অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-২৯

0
476

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ২৯

নাকীব ফিরে আসে মাথা নাড়তে নাড়তে। জাফর কিংবা অন্যকেউ লাল শার্ট পরিহিত কাউকেই পায়নি ও। কাশবনে গিয়ে বাচ্চারা রীতিমতো লাফালাফি শুরু করে দিলো। আমি ও নাকীব ওদেরকে চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে সেই বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালাম যেখানে আমি ও রাফিন বহুবার একসাথে বসেছি। ওখানে এসেই নাকীব বাদে সবাই হুড়মুড় করে বেঞ্চে বসে পড়লো। আবির বললো,
“এইখানে প্রেমিক-প্রেমিকারা বসে।”
“হ্যাঁ আমরা সিনেমাতে দেখছিলাম।”
“ঐ যে একবার.. কুলসুম আপা, নাম কি ছিল যেন?”
“আমার খেয়াল নেই।”

আমি একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলাম আর চারপাশে দেখছিলাম। এ কয়দিনে অনেক কিছু বদলে গেছে। বৃষ্টির কারণে চারপাশটা একটু স্যাঁতস্যাতে হয়ে আছে। তাকাতে তাকাতে হঠাৎ বইয়ের মতো কি যেন দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। খয়েরী রঙের শক্ত মোটা মলাটের একটা ডায়েরি। ডায়েরিটা তুলে পৃষ্ঠা উল্টালাম। কয়েকটা পৃষ্ঠা কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম কর্দমাক্ত পৃষ্ঠাগুলোয় কোনো লেখা নেই। প্রায় শ’খানেক কাগজে লেখা আছে। সেগুলো রেখে কর্দমাক্ত কাগজগুলো ছিঁড়ে ডায়েরিটা নিয়ে নিলাম। বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও মোটা ও শক্ত কভার থাকায় পেইজগুলো ভিজে যায়নি। কাশবনে ঘোরাঘুরি শেষে বাসায় এসে শুকোতে দিলাম। কেন ডায়েরিটা নিয়েছি, কেনই বা শুকোতে দিয়েছি নিজেই জানি না। তবে ইচ্ছে করছিলো ডায়েরিটা পড়তে।

কাশবন থেকে ফেরার পর থেকে নাকীবের শরীর খারাপ হতে থাকলো। জ্বরের সাথে মাথা ব্যাথা, কাশি, হাঁচি এবং কফ লেগে একাকার অবস্থা। আজ সকাল থেকে আবার পাতলা পায়খানাও শুরু হয়েছে। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দ্রুত। বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করালো ওকে। ভর্তি করাতে করাতে ওর স্ট্রং ডায়রিয়া শুরু হয়ে গেল। ওর অবস্থা দেখে ডায়েরির কথাও বেমালুম ভুলে গেলাম আমি।

দীর্ঘ পাঁচদিন হসপিটালাইজড থাকার পর ওর শরীরে কিঞ্চিৎ শক্তি ফিরতে শুরু করে। সন্ধ্যায় ওর পাশে গিয়ে বললাম,
“কিরে কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো।”
“আলহামদুলিল্লাহ বল।”
“আলহামদুলিল্লাহ।” দূর্বল গলায় বললো ও।
“কাশবনে গিয়ে এখন কে অসুখে পড়লো আমি না তুই? আমার তো মনে হয় আমার চেয়ে তুই বেশি স্মৃতিকাতর রাফিনকে নিয়ে।”
নাকীব আহত দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।
“মজা নিও না।”
আমি আরও মজা নিলাম। হে হে করে হেসে বললাম,
“আজকে কয়বার গিয়েছিস বাথরুমে?”
“আপু?”
মাহফুজ এলো স্যুপ নিয়ে। ও নাকীবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে। নাকীবকে স্যুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে পাশে বসলো।

“কয়েকদিন পর তোর পরীক্ষা আর এখনো হসপিটালে বসে আছিস?”
“ইচ্ছে করে বসে আছি নাকি? আজব!”
“দেখি আজকের মধ্যে সুস্থ হয়ে যা, কাল বাড়ি যাবি। আমি উঠছি এখন।” আমি বাসায় চলে এলাম।

