আজ জুঁইয়ের কলেজের ফাস্ট দিন।
ফাস্ট দিন বলতে…. আজ ওদের নবীন বরণ। আর এদিকে জুঁইয়ের মাথাটাও প্রচন্ড ব্যাথা করছে। ইচ্ছে করছে শুয়ে থাকতে,কিন্তু এমনিতেই ৫ মিনিট লেইট হয়ে গেছে,শুয়ে থাকলে চলবে না।তাই কোন রকমে তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হলো। আর ভাগ্য ভালো ছিলো যে,রাস্তায় বের হতে না হতেই একটা রিক্সাও পেয়ে গেলো। আর কলেজটাও ওর বাসা থেকে খুব একটা দূরে না,১০ টাকার ভাড়া লাগে যেতে….
রিক্সায় ওঠে, চোখ দুটো বন্ধ করে স্বস্তির শ্বাস নিলো জুঁই। রিক্সা চলছে তার গতিতে,একে একে সব কিছু পিছনে পেলে,তারই সাথে তাল মিলিয়ে জুঁই ও ভাবছে মনে মনে,সময় কত ঠুনকো দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছে সে।স্কুল লেভেল পার করে আজ কলেজে।কখন যে স্কুলের গন্ডি পার করে কলেজে পৌঁছে গেছে টেরও পায় নি।
— আফা!! আইসা পারছি নামেন..’!
জুঁইয়ের কল্পনার ঘোর ভাঙ্গে রিক্সা ওলার ডাকে,জুই রিক্সা থেকে নামতে যাবে ঠিক তখনই রিক্সায় লেগে ওর ওড়নাটা ছিঁড়ে যায়।কি বিচরি একটা ব্যাপার, বিরক্তে চেয়ে গেলো জুইয়ের পুরো মুখ।প্রথম দিন কলেজে যাবে,তাও কি না ছেঁড়া ওড়না পড়ে? ভেবেই যেন ওর কান্না পাচ্ছে। রিক্সা ওলাকে ভাড়া মিটিয়ে কোন রকমে কলেজে ঢুকলো জুই।অনুষ্ঠান প্রায় আরম্ভ হয়ে গেছে। স্টেজে দুই টি মেয়ে তালে তাল মিলিয়ে নেছে যাচ্ছে,কী মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, এক নিমিষেই মন ভালো করে দেওয়ার মতো,জুইঁ ঐ দিকেই এগোছিলো,তখন পিছন থেকে কেউ একজন বলে ওঠলো –
— ছেঁড়া ওড়না পড়ে এসেছো কেন?
এমন প্রশ্নে জুঁইয়ের ইচ্ছে করছিলো, মাটির নিচে চলে যেতে,তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হচ্ছে না,তখন সে আবারও বলে ওঠলো-
— কী হলো বলছো না কেন? ছেঁড়া ওড়না পড়ে এসেছো কেন?
এবার জুঁই কিছুটা রেগেই গেলো,নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে বলেই পেললো,
— আজব তো!! এক প্রশ্ন বার বার করছেন কেন? কেউ তো আর শখ করে ছেঁড়া জামা পড়ে আসে না তাই না?
কথাটা বলেই জুঁই আর এক মিনিটও দাড়ালো না। সোজা গিয়ে স্টেজের সামনে রাখা পিছনের একটি চেয়ারে গিয়ে বসলো।নিজেই নিজেকে গা/লি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে, কীভাবে এত কেয়ার লেস হয় সে,ভাবতেই রাগ হচ্ছে।
অবশেষে জুঁই সকল ভাবনাকে সাইডে রেখে অনুষ্ঠানে মন দিলো,সব কিছু বেশ ভালোই লাগছে,। একের পর এক নাচ, গান,আবৃত্তি, আহা! কী মনমুগ্ধকর..!”
এরই মাঝে একটা মেয়ে এসে জুঁইয়ের হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো–
–এই নেও,,ওড়নাটা পড়ে নেও।
জুঁই তো পুরাই অবাক,সে তো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে,এই মেয়ে কেন ওকে ওড়ানাটা দিলো? সে তো মেয়েটা কে চিনে না।
তখন মেয়েটা আবারও বলে ওঠলো …….
