অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৯

0
869

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৯

বাবা রক্তবর্ণ অথচ শীতল চাহনিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘সে তার জেদ বজায় রেখেছে তাই না?’

আমি ও নাকীব চুপ করে রইলাম। মা ডাইনিংয়ে বাবার নাস্তা দিতে এলেন। বাবা বললেন,
‘তুমি তোমার জেদ ঠিকই বজায় রেখেছো। আজীবন কি এরকম উল্টোই চলতে থাকবে সবকিছু?’

‘অসহায় মহিলা! কোথাও কাজ পাচ্ছে না তাই কাজ দিয়েছি। বেশি না মাত্র পাঁচশো টাকা।’ মা বললেন।
‘টাকার কথা আসছে না এখানে। বেগানা নারী সারা ঘরময় চোখের সামনে পায়চারী করতে থাকলে আয়-বরকত সব উঠে যাবে।’
‘অন্যরা বুয়া রাখে না? আমি রাখলেই আয়-বরকত উঠে যাবে?’ খানিকটা রেগে বললেন মা।

‘যাদেরটা তাদের ব্যাপার। যার জ্ঞান যতটুকু আল্লাহ তাকে ঠিক ততটুকুই পরীক্ষা করেন। বাকিদের নাহয় খাদেম সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান নেই। রাসূল সা: এর বলে দেওয়া যিকিরগুলো হয়তো তারা জানে না। যেগুলো গতরাতেই তোমাকে বলেছি। তুমি তো জানো, আমরা সবাই জানি। তাহলে আমরা জেনেও কেন মানবো না? আল্লাহর ওপর কেন ভরসা করবো না?’

‘বাবা, এগুলো মাকে আমরা একটু আগেই বললাম।’ আমি বললাম।

‘হ্যাঁ, তোমরা সবাই মিলে এখন আমাকে জ্ঞান দাও৷ আমি অধম, তোমরা উত্তম।’ মা বললেন।

বাবা উঠে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন,
‘কুরআন-হাদীসের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যে মানে না তাকে আমার আর কিছু বলার নেই।’

মা একবার চেঁচালেন, ‘খাবার না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো?’
বাবা পিছু ফিরে বললেন, ‘গলার স্বর নামিয়ে কথা বলো। নারীদের কন্ঠও পর্দার অন্তর্ভুক্ত। আর কতবার বলতে হবে?’

‘হ্যাঁ…’ মা লেকচার শুরু করার আগেই বাবা বললেন,
‘তুমি আর তোমার খাদেম মিলে খাবারগুলো খেয়ে নাও। অসহায় খাদেমের পরিবারের জন্য দিয়ে দিও খাবারগুলো।’

বাবা চলে গেলেন। আমি ও নাকীব উঠে চলে এলাম। মা আমাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
‘তোরাও চলে যা। সবগুলো তো বাপের মতোই হয়েছিস? পেলেপুষে বড় করলাম আমি, এখন সব বাপের সাপোর্টে।’

সকালের কড়া রোদ উপেক্ষা করে কাশবনে গিয়ে আমি বসেছিলাম গাছতলায়। বেশ খানিকক্ষণ পর দূর থেকে দেখলাম, রাফিন আসছে সাইকেল চালিয়ে। হলুদ জ্যাকেট, ব্ল্যাক জিন্স। মাই আল্লাহ! এত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। আমার বুকে ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ও সামনে এসে বললো,
”এত সকালে ম্যাম আরোহী এখানে কি করেন?”
মাথা নেড়ে বললাম, “এমনিই এসেছি।”

আজকে রাফিনকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। ও ফুরফুরে মেজাজে বললো,
“আমার সাথে রেস দিবে, মিস আরোহী? সাইকেল রেস?”

আমি বুকে হাত দিয়ে ‘হায়য়য়’ বলে বসে পড়লাম। ও হেসে বললো,
‘কি হলো?’
‘তোমাকে আজকে মাত্রাতিরিক্ত কিউট দেখাচ্ছে। যাও চেঞ্জ করে এসো, তারপর রেস শুরু হবে। আদারওয়াইজ, আমি হেরে যাবো।’

ও হো হো করে হেসে বললো, ‘এত পাম্প একদিনেই দিও না হাওয়ায় উড়ে যাবো, ধরেও রাখতে পারবা না।
‘যাহ!’
‘চলো রেস দিই?’
‘আজকে না, অন্য কাজ আছে।’
‘অন্য কি কাজ?’
‘ঐ যে ফুফির বাসায় যেতে হবে।’
‘আবার ওখানে?’ খানিকটা রেগে বললো রাফিন।
‘হুম। অনেকদিন যাইনি।’
‘অকে চলো।’

