অদ্ভুত প্রেমোমোহ তুমি পর্বঃ৪৩ শেষ পর্ব

0
4516

#অদ্ভুত_প্রেমোমোহ_তুমি
#পর্বঃ৪৩
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

সময় অনেকটা আকাশে ওড়া ঘুড়ির
মতো।যতই তাকে আমরা তার গতিতে চলতে দেই ততই সে তার গতি বৃদ্ধি করে।মৃত্যু অমোঘ সত্য।নশ্বর পৃথিবীর অবিনশ্বর সত্য।জন্ম নিলেই তাকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।তবুও মানুষ স্বপ্ন সাজায়।স্বপ্নের মাঝে বিচরণ তার।হয়তো কখনো পূরন হয় হয়তো কখনো না।তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে।পরিস্থিতি অনেক সময় এমন হয় যে মানুষের বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে।ওই যে ভাগ্যবিধাতা!!
সমস্ত সৃষ্টি তার অনুগত।তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো কিছু করার থাকে না।তবু বলবো–

“তবুও হাসতে হয়
জীবনকে ভালোবাসতে হয়
অন্ধকার কে দূরে ঠেলে
ভোরের আলো খুজতে হয়।”

আজ দীর্ঘ আট মাস পর আজরাহান ফিরছে আমেরিকা থেকে।তৃষ্ণার্ত কাকের মতো দরজার পানে নয়নযুগল আবদ্ধ করে বসে আছে আজরাহানদের বাড়ির প্রত্যেক নরনারী।এক মা।যে তার ছেলেকে চোখে হারায়।এক বোন,যার কাছে খুনসুটির আরেক নাম তার পাজি ভাই।এক ভাবী,যাকে সে বোনের মর্যাদা দিয়েছে।এক ভাই,যে সমসময় তার কৃতকর্মের জন্য ছোট ভাইয়ের কাছে আচ্ছাদন পেয়েছে।এক স্ত্রী,যার অবুজ ভালোবাসায় ঘেরা তার স্বপ্নের ঘর।

নিস্তব্ধতায় ঘেরা বাড়ির ফটকে পা রাখতেই সমস্ত দেহপিঞ্জর কেঁপে উঠে আজরাহান এর।অতি পরিচিত বাড়ি যেনো আজ তার কাছে এক অপরিচিত বদ্ধখোলস।যার থেকে সে পালাতে চায়।কিন্তু পারছেনা।

মারশিয়াদ কে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর জানায় তার হার্ট ড্যামেজ হয়ে গেছে।অতিদ্রুত হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন।তাই ইমার্জেন্সী টিকেটের ব্যবস্থা করে তাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া হয়।সাথে ছিলো আজরাহান আর শিহরণ।কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।অতিরিক্ত ব্ল্যাডিং আর হার্টের সাথে সংযুক্ত কিছু নার্বস এর অবস্থা বেজায় খারাপ এর কারণে সার্জারীর আগেই মারশিয়াদ এর মৃত্যু হয়।ওকে সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়।তার এক সপ্তাহ পর সেখান থেকে ফেরার জন্য এয়ারপোর্ট যাওয়ার রাস্তায় আজরাহানদের গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হয়।জানালার কাচ ভেঙে তা ঢুকে যায় আজরাহান এর গলায়।তাই তার সার্জারীর প্রয়োজন পড়ে আর এতে করে আজরাহান এর কন্ঠস্বর অনেকটা বদলে যায়।তা ঠিক হতে দীর্ঘ আট মাস সময় নেয়।আজরাহান এর যেনো এক নতুন জন্ম হয়।তার মন এবং মস্তিষ্ক সবকিছুই বদলে গেছে এই আট মাসে।
পৃথিবীর অনেক বড় তিক্ত সত্য হলো অপেক্ষা।যা কারো জন্য সুখের পায়রা উড়িয়ে আনে কারো জন্য কষ্টের খেয়া নৌকা।

নরম পায়ে বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই স্থবির হয়ে যায় আজরাহান।এক সাগর ভালোবাসার অথৈ জলে ডিঙি নৌকা বহনকারী প্রত্যেকটি মানুষ যেনো তাদের কুলের জন্য অপেক্ষা করে আছে যার অবস্থান শুধু আজরাহান ওই স্বশরীরের উপস্থিতি।

আজরাহান কে দেখে হতবিহব্বল কুহেলিকা আর কিছু ভাবতে চান না।দৌড়ে তার চোখের মনি কে ভালোবাসার উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন।নির্বাক দুজন মানুষ শুধু তাদের নোনতা নেত্রনীড় এর ধারা প্রবাহিত করছে।কুহেলিকা কোনোদিনও তার ছেলে কে ছেড়ে এতোদিন দূরে থাকেন নি।তার শূন্য বুকের একমাত্র নিঃশ্বাস ফিরে এসেছে।আজ সে বুক ভরে সজীবতার শ্বাস নিবে।

আজরাহান কে নিজ থেকে আলগা করে ওর মুখে অসংখ্য চুমু একে দেয়।মমতাময়ী মায়ের মাতৃছায়ায় নিজেকে সপে দেয় আজরাহান।তার হাজারো দিনের শূন্যতার ভরন হচ্ছে আজ।এক স্নিগ্ধ অনুভুতি যা সে চাইলেও সে অগ্রাহ্য করতে পারবে না।মমতাময়ী তার ভালোবাসার আচল বিছিয়ে দিয়েছে আজ তার চরনতলে।আজরাহান ধপাস করে নিচে বসে পড়ে।অস্ফুটভাবে বলে–

“মা!!!

