#অদ্ভুত_প্রেমোমোহ_তুমি
#পর্বঃ৩৪
✍️ তাজরিয়ান খান তানভি
হসপিটালে শুয়ে আছে আশফিক।ইনশিরাহ এর অগ্নিদৃষ্টির চাহনিতেই ভষ্ম হয়ে যাচ্ছে আশফিক।
কাল রাতে ওই লোকগুলো ইনশিরাহ কে উঠিয়ে নিতে এসেছিলো।মারশিয়াদ তার গান অলওয়েজ সাথে রাখে।মারামারির এক পর্যায়ে শুট করা হয় তা গিয়ে লাগে আশফিক এর গায়ে।মারশিয়াদ এর গায়ে শুধু ছুরির পোচ লেগেছে।এইসবে সে অভ্যস্ত।তাই তার তেমন বেগ পেতে হয়নি।ডক্টর তিনটা স্টিচ করে দিয়েছে।কিন্তু আশফিক শুয়ে আছে।ইনশিরাহ ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলে–
“এই হাঁদারাম,কে বলেছে তোমাকে সেখানে আসতে??
হলো তো শান্তি!!
“আমি কি জানতাম যে গুলি তোমার গায়ে না লেগে আমার গায়ে লাগবে!!
“কি বলতে চাও তুমি??
“গুলিটা তোমার গায়ে লাগলে ভালো হতো।”
“ইউ রাবিশ!!!
ইনশিরাহ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আশফিক এর সামনে চলে আসে যেনো ওকে এখনই মেরে চ্যাপ্টা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসাবে।মারশিয়াদ এতোক্ষন বসে ওর আর আশফিক এর ঝাল মিষ্টি মাখা ঝগড়া দেখছিলো।
ইনশিরাহ এর গরম মেজাজ দেখে উঠে এসে থামায় ইনশিরাহ কে।
“ক্লাম ডাউন,মিস শিরা-উপশিরা।”
মারশিয়াদ এর মুখে শিরা নাম শুনতেই ইনশিরাহ এর সমস্ত রাগ বরফের মতো গলে যায়।
“আশফিক,হ্যাটস অফ ম্যান।তুমি না থাকলে মিস উপশিরা তো এতোক্ষনে চাঁদের দেশের চরকা কাটা বুড়ির ছেলের বউ হয়ে যেতো।থ্যাংকস আ লট।”
আশফিক আড়চোখে তাকায় ইনশিরাহ এর দিকে।
“তুমি থ্যাংকস বলছো।আর যার বলা উচিত সে তো পারলে আমাকে এখন পাঁচ তলা থেকে নিচে ফেলে আমার ভবিষ্যৎ বউকে বিধবা বানিয়ে দেয়।”
মারশিয়াদ এইবার বেশ জোরেই হেসে উঠে।কিন্তু ইনশিরাহ নাক ফুলিয়ে চক্ষু জোড়া পড়ন্ত বিকেলে আকাশে উড়ে যাওয়া চিলের মতো করে রেখেছে।মারশিয়াদ ওকে নিয়ে হসপিটাল এর করিডোরে চলে আসে।
“হাসসো কেনো তুমি??
মারশিয়াদ ওর অধর সংকীর্ণ করে।
“ছেলেটা কিন্তু তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে উপশিরা।
“একদম বেশি কথা বলবে না তুমি।”
“ওরা তোমাকে নিতে এলো কেনো??
অবশ্য নিয়ে গেলে ভালোই হতো।দ্যা ডায়মন্ড ডিলার কিং ইতিকাফ আজমীর একমাত্র মেয়ে কে কিডন্যাপ করলে কোটি টাকা অনায়াসে হাত করা যেতো।
এই তোমার বাবা কী স্মাগলার নাকি??
“একদম বাজে কথা বলবে না।আমার পাপা এইসব কিছুই করে না।”
“হয়তো।
আশফিক কে থ্যাংকস বলা উচিত তোমার।ও না থাকলে তোমার কিছু একটা হয়ে যেতো।”
“কেনো??
তুমি তো ছিলে।”
“হুম,ছিলাম।কিন্তু গুলিটা ও খেয়েছে তোমার জন্য।তুমি যেমন তোমার তীক্ষ্ম কথার ছুরিকাঘাতে ওর হৃদয়টা ক্ষত বিক্ষত করেছো ঠিক তেমনই ও নিজের রক্ত ঝরিয়ে ভালোবাসার শুদ্ধি পরীক্ষা দিয়েছে।”
ইনশিরাহ চুপ মেরে যায়।কিছু একটা ভেবে চলছে সে।মারশিয়াদ ভুল কিছু বলে নি।
“পাপা,কেনো পাঠালো আমার পিছনে কে জানে!!
