#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২
অন্ধকার রুমে বেহুঁশ অবস্হায় শুয়ে আছে আরিবা। তার পাশে বসে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে আরশ। সে আরিবার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে। সে কি আরিবাকে বেশি কিছু বলে ফেলছে? আরিবা এতে বেহুঁশ হলো কেনো? কিছু বুঝতে পারছেনা সে। নিজের ভেতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। আরিবার চেহারার দিকে তাকিয়ে তার ভেতরটা হাসফাস করে উঠলো। যদিও ভয়ের কিছুই নাই। নিজেই ওর চেকআপ করছে। আরশ মেডিকেলে পড়তাছে তাই আর ডক্টর ডাকেনি। আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ভাবছে কেন ওকে ছাদে একা রেখে এলো।
আরশের খুব রাগ হয়েছিল ও আরিবাকে একা রেখেই রুমে চলে এলো। এসে সোফার কুশন একেকটা একেক জায়গায় ফালাচ্ছে। তারপর সোফায় বসে হাটুতে দু হাতের ভর রেখে চুল মুঠ করে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ তার মনে হলো আরিবা ছাদে একা। ওকি রুমে আসছে? না আসলে তো ভয় পাবে। আরশ এসব ভেবে নিজেই দেখতে গেলো। এসে যা দেখলো তাতে ওর পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা। ওর পা আর সামনে আগাচ্ছে না মনে হয় তবুও আস্তে আস্তে স্টোর রুমের সামনে আসলো সেখানে আরিবা পরে আছে। আরশ খুব ভয় পেয়ে গেলো। আরিবাকে সোজা করে গালে হালকা করে থাপ্পড় দিতাছে আর কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকতাছে।
“রিবা! এই রিবা! কি হইছে? চোখ খোল। দেখ আমি এসে গেছি। কথা বল? ভুল হইছে আর কখনো তোকে বকবো না। এই দেখ কান ধরেছি তবুও চোখ খোল।
আরশ পাগলের মতো করে ওকে ডাকছে কিন্তু ওর হুঁশ নাই। আরশ কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। কিছুন পর নিজেকে সামলে ওকে কোলে করে রুমে এনে শোয়ায়ে দিছে। আরশ চেক করে দেখলে ভয়ের কিছু নাই তাই আরিবার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
রাত প্রায় শেষ হতে চললো। আরশের আজ ঘুম আসবেনা। ও বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো ওর ভালোবাসা কি আরিবা বুঝবে? আরিবা যদি সব জেনে যায়? নাহ জানতে দিবেনা সে। যেটা এত বছর লুকানো ছিলো ওটা সারাজীবনেই লুকিয়ে রাখবে। জানলে ওকে কি কখনো ক্ষমা করবে? এই ভুলের ক্ষমা হয়?
সত্যিটা জানলে আরিবা আমায় ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই আরশের মন অস্থির হয়ে উঠলো। ও আরিবাকে ওর সাথে শক্ত করে মিশিয়ে নিলো যেনো আরিবা চাইলেও দূরে যেতে না পারে।
———————
মি. জাকির ও মি. আফজাল খবরের পাতা উল্টাচ্ছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এমন সময় রান্না ঘর থেকে মিসেস আনজুমান মি. জাকির কে উদ্দেশ্য করে বললো।
” লাই দিয়ে তোমরা মেয়েটাকে মাথায় তুলছো। এখনো ঘুম থেকে উঠার নাম নিচ্ছেনা।”
মি. জাকির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন–
“সে কি! ৭.৩৪ বাজে, ওর না ৮টায় কোচিং?”
“সবে খেয়াল হলো তোমার?”