কুহেলিকা এক নিঃশ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করে নেয়।তার পরম শান্তি অনুভুত হচ্ছে।আজরাহান ঝাপটে ধরে ওর মা কে।সদ্য জন্ম নেওয়া পাখিদের মুখে খাবার তুলে দেয় মা পাখাটি।নিজের মুখের খাবার দিয়ে সন্তানদের ক্ষুধা নিবারনে তার জুড়ি নেই।আজ আজরাহান এর তেমনটা মনে হচ্ছে।তার বুকের খা খা করা জায়গাটা মাতৃস্নেহের এই হীমেল পরশের জন্য দীর্ঘকাল আকুলিবিকুলি করছে।পরম যত্নে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কুহেলিকা।আট মাসে অনেক বদলে গেছে আজরাহান।অনেকটা।কিন্তু তা দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যায়।

একের পর এক সবার সাথেই উষ্ণ ভাব বিনিময় করে আজরাহান।তেমন কথা বলে না।কিন্তু সব কিছুর মধ্যে এক অজানা আগ্রাসন তাকে বল্লমের মতো বিদ্ধ করে চলছে। ক্ষত বিক্ষত করছে তার নতুন অস্তিত্ব কে।যা সে চায় নি।নিজের মধ্যে এক আকাশ জড়তা তার।এক মিথ্যের মায়াজালে জড়ানো এই সম্পর্ক।কি হবে এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি!!!!

সানোয়ার আহমেদ ধীরস্থির পায়ে আজরাহান এর সামনে দাড়ায়।নির্বাক অঙ্গভঙ্গি তার।নিদারুণ সেই দৃষ্টি যাতে আজরাহান এর অন্তর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।এ কেমন পরিস্থিতি !!!

শান্ত,স্নিগ্ধ,স্বাভাবিক সানোয়ার আহমেদ নিজের দু বাহু প্রসারিত করে আজরাহান কে বুকে টেনে নেয়।পরম আদরে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখে।নতুন সত্ত্বা তার নতুন অস্তিত্ব।নিজের সামনে দাড়িয়ে গাঢ় নজর ক্ষেপন করে আজরাহান এর চোখে।ছলছল অক্ষিপল্লব মেলে এক অপরাধী আজরাহান আজ তার সামনে।মুখে তার নির্লিপ্ত ভাব।যা সে বুঝতে পারে।একটু পরপর নাকের ডগা ফুলিয়ে এক শ্বাস ছাড়ে সানোয়ার আহমেদ।কিছুক্ষন মৌনতা পালন করে দেখতে থাকে তার আদর্শ ছেলেকে।সত্যিই সে এক আদর্শ ছেলের পিতা।কিন্তু কেনো যেনো আজ তা ভাবতে তার একটুও ভালো লাগছে না।কি হতো,,
যদি তার ছেলে একটু বেপোরোয়া হতো!!কি হতো,,,
যদি তার ছেলে একটু অশান্ত হতো।বড্ড কী বেশি খারাপ কীছু হতো!!!

সানোয়ার আহমেদ আবার আজরাহান কে বুকে টেনে নেয়।তার শূন্য বুকের খালিঘর পূরন করছে সে।কিন্তু তা সঠিক শব্দে কিনা তা সে জানে না।কাউচে এসে বসতেই মাথা নিচু করে থাকে আজরাহান।সে অপরাধী।সত্যিই সে অপরাধী।তার সাজা কী হতে পারে!!!

ওকে বসতে দেখে সেখানে এসে দাড়ায় প্রহর।আজরাহান এর নিরব দৃষ্টি প্রহর এর পায়ে সেই পায়েলে।যা আস্তে আস্তে উর্ধ্বগামী হয়।নীলচে তারার আবদ্ধ চোখের নিচ টা কালচে আঁধারে লেপ্টে আছে।চোখ নির্বাক।নিঃশ্বাসের গতি এতোটা যা দুর থেকেই নজরে আসছে আজরাহান এর।শান্ত প্রহর দু কদম পা বাড়াতেই সানোয়ার আহমেদ শক্ত এবং ভারী কন্ঠে বলে—-

“দাড়া প্রহর।”

প্রহর থমকে যায়।বিস্ফোরিত তার দু চোখ।কিন্তু শান্ত।নরম গলায় বলে–

“ছোট আব্বু!!