এরপর প্রায় দু’বছর কেটে গেল। নাকীবের এইচএসসি পরীক্ষাও শেষ ততদিনে। আমার পড়ালেখা প্রায় শেষের দিকে। ব্যবসাও দাঁড়িয়েছে বেশ৷ ব্যবসায় এখন নাকীবও যুক্ত হয়েছে। আমরা ব্যবসার পাশাপাশি কুলসুম, মাহফুজ, আবরার, ঝিলিদের পড়াই। নাকীব ছেলেদেরকে আর আমি মেয়েদেরকে পড়াই। মাহফুজরা এখন বড় হচ্ছে তাই ওদের সামনে খুব একটা যাই না আমি। ওরাও আসে না মেয়েদের সামনে। এতদিনের দ্বীনি শিক্ষা খুব কাজে দিচ্ছে। ঝিলি প্রায়ই দাদুর সাথে থাকে। গল্প শুনে অবসর সময় কাটায়। এদিকে আমাদের অবসর সময়ই নেই। ইদানীং খুব ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে ও নাকীবকে। তবে শত ব্যস্ততার ফাঁকেও আমি আমার ইবাদত ছাড়িনি। বরং আরও কিছু যোগ করেছি। যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং তাহাজ্জুদ ছাড়াও এখন ইশরাক ও সালাতুত দোহার নামাজও আমি ছাড়ি না। সালাতুত দোহাকে বাংলায় চাশতের নামাজ বলা হয়। এই নামাজের ফজিলত যেদিন থেকে আমি জেনেছি সেদিন থেকে একদিনও বাদ দেইনি।
হযরত আয়েশা (রা.) চাশতের নামাজ আট রাকাত পড়তেন এবং বলতেন, ‘যদি আমার মা-বাবাও কবর থেকে উঠে চলে আসেন, তাহলেও আমি তা ছাড়ব না।’ [১]

মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, “দৈনিক ভোরে প্রতিটি মানুষ (তার শরীরের) প্রত্যেক জোড়ার পক্ষ থেকে সদকা করা উচিত। প্রত্যেক ‘সুবহানাল্লাহ’ সদকা, প্রত্যেক ‘আলহামদুলিল্লাহ’ সদকা, প্রত্যেক ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সদকা ও প্রত্যেক ‘আল্লাহু আকবার’ সদকা। আর সৎ কাজের আদেশ করা সদকা ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা সদকা। চাশতের দুই রাকাত পড়ে নেওয়া তার পক্ষ থেকে (অর্থাৎ প্রত্যেক জোড়ার সদকার জন্য) যথেষ্ট।’’ [২]

অন্য হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চাশতের দুই রাকাতের প্রতি যত্নবান হলো, তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমপরিমাণ হয়।’ [৩]

মহানবী (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চাশতের বারো রাকাত নামাজ আদায় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি স্বর্ণের ঘর নির্মাণ করবেন।’ [৪]

এই এত এত গুরুত্ব দেখে আমি নিজেকে নামাজটা পড়া হতে বিরত রাখতে পারিনি। যোগ দিয়েছি নিয়মিত এই নামাজে। আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার মতো আমিও অটল, দুনিয়া উল্টে গেলেও যদি নামাজ পড়ার সুযোগ থাকে তাহলে এই নামাজ আমি ছাড়বো না। আমার দেখাদেখি নাকীবও নফল নামাজগুলো পড়তে শুরু করেছে।
দিনের তৃতীয়াংশে যখন দুনিয়াবি ব্যস্ততা আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে ঠিক তখনই এই নামাজের সময় শুরু হয়। তাই নামাজটা সবাই জীবনে ধরে রাখতে পারে না। শুধু তারাই পারে যাদের কাছে আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াবি জীবনটা অতি নগণ্য। আমি ও নাকীব এই সময়টায় খুব ব্যস্ত থাকি। কিন্তু আমরা দুজনই সকল ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে চাশতের নামাজে মন দিই। খানিক পর পর নামাজ পড়ার কারণে আমাদের মনও সবসময় প্রফুল্ল থাকে।

আজ চাশতের নামাজ সেরে উঠতেই ঝিলি আবদার করে বসলো ওকে ফুলের মালা কিনে দিতে হবে।
আমি বললাম,
“ফুলের মালা দিয়ে কি করবে?”
“লাগবে আমার, এনে দাও না।” ও আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলো।
“আচ্ছা রে বাবা, এনে দিবো।”
“এখনই।”
“এখনই আনতে হবে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ এক্ষুনি।”

অগত্যা বাধ্য হয়ে বোরকা-নিকাব করে বেরিয়ে গেলাম ওর সাথে। রাস্তার ওপারে গিয়ে ঝটপট একটা মালা কিনে দিয়ে নিজের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছিলাম। ঝিলি কখন যে রাস্তা পার হতে নিজেই এগিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। জিনিস কিনে পেছন ফিরে দেখলাম ঝিলি ঠিক রাস্তার মাঝখানে। ওর সামনে এবং পেছন থেকে একটা ট্রাক এবং দুটো মাইক্রোবাস ধেয়ে আসছে। ও মনের সুখে মালা নিয়ে খেলতে খেলতে রাস্তা পার হচ্ছে। আমি সজোরে ডাক দিলাম,
“ঝিলি! পেছনে আয়।”
ও আমার ডাক শুনলো না। আমি ঝিলির দিকে ছুটতে লাগলাম এবং একসময় প্রচন্ড আওয়াজে চোখ বন্ধ করে কান চেপে ধরে রাস্তায় বসে পড়লাম। যখন চোখ মেললাম তখন সামনে ভীড় দেখতে পেলাম। কিছু দূরে গাছের সাথে লেগে উল্টে পড়ে আছে ট্রাকসমেত মালগুলো। অন্যপাশে মাইক্রোবাস দুটো একটার সাথে অন্যটা সাংঘর্ষিক অবস্থায় পড়ে আছে। আমি হন্য হয়ে চারপাশে তাকালাম, “ঝিলি কোথায়?”

ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখি ঝিলি প্রচন্ড ভয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরে আছে। অবয়বে বোঝা যায় একটা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে আছে ও। আমি ওর সামনে গিয়ে ওর হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালাম এবং জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। ঝিলির বুকের ভেতরের অসম্ভব দ্রুতগতির হৃৎস্পন্দন আমার হৃদয় ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ভয়ে তখনও কাঁপছে ঝিলি। অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর ওকে ছেড়ে দিলাম। ততক্ষণে ভীড় কমে গেছে। সবাই যার যার গন্তব্যস্থলে চলে গেছে। শুধুমাত্র সেই ছেলেটা বাদে যে ঝিলিকে টেনে সরিয়ে এনেছে। মহান রবের রহমতে যে বাঁচিয়েছে ঝিলিকে। আমি তখনও তার চেহারা দেখিনি। ঝিলিকে ছেড়ে দিয়ে বললাম,
“জাযাকাল্লাহ্ ভাই…”

সামনের ব্যক্তিকে দেখে আমার কথা নয় শুধু হৃৎস্পন্দনও থেমে গেল। অবাক চোখে শুধু তাকিয়েই রইলাম৷ কতদিন পর, কত বছর পর মানুষটা আমার সামনে। আমার কি বলা উচিত, কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। সে-ই বললো,
“দেখে রাখবেন তো বাচ্চাকে। আরেকটু হলেই তো অঘটন ঘটে যাচ্ছিলো।”

আমি কিছু বললাম না। রাফিন হয়তো আমাকে চিনতে পারেনি। অচেনাই থাক তাহলে। কথাটা বলে ঝিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“আর কখনো একা রাস্তায় আসবে না, বুঝেছো?”
ঝিলি মাথা কাৎ করে বললো,
“বুঝতে পারিনি যে আপু আমার সাথে আসেনি।”
“ভবিষ্যতে আর কখনো আপুর হাত ছাড়বে না, হুম?”
“আচ্ছা।” রাফিন ঝুঁকে এসে ঝিলির কপালে চুমু খেলো। ঝিলিও বিনাবাক্য রাফিনের গালে চুমু খেয়ে নিলো। রাফিন মুচকি হেসে ওকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

কিছুদূর গিয়ে শুধু একবার, মাত্র একবার পেছন ফিরে তাকালো আমার দিকে। সে-ই তাকানোতে কি ছিল আমি জানি না, মুহুর্তেই আমার ভেতরটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে চাইলো। ও কি চিনে ফেলেছে আমাকে? ও দূরে থাকলে আমি দিব্যি ভালো থাকতে পারি, কোনো দুঃখ, হতাশা থাকে না আমার মধ্যে। কিন্তু ওর অল্প একটু তাকানো, ওর একটু স্বর শুনলেই আমি পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যাই। তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজেকে মুহুর্তেই ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলি। এমন কেন হয়? এই যে এখন ওর জন্য আমার ভেতরে জ্বলছে এটার জন্য তো আমাকে শাস্তি পেতে হবে। কেন ওর দিকে তাকিয়েছি আমি? কেন দেখেছি ওকে? কেন তাকিয়েছি পরপুরুষের দিকে? এই প্রতিটা কাজের জন্য তো আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তারপরও কেন অবাধ্য মনটা এত বেয়াড়াপনা করে? কেন করে? আমি তো অবৈধ কাজগুলো করতে চাই না, তাও কেন করে ফেলি?

যদিও আজকের ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ছিল না এবং আমি রাফিনের সাথে একটাও কথা বলিনি তারপরও মনের মধ্যে খচখচ করছিলো। ‘কেন আজও ওর জন্য ভেতরটায় পুড়ছে’ এই ব্যাপারটা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিলো। কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছে যদি এই মুহুর্তে মারা যাই রবের সামনে দাঁড়াতে পারবো তো? একই ব্যাপারে বারবার তওবা করছি আর পুনরায় ভুলটা হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছায়।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ সূরা যুমার এর ৫৩ নং আয়াতটা মনে পড়ে গেল আমার। মুহুর্তেই স্বস্তি ফিরে এলো মনে এবং তৎক্ষনাৎ তওবা করলাম। ঐ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
“বলে দিন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছো! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ তো সব গুনাহ মাফ করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।” [৫]

রেফারেন্স:
১. মিশকাত শরিফ
২. মুসলিম শরিফ
৩. তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ
৪. তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ
৫. সূরা যুমার – ৫৩

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here