অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৮

0
891

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৮

সারা বিকেল কাশবনের গহীনে সুউচ্চ টাওয়ারের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমি উদাস গলায় বললাম,
‘একদিন আমরাও সূর্যের মতো ডুবে যাবো, হারিয়ে যাবো পৃথিবী থেকে। তখন নিশ্চয়ই আমাদেরকে আর কেউ মনে রাখবে না। রাতের আঁধারকে পেয়ে যেমন দিনের আলোকে মানুষ ভুলে যায় তেমনই হয়তো পৃথিবীর বুকে অন্য মানুষ পেয়ে আমাকে সবাই ভুলে যাবে।’

রাফিন ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমার দিকে। ঠোঁট উল্টে বলে,
‘এটাই তো জগতের নিয়ম।’
আমি ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,
‘তুমিও আমাকে ভুলে যাবে, তাই না?’

অকস্মাৎ কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না রাফিন। কিছুক্ষণ পর বলে,
‘এখন আমরা এসব নিয়ে কেন কথা বলছি?’
‘মৃত্যু নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবা উচিত আমাদের।’
‘আচ্ছা এখন এসব বাদ।’
‘হু।’ বলে চুপ করে গেলাম দুজনই।

সময় দ্রুত অতিবাহিত হলো। চলে এলাম বাসায়। বাসায় ঢোকামাত্র চেঁচামেচিতে কানে তাক লেগে গেল। আমি ও নাকীব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম বাবা মায়ের রুমে।

বাবা বলছেন, ‘আল্লাহর হুকুম এমনই তুমি আজীবন সবকিছু আমার উল্টো করে গেলে। আমার মতের সাথে কোনদিন তোমার মত মিলে না।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ মা নিজের কাজ করতে করতে অবজ্ঞা নিয়ে মাথা নাড়লো।
এটা দেখে আমারই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি বাবাকে বললাম,
‘কি হয়েছে বাবা?’
‘তোর মা কি করেছে জানিস?’
‘কি করেছে?’
‘সে কাজের বুয়া রেখেছে। বাসায় কি এমন আহামরি কাজ আছে যে তাকে বুয়া রাখতে হবে? কেন সে বুয়া রাখবে?’

মা সেলাই করছিলেন। সুঁইয়ের ফোড় দিতে দিতে মা বললো,
‘আমাকে তোমাদের দাসীবাঁদী রেখেছো? এত খাটুনি আমি করতে পারব না৷ তোমার মেয়েও তো কোনো কাজ করে না। পায়ের ওপর পা তুলে খাওয়া ছাড়া কোন কাজটা সে পারে?’

বাবা ভয়ানক রেগে গেলেন এবার। গর্জে উঠে বললেন,
‘ঘরে নিশ্চয়ই এত কাজ নেই যে ওকে করতে হবে। তাছাড়া তুমি শুধু রান্নাঘর সামলাও। বাকিসব ও সামলাচ্ছে না? পুরো বাড়িটা ও সাজিয়ে রাখছে না।’

‘না, রাখছে না। তোমার মেয়ে শুধু ভাঙতে শিখেছে, গড়তে শিখেনি।’

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কথার মাঝখানে আমি কোথা থেকে চলে এলাম? আমি তো কোনো কথাও বললাম না। আমার বুকে ব্যাথা হচ্ছে প্রচুর৷ চোখ জ্বালা করছে। নাকীব আমার দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
‘তোমার বুয়া কি করে দিবে শুনি?’
‘বুয়া আমাকে রান্নাঘরে সাহায্য করবে। আপনারা রাজা-বাদশাহগণ খেয়ে যা এঁটো করেন সেই জিনিসপত্র ধুঁয়ে দিবে। বিছানার চাদর থেকে শুরু পর্দা ও ভারী ভারী জামা-কাপড় ধুয়ে দিবে। যেগুলো তোমাদের মতো তুলতুলে হাতের মানুষেরা করতে পারে না বলে আমাকেই করতে হয়৷’