সানোয়ার আহমেদ ধুপ করে উঠে দাড়ায়।কিন্তু বিচলিত নন।স্বাভাবিক ভাবে বললেন–

“ঘরে যা।”

প্রহর চকিত হয়।কেনো সে যাবে!!কেনো সে তার প্রানদেব এর কাছে যেতে পারবে না!!

প্রহর অক্ষিযুগল দৃঢ় করে।তার নিঃশ্বাস যেনো আটকে গেছে তায স্বরনালীতে।রূদ্ধ কন্ঠে বলে–

“কী হয়েছে ছোট আব্বু??

“সানোয়ার আহমেদ ক্ষনকাল সময় অতিবাহিত করলেন নির্বিকার ভাবে।মৌনতা ভেঙে নিরস কন্ঠে বললেন—

“ঘরে যা প্রহর।আজ থেকে তুই তোর ঘরে থাকবি।”

প্রহর আতকে উঠে।চোখ ছোট ছোট করে।কপাল কুচকে বলে–

“কেনো??

“আমি তোর আর আজরাহান এর আবার বিয়ে দিবো।”

প্রহর এই কথায় এক শুকনো ঢোক গিলে।কিঞ্চিৎ বিস্মিত চোখে তাকায় আজরাহান এর দিকে।এক অদ্ভুত আচরণ তার।আজ যেনো সে অন্য আজরাহান।আজরাহান খানিক চোখ তুলে তাকায়।অক্ষি তার নির্বিকার।কিন্তু ওই চোখ তো এতো শান্ত কখনো ছিলো না।ওই অধরে ভুবন ভোলানি হাসি হারিয়ে গেলো কোন অজানা তমসায়।

শান্ত,স্থির প্রহর এর জিঙ্গাসু দৃষ্টি তার রাহান ভাইয়ার দিকে।থমথমে তার দেহভঙ্গিমা।যেনো সবকিছু তার বিপরীত।

সানায়া ভ্রু কুটি করে নিরস কন্ঠে বলে–

“কিন্তু বাবা,ওদের তো বিয়ে হয়েছে।”

সানোয়ার আহমেদ কন্ঠে হালকা উষ্ণতা ছড়ালেন।উচু করলেন তার স্বর।আর বললেন–

“ওটা কোনো বিয়ে ছিলো না।ছিলো একটা অপ্রত্যাশিত নাটক। এইবার সমস্ত নিয়ম মেনে ওদের বিয়ে হবে।”

সানোয়ার আহমেদ কিছুক্ষন থামলেন।বুকে উঠা জ্বলচ্ছাস ছাপিয়ে দিচ্ছে তার বুকের ভিতরের দু কুল।দুমড়ে মুছড়ে একাকার করে দিচ্ছে।কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া তিনি দেখালেন না।নরম সুরে আবার বললেন–

“আর ততোদিন প্রহর ওর নিজের ঘরে থাকবে।”

প্রহর এর চোখের জল আর বাধা মানলো না।কিন্তু কন্ঠস্বর রূদ্ধ করে রাখলো।দৌড়ে চলে গিয়ে লুকাতে চাইলো তার অবাধ্য ঘন বর্ষার অথৈ জল।কুহেলিকা শান্ত হয়ে আজরাহান এর ঘাড়ের উপর মাথা দিয়ে রেখেছে।প্রহর এর উপর তার এখন রাগ নেই।যার মৃত্যু আশংকায় সে এতোদিন ওকে মানতে পারেনি আজ তার ছেলে কে আবার ফিরে পেয়ে সে তার অতীতে করা অহেতুক ভুল গুলো শুধরাতে চায়।তাই এই বিয়েতে তার কোনো আপত্তি নেই।

নিজের সেই পুরোনো ঘরে পা রাখে প্রহর।আজরাহান এর ঘরের উল্টো পাশেই তার ঘর।এই আট মাস ও আজরাহান এর ঘরেই প্রতিটা রাত ওর প্রতিক্ষায় কাটিয়েছে।কবে ফিরবে তার প্রানপুরুষ।কিন্তু আজ যখন ফিরলো কেনো সে একবার তাকে ছুয়ে দেখার অধিকার পেলো না!!
প্রহর ধীরপায়ে জানালার কাছে যায়।জানালার কপাট খুলতেই এক দমকা হাওয়া ছুয়ে যায় প্রহর এর সারা শরীর।একদিন সে নিজেই চেয়েছিলো যেনো তাদের বিয়েটা আবার হয়।তবে আজ কেনো তার কষ্ট হচ্ছে!!পুড়ে যাচ্ছে তার মন!!
শুধুই কী একটু দূরত্ব নাকি অন্য কীছু???
,
,
,
তোড়জোড় আয়োজন শুরু হয় আজরাহান আর প্রহর এর বিয়ের।এই এক সপ্তাহ আজরাহান নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে নিজের ঘরে।বাইরের পরিবেশ তার কাছে বিষন্ন।এক অজানা জগত যার বাসিন্দা সে নয়।নিজেকে ঘুটিয়ে নিয়েছে অন্ধকার অতলে।এ বড় অন্যায়!!
নিজের সত্ত্বায় কী করে বাঁচিয়ে রাখবে সে অন্যকে!!!

