অজানা_আলোর_খোঁজে পর্ব-১০

0
1629

#অজানা_আলোর_খোঁজে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১০

তানভীর কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে গেল। কি বলবে বুঝতে পারছিল না। শুধু অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। রুকু খেয়াল করল একটা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো ভীষণ লম্বা। চোখ গুলো টানা টানা। বেশ ধবধবা ফর্সা। রুপকথার রাজকন্যা বললে ভুল হবে। রুপকথার রাজকন্যার থেকে আরও সুন্দর বলতে হবে। রুকু মেয়েটার রুপের সৌন্দর্য দেখে এতটাই বিমোহিত যে সে চোখ সরাতে পারছে না। যতই চোখ সরানোর চেষ্টা করছে ততই যেন চোখটা আরও বেশি করে মেয়েটার দিকে তাক হয়ে আছে। মনে মনে ভাবতে লাগল এ মেয়েটা কে? এর সাথে তানভীরের সম্পর্কই বা কী। চুপ করে এসব ভাবতে লাগল। এর মধ্যে মেয়েটি বলে উঠল

– কি রে কেমন আছিস? আগের থেকে তো বেশ বদলে গেছিস।

তানভীরের চোখটা তখন মেয়েটার দিকে তাক করা। মেয়েটার কথায় তানভীর মেয়েটার মুখ থেকে চোখটা সরিয়ে নিল তারপর বলে উঠল

– আরে নিশা তুই এখানে? আমি তো বেশ ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস?তুই ও তো বেশ বদলে গেছিস।

মেয়েটা হালকা হেসে জবাব দিল

– এক মেয়ের মা হয়ে গেছি বদলাব না এখনো।

কথাটা শোনে রুকু হা করে তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে। কে বলবে এ মেয়েটার একটা বাচ্চা আছে। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য ১৯-২০ বছরে পা দিয়েছে। অপরদিকে মেয়েটার কথা শোনে তানভীর একদম চুপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার ভেতরে কোনো ঝড় আঘাত হেনেছে। মুখ ফুটে অনেক কথায় বলতে ইচ্ছে করছে তার তবুও অজানা বাঁধা যেন মুখটাকে আটকে দিচ্ছে। বেশ তালগোল পাকিয়ে ফেলছে সবকিছু৷ নিজেকে সামলাতে চেয়েও সামলাতে পারছে না। আনমনা হয়ে যাচ্ছে বারবার। মনের বিরুদ্ধে তোলপাড় চলছে তার। সে তোলপাড়কে দমিয়ে দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল

– বাহ! তোর মেয়েও হয়ে গেছে। মেয়ের বয়স কত হলো?

– এই তো দু বছর চলে।

– বাহ! বেশ ভালো তো। তা তোর স্বামী কেমন আছে? কেমন চলছে তোর দিনকাল।

নিশাকে স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করতেই নিশা একদম চুপ হয়ে গেল। নিশার নীরবতা দেখে তানভীর বলে উঠল

– কি রে চুপ হয়ে গেলি যে?

– নাহ এমনি কিছু না। এসব কথা বাদ দে তো।

– আরে বল না কি হয়েছে?

বলেই নিশার চোখের দিকে তাকাল। খেয়াল করল নিশার চোখের কোণে এক বিন্দু অশ্রুজল চিকচিক করছে। এই বুঝি জলটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। চোখের জলটাকে আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে বারবার। তবুও শেষ পর্যন্ত আড়াল করতে পারেনি। টুপ করে জলটা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। নিশাকে কাঁদতে দেখে তানভীরের বুকের ভেতরটাও যেন হুহু করে উঠল। নিশার দিকে একটু এগিয়ে বলল

– কি রে কি হয়েছে বললি না তো। এভাবেই বা কাঁদছিস কেন? বাপ্পি ভাই ঠিক আছে তো?

নিশা উড়নার কোণা দিয়ে চোখের জলটা মুছতে মুছতে বলল

– তেমন কিছুই হয়নি। বাপ্পি ভালোই আছে।

– তাহলে কাঁদছিস কেন?