আমার দুজন ফুফি আছে। নিশা ও দিশা। একজন খুব বেশি ভালো আর অন্যজন ঠিক তার উল্টো। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। প্রথম ফুফি আমাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না। তার নাম নিশা। তিনি শুধু যে আমাকে সহ্য করতে পারেন না তা’না। তিনি তার ছেলেকে ছাড়া কাউকেই সহ্য করতে পারেন না। আর তার ছেলেটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বদমাশ ছেলে। সেই ছেলেকে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। ফুফির বাড়িতে বৃদ্ধা শ্বাশুড়ি রয়েছেন। শ্বাশুড়িকে ফুফি মানসিক ও শারীরিকভাবে বেশ নির্যাতন করেন। নিষ্ঠুর মানুষ বলা যায় তাকে। ফুফির শ্বাশুড়িকে আমার খুব ভালো লাগে। উনিও আমাকে ভালোবাসেন। একদম মাটির মানুষ তিনি। তাই আমিও বারবার ফুফির অত্যাচার, চেঁচামেচি ভুলে ঐ বাড়ি ছুটে যাই বৃদ্ধা দাদুকে দেখতে। কিন্তু প্রতিবারই ফুফি আমাকে তাড়িয়ে দেয় খুব বিশ্রীভাবে। এরপর দাদুর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। রাফিন ঘটনাটা পুরো জানে। কিভাবে জানে সেটা বলছি।

একদিন সাইকেল নিয়ে ফুফির বাসায় যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে রাফিন বাইক নিয়ে এসে আমার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
”কই যাওয়া হচ্ছে মিস?”
“এই তো কাছেই, চলে আসবো এখনই।” মুচকি হেসে জবাব দিলাম।
“কোথায় যাচ্ছো?”
“ফুফির বাসায়।”
“একা কেন? একা যেতে হবে না, চলো আমিও যাচ্ছি।”
“না, না তোমার যেতে হবে না। আমি গিয়েই চলে আসবো।”
“উহু! তোমাকে একা ছাড়া যাবে না। চলো আমিও যাবো।”
“তোমাকে ফুফি দেখে নিলে প্রবলেম হয়ে যাবে তো।”
“কেউ দেখবে না। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো।” জোর গলায় বললো রাফিন।

আমি ওকে নিতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু ও এত জোর করলো, রাস্তায় রীতিমতো ধমকাধমকি শুরু করে দিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে গেলাম। ওকে বাইরে রেখে আমি ফুফির বাসায় ঢুকে ফুফির শ্বাশুড়ির রুমে চলে যাই সোজা। সালাম দিতে গিয়ে খেয়াল করলাম, বৃদ্ধা মহিলাটি ফ্লোরে পড়ে আছে।
আমি আঁৎকে উঠে “দাদু” বলে চেঁচিয়ে ওনাকে ধরে কোনোমতে খাটে বসালাম। চামড়া কুঁচকে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতে দাদু আমাকে ধরে বললেন,
“তুমি আবার ক্যান আসছো? তোমারেও পিটায়ে বের করে দিবে রে বোন!”

দাদুর হাতের কোণায় রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। স্টিলের টেবিলের কোণায় হাত লেগে কেটে গেছে নিশ্চয়ই। আমার চোখে অশ্রু চিকচিক করতে লাগলো। এত নিষ্ঠুর কোনো মানুষ হয়? একজন বৃদ্ধাকে এভাবে মারতে পারে কেউ? দিলে রহমত বলে কিছু নেই? জাঁদরেল এই মহিলা আমাদের বংশের হয় কি করে? এটাকে নিশ্চয়ই কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছে। মনে মনে বিড়বিড় করছিলাম আমি।

দাদুর চোখের কোণে পানি জমেছে। আমি বললাম,
“দাদু, আপনাকে আর এখানে থাকতে হবে না, আমাদের বাসায় চলুন।”

দাদু কান্নাজড়িত গলায় আমার গালেমুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুমি বড্ড ভালো গো মেয়ে। যার ছেলেই মাকে দেখে না, সেই অভাগা মায়ের জন্য তুমি এত চিন্তা কইরো না। আল্লাহ আছে, সময়মতো আল্লাহই সব বিচার করবোনে।”

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তার আগেই খুন্তি হাতে ফুফি রুমে ঢুকে। আমি তৎক্ষনাৎ দাদুকে আড়াল করে দাঁড়ালাম। ফুফি ছুটে এসে হিজাবসমেত আমার চুল টেনে ধরে বললেন,
“তুই আবার আসছোস? তোর গায়ের চামড়া কি গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরী রে? কোনো কথায় কাজ হয় না? বাইর হ আমার বাড়িত্থে!”