না আসলে তো আর গুলিটাও খেতো না।”
“আচ্ছা,জাস্ট ফরগেট ইট।
তোমার বান্ধবীর নাম যেনো কী!!
মনে পড়েছে।নুরাইসা।কী খবর ওর??
ইনশিরাহ ভ্রু কুটি করে বলে–
“কেনো??
“মেয়েটা দেখতে ততটা খারাপ না।”
“কী বলতে চাও তুমি??
“কাল ওকে নিয়ে এসো আমার বাসায়।”
“কেনো??
“দরকার আছে।”
ভাবছি বিয়েটা এইবার করে নিবো।”
“একদম জানে মেরে ফেলবো।”
মারশিয়াদ ওর মুখটা ইনশিরাহ এর মুখের সামনে এনে বলে–
“মেরে ফেলো।
তোমার দাওয়াত আমার চল্লিশায়।খালি হাতে এসো না।একটা ডায়মন্ড বসানো ওয়াচ নিয়ে এসো।”
“ইউ,,,,
ইনশিরাহ উপর্যুপরি কয়েকটা কিল বসিয়ে দেয় মারশিয়াদ এর পিঠে।
,
,
,
সকালে ঘুম ভাঙার পর এমনিতেই মাথাটা ভারী ভারী লাগছে প্রহর এর।সকালে উঠতেও পারেনি জলদি।কাল রাতে আইসক্রীম খেয়েছে ইচ্ছে মতো।তাই এই অবস্থা।তার উপর ঘুম থেকে উঠে আজরাহান কে কোথাও পেলো না।খেতে গিয়ে দেখলো সেখানেও নেই।নন্দিতা কে জিঙ্গেস করলে বলে আজরাহান কোনো একটা কাজে বাইরে গেছে।প্রহর এর ভীষন খারাপ লাগে।একবার বলেও তো যেতে পারতো।নুরাইসা কে পেলো না ঘরে।তখন ওর মাথা গরম হয়ে যায়।নন্দিতার কাছ থেকে জানতে পারে নুরাইসার কলেজে এক্সট্রা ক্লাস ছিলো।সেখানেই গিয়েছে।
নাহ,খাইনি সে সকালে।কাল রাতের ঘটনা এখনো সে ভুলেনি।এতো কিসের টান তার নুরাইসার জন্য!!
ব্যালকনিতে দাড়িয়ে থাকে প্রহর।বেলা দ্বিপ্রহর হতে চলল।প্রভাকর তার তীর্যক রশ্মিবিচছুরণ করছে পৃথিবীর প্রান্তদেশে।প্রহর দেখতে পায় আজরাহান আর নুরাইসা পাড়ার মোড় দিয়ে একসাথেই হাসতে হাসতে আসছে।
চৈত্রের খরায় যেমন মাঠ প্রান্তর চৌচির হয়ে যায় ঠিক নিজেকে তেমন মনে হচ্ছে প্রহর এর।রাগে শরীর দিয়ে যেনো আগ্নেয়গিরি লাভা গড়িয়ে পড়ছে।বিছানায় ধপ করে বসে প্রহর।দুহাত দিয়ে বিছানার চাদর খামছে ধরে যেনো এখনি ছিড়ে ফেলবে।রাগে চোখের কোন বেয়ে শীতল লবনাক্ত নীড় গড়িয়ে পড়ছে।পায়ের আঙ্গুল অনবরত ঘষে যাচ্ছে।
আজরাহান দরজা খুলে ভিতরে আসতেই দম করে দাড়িয়ে পরে প্রহর।
“কোথায় ছিলেন আপনি??
“কাজ ছিলো।”
“আপনার নুরাজান এর সাথে??
আজরাহান অক্ষিকোটর ঘুরিয়ে তাকায়।
“ওর সাথে আমার রাস্তায় দেখা হয়েছে।আর তুই কাঁদছিস কেনো??
“মিথ্যে বলছেন কেনো??
আজরাহান শান্ত কন্ঠে বলে —
“তুই জানিস আমি মিথ্যে বলি না।”
“তাহলে এখন কেনো বলছেন??
