#অজানা_আলোর_খোঁজে
#লেখিকা-শারমনি আঁচল নিপা
#পর্ব-২
ভাবলো তার বাবার লোক এসেছে। কিন্তু পাশে তাকাতেই দেখল একটা চিপচিপা গড়নের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো খাড়া খাড়া। মুখে এলো মেলো উসকো খুসকো খুচা খুচা দাঁড়ি । গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ। উচ্চতা মাঝারি গড়নের। দাঁড়িয়ে থাকা সে ছেলেটির নাম হলো তানভীর। পড়ালেখা শেষ করে এখন ভবঘুরের মতো এদিক ওদিক দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে। বেকার জীবনটা ঘুরাঘুরি করে উপভোগ করছে। বেশ ভ্রমণ পিয়াসী ছেলেটা। তার জীবনের একটা অংশ হলো ঘুরে বেড়ানো। তানভীরকে দেখে রুকু একটু চুপ হয়ে সশব্দ নিঃশ্বাস নিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে পড়ল। এর মধ্যেই তানভীর হাতটা বাড়িয়ে জানালা লাগাতে নিলে রুকু একটু অস্বস্থি নিয়ে বলল
– জানালা আটকাচ্ছেন কেন?
তানভীর ভ্রূটা কুঁচকে চোখগুলো কপালে তুলে বলল
– বাইরে থেকে বৃষ্টির ছাঁট আসছে৷ জানালা লাগাব না তো খুলে রাখব?
রুকু কপট রেগে গলাটা ভার করে বলল
– বৃষ্টির ছাঁট তো আর আপনার শরীরে আসবে না যেহেতু আমি জানালার পাশে বসেছি সেহেতু ছাঁটটা আমার কাছেই আসবে। আপনি আপনার জায়গায় বসুন।
– আপনাকে কে বলেছে বৃষ্টির ছাঁট আমার গায়ে আসবে না।
বলেই শার্টের বুকের অংশ এগিয়ে দিয়ে বলল
– দেখুন অলরেডি ছাঁটটা চলে এসেছে। শার্টটা পুরো ভিজে যাচ্ছে।
রুকু তানভীরের এমন আচরণে কথার জবাব না দিয়ে চট করে জানালাটা লাগিয়ে দিল। তানভীর মুচকি হেসে বাসের পাশের সিটে বসলো। পাশে বসে কানে ইয়ার ফোন গুজে দিল।
“আমার পরাণও যাহা চায়
তুমি তাই
তুমি তাই গো
আমারও পরাণও যাহা চায়।”
গানটা ইয়ার ফোনে হালকা আওয়াজে বাজতে লাগল আর তানভীর সেটা বাসের সীটে হেলান দিয়ে শোনতে লাগল। তানভীর খুব রবীন্দ্র সংগীত প্রিয়সী। ভ্রমণের মতো সারাদিন কানে ইয়ার ফোন গুজে রবীন্দ্র সংগীত শোনার একটা বদ অভ্যাস তার আছে।
এদিকে রুকুর চোখে শুধু মৃতদেহগুলো ভেসে উঠছে আর ভেতরটা কেঁপে উঠছে। মুখের আদলে ভয়ার্ত একটা ছাপ যেন রুকুকে গ্রাস করছে। এর মধ্যে মোবাইল স্ক্রিনে আবির নামটা ভেসে উঠল। উল্লেখ্য যে রুকু মোবাইলটা ব্যবহার করতো পরিবার থেকে লুকিয়ে। রুকু কলটা দেখে কলটা কেটে দিল। বারবার কল আসতে লাগল আর রুকু কল কাটতে লাগল। ঠিক সে মুহুর্তে তানভীরের নজর গেল রুকুর দিকে। রুকুকে বারবার কল কাটতে দেখে বলে উঠল
– কী ব্যপার কল ধরছেন না কেন?
রুকু বিরক্তি নিয়ে গলাটা খেকিয়ে জবাব দিল
– সবকিছু কী আপনাকে বলতে হবে?
– নাহ তা বলতে হবে না তবে বারবার কল কাটছেন তো তাই বললাম।
– আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই কল কাটছি আপনার কোনো সমস্যা?
– আমার সমস্যা হতে যাবে কেন?