বলতে বলতে ফুফি ধাক্কা দিয়ে আমাকে উঠানে ছুঁড়ে ফেললো। উঠোনে পড়ে চোখেমুখে বালি ঢুকে গেছে আমার। খুক খুক করে কাঁশতে লাগলাম। রাফিন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছি। গলায় পিন দেবে গেছে। হাত দিয়ে সেটা খুলতে গিয়ে গলায় বেশ ব্যাথা পেলাম। প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিলো। কোনোরকমে পিনটা খুলে নিয়ে আসলাম। ততক্ষণে রাফিন আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে তোলার চেষ্টা করছে। আমি উঠে দাঁড়াতেই রেগেমেগে বললো,
“ঐ মহিলা তোমাকে এভাবে কেন ধাক্কা দিলো?”
“কিছু না। চলো বাসায় যাই।”
“আরোহী, আমার মেজাজ খারাপ করবে না একদম। বলো কি হয়েছে? কে উনি? আমি এখনই তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবো কিন্তু।”

বাধ্য হয়ে রাফিনকে সব খুলে বললাম। ও রেগেমেগে ভেতরে যেতে চাইলো, আমি টেনে ওকে বাইকে বসালাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
“উনি আমার ফুফি। তোমাকে আমার সাথে দেখলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। চলো যাই।”

রাফিন বাকরুদ্ধ হয়ে খানিক আমার দিকে তাকিয়েই রইলো। অনেকক্ষণ পর অস্ফুট স্বরে বললো, “ফুফি?”

এরপর থেকে যতবার ঐ বাড়িতে যাই রাফিনকে নিয়ে যেতে হয়। এটা ওর কড়া হুকুম।

আমি ও রাফিন ফুফির বাসায় এসে পৌঁছালাম। এতদিনে দাদু রাফিনকেও চিনে ফেলেছে৷ আমি যতবার আসি ততবার রাফিন দাদুর জানালার কাছে থাকে আর আমি ভেতরে দাদুর রুমে থাকি। আমরা প্রায়ই দাদুর সাথে অনেকক্ষন সময় কাটাই।

রাস্তার পাশেই আধপাকা লাল রংয়ের বাড়িটা ফুফির। বাড়ির চারপাশে বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। পাশের কয়েকটা বাড়িতে ছাগল ও হাঁসমুরগি পোষে। সেই ছাগল ও মোরগগুলো ফুফির উঠানে চলে আসে বলে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির পেছনে একটা পুকুর। সেটাও ঘেরাও করে রাখা। ফুফির নিষ্ঠুর আচরণের কথা এলাকার সবাই জানে। তারা কেউ ভুলেও ফুফির বাড়িতে পা মাড়ায় না। বাড়ির উঠান পেরুতে হলে বড় একটি গেইট পার হতে হয়। গেইট বলছি বলে আহামরি রাজকীয় গেইট ভেবে ভুল করবেন না। বেড়া দিয়ে বানানো গাছের একটা দরজা। দরজা ধাক্কা দিতেই ফ্যাচ ফ্যাচ আওয়াজ তুলে দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা আস্তে করে ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। তখনই ফুফি ভেতর থেকে চেঁচালো, “কে রে ভেতরে ঢুকে?”

আমরা দুজন চট করে বাথরুমের পেছনে লুকিয়ে পড়লাম। ওহ হ্যাঁ বলা হয়নি, বাড়ির বাইরে একটা টিন শেডের বাথরুম আছে। তার পেছনে খানিকক্ষণ লুকিয়ে রইলাম। ফুফি বাইরে এসে চারপাশে তাকালেন। গেইট খোলা দেখতে পেয়ে রাগে গিজগিজ করতে করতে বললেন, “কেডায় আইছিলো রে? গেইট খোলা রাইখা পলাইছে?”
কাউকে না দেখতে পেয়ে তিনি গেইট লাগিয়ে চলে গেলেন। আমার বেশ লজ্জা লাগছে ফুফির ভাষা শুনে। এই ভাষা কোথা থেকে শিখেছেন উনি? রাফিন কি ভাবছে আমার পরিবারকে? আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা তো এমন না। আমাদের কারো ভাষাও এত জঘন্য না। ইশ! রাফিনকে যদি একবার ছোটফুফির সাথে দেখা করাতে পারতাম। কি মিষ্টি ব্যবহার ছোটফুফির।