নাকীব বললো, ‘ঠিক আছে, এখন থেকে সেসব তোমাকে করতে হবে না৷ জামাকাপড় যা হবে আমি আর আপু পালাক্রমে ধুয়ে দিবো।’
‘সেটা তোমাদের ব্যাপার। আমার রান্নার কাজের জন্য বুয়া লাগবে।’ মা বললো।

বাবা বললো, ‘আসল কথাটা বলো না। তুমি কারো কথার তোয়াক্কা না করে বুয়া রাখবেই।’
‘হ্যা, তাই রাখবো।’

আমার চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ হলো। বললাম,
‘তাহলে বলে দাও না তুমি আমাদেরকে রান্না করেও খাওয়াতে পারবে না। সেই দায়িত্বটাও আমাদেরকে দিয়ে দাও। আমরা সারাদিন ক্লাস, কোচিং, অফিস শেষে এসে এগুলো করে নিবো।’

নাকীব বললো, ‘আমরা করবো বুঝলাম। কিন্তু মা কি করবে?’
‘আমার কোনো অবসর আছে? তোদের জন্য আজীবন খেঁটে গেলাম। নিজের জন্য কিছু করতে পেরেছি? এখন আমি নিজের কাজ করবো। তারজন্য আমার বুয়া লাগবে।’ মা বললেন।

এতকিছুর পরও যখন মায়ের সিদ্ধান্ত বদলালো না তখন বাবা বললেন,
‘তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটুট থাকো। বাইরের মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে সাহায্যকারী বানাতে চাইছো বানাও। একবারও ভাবোনি, বাড়িতে আমি আছি, নাকীব আছে। মেয়েটা আমাদের সামনে বেপর্দা চলাফেরা করবে। না চাইলেও তো আমাদের দৃষ্টি মাঝেমধ্যে তার দিকে চলে যাবে। সেই গুনাহর দায়ভার তুমি নিবে?’

মা হু, হাঁ করে বললো, ‘আমার কথা তোমরা কোনদিন ভাবলে না।’
মা এবার বুয়া রাখার জন্য অন্য কথা বলা শুরু করলো।
‘বুয়াকে তার স্বামী মেরেধরে ফেলে চলে গেছে। ওর আগে যে বাড়িতে কাজ করতো সেটাও হারিয়েছে। তাই ওর একটা চাকরী দরকার।’

বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু’পাশে মাথা নাড়লেন। একবার আমাদের দিকে পরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আজকে একটা কথা আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। ছেলেমেয়েকে স্বাক্ষী রেখেই বলছি, তুমি যদি বাইরের মেয়ে এনে শান্তি পাও তাহলে আমিও বাইরের মেয়ে নিয়ে শান্তিতে থাকবো। তুমি যে রাস্তায় চলবে আমিও সে-ই রাস্তাতেই চলবো। তুমি ঘরে মেয়ে এনে ফূর্তি করো, আমিও তবে সেই পথে চলবো। তোমার দিকে, তোমার বাড়ির দিকে, তোমার সংসারের দিকে আর ফিরেও তাকাবো না। আমার কথা পরিষ্কার। এবার সিদ্ধান্ত তোমার। কি করবে ভাবো তুমি।’

বাবার কথা শুনে মায়ের কোনো ভাবান্তর হলো না। আমি ও নাকীব মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। আমার বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি বাবা-মা আলাদা হয়ে গেল। বাবা অন্য একটা মেয়ের সাথে… না! আর ভাবতে পারছি না। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুখে হাত চেপে দ্রুত প্রস্থান করলাম।

নাকীব আমার পিছু পিছু চলে এলো। রুমে এসে দুজন বেডের দু’কোণায় পাথর হয়ে বসে রইলাম।

রাত বাড়লো, টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। আমি ও নাকীব খাবার গুছিয়ে টেবিলে এনে রেখেছি। বাবা-মা দুজন দু’রুমে ছিল। বাবা ড্রইংরুমে আর মা নিজের রুমে। নাকীব মায়ের কাছে আর আমি বাবার কাছে গিয়ে খাবার খেতে ডেকে আনলাম।

চুপচাপ খাচ্ছিলো সবাই। বাবা আস্তে আস্তে বললেন,
‘তোমার সিদ্ধান্ত কি?’
‘সিদ্ধান্ত জানাতে বাধ্য নই।’ নির্বিকার কন্ঠ মায়ের।

মায়ের ওপর আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। বাবার কথা শুনলে সমস্যাটা কোথায়?