– তাহলে চুপ করে বসে থাকুন। এত কথা কেন বলছেন?
এর মধ্যেই রুকুর ফোনে আবার কলটা ভেসে উঠল। রুকু কলটা কেটে দিলে পাশ থেকে তানভীর বলে উঠল
– কলটা বারবার না কেটে ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিলেই তো পারেন। তাহলে তো সময় ও বাঁচে আপনার কষ্টও কমে যায়।
তানভীরের কথাটা শোনে রুকুও ভাবতে লাগল যে সত্যিই তো ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিলেই তো হয়। সাথে সাথে মোবাইলটা নিয়ে নম্বরটা ব্ল্যাকলিস্টে দিল। তারপর বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসল। চারদিকে মাতাল হাওয়া বইছে। বৃষ্টির বড় বড় ছাঁটগুলো তখন বাসের কাচের জানালায় আঁচড়ে পড়ছে। এ বৃষ্টিতে ভিজে নিজেকে শীতল করতে খুব ইচ্ছা করছে রুকুর। তবে শীতল করার মতো কোনো উপায় এখন নেই। তাই মাথাটা সিটে ঠেক দিয়ে হালকা চোখটা বুজল। এর মধ্যেই মোবাইলটা কেঁপে উঠে ভাইবার্ট হয়ে ভো ভো শব্দ করে উঠল। রুকু হালকা কেঁপে উঠে চোখটা খুলে দেখল অন্য একটা নম্বর থেকে কল আসছে। বেশ বিরক্ত নিয়ে কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল
– রুকু আমি আবির আমার কথাটা শোনো। আমার কথাটা শোনে কলটা কাটো। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।
কথাটা শোনার পর রুকুর বিরক্তির মাত্রাটা যেন আরও বেড়ে গেল। আস্তে বলতে চেয়েও কন্ঠটা বেশ জোরালো হয়ে গেল। তাই একটু জোরে বলে উঠল
– তুমি আমাকে কল দিয়ে আর ডিস্টার্ব করবে না প্লিজ। আমি এসব নিতে পারছি না। অনেক পেইন হচ্ছে আমার।
রুকুর জোর গলা শোনে তানভীর তার কানে থাকা ইয়ার ফোন টা খুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তানভীরের তাকানোতে রুকু একটু ইতস্তত অনুভব করছিল। ইতস্তত অনুভব করে ফোনটা কেটে বন্ধ করে দিল। তারপর বাসের সিটে পুনরায় হেলান দিয়ে শুয়ে রইল। তানভীর ও আর কোনো কথা বলল না। পুনরায় ইয়ার ফোন কানে গুজে দিয়ে গান শোনতে লাগল। রুকু ফোনটা ব্যাগে রেখে চুপটি করে কাঁদতে লাগল। এখন রুকুর বেশ জোরে জোরে হেঁচকি তুলে কাঁদতে মন চাচ্ছে কিন্তু বাসে থাকায় সেটা পারছে না। বাসায় হলে হয়তো দেয়ালে মাথাটা আঁচড়ে দিয়ে কাঁদত। ভেতরে তার কান্নাটা জমে যেন ভ্যাবসা হয়ে বুকের ভেতরের ছাতিটা ফুলে গিয়েছে। নিজের সমস্যাগুলো তার উপর গন্তব্যহীন এক পথে যাওয়াটা তাকে অস্থির করে তুলছে।
তানভীর আঁড়চোখে রুকুকে খেয়াল করে দেখল তার চোখের জল যেন টুপ টুপ করে পড়তেছে। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। মনে হচ্ছে বাইরের বৃষ্টিটা থেমে গিয়ে রুকুর চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে। আঁড়চোখে তাকিয়ে থাকতে তানভীরের মাথাটা বেশ ব্যাথা করলেও রুকুর মুখ থেকে দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছা করছিল না। কিছুক্ষণ মাথাব্যথা উপেক্ষা করে তাকিয়ে থাকলেও সে তাকানোর স্থায়িত্বটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না। কারণ ইতিমধ্যে তানভীরের মাইগ্রেনের ব্যথাটা বাড়তে শুরু করেছে। বাইরের দিকে জানালার কাচঁটা ভেদ করে আকাশটা দেখার চেষ্টা করলো। আকাশের রঙটা এই হলুদ, এই লাল, এই নীল হলেও এখন আকাশের রঙটা ধূসর হয়ে আছে। মনে হচ্ছে হুরহুরিয়ে আবার বৃষ্টি নামবে। আকাশে মেঘের গর্জন দেখা গেলেও সে মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামতে চাচ্ছে না। এর মধ্যে এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না। তবে বাসে যে ভীড় আর রাস্তার