– বাপ্পির সাথে ডিভোর্স হয়েছে সবে আট মাস হলো। তুই ঠিকেই বলেছিলে বাপ্পি ছেলেটা ভালো না। সেদিন তোর কথা না শোনে বেশ বড় ভুল করেছি। সেদিন তোকে অনেক অপমান করেছিরে। তুই পারলে ক্ষমা করে দিস।

ডিভোর্স এর কথাটা শোনতেই তানভীরের মনটা ব্যাকুল হয়ে গেল।

– আমি ঐদিকের কথা এখনো মনে রাখব সেটা ভাবলি কি করে? কবে কি হয়েছে এগুলো নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোর ভালো সবসময় চেয়েছিলাম আজকেও চাই। আল্লাহ তোকে উত্তম প্রতিদান দিক। তা কোথায় যাচ্ছিলি তুই?

– এখানে ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম পাঁচদিন হলো। একটা কাজে এসেছিলাম। ঐ কাজেই যাচ্ছি।

– ওহ আচ্ছা। তা তোর মেয়ে কোথায় মেয়েকে তো দেখছি না।

কথাটা শোনে নিশা হাত দিয়ে ইশারা করে একটা ছেলের কোলে ছোট বাচ্চা দেখাল। তানভীর বাচ্চাটাকে দেখে বলল

– বাহ তোর মেয়ে তো তোর মতোই সুন্দর।

নিশা হালকা হেসে বলল

– তুই ও না। তা তোর পাশে কে? বিয়ে করেছিস নাকি? নাম কি ওর।

তানভীর কি বলবে বুঝতে পারছিল না। সত্যি বললে ভালো হবে নাকি মিথ্যা বললে ভালো হবে সেটা তানভীরের অজানা। রুকু শুধু তানভীর আর নিশাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। তানভীরের নীরবতা দেখে নিশা পুনরায় বলে উঠল

– কি রে বললি না তো কে হয় মেয়েটা।

তানভীর আমতা আমতা করে বলল

– হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস। বিয়ে করে নিয়েছি ওকে। কিছুদিন হলো বিয়ের। কুয়াকাটা হানিমুন করতে এসেছি।

নিশা এক গাল মিথ্যা হেসে বলল

– তা তোর বউয়ের নাম কি?

– সম্পূর্ণ নাম রুকাইয়া। তবে সবাই রুকু বলে ডাকে।

– বাহ বেশ সুন্দর নাম। কিন্তু এভাবে মুখ মুড়িয়ে আছে কেন?মুখটা একটু খুলতে বল দেখি দেখতে কেমন।

তানভীর আমতা আমতা করে বলল

– আসলে ও সবার সামনে মুখ খুলতে লজ্জা পায়। মনে কিছু নিস না। অন্য একদিন দেখাব। এখন গেলাম রে পরে কথা হবে।

বলেই যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করতে লাগল।নিশাকে তানভীর এড়িয়ে যাচ্ছে এটা যেন নিশা মেনে নিতেই পারছে না। এক রাশ কষ্ট যেন তাকে গ্রাস করছে। তবুও কিছুক্ষণ নীরব থেকে মুক্ত মাখা দাঁতগুলো বের হালকা হেসে বলল

– আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থাকিস।

কথাটা বলার পরপরই রুকুকে নিয়ে তানভীর বি আর টিসির কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কেটে বাসে বসল। বাসে বসতেই রুকু তানভীরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল

– মেয়েটা কে ছিল?

কথাটা শোনেই তানভীরের রাগটা পাহাড়সম হয়ে গেল। দাঁতটা কিড়মিড় করে বলল

– কে সেটা আপনার জানার দরকার নেই আপনি যেমন আছেন তেমনিই থাকেন। বেশ অদ্ভূত মেয়ে আপনি। এত প্রশ্ন করার কি হলো?

তানভীরের এমন আচমকা রাগে রুকু ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে মুখটাকে ফ্যাকাশে করে বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। তানভীর কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুকুকে বলল

– মেয়েটার নাম নিশা।মেয়েটা আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়তাম। আমার ব্যাচমেট। খুব ভালো লাগত ওকে। প্রথম দেখায় হালকা ভালোবাসায় মুড়ে নিয়েছিলাম ওকে। অসম্ভব মায়াময় মুখের আদলে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলাম। আমি অনেক ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাধে নিশার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় বেশ ভালো করেই। নিশার প্রতি মনের অজান্তেই বোকার মতো অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। বেশ শান্ত আর গম্ভীর স্বভাবের ছিলাম। তাই বেশ কয়েকবার মনের কথা বলতে চেয়েও বলতে পারি নি। তবে বন্ধু মহলের সবাই জানতো আমি নিশাকে অনেক পছন্দ করি। কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে নিশার কানে এ কথাটা গেলেও নিশা তেমন পাত্তা দেয়নি। আমার সাথে তার কথা স্বাভাবিক ভাবেই হত। একদিন বেশ সাহস করে বললাম

– নিশা তোকে অনেক ভালোবাসি। চাইলে বিষয়টা বিয়ের দিকে এগিয়ে নিতে পারি। তুই কি বলিস?