বাবা বলে, ‘আল্লাহ তোমাকে সম্পূর্ণ উল্টো করে বানিয়েছে।’
মা বলে, ‘তাহলে তো আমার পা উপরে মাথা নিচে থাকতো।’

বাবা কিছু বললেন না। আমরা সবাই চুপচাপ খেয়ে চলে গেলাম নিজেদের ঘরে। পুরো বাড়িতে একটা বিষাদের ছায়া নেমে এলো। সবাই আছে, কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সকাল হতেই দেখি একজন নতুন মানুষ রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করছে। মায়ের জেদ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বাবা এত করে বললেন, তাও শুনলো না? কোন ধাতুতে তৈরী মানুষটা?

আমি নাকীবকে গিয়ে জাগালাম। ও ঘুমঘুম চোখে বললো,
‘এত সকাল সকাল কেন ডাকছো আপু?’
‘মা সত্যিই বুয়া রেখেছে।’

নাকীব ধড়ফড়িয়ে উঠে বলে, ‘কিহ?’
‘হুম।’
‘কোথায়?’
‘রান্নাঘরে আছে।’

নাকীব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘এবার কি হবে আপু? বাবা যদি সত্যিই চলে যায়?’
‘চুপ! বাবা কোথাও যাবে না। আমরা মাকে বোঝাবো।’
‘অসম্ভব! মা কখনোই বুঝবে না। এত জেদ কেন আপু?’
‘ আমি জানি না।’

‘আচ্ছা আপু, রাফিন ভাইয়া যদি বলে ও অন্য মেয়ের সাথে চলে যাবে তখন তুমি কি করবে? ও যা বলে তা-ই করবে নাকি নিজের জেদ বজায় রাখবে?’

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, ‘ও যা বলবে তাই করবো অবশ্যই। ওকে আমি অন্যকারো সাথে সহ্যই করতে পারবো না।’
‘রিল্যাক্স আপু। জাস্ট বললাম আর কি। উত্তেজিত হইয়ো না। চলো মাকে বোঝাই।’
‘হুম চল।’

নাকীব গিয়ে মাকে ডাইনিং রুমে ডেকে নিয়ে আসলো। আমি বাবার লাইব্রেরি থেকে হাদীস শরীফ নিয়ে ডাইনিং-এ বসেছিলাম। মা আসতেই আমরা মুখোমুখি বসলাম। আমি হাদীস খুলে বললাম,
‘মা, একটা ঘটনা বলি। মা ফাতেমার ঘটনা।’
‘বল।’

আমি পড়া শুরু করলাম,
‘হযরত ফাতিমা (রাঃ) নিজের হাতে যাঁতা ঘুরিয়ে ও সংসারের সব কাজ একা করতে কষ্ট পেতেন। হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে পরামর্শ দেন যে, তোমার আব্বার নিকট যুদ্ধলব্ধ একটি দাসী চাও, যে তোমাকে সংসারের কাজে সাহায্য করবে। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর সাথে দেখা করতে এসে তাঁকে না পেয়ে ফিরে যান। রাত্রে তাঁরা বিছানায় শুয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁদের কাছে আসেন। তিনি বলেন,“আমার আসহাবে সুফফার দরিদ্র সাহাবীগনকে বাদ দিয়ে তোমাকে কোন দাসী দিতে পারব না। তবে দাসীর চেয়েও উত্তম বিষয় তোমাদেরকে শিখিয়ে দিচ্ছি। তোমরা যখন বিছানায় শুয়ে পড়বে তখন ৩৩ বার সুবহানআল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর বলবে।’