রাফিন কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে ফিসফিস করে বললো, “হেই কি ভাবছো? টয়লেটের দুর্গন্ধটা কি তোমার খুব ভালো লাগছে? একেবারে আঁঠার মতো টয়লেটের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছো? এত সুগন্ধ লাগলে ভেতরে গিয়ে বসো না।”

রাফিনের কথা শুনে খেয়াল হলো, কখন যেন ফুফিদের কথা ভাবতে ভাবতে টয়লেটের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছি নিজেই জানি না। আমি চট করে সরে গিয়ে জিভ কাটলাম। ও নাকমুখ কুঁচকে বললো, “থাকবে নাকি যাবে?”
“যাচ্ছি তো, চলো।”

রাফিন বাড়ির পাশ ঘেঁষে দাদুর রুমের জানালার কাছে চলে গেল। আমি ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে উঁকি দিলাম। বাড়িটার মাঝখানে লম্বা একটা করিডোর। ঢোকামাত্র বড় একটা রুম, ড্রইং রুম বলা যায়। এরপর থেকে করিডোর শুরু। করিডোরের দু’পাশে দুটো করে মোট চারটে রুম। ডানপাশের দ্বিতীয় ঘরটা দাদুর। দাদুর ঘরে যেতে হলে ডাইনিং রুম পার হয়ে যেতে হয়। আমি ডাইনিংয়ে উঁকি দিতেই দেখলাম, ফুফি তার ছেলেকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে আর ছেলে মহানন্দে মুরগির রান চিবুচ্ছে। আমি সিলিংয়ের দিকে তাকালাম। ফ্যান ঘুরছে গটর গটর শব্দে। তাও হাতপাখা দিয়ে বাতাস করার কি আছে বুঝলাম না। ঢং যতসব! ছেলেটাও কেমন? মাকে বাতাস করতে দিয়ে নিজে বসে বসে খাচ্ছে। পরক্ষনেই ভাবলাম, বাপ-মা যেমন ছেলে তো তেমনই হবে। করো বাতাস করো ভালোমতো। বাতাস করে করে ছেলেকে গুন্ডা বানাও। এই ছেলে যে তোমার কত দাম দিবে দেখবো। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে ধীরপায়ে দাদুর রুমে ঢুকলাম।

আজও গিয়ে বসলাম দাদুর কাছে। আগেরবার ফুফি তাড়িয়ে দেওয়ার পর বেশ কিছুদিন ধরে আসা হয়নি এখানে। আমি ঢুকতেই রাফিন ধমকালো।
“এত দেরী লাগলো কেন আসতে?”
আমি জবাব দেওয়ার আগে দাদুই বললেন, “আমার নাতিডায় আইছে সকালবেলা। খাওনের ঘরে মা-ছেলে খাচ্ছে বোধয়৷ তোমারে আসতে দেখলো নাকি দাদু?”

আমি দাদুর পাশে বসে বললাম, “দেখেনি দাদু। তুমি কেমন আছো বলো?”
“আছি কোনোরকম।”

রাফিন হঠাৎ দাদুর দিকে তাকিয়ে বললো, “দাদু, আপনার হাতে কি হয়েছে?”
দাদু শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত ঢেকে বললেন, “কি অইবো? কিছু না।”

আমি আঁচল সরিয়ে বললাম, “দেখি কি হয়েছে?”
দাদুর হাতে লম্বা একটা সেলাই। আমরা দুজন আঁৎকে উঠে বললাম, “কি হয়েছিল দাদু?”