ফেরার পর থেকে আজরাহান এর আকস্মিক পরিবর্তিত ব্যবহার সবাইকে চিন্তিত করে তুলছে।ওকে দেখলেই কেনো যেনো মনে হয় সে আজরাহান নয় অন্য কেউ।সেদিন তো সানায়া বলেই ফেলল–

“বাবা,আজরাহান কে কেনো যেনো অন্যরকম লাগে!!
ওর তো গলার অপারেশন হয়েছে কিন্তু শরীরের কাঠামো কী করে এতোটা বদলে গেলো?

সানায়ার উদ্ভট প্রশ্নে বিষম খায় সানোয়ার আহমেদ।নাহ,সত্য জানার সময় এখনো হয়নি।সানোয়ার কিঞ্চিৎ কপাল ভাজ করলেন।বললেন—

” একটা মৃত্যু,একটা সার্জারী।এতোটা সময় প্রিয় মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকা ওকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।ওকে সময় দাও।এ নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।”

সবাই তাদের মনে উদ্ভাসিত প্রশ্ন মনের অন্ত:পুরেই দাফন করে দিলেন।আজরাহান অনেক সেনসিটিভ।ওর পক্ষে এতোটা ধাক্কা আসলেই পাহাড়সম।
সেদিনের মতো সবাই থেমে গেলো।আজরাহান মাঝে মাঝে ব্যলকনিতে দাড়ায়।আশ্চর্যজনক পর্যবেক্ষন করে সেই গন্ধরাজ।এখান থেকে শুরু সে কাহিনি।যার শেষ কী হবে তা সে জানে না!!

প্রহর বারংবার আজরাহান এর দরজায় কড়া নেড়েছিলো কিন্তু প্রত্যেকবার তাকে নিরাসা নিয়েই ফিরতে হয়েছিলো।সে জানে না তার রাহান ভাইয়া কেনো এমন করছে।যাওয়ার আগে ওর কপালে এক গভীর চুমু খেয়ে আজরাহান বলেছিলো,,,,,” এই জনমের মতো তার সব কাজ শেষ করে ফিরবে সে।আর কোনোদিন সে তার প্রহরিনী কে ছেড়ে যাবে না।”
কেনো যেনো সেদিন প্রহর এর ইচ্ছে করছিলো না তার রাহান ভাইয়া কে যেতে দিতে!!
মনে হচ্ছিল যেনো কেউ তার বুকের ভিতর লালন করা এতো বছরের ভালোবাসার ফোটা সেই ফুলকে ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে।তবুও সে বাধ্য হয়।

প্রহর প্রায়ই এসে দাড়ায় সেই গন্ধরাজ এর কাছে।এখান থেকে একপলক দেখবে তার রাহান ভাইয়া কে।তার তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের শ্রাবনের ধারা সে।কিন্তু তা হয় না।আজরাহান এর চোখে চোখ পড়তেই আজরাহান নিজেকে লুকিয়ে নেয়।দ্রুত পায়ে এসে বসে বিছানার পাশটায়।কিঞ্চি এখন আজরাহান এর কাছে থাকে না।ওদেরও মনের দূরত্বের সাথে শরীরের দূরত্ব বেরেছে।সানোয়ার আহমেদ নিজের ঘরে নিয়ে রেখেছে কিঞ্চি কে।মানুষের চোখ আড়াল করা গেলেও প্রভুভক্ত প্রানীর দৃষ্টি তার মালিকের ঘ্রান পর্যন্ত অন্তরে ধরে রাখে।

প্রহর এর চোখে আজরাহান তাকাতে পারে না।মনে হয় ওই চোখের জ্বলন্ত মশাল এখনি তীব্র গতিতে এসে ওর সমস্ত দেহ জ্বালিয়ে দিবে।
সপ্তাহ ঘুরে এসে গেলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন।সব কিছু মেনেই বিয়ে সম্পন্ন হলো আজরাহান আর প্রহর এর।এ সবকিছু মাঝে আজরাহান কে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়েনি সানোয়ার।
,
,
গন্ধরাজ এর ছড়াছড়ি শুভ্রতায় আচ্ছন্ন আজরাহান এর ঘরে।বিছানার এক কোনে হালকা মিষ্টি কালারের একটা জামদানি শাড়ী পড়ে বসে আছে প্রহর।আজ সবকিছুই যেনো নতুন তার কাছে।এই আট মাস তার জীবনের বহু প্রতিক্ষিত স্বপ্নকে সত্যি করতে চলেছে।মাথায় আধ হাত ঘোমটা টেনে বসে আছে প্রহর।আজরাহান এর ধীর পায়ের উপস্থিতি ওর মনে বর্ষার কদম হয়ে ফোটা শুরু করছে।নরম পায়ে এসে একটু দূরত্ব নিয়ে বসে আজরাহান।জড়তা,গ্লানি,বিষন্নতা সবকিছু মিলিয়ে এক ভঙ্গুর আজরাহান।সে এমন টা কখনো চাই নি।সমস্ত ঘরের নিরবতা জানান দিচ্ছে দুটো মানুষের মনে উঠা উত্তাল ঢেউ এর।কিন্তু তা আলাদা।