মিসেস তারিন আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বের হচ্ছে আর বলছে।
” থাক একদিন না গেলে কিছু হবেনা।”
মি. আফজালও তার স্ত্রীর কথায় তাল মিলালো।
মিসেস আঞ্জুমান রেগে বললেন।
” হুম সবাই আরও মাথায় করে নাচো। দেখবে একদিন ওই মেয়ে সবাই কে খাবে।”
“থামো। আমার মামনিকে নিয়ে একটাও কথা বলবেনা।”
মি. জাকিরের ধমকে চুম হয়ে গেলেন তার স্ত্রী। তিনি একটু ভেবে গম্ভীর হয়ে বললেন।
” আমি ভাবছি অন্য কিছু, মেয়েটা কি অসুস্থ? এখনো উঠছেনা কেন?”
মি. জাকিরের এই কথায় সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকালো তার দিকে। মিসেস আঞ্জুমান কান্নাময় মুখে বলে উঠলেন–
” আমার মেয়ে কে নিয়ে তুমি এমন অলক্ষনে কথা বলবেনা বলে দিলাম।”
“এতক্ষন বকলো আর এখন আমার দোষ?”
“দেখ আঞ্জু কিছুই হয়নি কাদিস না।”
মিসেস তারিন আঞ্জুমান কে পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিচ্ছে। তবুও যেনো সে স্হীর থাকতে পারছেনা। যতই বকুক নিজের আদরের একমাত্র মেয়েই তো।
“এত কথা না বলে গিয়ে দেখি। চল!!”
মিস্টার আফজালের কথায় সবাই সায় দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো।
“রিবা ঠিক আছে কাওকে যেতে হবেনা।”
এ কথা শুনে অগত্যা সবাই সিঁড়ির দিকে তাকালো। আরশ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামছে আর এ কথা বলছে।
মিস্টার আফজাল সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
” তুই কি করে জানলি।”
আরশ বিরক্ত সুরে বললে।
“ওফফ বাবা! তোমরা সবাই কথা বলতে ছিলে তাই দেখে আসছি। that’s clear!”
“I know my dear son!!”
মিসেস আঞ্জুমান লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন।
“আমার বাবাইটা যখন বলছে তাইলে আমি টেনশন মুক্ত।”
আরশ সবিনয়ে তার কাকিমনি কে জরিয়ে ধরে বললো।
” এই জীবন তোমার পানে সমর্পন করিলাম।”
আঞ্জুমান আরশের গাল দুটো টেনে বললো।
“হায়রে ফাজিল!!”
“কাকিমনি রিবা একটু উইক, ওকে ঠিকমতো খাবার খাওয়াবা।”
“আরশ! কি বলিস? মামনি কি অসুস্থ?”
উত্তেজিত হয়ে কথাটা বললেন মি. জাকির। সবাই প্রশ্নাত্বক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আরশের দিকে।
“নাহ কাকা! রিবা সুস্হ। খাওয়ায় একটু অনিয়ম। ”
আরশের কথায় সবাই স্বস্তি পেলো। আরশের মা আর রিবার মা সবাই কে নাস্তা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আমারও পরানে যাহা চায়..
আমি তাই ও আমি তাই করি গো..
আমারো পরানে যাহা চায়…
দুষ্টামি ছাড়া এ জগতে আমার কিছু নাই..
আমি তাই ও আমি তাই
শুধু দুষ্টামি করি গো….
সবাই চেয়ার টেনে বসতে ছিলো কিন্তু এমন উদ্ভট গান শুনে সবাই সিড়ির দিকে তাকালো। আরিবা সিড়ি দিয়ে হেলে দুলে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে আর গান করছে।
আরিবার এমন অদ্ভুত গান শুনে সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আরিবা সিঁড়ি থেকে নেমে সবার দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে বললো।
কি ব্যাপার! তোমরা আমার দিকে এমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
“তো কি করবে? এটা তুই গান গাইলি!
আরশের বিরক্তি মাখা উওর শুনে আরিবা ভাব নিয়ে বললো।
” হ্যা! কেনো? খুব সুন্দর হয়েছে বুঝি?”