“বললাম তো রাস্তায় দেখা হয়েছে ওর সাথে।”
“আমাকে বোকা মনে হয় আপনার??
আমি কিছু বুঝিনা।এতো কিসের টান আপনার তার জন্য!!কেনো বারবার যান তার কাছে??
আজরাহান একটু জোরেই বলে।
“প্রহর!!!
একদম বাজে কথা বলবি না।”
“আমি বললে বাজে!!
আর নিজে যখন বারবার তার কাছে যান তখন??
“তুই কী আমাকে সন্দেহ করিস??
“সন্দেহ কেনো করবো!!
সত্যি করে বলেন তো কী করেছিলেন আপনি সামান ভাইয়ার বিয়ের দিন নুরাইসা আপুর সাথে যে ছোট আব্বু আপনাকে থাপ্পড় মেরেছিলো??
আজরাহান এইবার উত্তেজিত হয়ে বলে–
“আর একটা কথা বলবি না তুই।”
“একশ বার বলবো।এতই যখন তাকে পছন্দ তাহলে তাকেই বিয়ে করতেন।এতো ড্রামা করে আমাকে কেনো বিয়ে করলে??
“এক কথা বারবার ভালো লাগছেনা আমার।”
“তাই নাকি!!
তাহলে নতুন শুনুন।আজ থেকে তাকে আপনার ঘরে এনে রাখেন।আর না হয় আপনি তার ঘরে গিয়ে রাত কাটিয়ে আসেন।তাহলে আর বাইরে যেতে হবে না আপনাদের।”
প্রহর এর এহেন কথায় আজরাহান বেজায় চকিত হয়।ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয় প্রহর এর গালে।প্রহর থপ করে পড়ে বিছানার উপর।আজরাহান ওর বাজু ধরে বলে—
“এই,এতো নোংরা কথা কোথায় শিখেছিস তুই??
এতো কীসের জ্বালা তোর??শরীরের জ্বালা উঠেছে না!!
বের হ আমার ঘর থেকে।বের হ।”
প্রহর ভয় পেয়ে যায়।আজরাহান একদম শীতল রক্তের প্রানী বলা চলে।ওর রাগ কখনো ওর সীমা লংঘন করতে পারে না।কিন্তু আজ প্রহর এর কথায় ও বোধহয় নিজের মধ্যে নেই।
“রাহান ভাইয়া!!
“একদম চুপ।আর একবারও আমার নাম তোর মুখে নিবি না।বের হ আমার ঘর থেকে।”
আজরাহান জোর করে প্রহর কে ঘর থেকে বের করে দরজা লক করে দেয়।প্রহর দরজায় কড়াঘাত করতেই থাকে।আজরাহান এর মোবাইল বেজে উঠে।
“জ্বি বলেন।”
অপরপাশ থেকে ব্যক্তি কিছু একটা বলল।
“কোনো সমস্যা নেই।আমি যেভাবে বলেছি আপনি সেভাবে করেন।”
কল কেটে আজরাহান বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।ভীষন ক্লান্ত সে।প্রহর এর মুখ থেকে এ ধরনের কথা সে কখনো এক্সপেক্ট করেনি।তাহলে কী প্রহর ওকে সন্দেহ করে???
দরজার বাইরে দাড়িয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে প্রহর।
“রাহান ভাইয়া,খুলেন না দরজা।আমি আর কখনো এইরকম বলবো না।খুলেন না দরজা।
রাহান ভাইয়া!!!
ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।প্রহর এর কান্নার আওয়াজে সেখানে আসে নন্দিতা।
“কী হয়েছে??
“ভাবী,বলোনা রাহান ভাইয়াকে দরজা খুলতে।”
“কাঁদছিস কেনো তুই??
কী হয়েছে??
প্রহর পুরো ঘটনা খুলে বলে।
“তুই কী পাগল হয়ে গেছিস??
এইসব কী বলেছিস তুই ওকে!!!
“আর কখনো বলবো না।আমার ভুল হয়ে গেছে।বলো না তুমি রাহান ভাইয়া কে।”
নুরাইসা সব শুনতে পায়।সিড়ির নিচে দাড়িয় বলে—
“আজরাহান এইবার বুঝবে,হীরে ভেবে সে কাঁচ কে হাতে তুলে নিয়েছে।তার আঘাতে রক্ত তো ঝড়বেই।”
“সব কিছুর জন্য তুমি দায়ী।কেনো যাওনা তুমি এই বাড়ি ছেড়ে??