বেশ কিছুক্ষন পিনপতন নিরবতায় প্রহর অস্বস্তি বোধ করে।মুখের উপর থেকে ঘোমটা উঠিয়ে উচ্ছল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আজরাহান এর দিকে।কপট রাগি কন্ঠে বলে—

“এই যে ঢ্যামনা বুড়ো সমস্যা কী আপনার??

আজরাহান তাকায় না।প্রহর এর এক এক টা শব্দ যেনো বিষাক্ত সাপের ছোবলের মতো লাগছে তার কাছে যেনো এখনি সব শেষ হয়ে যাবে।প্রহর এর নির্বাক দৃষ্টি পড়ে আজরাহান এর ঘাড়ে।সেখানে একটা কাটা দাগ।
প্রহর দু হাটুর উপর ভর করে একটু এগিয়ে যায়।আজরাহান নিজেকে ঘুটিয়ে নেয় তার খোলসে।হালকা উচু হয়ে দু হাত রাখে আজরাহান ঘাড়ের পাশে।ফু দিতে থাকে।আদরমিশ্রিত কন্ঠে বলে–

“ব্যথা লাগছে রাহান ভাইয়া??

আজরাহান এর শ্বাস আটকে যায়।টেনে নেওয়া শ্বাস তার গলায় কাটার মতো বিধঁতে থাকে।প্রহর এর উষ্ণ ছোয়া অন্তর কাপিয়ে তুলছে আজরাহান এর।ওর স্পর্শ ওকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।প্রহর বসে স্বাভাবিক হয়ে।হালকা ঘুরে মাথা রাখে আজরাহান এর হাতের উপর।শান্তভাবে বলে–

“জান কে কেনো নিয়ে গেলো আল্লাহ??
ও তো কখনো কারো ক্ষতি করে নি।”

প্রহর এক নিঃশব্দ নিঃশ্বাস ত্যাগ কর।আবার বলে–

“জানেন,আমি আল্লাহ কে বলেছি,যেনো আমাদের ছোট্ট আজরাহান করে জান কে পাঠায়।”

প্রহর এর কথায় কোনো শব্দ করে না আজরাহান।তার মনে উঠা সমুদ্রের মাতাল মাতম আজ থামবার নয়।কেপে উঠছে তার শরীর।প্রহর টের পায়।প্রহর অনুভব করে এক ঠান্ডা জল ছুয়ে যাচ্ছে তার অধর।প্রহর সোজা হয়।আজরাহান কে দেখে।বিধ্বস্ত আজরাহান।কেমন যেনো ফ্যাকাশে তার চাঁদবদন।গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।প্রহর ভেজা কন্ঠে বলে–

“আপনি কাঁদছেন কেনো রাহান ভাইয়া!!
এতে আপনার কোনো দোষ নেই।জান আবার ফিরে আসবে দেখবেন।ভালো মানুষদের আল্লাহ কখনো নিরাস করে না।”

আজরাহান চোখ তুলে তাকায়।যতটা মায়া তার চোখে ঠিক ততটা মায়া তার কথায়।কিন্তু আদৌ কী এই ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার তার আছে??
সে তো অন্যের সত্বায় জীবিত!!!

প্রহর মুচকি হাসে।আর বলে–

“দেখেন আজকে আমি লিপিস্টিক দিয়েছি।
আপনি খাবেন??

প্রহর আবার হেসে দেয়।নিজের ঠোঁটে কামড় দিয়ে মুখ লুকায় নিজের হাতে।তার বেশ লজ্জা করছে।কী বলল সে!!!

আজরাহান শান্ত ভাবে বসে আছে।তার এখন অধিকার আছে কিন্তু,,,

প্রহর দুষ্টু মাখা কন্ঠে বলে—

“রাহান ভাইয়া,,লাইট অফ করেন।আমার লজ্জা করছে।”

প্রহর সেই অবস্থায় থেকে মিটিমিটি হাসতে থাকে।কিঞ্চিৎ থেমে হালকা উচু কন্ঠে বলে—

“কী হলো বন্ধ করেন।”

আজরাহান প্রতিত্ত্যুর করে না।টুপ করে লাইট অফ করে দেয়।জানালার পর্দার ফাক গলিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চন্দ্রকিরণ।হালকা বাতাসে উড়ছে অবাধ্য পর্দাগুলো।গন্ধরাজ এর ঘ্রাণ যেনো তার তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।প্রহর এর বুকের ডিপডিপ যেনো তরতর করে বাড়তে থাকে।তার প্রানপুরুষ আজ তার কাছে।তার সমস্ত তৃষ্ণা আজ মিটিয়ে নিবে তার প্রাণেশ্বর এর ভালোবাসার সুধায়।অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে আজরাহান প্রহর এর দিকে।তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় তাকে সাড়া দিলেও তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু একটা হবে আজ যা সব বদলে দিবে।আজরাহান নিজেকে সংবরন করার পূর্ন চেষ্টা করছে।বিছানার চাদর খামছে ধরে রেখেছে।তার ভিতরের ঝড় তার অন্তর চিত্তের সাথে বাহিরটাও কাপিয়ে তুলছে।কি করবে সে???