— কী হলো! হা করে তাকিয়ে আছো কেন?ওড়নাটা পড়ে নেও..
জুই এবার আর কিছু না ভেবে বলেই পেললো
— আপনার দেওয়া ওড়না আমি কেন পড়বো? আপনি বা কেন আমাকে ওড়না দিতে যাচ্ছেন? কে আপনি?
— এই ওড়নাটা আমি দিচ্ছে না তোমাকে, এই ওড়নাটা ফাহাদে পাঠিয়েছে। বলছে তোমাকে দিতে।
– ফাহাদ……?
জুই বেশ অবাকই হলো কারণ ফাহাদ, নামের কেউকে তো সে চিনে না,তাহলে অচেনা কেউ একজন কেন তার জন্য ওড়না পাঠাবে? আজব তো…সাত /পাঁচ না ভেবে জুই এবার বলেই পেললো —
— ফাহাদ কে? আমি তো এই নামের কাউকে চিনি না। কে এই ফাহাদ?
এবার মেয়েটা আঙ্গুল দিয়ে দুরে দাড়িয়ে থাকা ফাহাদকে ইশারা দিয়ে দেখালো।
জুঁই তো এবার অবাকে শীর্ষে..!” এইটা তো সেই ছেলে, যে কী না ওকে প্রশ্ন করে ছিলো, “”ছেড়া ওড়ানা পড়ে এসেছো কেন?”” তাহলে কি এই ছেলের নামই ফাহাদ 🤔
জুঁইয়ের রাগ করার কথা ছিলো,কিন্তু কেন জানি না,ওর চোখ দুটো কৃতজ্ঞতায় ভরে গেলো। সে ভাবলো হয় তো বা লোকটা ওকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতেই ওড়নাটা পাঠিয়ে,হয় তো বা বুঝতে পেরেছে তার অস্বস্তি টা।না লোকটা কে সে যতটা খারাপ ভেবেছে ততটাও খারাপ না। লোক টা তো একটা ধন্যবাদ ডিজার্ভই করেই।
অন্যদিকে…….
বন্ধুদের সাথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলছিলো, ফাহাদ।
ফাহাদ হচ্ছে,এক ধনী পরিবারের আলালের ঘরের দুলাল। দেখতে যেমন সুন্দর, তেমন ই পড়ালেখায়ও পারদর্শী, বাবার এক মাত্র ছেলে। শহরের বড় বড় নাম করা বিজনেস ম্যানদের মধ্যে একজন হচ্ছে ওর বাবা আহাস নুর। ফাহাদ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না এই আহাস নুর।আর ফাহাদও বাবা বলতে পাগল।পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার বিজনেসেও জয়েন করেছে সে,বিজনেসে তারও নাম ডাক রয়েছে।বিজনেস ব্যাপার টাই ফাহাদের বেশ ভালো লাগে….।
বন্ধুদের সাথেই কথা বলায় মগ্ন ছিলো ফাহাদ তক্ষণ পাশ থেকে মিষ্টি একটা শীতল কন্ঠে কেউ একজন বলে ওঠলো…
— ধন্যবাদ
ফাহাদ যেন থমকে গেলো,পাশে তাকিয়ে দেখে ছেঁড়া ওড়না পড়ে আসা সেই মেয়েটা যাকে সে ওড়না পাঠিয়েছে…হয়তো বা ওড়ানাটা পেয়েই খুশিতে ওকে ধন্যবাদ বলতে এসেছে…..
তাই সেও বললো…
— না,না,ধন্যবাদ দিতে হবে, মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাড়ানো টাই তো আমাদের কতব্য তাই না….
এবার জুঁই কিছুটা মৃদু হেসেই বললো,
— আমি জুই,ইন্টার ফাস্ট ইয়ার। আপনি?
— আমি ফাহাদ, অনার্স থার্ড ইয়ার।
— ওহহ আচ্চা।
— হুম,আচ্চা আপনি যদি রাগ না করেন,তাহলে একটা কথা বলবো?
— জ্বী বলেন.