“কেমন স্ত্রী তুই,নিজের স্বামী কে বিশ্বাস করিস না!!!
সানোয়ার আহমেদ এসে দাড়ায় সেখানে।তাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়।প্রহর কে নিয়ে কাউচে বসায়।
“চোখ মুছ।কিছু হলেই কী কাঁদতে হয় নাকি পাগল মেয়ে!!
“আমি কী করে পারলাম রাহান ভাইয়া কে এতো পঁচা কথা বলতে!!
“স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক।আর এই সম্পর্কের বুনিয়াদ হলো বিশ্বাস।একে অপরকে বিশ্বাসের মাধ্যমেই টিকে থাকে একটি সম্পর্ক,একটি পরিবার।
আর তোর রাহান ভাইয়া কী কোনো ভুল করতে পারে??
প্রহর ঘাড় নাড়িয়ে না বোধক সম্মতি দেয়।
“তাহলে আর কাঁদবি না।তোর রাহান ভাইয়া কী কখনো তোর সাথে রাগ করে থাকতে পারে।কখনো না।ধৈর্য্য ধর সব ঠিক হয়ে যাবে।বি স্ট্রং প্রিটি গার্ল।”
“হুম।”
,
,
,
শহর থেকে দূরে একটা বাংলো বাড়ির সামনে এসে থামে মারশিয়াদ এর গাড়ি।ঘুটঘুটে অন্ধকার।যেনো নিজেকে দেখাও দায়।হালকা পায়ে কোনোরকম ছন্দপতন ছাড়াই বাড়ির ডোর বেল প্রেস করে মারশিয়াদ।দরজা খুলতেই ভিতরে ঢুকে পরে সে।যেনো এক জীবন্ত কবরস্থান।
“কেমন আছো??
মারশিয়াদ এর সামনেই বসা চৌদ্দ কি পনেরো বছরের একটি মেয়ে।
“ভালো।”
“ভয় পাচ্ছো??
মেয়েটি কোনো উত্তর দিলো না।মারশিয়াদ ওর সামনে এসে ললাটে উষ্ণ চুম্বন করে।
“ভাইয়া কে বিশ্বাস করো।আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দিবো না।
আমি আমার সাথেই নিয়ে যাবো তোমাদের।”
মেয়েটি দু ফোটা অশ্রু বিসর্জন দেয়।
“আনটি কেমন আছে??তার দেখাশোনা ঠিক মতো হচ্ছে তো??
“হুম।”
মেয়েটি মারশিয়াদ কে ওর মায়ের রুমে নিয়ে যায় যেখানে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা।পাশেই হুইল চেয়ারে বসা মেয়েটির বাবা।যে অর্ধ প্যারালাইসিস।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শয্যাশায়ী তার প্রিয়তমার দিকে।মারশিয়াদ তার পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসে।
“কেমন আছেন জানতে চাইবো না।জানি ভালো নেই।কিন্তু কথা দিচ্ছি,নৈসরাকে দেওয়া কথা আমি রাখবো”।
লোকটি কিছু বলতে চাইলেন।বাম হাত উচু করতে গিয়েও পারলেন না।তাই এক বাক্যে চোখের জলের মাধ্যমে তার অব্যক্ত কথা প্রকাশ করলেন যে তিনি এখনো বেঁচে আছেন সেইদিনের জন্য।
মেয়েটি ডুকরে কেঁদে উঠে।মারশিয়াদ ঘুরে দাড়াতেই ওকে জড়িয়ে ধরে।
“ভাইয়া,আমরা কি আর কখনো পৃথিবীর আলো দেখবো না??
“কে বলল এই কথা!!
অতি শীঘ্রই দেখবে।আমেরিকার বেস্ট স্কুলে পড়াবো তোমাকে আমি।তুমিও তার মতো একজন ডক্টর হবে।বেস্ট ডক্টর।তোমার ভাইয়া তোমাকে কথা দিচ্ছে।
আজ আসি।কোনো কিছুর দরকার হলেই আমাকে জানাবে।”
মারশিয়াদ বাড়ির বাইরে আসতেই কয়েকজন লোক এসে দাড়ায় সেখানে।
“একটা মাছিও যেনো ভিতরে ঢুকতে না পারে।তাহলে কিন্তু একটা কেও আমি ছাড়বো না।ওয়াসিম কে ওরা কিন্তু ছাড়েনি।বি অ্যালার্ট!!
চলবে,,,