যে হাল চা টা খেতে গেলে নির্ঘাত ঝাঁকুনিতে চোখে মুখে ছিটকে পড়বে। তাই চা খাওয়ার ইচ্ছাটা মাটি চাপা দিয়েই ব্যাগ থেকে একটা পেপার বের করে পেপারে মুখ গুজে পড়তে লাগল। বাসের মধ্যে ভ্যাবসা গরমে যেন তানভীর অস্থির প্রায়। কিছুক্ষণ পেপারে মুখ গুজে হুট করে রুকুকে খেয়াল করে দেখল খুব মায়াময় ভাবে ঘুমাচ্ছে। মুখের আধখানা ঢেকে আছে চুলে। চুলগুলো সরাতে ইচ্ছে করলেও সেটা পারছে না কারণ এতে অনধিকার চর্চা হয়ে যাবে। তাই বেশি কিছু না ভেবে জানালা খুলে দিল। জানালা দিয়ে শীতল বাতাস আসতে লাগল। শীতল বাতাসে রুকুর চুলগুলো উড়তে লাগল। অনেকটা কাশফুলের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছে কালো কুচকুচে চুলগুলো কাশফুলের মতো এদিক ওদিক হেল খাচ্ছে। রুকুর দিক থেকে চোখটা সরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বিকাল পাঁচটা বাজে। সদরঘাট পৌঁছাতে আরও দুই ঘন্টা সময় বাসে বসে থাকতে হবে। জ্যামের কারণে আগের জার্নিটা বেশ বোরিং লাগলেও আজকে তেমনটা লাগছে না৷ চারদিকে রিকশা, বাসের শব্দ, সেই সাথে পথচারীর ব্যস্ত ভীড়। মাঝে মাঝে কেউ বাসের জানালা দিয়ে পানি নিয়ে আসছে। আবার বাসে কেউ হরেক মালের জিনিসপত্র এক দাম এক রেটে বিক্রির স্লোগান তুলছে। এর মধ্যে বাদাম বুট,ঝালমুড়ির মাখা তো আছেই৷
ততক্ষণে তানভীরের মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করতে লাগল চোখটা প্রায় বুজে এলো। কখন যে ঘুমিয়ে গেল টের পেল না। ঘুমটা ভাঙ্গে বাসের হেল্পারের ডাকে। বাসের হেল্পার ডেকে বলল
– মামা ভাড়া দিবেন না?
কথাটা তানভীরের কানে আসলেও হালকা বুজে রইল কারণ এখন তাকাতে একদম ইচ্ছা করছে না। তবুও বাসের হেল্পার এমন ভাবে ডাকতে শুরু করল যে না উঠে পারল না। চোখগুলো টেনে টেনে তাকিয়ে ভ্রূটা কুঁচকে বলল
– একশ টাকা ভাংতি হবে?
– হ মামা হবে।
তানভীর কথাটা শোনে পকেট থেকে একশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– আমার আর পাশের জনের ভাড়াটা রাখুন।
এরমধ্যে রুকু উঠে রাগী চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল
– আমার ভাড়া আপনি কেন দিবেন? এ অধিকার আপনাকে তো আমি দেয়নি। আপনি আমার ভাড়া দিতে যাবেন কেন? সাহস তো কম না আপনার।
তানভীর হতচকিয়ে বলল
– আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই ভেবেছিলাম আপনার ভাড়াটা দিয়ে দিই। পরে ঘুম থেকে উঠলে আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেব। সত্যি বলতে এত ঘুমের মাঝে উঠাটা যে কতটা বিরক্তিকর সেটা শুধু আমি জানি। তাই এমন ভাবনা থেকে এ কাজটা করা। নেতিবাচক ভাবে নিবেন না দয়াকরে।
রুকু তানভীরের কথা শোনে রেগে আগুন হয়ে পার্স থেকে চকচকা একটা একশত টাকার নোট বের করে বাস হেল্পারটার দিকে এগিয়ে বলল
– আমার ভাড়া এখান থেকে রাখুন।
বাসের হেল্পার রুকুর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে নিজের হাতে থাকা টাকা কয়টা দেখে বলল
– আপা আপনি ভাংতি দেন। একশত টাকার ভাংতি হবে না।
কথাটা শোনে রুকু ব্যাগটা চেক করে দেখল ভাংতি নেই। তানভীর পাশ থেকে দাঁতটা কেলিয়ে বলল
– আমি ভাড়াটা দিয়ে দিই। আপনি বাস থেকে নেমে আমাকে দিয়ে দিবেন। হয়ে গেল। উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।
রুকু আর কোনো কথা বলল না। হেল্পার রুকুর দিকে টাকাটা বাড়িয়ে দিতেই সে হেল্পারের থেকে একশ টকা ফেরত নিয়ে ব্যাগে পুরে নিল।
হেল্পারটা তানভীরের একশত টাকা নিয়ে বলল
– মামা আপনারা কে কোথায় যাবেন?