— এই কার্ড টা আপনি রাখোন, আপনার যদি কোন পরিবারি,বা আস্থিক কোন সমস্যা থাকে তাহলে আপনি সেখানে যোগাযোগ করতে পারেন,এটা আমাদের সংগঠন আমরা দরিদ্রদের সহযোগিতা করে থাকি,বিশেষ করে তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে।
আপনিও চাইলে ঐখানে সাহায্য চাইতে পারেন।তবুও প্লিজ এই সব ছেঁড়া জামা কাপড় পড়ে কলেজে আইবেন না..খারাপ দেখায়….( ফাহাদ খুবই স্বাভাবিক ভাবেই বললো কথাটা, কারণ সে দরিদ্রের সাহায্য করতে উদ্ধহু, সে অনেক দরিদ্র পরিবার কেই সাহায্য করেছে এর আগে,তাই ওর কাছে ব্যাপারটা খুবই নরমাল।)
এদিকে জুই তো এইসব শুনে পুরাই হা,, কি সব বলছে এই ছেলে।পাগল টাগল নয় তো.? জুই হচ্ছে চৌধুরী বাড়ির মেয়ে, ছোট বেলা থেকেই কোন অভাব তাকে স্পর্শ করতে পারে নি।যখন যা চেয়ে তখন তা পেয়েছে,আর এখন কী না এইসব শুনতে হচ্ছে।
এবার যেন কিছুটা রাগ জুইকে আকড়ে ধরলো,না জেনে না বুঝে একটা মানুষ কিভাবে এইসব বলতে পারে,রাগ যেন জুইয়ের মাথায় আগুন জ্বলছে,জুইয়ের সমস্ত কৃতজ্ঞতা যেন এক নিমিষেই রাগে পরিণত হলো,, রাগে, ক্ষোভে,সে এবার ওড়নাটাই ছুড়ে মারলো ফাহাদের মুখে। আর সাথে বলতে ও লাগলো….
— আমাকে দেখে কি আপনার ফকির মনে হয়? ছেঁড়া ওড়না পড়া মানেই কি ফকির?
ফাহাদ তো পুরাই অবাক,এই মেয়ে এমন করছে কেন? সে ভুলটা কি বলছে। এবার সে কিছুটা পরকে হেলো,আমতা আমতা করে বলতে লাগলো…
— আসলে আপনি যা ভাবছেন তা না,আসলে হয়েছে কি,, ঐ যে তখন তো আপনি নিজেই বললেন যে, “কেউ তো আর ইচ্ছা করে ছেঁড়া জামা পড়ে আসে না” তাই ভাবছি আপনার হয় তো আর্থিক অবস্থা ভালো না, তাই বাধ্য হয়ে ছেঁড়া জামা পড়ে এসেছেন।
— ও মাই গুড নেস!! আপনি এইসব ভেবে আমাকে ওড়না পাঠিয়েন,আর আমি তো ভাবছি আপনি আমার অস্বত্তিটা বুঝতে পেরে ওড়নাটা পাঠিয়েছেন,। কান খুলে শোনে রাখোন,, আমি ভিক্ষারী নই,আমি ইচ্ছে করে ছেড়া ওড়না পড়ে আসি নি, আমার ওড়নাটা রিক্সায় লেগে ছিড়ে গেছে। আর তক্ষণ কোন উপায় ও ছিলো না তাই এই ছেড়া ওড়নাটা পড়ে আসতে হইছে,আর তার জন্যই বলছি যে, “কেউ তো আর ইচ্ছা করে ছেঁড়া ওড়না পড়ে আসে না তাই না”
এবার ফাহাদ সবটা বুঝে পারলো,পুরোটাই এখন ওর কাছে জলের মতো পরিক্ষার।কিন্তু এখন সে কি করবে..?সরি বলবে? কিন্তু ফাহাদ তো সরি বলতে পারে না,সে তো আজ পর্যন্ত কাউকে সরি বলে নি। আজ সে কেমন করে বলবে? তাই সে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো,কি বলবে সেটাই ভাবছে…..
এদিকে জুই তো রাগে ক্ষোভে আর এক মিনিটও দাড়ালো না সোজা……….
চলবে…?
গল্প 👉 অতঃপরঃ ইতি
পর্ব – ১
লেখিকা👉 অপরাজিতা আফরিন মিম