” তোর সুন্দর তোর কাছেই রাখ। যদি আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকতেন তাইলে তোর এই গান শুনো ওনি সোজা পরপারে চলে যেতেন।”
“তিনি পরপারে গেলে আমার কি ভাইয়া? তাতে তার বৌ বিধবা হবে। ওনি বেঁচে থাকলেও আমার কিছুনা মরে গেলেও আমার কিছুনা।”
আরিবা মুখ বাঁকিয়ে কথাটা বললো। অতঃপর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চেয়ারে বসে পরলো নাস্তা করতে। আরশ আরিবার দিকে চোখ গরম করে চেয়ে আছে। ওর ডোন্ট কেয়ার ভাবটা তার সহ্য হচ্ছে না। অগত্যা সে রিবার মাকে বললো।
“দেখছো কাকিমনি! তোমার মেয়ে মানুষের মৃত্যু কামনা করতেও ভয় পায়না। কদিন পর আমায় খুন করলেও ওর কিছু মনে হবেনা।”
আরশের কথা শুনে ওর মা ওকে ধমক দিয়ে বললো।
“আরশ! মুখে যা আসছে তাই বলছো? চুপচাপ খাও। রিবা খুব লক্ষী মেয়ে।”
“হু আমার কাকিমনি টাই শুধু আমায় বুঝে আর কেউ আমায় বুঝেনা।”
আরিবা মুআকি হেসে কথাটা বলে খাওয়ায় মন দিলেো।
” কেনো মামনি আমি ভালোবাসি না?”
“বাবা! আমি জানিতো তুমি আমায় কতো ভালোবাসো।”
আরিবা পরোটা ছিড়ে মুখে দিতে দিতে বললো।
“তো? আমি বুঝি মামনিকে ভালোবাসি না? মামনিটার কি চাই বলো তোমার কাকা সব তোমার সামনে হাজির করবে।”
“কাকা আমার কিছু লাগবেনা। আমি জানি তোমরা আমায় অনেক ভালোবাসো। শুধু আম্মু আর তোমার গুণোধর ছেলেটাই আমায় সহ্য করতে পারেনা।”
আরিবা পরোটা চিবাতে চিবাতে ওর কাকার কথার জবাব দিলো। আরিবার কথা শুনে ওর মা কটকট করে বললেন।
“হুম, আমরাতো ভালোবাসিই না। যে তোমায় উল্টো পাল্টা কাজ করতে দিবে সেই ভালো তাইনা? এই দুধ ডিম খেয়ে তারাতারি স্কুলে যা!”
আরিবা দুধ আর ডিম দেখেই ঠোঁট উল্টালো। যেনো পৃথিবীর সব থেকে খারাপ বস্তু তাকে খেতে দিছে। দুধ যদিও একটু খেতে পারে ডিম খেলেই তো বমি আসে। এসব ভেবে সে মনে মনেই কঁদে দিলো।
আরশ ওর দিকে তাকিয়ে বললো।
” ওই যে মহারানী! ঠোঁট উল্টিয়ে লাভ নেই। চুপচাপ এগুলো খা। কথা বললে আরো বেশি এনে দিবো।”
আরিবা ওর বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
“বাবা! তুমি কিছু বলো?”
“মামনি খাও! তোমার শরীর দূর্বল খেতে হবে।”
বাবার সোজাসাপ্টা কথা শুনে আরিবা ওর কাকার দিকে তাকালো তিনি চোখ দিয়ে বুঝালেন তিনি এখন কিছুই করতে পারবেননা। আরিবার কাকিমনিও একই ভাব করলেন। আরিবার মা এসব দেখে ঝাড়ি মেরে বললেন।
“এদিক ওদিক তাকিয়ে কি হবে? তারাতারি খা”
আরশ খেতে খেতে বললো।
” কাকিমনি তুমি কিছু বইলো না! ৫মিনিট দেখো! না খেলে আরো দুধ আর ডিম আনবে।”
আরিবা আবারও কান্না মাখা মুখ নিয়ে বাবা ও কাকার দিকে তাকালো। তারা তাকে খেতে বলে মাথায় হাত বুলিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। আরিবা এবার আরশের দিকে তাকালো। নিজে একটু স্টং করে দাঁত কেলিয়ে বললো।
“ভাইয়া!! বলছিলাম কি..”
