অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-২১

0
643

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ২১

শাওন ততক্ষণে নাস্তা নিয়ে এসেছে। আমাকে হা করে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
“কিরে কি দেখছিস?”

আমি অস্ফুট স্বরে রাফিনকে দেখিয়ে বললাম,
“কে ওটা?”
“ফাইয়াজ। ক্যান তোর পছন্দ?”

আমি উপর-নীচ মাথা নাড়ালাম। পরক্ষণেই আবার ডানে-বায়ে।
আমার অবস্থা দেখে শাওন বললো, “কি সমস্যা তোর? আয় খেতে আয় তো। নাস্তা তো সব ঠান্ডা হয়ে গেল।”

আমি ওর কথায় কান না দিয়ে রাফিনকে ফোন দিলাম। আর তাকিয়ে রইলাম উঠানের দিকে। দেখলাম রাফিন বিরক্ত হয়ে একপাশে এসে ফোন রিসিভ করলো। একপাশে আসতে গিয়ে ও আমার জানালার একটু কাছেই এসে পড়েছে। ওর কথা আমি দু’বার করে শুনছি। রিয়েল ভয়েসটাও শোনা যাচ্ছে আবার ফোনেরটাও। আমি একটু পিছিয়ে এলাম।

ও হড়বড় করে বলে গেল,
“কি হয়েছে? একটু আগে না চ্যাট করলাম? এজন্যই আমার বিরক্ত লাগে। চ্যাট করলেও গেইমস খেলার টাইমে ফোন দেওয়া লাগবে।”

“গেইমস খেলছো?”
“খেলবো একটু পর।”
“মাঝে তো ডিস্টার্ব করিনি।”
“আচ্ছা কি বলবে বলো?”
“কি করছো?”
“ধুরর! মেজাজটা খারাপ হয় না? বললামই তো গেইমস খেলবো।”
“কোথায় খেলবে?”
“তোমার মাথায়।”
“রেগে উত্তর না দিয়ে শান্তভাবে জবাব দিয়ে দাও। আমি এক্ষুনি ফোন রেখে দিবো৷ অত টাইম নেই আমার৷ রাগ দেখাবা না একদম।”

তখনই একটা বাচ্চা ওকে ডাক দিলো। “এই ভাইয়া, আসো না গেইমস দেখবো।”

“উফ কি বলবা বলো তো? বাচ্চাগুলো সব ডাকছে আমাকে।”
“বাচ্চা? বাচ্চা কই থেকে এলো?”
“আরে আমার গেইমস খেলা দেখবে বলে বাচ্চাগুলো সব উঠোনে চেয়ার পেতে বসেছে। ওরা ওয়েট করছে। এখন বৃষ্টি নামলে আর খেলা দেখা হবে না ওদের।”

“ওহ অকে অকে যাও। স্যরি লেইট করিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“ইট’স অকে।”

ফোন রাখতেই শাওন বললো, “এটা কি হলো?”
আমি ইশারায় বাইরে দেখিয়ে বললাম, “রাফিন।”
“ফাইয়াজ না ও?” অবাক হলো শাওন।
“ফাইয়াজ রাফিন।”
”ওওপস! আমার এত কাছে ছিল অথচ কোনোদিন টেরই পেলাম না। তুই কোত্থেকে ওকে পেয়ে গেলি?”

আমি মুচকি হাসলাম শুধু। নাস্তাগুলো জানালার পাশে নিয়ে এসে খেতে খেতে দেখতে লাগলাম ওরা কি করে। শাওন বললো, “এতদিন ধরে ওকে দেখছি কখনো তেমনভাবে খেয়াল করা হয়নি। ছেলেটা অনেক সুন্দর।”

আমি কড়া চোখে তাকালাম ওর দিকে। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। শাওন খেতে খেতে বললো, “এমনিই বললাম।”

জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। রাফিন মনোযোগ দিয়ে পাবজি খেলছে। সবাই চেয়ার পেতে বসেছে। উৎসুক বেশ কয়েক জোড়া চোখ চারকোণার মোবাইলটায় নিবদ্ধ। মানুষ কোপাকুপির এই খেলায় কি মজা আছে ওরাই বেশ ভালো জানে।
বেশ আয়েশ করেই গেইমস খেলছিলো আর উপভোগ করছিলো ওরা। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই ঝুম বৃষ্টি নামে। সবাই হুড়মুড়িয়ে চেয়ার টেনে দাওয়ায় তুলে দিয়ে যে যার বাসায় ছুট লাগায়। রাফিন কিছুক্ষণ হতাশ দৃষ্টিতে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর মোবাইল রেখে চেয়ারগুলো টেনে টেনে ভেতরে ঢোকালো। সবশেষে একটা মোড়া নিয়ে এসে দাওয়ায় বসলো। ওদের বাড়ি পুরোটা পাকা হলেও সামনের বারান্দার কিছু অংশে টিনের ছাউনি দেওয়া। সে-ই ছাউনি দেওয়া জায়গাটাই আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হলো। বৃষ্টির দিনে অনায়াসে এখানে বসে সময় কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

রাফিনের সামনে টিনের চালে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে। ঝুম বৃষ্টি। ও দাওয়ায় বসে অনেকক্ষণ উদাসীন হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো টিনের চাল থেকে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো। এরপর হঠাৎ ডাক দিলো, “ভুউতুউউউ” বলে।

তখন থেকে কিছুক্ষণ পর পর হাঁক ছাড়তে থাকলো, “ভুউতুউউ” বলে।

মাগরিবের আযান হয়৷ রাফিন ঘরে ঢুকে। আমিও নামাজ সেরে ফেলি৷ কিছুক্ষণ পর ও আবার এসে বসে দাওয়ায়। তখনও অন্ধকার হয়নি। নাকীব আমাকে নিতে আসে আমার দেরী দেখে। আমার তো বিকেলেই চলে যাওয়ার কথা ছিল। বৃষ্টির জন্য হোক বা রাফিনের জন্য আমি আটকে গেছি। আমি তৈরী হয়ে নিলাম জানালায় চোখ রেখেই। অজ্ঞাত কারণবশত আমার যেতে ইচ্ছে করছে না রাফিনকে ছেড়ে। ওর সাধারণ চালচলন, সাধারণ জীবন দেখতে ইচ্ছে করছে লুকিয়ে। তবুও যেতে হলো আমাকে। কে জানতো এটাই ওর সাথে আমার শেষ দেখা হবে?

রাতে রাফিন টেক্সট করে জানায়, একটা কথা আছে। জবাবে আমিও পাঠাই,
“কথা আছে, কথা আছে করছো, বলছো তো না।”
“আচ্ছা পরে বলবো।”

‘ধ্যাৎ’ বলে ফোনটা বালিশে ছুঁড়ে মেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। এরপর একসপ্তাহ ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হলো না। ইনফ্যাক্ট, আমি কোনো চেষ্টাই করলাম না যোগাযোগ করার৷ অবাক হয়ে দেখলাম, আমার তেমন খারাপ লাগছে না ওর সাথে কথা না বলে থাকতে। প্রথমে দুদিন বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। তৃতীয় দিন থেকে সবটা কেমন স্বাভাবিক হয়ে গেল। নিজেকে আরও স্বাভাবিক রাখতে ইসলামিক বইয়ের ভেতর নিজেকে সপে দিলাম।

ছোটফুফি চলে গিয়েছেন ইতিমধ্যেই। আমিও নামাজ-দোআ পড়ার চেষ্টা করছি। ইদানীং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে তাহাজ্জুদও পড়ার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন উঠতে না পারলেও সপ্তাহে তিনদিন অন্তত নামাজ পড়ি। কিন্তু আমার মন বলছে, এই নামাজ আমার ঠিকঠাক হচ্ছে না৷ আমি কিছুতেই পূর্ণ মনোযোগে নামাজ পড়তে পারি না। নামাজ পড়তে পড়তে কখন যে আমি রাফিনের ভাবনায় ডুবে যাই নিজেও জানি না। শত চেষ্টা করেও নামাজে কিছুতেই মন ফেরাতে পারছি না। আমার মনে হতে লাগলো আমার পিঠের ওপর বিশাল একটা বোঝা রয়ে গেছে। হারাম রিলেশনশিপের বোঝা। এই বোঝা যতক্ষণ নামাতে পারবো না ততক্ষণ আমি আল্লাহর প্রতিও মনোযোগী হতে পারবো না, নামাজের প্রতিও না। এদিকে মাত্র কয়েকদিন পর থেকে রোজা শুরু হবে। রোজার আগেই সব দায় মিটিয়ে ফেলা উচিত৷ সব হারামের সমাপ্তি ঘটানো উচিত। এবারের রমজান হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রমজান।

অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, আজই সব শেষ হবে। তার আগে রাফিন কি বলতে চায় সেটা শুনবো আমি। সন্ধ্যায় ওকে টেক্সট করলাম,
“তোমার নাকি কি বলার ছিল?”