প্রহর মুখ থেকে হাত সরায়।ভালোবাসার এই রাত সে বৃথা যেতে দিতে পারে না।সে আর ছোট্ট প্রহর নেই।চাঁদের আলোয় প্রহর এর রূপ যেনো চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে আজরাহান এর।ভালো করে দেখে সে প্রহরকে।ওই চোখের ওই নিরবিচ্ছিন্ন ভালোবাসার বাগানের একচ্ছত্র অধিকার যে অন্যকারো।কি করে সে ওই বাগানে তার অযাচিত ভালোবাসার ফুল ফোটাবে।আজরাহান এর চিন্তার ইতি ঘটে প্রহর এর মিষ্টি কন্ঠে।

“রাহান ভাইয়া,,ভালোবাসবেন না আমাকে???

আজরাহান ওর কম্পনরত হাত স্পর্শ করায় প্রহর এর গালে।এক বিদ্যুৎ খেলে যায় প্রহর এর শরীরে।তার শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা।চোখ বন্ধ করে নেয় প্রহর।অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে তার সোনার অঙ্গে।আজরাহান ধীরে ধীরে নিজেকে এগিয়ে নেয় প্রহর এর কাছে।ওর মিষ্টি নিঃশ্বাস ছুয়ে যাচ্ছে প্রহর কে।প্রহর হতবুদ্ধির মতো তৎক্ষনাৎ ঝাপটে ধরে আজরাহান কে।একদম মিশে থাকে ওর সাথে।কিন্তু আজরাহান পারে না ওর প্রহরিনী কে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে।কি করে পারবে সে !!
প্রহরিনীর চোখে যে রাহান ভাইয়া সে তো তা নয়।
হঠাৎ প্রহর হকচকিয়ে উঠে।এক ধাক্কায় সরিয়ে ফেলে আজরাহান কে।ভয় আর রুষ্ট কন্ঠে বলে–

“কে,কে আপনি???

সমস্ত নিরাবতা ভেঙে এইবার আজরাহান তার মুখ শ্রী থেকে ধ্বনি উচ্চারন করে।কম্পনরত ঠোঁটে বলে—

“প্রহর!!!

ভয়ার্ত প্রহর ক্ষীপ্র বেগে বিছানা থেকে উঠে দাড়ায়।অগোছালো ভাবে উঠতেই পাশে থাকা টেবিলে লেগে হাটু তে ব্যথা পায়।আজরাহান দ্রুত উঠে লাইট অন করে।কপালের ধার বেয়ে ঘাম ঝড়ছে আজরাহান এর।প্রহর এর সারা শরীর ঝিম ঝিম করছে।বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে সে।কম্পিত কন্ঠে বলে–

“একদম আমার কাছে আসবেন না।আপনি আমার রাহান ভাইয়া নন।কে কে কে আপনি??

আজরাহান শান্ত ভাবে বলে–

“প্রহর আমার কথা শোন।”

প্রহর ঝামটা মেরে উঠে।উত্তেজিত কন্ঠে বলে—

“নাহ।একদম আমার নাম ধরে ডাকবেন না।আপনি রাহান ভাইয়া নন।আমি,আমি আমার রাহান ভাইয়ার গায়ের গন্ধ চিনি।সে আমার গন্ধরাজ।আপনি আমার গন্ধরাজ নন।”

আজরাহান নিরুত্তাপ ভাবে অবলোকন করে প্রহর কে।নিঃশ্বাসের গতি এতোটা যে ওর বুকের উঠানামায় মনে হচ্ছে এই বুঝি শ্বাস আটকে গেলো।থরথর করে কাপছে প্রহর।ড্রেসিং টেবিলের কোন ঘেষে দাড়িয়ে আছে।ধুম করে দরজার লক খুলে বাইরে চলে আসে প্রহর।তটস্থ পায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসে নিচে।গলার স্বর উচু করে বলে–

“ছোট আব্বু,ছোট আব্বু।”

সানোয়ার আহমেদ এই সময়েরই অপেক্ষা করছিলেন।প্রহর তার দু বাহু শক্ত করে ধরে বলে–

“ছোট আব্বু,ইনি আমার রাহান ভাইয়া নন।যেতে বলে তাকে।”

সানায়া এক লাফে ওর কাছে এসে বলে–

“এইসব কী বলছিস তুই??