আরিবার দাঁত কেলানো তো আরশের মন গললো না। সে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো।
“চুপচাপ খেয়ে রেডি হয়ে আয়। আমিও আজ তোর স্কুলে যাবো।”
আরিবা আবাক হয়ে বললো।
“ভাইয়া!! তুমি মেডিকেলে পড়া ছেরে দিয়ে স্কুলে ভর্তি হবে?”
“just shut up!! Stupid!!”
আরশের রাগ নিয়ে বলা কথায় যেনো আরিবা ভয় পেলোনা। সে অসহায় ভাব নিয়ে বললো।
“এখানে চুপ করার কি আছে ভাইয়া? আমি আগেই বলছিলাম মেডিকেলের পড়া কঠিন তুমি পাড়বেনা।”
আরশ রেগে কিছু বলতে নিবে কিন্তু তার আগেই তার মা তাকে থামিয়ে দিয়ে রাগ নিয়ে বললেন।
“চুপ! তারাতারি খা! ঝগড়া শুরু করছোছ, তুই কি এখনও ছোটো নাকি?
আরিবা তার কাকির কথায় তাল মিলিয়ে বললো।
“হ্যাঁ!! তাইতো বলো কাকিমনি। ভাইয়া তো অনেক বড়ো সে কেন ঝগড়া করবে? ঝগড়া তো করবে আমার মতো ছোটো ছোটো বাচ্চা মেয়েরা।”
আরিবার মা তাকে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন।
” ক্লাস টেন এ পড়ছ আবার নিজেকে বাচ্চা দাবি করোছ? এই বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিল বুঝলি?”
“ওকে তো আমাকেও দিয়ে দাও! আমি তো মানা করিনি।”
আরিবা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পা দুলাতে দুলাতে কথাটা বললো। আরিবার মা ও কাকিমনি অবাক চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। তারা বুঝতে পারলোনা যেই মেয়ে বলতো জীবনেও বিয়ে করবেনা সে এসব বলছে? আরশের কথাটা বুঝতে একটু টাইম লাগছে কথাটা ঠিক ওর বোধগম্য হলোনা। ওতো রিয়াকশন দিতেই ভুলে গেছে তবুও কয়েক সেকেন্ড পর আরশ নিজেকে ঠিক করে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
“তারাতারি এগুলো খেয়ে রেডি হয়ে আয়! আজ তোকে বিয়ে দিতেই নিবো।”
আরিবা আরশের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু আরশের চোখের দিকে তাকিয়ে সে ভয় পেয়ে গেলো। আরশের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। হাত দিয়ে গ্লাসটা এমন ভাবে ধরে আছে যেনো এখনই ওটা ভেঙে যাবে। আরিবা ভয়ে আর কিছুই বললোনা। চোখ মুখ খিচে সব শেষ করলো। তারপর পানি টা খেয়ে টেবিলের উপর গ্লাসটা শব্দ করে রেখে আরশের দিকে একবার গরম চোখে তাকালো। দেখলো আরশ অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো এখানে কি হইছে সে কিছুই জানে না। আরিবার মাথা গরম হয়ে গেলো। সে পা দিয়ে জোরে জোরে শব্দ করে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল।
আরশ ওর যাওয়ার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো। ওর মায়াপরীর মনে কি তাইলে অন্য কেউ বাস করছে? যদি তার মায়পরীর মনে অন্য কেউ থাকে? তাহলে সে কি করে তাকে বের করবে? কিভাবে করবে সে? তাইলে তো তার মায়াপরী কষ্ট পাবে। সে তো পারবেনা তার মায়াপরীকে কাঁদতে দেখতে। সে কি পারবে তার মায়াপরীকে ছাড়া থাকতে? যদি মায়াপরী তাই চায় তাকে পারতেই হবে। এসব ভেবেই তার ভিতরে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।
মিসেস আঞ্জুমান ও মিসেস তারিন আরশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
চলবে…
- (ভুলত্রুটি মাফ করবেন। হ্যাপি রিডিং😊😊)