নাকীব বললো, ‘আপু এটা কি সহীহ হাদীস? রেফারেন্সসহ পড়ো।’
‘হাদিসটি সহীহ বুখারী ৩/১১৩৩ নং এবং সহীহ মুসলিমের ৪/২০৯১, নং ২৭২ এ এসেছে। এছাড়াও আরও অনেক জায়গায় এটি বর্ণিত রয়েছে।’ আমি বললাম।

মা বললো, ‘এগুলো আমি জানি।’
আমি ও নাকীব মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। নাকীব বললো, ‘আপু, আমাকে দাও। আমিও একটা পড়বো।
‘পড় তাহলে। সেইম হাদীস আরও একটা আছে।’

নাকীব পড়া শুরু করলো,
‘রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা ও ফাতেমা (রাঃ)-কে বলেন, তোমরা এ দো‘আটি ( ৩৩ বার সুবহানআল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর) প্রত্যেক সালাতের শেষে এবং শয়নকালে পড়বে। এটাই তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চাইতে উত্তম হবে। এটা এসেছে মিশকাত হা/২৩৮৭-৮৮ তে।’

‘তাহলেই বোঝ, এটাও সহীহ হাদীস। মা, আমরা সবাই যদি উক্ত যিকিরগুলো করি তাহলে আমাদের আর বুয়া লাগবে না। কাজ আল্লাহই সহজ করে দিবেন। তাছাড়া আমাদের উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব কাজ শেষ করা। তাহলে আল্লাহ সব কাজ সহজ করে দিবেন।’ আমি বললাম।

মা বললো, ‘এগুলো সব আমি জানি। তোদের কথা শেষ হলে যা এখান থেকে।’ বলে মা উঠে রান্নাঘরে চলে গেল।
নাকীব বললো, ‘আপু, বাদ দাও এসব। যে জেনেও বোঝে না তাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। ছেড়ে দাও।’
‘বাবাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে খুব।’

‘চিন্তা করো না। বাবা এমন কিছুই করবে না।’
‘করলেই বরং ভালো হতো। মায়ের একটা শিক্ষা হতো।’ আমি বললাম।

নাকীব চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়।
‘বাবা চলে গেলে তোমার ভালো লাগবে?’
‘কখনোই না। বাবা চলে গেলে আমি এখানে থাকবো ভেবেছিস? আমিও চলে যাবো।’

‘না আপু, কারো যেতে হবে না। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘হুহ! কিচ্ছু ঠিক হবে না। মায়ের জেদ দেখেছিস? বাবা উঠে এখন ঐ মহিলাকে দেখলে কি তুলকালাম কান্ডটাই না ঘটবে বুঝতে পারছিস?’

আমার কথা শেষ হতে না হতেই বাবা ডাইনিংয়ে এসে বসলেন। আমার হাতে হাদীস শরীফ দেখে বললেন,
“কিরে এটা নিলি যে হঠাৎ?”
“একটু দরকার ছিল বাবা।”
“দরকারটা একটু না হয়ে অনেকটা হওয়া দরকার ছিলো। তোমাদেরকে তো বলি প্রতিদিন কমপক্ষে একটা করে হাদীস পড়বে। এগুলো জানা দরকার।”

“ঠিক আছে বাবা, এখন থেকে রোজ হাদীস পড়বো।” আমি বললাম।

“হুম” বলে বাবা রান্নাঘরে তাকাতেই দেখতে পেলেন অপরিচিত এক মহিলা সিঙ্কে স্তুপ করে রাখা এঁটো থালাবাসন মাজছেন। মহিলাকে দেখেই চোখ সরিয়ে টেবিলের ঠিক মাঝখানে চোখজোড়া নিবদ্ধ করলেন। আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, বাবার চোখজোড়া ক্রমেই রক্তের ন্যায় লাল হয়ে আসছে। আমরা দুজন ভয়ানক কোনো দুর্ঘটনা ঘটার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here