প্রহর বড় বড় শ্বাস ফেলে বলে–

“আমি ঠিক বলছি।ইনি আমার রাহান ভাইয়া নন।”

ততক্ষনে সেখানে উপস্থিত হয়েছে আজরাহান।নির্লিপ্তি তার দৃষ্টি।অপরাধী ভাব তার চোখে মুখে।সবাই বিস্ফোরিত চক্ষুপাত করে আজরাহান এর দিকে।প্রহর তাকায় আজরাহান সেই জ্বলন্ত চোখের দিকে।
আনমনেই বলে উঠে—-

“জান!!!!!!!!

ধপ করে ফ্লোরে পড়ে যায় প্রহর।
,
,
,
হসপিটাল এর করিডোর এ ওয়েটিং চেয়ার বসে আছে মারশিয়াদ আর সানোয়ার আহমেদ।হতাশাদায়ক কন্ঠে বলে–

“কেনো করলো আজরাহান এইসব!!!কেনো সবার কাছে আমাকে অপরাধী বানিয়েদিলো!!!

সানোয়ার আহমেদ শুনলেন।তা সংবরন করলেন।ভাবলেন।বললেন–

“এতে তোমার কোনো দোষ নেই।”

“সব দোষ আমার।আমার জন্যই সব হয়েছে।”

সানোয়ার আহমেদ এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।হু হু করে কেঁদে উঠলো তার মন।ক্রন্দরত কন্ঠে বললেন—

“আমার আজরাহান স্বার্থপর।তাই সে তোমার অস্বিত্ব মিটিয়ে দিয়েছে।তোমার সত্ত্বায় নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছে।স্বার্থপর আমার আজরাহান,স্বার্থপর।”

সানোয়ার আহমেদ এর কান্নার প্রতিটি ধ্বনি করিডোরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে যেনো তার বুকেই বর্শা র মতো গেথে যাচ্ছে।মারশিয়াদ তার চোখের জল ছেড়ে দিয়েছে।দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে বলে–

“একবার তো আমাকে বলতে পারতেন।আমি শেষ চেষ্টা করতাম।”

সানোয়ার আহমেদ ধরা গলায় বললেন–

“সেই সময় যে ছিলো না তার হাতে।চট্টগ্রাম গিয়ে সেই চেষ্টাই তো করেছিলো সে।কিন্তু পারে নি।ডক্টর বলেছে তার হাতে সময় নেই।ব্রেইন ক্যান্সার এর লাস্ট স্টেজে সে।সময় মাত্র কিছুদিন।”

সানোয়ার আহমেদ থামলেন।গলায় বাধা তার নির্ঘুম রাতের সেই কষ্ট গুলো ঘাপটি মেরে ধরেছে তার শ্বাস।নরম কন্ঠে আবার বললেন—

“প্রতি রাতে আমাকে কল করে কী বলতো জানো,,
বলতো ইউ আর মাই সুপার হিরো।তুমি আমার সাথে থাকলে আমি সব সামলে নিবো।”

সানোয়ার আহমেদ এর কথা শেষ হতেই মারশিয়াদ তার চোখ বন্ধ করে নেয়।অক্ষির কোন ঘেষে চলছে ঝর্নার অবারিত ধারা।ক্ষনে ক্ষনে দু জন পুরুষের দীর্ঘ শ্বাস হসপিটাল এর বদ্ধ বায়ু ভারী করে তুলছে।

সানোয়ার আহমেদ ছোট্ট করে দম ছেড়ে বললেন–

“পৃথিবীতে একজন বাবার জন্য সবচেয়ে বড় বোঝা কী জানো!!
বৃদ্ধ বয়সে বাবার কাধেঁ তার যুবক ছেলের লাশ।আমার আজরাহান স্বার্থপর!!একবারও আমার কথা ভাবলো না।সেই ভারী বোঝা আমার কাধেঁ চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলো।ভাবলো না তার সুপার হিরো আসলেই সেই বোঝা বইতে পারবে কী না!!!
সানোয়ার আহমেদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।মারশিয়াদ তখন ই তার পা জড়িয়ে ধরলেন।বলে–

“আমি পারবো না আঙ্কেল,আমি পারবো না।আমি কখনো ওর জায়গা নিতে পারবো না।”

সানোয়ার আহমেদ নিজেকে সংযত করলেন।শান্ত ও স্বাভাবিক।মারশিয়াদ কে দু হাত দিয়ে ধরে দাড় করালেন।

“পুরুষ মানুষ অদ্ভুত।তারা নিজেদের ভাঙতে দিলেও মচকাতে দেয় না।নারীদের চোখের জলের প্রত্যক্ষ কারন যেমন তারা হতে পারে তেমন তাদের সুখেরও।”

