন লাগলো জানাবেন,খারাপ লাগলেও।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here