দু’ঘন্টা পর রিপ্লাই এলো, “পরে বলবো।”
“আজকে বললে হয় না?”
“আচ্ছা আজকেই বলবো।”
“কখন?”
“রাতে।”
“টাইমটা বলো?”
“বারোটা বা একটার দিকে।”
“ওকে।”

রাত ঠিক বারোটায় রাফিন আমাকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে প্রথম কথাটা বললো ও এভাবে,
“মানে কিছু না এমনিতেই।”
“এমনিতেই?”

“তোমার কি মনে আছে, যেদিন তোমার বারান্দায় বসে সারারাত তোমার সাথে কথা বললাম সেই রাতে আসার সময় আমি বলেছিলাম, তোমায় একটা কথা বলবো। তবে এখন না। যেদিন তুমি নিজেকে সামলাতে পারবে, নিজেকে শক্ত করতে পারবে, আমাকে ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারবে বলে মনোবল তৈরী হবে তোমার মনে সেদিন আমি কথাটা বলবো। মনে আছে?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে। আজ তাহলে কথাটা বলো?” দৃঢ়তার সাথে বললাম।
“আজই কথাটা বলার সময়৷ কারণ আমার মনে হচ্ছে আজ তুমি প্রস্তুত সবধরনের ধাক্কা মোকাবিলা করতে। এম আই রাইট মিস আরোহী?”
“এবসোলিউটলি।” গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বললাম।

“হ্যাঁ, বলছি তাহলে। মানে আমি কিছুদিন এই লাইফ থেকে সরে স্টাডি লাইফে ফিরে যাচ্ছি। ”
“আচ্ছা।”
“টু ইয়ার্স।”
“দুই মাস?”
“টু ইয়ার্স মানে ২ মাস?”
“টু ইয়ার্স?” খানিকটা জোরেই বললাম। প্রথমে ওর কথাটা বুঝতে পারিনি। পরে বুঝতে পেরে বেশ অবাক হলাম।
“হুম।”
“ভালো তো। কখন যাচ্ছো?”
“দেখি মাস দুয়েকের মধ্যে।”

আমার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। রাফিন চলে যাবে সেই কষ্টে না, আমার কান্না পাচ্ছে আনন্দে। দোয়া কবুল হওয়ার আনন্দে। মাত্র গতরাতেই তাহাজ্জুদে আমি দোআ করেছি আল্লাহ যেন ভালো কোনোকিছুতে রাফিনকে ব্যস্ত করে দেন। অন্তত এই পাবজিময় লাইফ থেকে ও বের হয়ে যাক৷ জাস্ট দু’বছরের জন্য হলেও চলবে৷ ওর নেশাটা কেটে যাক এটুকুই চেয়েছি আমি। অক্ষরে অক্ষরে আমার দোয়া কবুল করে নিয়েছেন আল্লাহ, আমার প্রিয় রব।

আমি বললাম, “বিশ্বাস করবে তুমি? আমি ঠিক এরকম কিছুই চাইছিলাম আল্লাহর কাছে৷ বারবার বলছিলাম, তুমি যেন কল করে এমনই কোনো একটা খবর দাও আমাকে। আল্লাহ যেন তোমাকে ভালো কোনো কাজে আটকে দেন।”
“যাক! তোমার দোআ কবুল হলো।”
“হু একদম অক্ষরে অক্ষরে।”
“স্টাডি শেষে বাবার বিজনেসে জয়েন করার ইচ্ছে আছে।”
“দ্যাট’স গ্রেট। কত ভালো ভালো নিউজ তুমি এতদিন আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলে?”
“আমি ভেবেছিলাম আমার চলে যাওয়াটা তুমি মেনে নিতে পারবে না।”
“কেন পারবো না? যদি তোমার উন্নতি হয় আমি আটকাবো কেন?”
”ওখানে কিন্তু ফোন এলাউড না বুঝেছো? মানে টু ইয়ার্স আমাকে ফোন ছাড়া থাকতে হবে। শুধু বাড়ি এলেই ফোন ধরতে পারবো। অনেক কষ্ট হয়ে যাবে আমার।”

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here