দাদু চুপ করে রইলেন। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,
“কে মেরেছে? ফুফি?”
এবার দাদু দু’পাশে মাথা নেড়ে বললো, “আমার পোলাডায় মারছে। বউয়ে বিচার দিছে আমি তার মুখে মুখে তর্ক করি। বাইরেত্থে আইসাই এরম কথা শুইন্না রাইগা গেল। আর আমার ওপর রাগটা ঝারলো। ধাক্কা দিয়ে খাটথে ফেলায় দিছে। নিচে উপুড় কইরা চোরাতা (যাতা) রাখা আছিল। ঐডির ওপর পইরা হাত পুরাটা ছিল্লা গেছে। পরে হেরা দেখতে পাইয়া ডাক্তার আনাইছে। সেলাই, ব্যান্ডেজ করলো পরে।”

আমি ছলছল চোখে দাদুর হাতে হাত বুলিয়ে দিলাম। রাফিন বললো, “এত নিষ্ঠুর ব্যবহারের পরও কেন আপনি এখানে পড়ে আছেন দাদু? আচ্ছা দাদু, আমরা কি পুলিশকে জানাবো এটা? এটা তো একটা ক্রাইম। একজন বৃদ্ধাকে নির্যাতন করা।”

দাদু রীতিমতো আঁৎকে উঠলেন। “না, না তোমরা এডি করবা না। একদম না। ওরা আমার পরিবার। ওদের আমি পুলিশের হাতে ক্যামনে ধরায়া দিমু?”

রাফিন বললো, “স্যরি টু সে, পশুগুলো আপনার পরিবার? ওরা আপনাকে কিভাবে নির্যাতন করে, এরপরও ওদের কথা ভাববেন?”
“সন্তান যতই অত্যাচার করুক, বাবা-মা সইতে পারে।”

আমি রাফিনের দিকে তাকালাম। ওর চোখ দ্রুতগতিতে লাল হয়ে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে রাফিনের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। রাগলেই ওর চোখ টকটকে লাল হয়ে যায়। ও দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলো। হঠাৎ একটা ছেলের কন্ঠ ভেসে এলো,
“আরে হৃদিতা সুন্দ্রী তুমি এহানে?”

রাফিন চট করে জানালার একপাশে সরে গেল। আর আমি উঠে দাঁড়ালাম। ফিরে দেখলাম, ফুফির ছেলে জাফর আমার একদম পেছনে, আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে আমার খুব বেশি ভয় করে। ওর মতো বখাটে এই তল্লাটে আর দ্বিতীয়টি নেই।

আমি আমতা আমতা করে পেছনে আসতে লাগলাম। আমি যতই পিছাচ্ছি ও ততোই আগাচ্ছে আমার দিকে। জঘন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও। দাদু বললেন,
“ওরে যাইতে দাও দাদু ভাই। তোমার আম্মায় দেখলে পরে মারবো খুব। যাইতে দাও দাদু ভাই।”

জাফর শুনলো না দাদুর কথা। আমি পিছনে আসতে আসতে জানালার সাথে লেপ্টে গেলাম। জানালার কাছেই তো রাফিন আছে এই ভরসায় বাইরে তাকালাম। না, রাফিন নেই। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এরমধ্যেই রাফিন কোথায় গেল? ভেতরে ভেতরে চেঁচালাম, “আল্লাহ, আমাকে বাঁচাও। শয়তানের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও প্লিজ!” মনে মনে দোয়ায়ে ইউনুস পড়তে লাগলাম। আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করলাম। চোখ বেয়ে পানির স্রোত নেমে আসছে। জাফর জানালার রড ধরে আমার এতই কাছে এসে পড়েছে যে আমার দম আটকে আসছে। শেষমুহুর্তে ভয়ার্ত, শুকিয়ে আসা কন্ঠে বললাম, “প্লিজ ভাইয়া, আমাকে ছেড়ে দাও। আর কোনোদিন আসবো না আমি।”

“আজকের পর থেকে রোজ আসবি। না আসলে তোর বাড়িতে যাবো আমি। রোজ তোকে কাছ থেকে দেখবো। তুই বড্ড সুন্দর হৃদি।”

ঘৃণায় আমার চোখমুখ লাল হয়ে আসছে। দাদু বারবার বলে যাচ্ছেন, “দাদু ভাই, ওকে ছাইড়া দাও। আল্লাহর দোহাই লাগে।”

জাফর জবাব দিলো না। আমার আরও কাছে মুখ নিয়ে এলো। হাতে হেঁচকা টান দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। এবার অঝোরে কেঁদে ফেললাম আমি। আমার এই দুঃসময়ে কেউ কি নেই আমার পাশে? আল্লাহ! তোমার ক্ষমতা তো সবখানে, সবসময় থাকে। বাঁচাও না আমাকে। কাউকে উছিলা করে তো পাঠাও আমার কাছে। ইয়া আল্লাহ!

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here