তানভীর হালকা হেসে বলল
– আমি সদরঘাট যাব।
– মামা আপনি সদরঘাট যাবেন ঠিক আছে আপা কোথায় যাবে?
তানভীর কপালটা কুঁচকে হেল্পারে দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল
– কে কোথায় যাবে পরে বলছি আগে বলেন আমাকে মামা আর পাশের জনকে আপা কেন বললেন? আপনি জানেন না ছেলে মেয়ে সমান অধিকার। ডাকতে হলে উনাকে আপা ডাকবেন নাহয় আমাকে ভাইয়া। সমতায় এনে ডাকবেন। একজনকে মামা একজনকে আপা এটা আবার কেমন ডাক শোনি?
বাসের হেল্পার জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
– সরি ভাইয়া। আপা কোথায় যাবে সেটা বলেন।
তানভীর কথাটা শোনে রুকুর দিকে তাকাতেও দেখল রুকু রাগে গজ গজ করছে। তানভীর নিজের মুখে জমে থাকা থুথুটা ঠুস করে গিলে নিয়ে বলল
– আমি সমতার কথা বুঝাতে চেয়েছিলাম। রাগ হয়ে আছেন কেন। কী হয়েছে?
রুকু চেহারাটা স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
– নাহ কিছু না। এমনি।
– তা আপনি কোথায় যাবেন?
এবার বুঝতে পারছে না রুকু কী বলবে। চুপ হয়ে রইল একদম। রুকুর নীরবতা দেখে তানভীর পুনরায় জিজ্ঞেস করল
– বললেন না তো কোথায় যাবেন। চুপ হয়ে আছেন কেন?
রুকু তানভীরের ডাকে সাড়া দিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল
– আপনি কোথায় যাবেন?
– আমি তো সদরঘার যাব।
রুকু হালকা হেসে বলল
– আমিও তো ঐখানে যাব।
তানভীর রুকুর কথা শোনে হেল্পারকে জবাব দিল
– দুজনেই সদরঘাট যাব। এবার ভাড়াটা রাখো।
হেল্পার দুজনের ভাড়া কেটে বাকি টাকা তানভীরকে এগিয়ে দিল। তানভীর টাকাটা নিয়ে মানিব্যাগে ভরতে ভরতে রুকুকে বলল
– আপনার নামটা কী জানতে পারি?
রুকু তানভীরের কথার ভ্রুক্ষেপ না করে চোখ বন্ধ করে বাসের সিটে ঠেক দিয়ে শুয়ে পড়ল। তানভীরও পাল্টা প্রশ্ন না করে কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে পুনরায় রবীন্দ্র সংগীত শোনতে লাগল।
এদিকে টানা এক ঘন্টা ব্যস্ত শহরের জ্যাম পেরিয়ে বাসটা সদর ঘাট এসে পৌঁছাল। দুজন সিট থেকে উঠে বাস থেকে নামতে নিতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়ল।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)
সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করলে আপনার নামটিও হয়ে যেতে পারে আমার পরবর্তী গল্পের একজন চরিত্র।ল্প নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে কমেন্টে দেওয়া গ্রূপ লিংকে ঢুকে গ্রূূপে জয়েন করুন