নিশা তখন আমার স্বপ্নটাকে ভেঙ্গে দিয়ে বলল

– তানভীর আমি তোকে সবসময় নিজের বন্ধুর মতো দেখে এসেছি৷ আর আমি ভালোবাসি বাপ্পিকে। সুতরাং এ বিষয়টা দ্বিতীয় বার আর তুলবি না। বন্ধু আছিস বন্ধুর মতোই থাক।

রুকু অবাক হয়ে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে তানভীরের কথা শোনছিল। তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল

– এ বাপ্পিটা কে?

– আমাদের সিনয়র ভাই ছিল। যাইহোক যখন বুঝতে পারলাম নিশা বাপ্পি ভাইকে ভালেবাসে তখন আর নিশাকে পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনায় পুনরায় মনোযোগ দিলাম। একটা সময় জানতে পারলাম বাপ্পি ভাইয়া ড্রাগস নেয় নেশা করে। একাধিক ময়ের সাথে রিলেশন করে। মেয়েদের পটিয়ে রুম ডেট করে। আরও অনেক বাজে অভ্যাস আছে তার। বড়লোক বাপের ছেলে তো টাকা উড়াতে কষ্ট লাগে না আরকি। এটা জানার পর আমি নিশাকে সবটা বললাম। নিশা আমার কথা শোনে বাপ্পি ভাইকে সব বলল। বাপ্পি নিশাকে কি বুঝিয়েছিল জানি না৷ নিশা বাপ্পি ভাইয়ের কথা শোনে আমাকে ক্যাম্পাসে সবার সামনে চড় দিয়ে বলল

– আমাকে পাবার জন্য বাপ্পির নামে এত গুলো মিথ্যা বলতে তোর বিবেকে বাঁধল না।

আমি শুধু হা করে নিশার কথা শেনছিলাম। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম ঠিক। তবে ভালেবাসা যে পেতেই হবে সেভাবে ভালোবাসি নি।ভালোবেসেছিলাম উদার মনে।
সেদিনের পর থেকে নিশার সাথে আর কথা হয়নি। তিন বছরের বন্ধুত্বটাও নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। আমি গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে অন্য কেথাও ভর্তি হয়ে নিই। আর নিশা বাপ্পিকে বিয়ে করে নিল। নিশার সাথে বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ নেই। সাড়ে তিন বছর তো হবে।এর মধ্যে আমি মাস্টার্স শেষ করলাম। আর দুবছর যাবৎ বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছি। টুকিটাকি ব্যবস্যা করছি হাত খরচটা চালানোর জন্য আর ভবঘুরে হয়ে বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করছি। এ ছিল আমাদের কাহিনি। অনেক দিন পর ওকে দেখে চমকে গেছিলাম। কথা বলতে চেয়েও কথা বলতে পারছিলাম না।

রুকু কাহিনিটা শোনার পর তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল

– নিশাকে বড্ড ভালেবাসেন তাই না?

রুকুর প্রশ্নটা শোনে তানভীর কোনো জবাব দিল না৷ কারণ তার উত্তর হয়তো তানভীর নিজেও জানে না। চুপ করে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে রইল। এর মধ্যেই বাসটা ছেড়ে দিল কুয়াকাটার উদ্দেশ্য। রুকু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাসের সিটে হেলান দিয়ে রইল। মিনিট বিশেক পর তানভীরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল৷ কারণ….

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

আজকে ভীষণ ব্যাস্ত তাই পর্ব ছোট হয়েছে। গল্প সম্পর্কিত আপডেট পেতে কমেন্টে দেওয়া লিংকে ঢুকে গ্রূপে জয়েন করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here