“তোমাকে পারতেই হবে মারশিয়াদ।আমার আজরাহান যে তোমাকে বিশ্বাস করেছে।তার অস্বিত্ব কে তোমার বাঁচাতে হবে।তার প্রহরিনী কে সে তোমার ভরসায় রেখে গেছে।
শরীরের সাথে শরীরের যে সম্পর্ক তা মৃত্যুর সাথে সাথে নশ্বর,কিন্তু আত্নার সাথে আত্নার যে সম্পর্ক তা অবিনশ্বর।প্রহর আর ওর রাহান ভাইয়ার সম্পর্ক আত্নার।”

বিধ্বস্ত মারশিয়াদ তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।জীবন আজ তাকে এমন জায়গায় দাড় করিয়েছে তার জেতা সম্ভব নয়।

“আমি পারবো না আঙ্কেল,আমি পারবো না।প্রহরিনীর যে চোখ শুধু তার রাহান ভাইয়াকে খুজে ওই চোখে ভালোবাসার নতুন শিখা আমি জ্বালাতে পারবো না।আমাকে ক্ষমা করবেন।”

সানোয়ার আহমেদ শক্ত হলেন।ভারী কন্ঠে বললেন–

“তোমাকে পারতেই হবে।আমার আজরাহান হেরে যেতে পারে না।তার ভালোবাসা হারিয়ে যেতে পারে না।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে শুধু এটাই ভেবেছে তার কিছু হলে তার প্রহরিনীর কী হবে!!
তুমি তার প্রানদূত হয়ে এলে।তুমিই পারবে তার প্রহরিনী কে বাঁচাতে।এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে সে তার প্রহরিনী কে একা ছেড়ে যেতে চায় নি।তাকে তোমায় দান করেছে।আমার আজরাহান কে ফিরিয়ে দিও না।ওর ভালোবাসা কে বাঁচাও।ওর অস্তিত্বকে বাঁচাও।সে শুধু তোমার পানে চেয়ে আছে।”

সানোয়ার আহমেদ দুই হাত জোড় করলেন মারশিয়াদ এর সামনে।একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সকল আহাজারির পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন।

মারশিয়াদ কে হার্ট ডোনেট করে আজরাহান।আশ্চর্যজনকভাবে ওদের সবকিছু ম্যাচও করে।হয়তো উপরওয়ালা এটাই চেয়েছেন।আজরাহান জানতো প্রহর মারশিয়াদ কে মেনে নিবে না।তাই তার কথা মতোই প্লাস্টিক সার্জারী করে মারশিয়াদ এর চেহারা পরিবর্তন করা হয় শুধুমাত্র ওদের বিয়ের জন্য।অবশ্য এইসব দেখার জন্য আজরাহান তখন আর এই দুনিয়াতে ছিলো না।আর এইসব কিছুই হয় মারশিয়াদ এর অগোচরে।স্বভিত হয়ে ফেরার পর মারশিয়াদ নিজেকে একবার শুধু আয়নায় দেখেছে।আর সাহস পায় নি।
,
,
,
সাদা শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে প্রহর।স্যালাইন চলছে তার।গন্ধরাজ এর তীব্র গন্ধ নাকে আসতেই হাত পা নড়ে উঠে প্রহর এর।চোখ খুলে পিট পিট করে তাকায়।অক্ষিপল্লব খুলতেই দেখে ওর সামনে বসে আছে আজরাহান।মুখে তার সেই ভুবন ভোলানো হাসি।প্রহর ধীরে উঠে বসে।প্রসন্নতায় তার নয়ন চকচক করছে।শান্ত কন্ঠে বলে–

“রাহান ভাইয়া,আপনি কোথায় গিয়েছিলেন আমাকে ছেড়ে??

আজরাহান ছোট্ট করে হাসে।উচ্ছলিত স্বরে বলে–

“রসমালাই,আমি কী তোকে ছেড়ে যেতে পারি!!!
আমি সবসময় তোর সাথে থাকবো।”

“তাহলে কেনো করলেন এমন??

আজরাহান মুচকি হাসে।বেডের এর উপর দুহাতে ভর দিয়ে মাথাটা পিছনের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে বলে—

” হৃদয়ের লেনা দেনা এপারে তে আর হবে না।তোমার আমার দেখা হবে ওই পারে বন্ধু ওই পারে।।””

প্রহর ঝরঝর করে কেঁদে উঠে।আজরাহান ওর কপালে নিজের কপাল দিয়ে হালকা ধাক্কা মেরে বলে–

“বোকা রসগোল্লা;কাঁদছিস কেনো তুই!!!
তুই জানিস না,তুই কাদলে আমার কষ্ট হয়!!

“তাহলে কেনো করলেন এমন!!আমাকে কেনো একা করে দিলেন??

“তোকে আমি একা করিনি প্রহরিনী।আমি সবসময় তোর সাথে থাকবো।দেখ ওইদিকে আমার অস্তিত্ব দাড়িয়ে আছে।”

প্রহর দেখে দরজার ফাকে দাড়িয়ে আজরাহান এর আদলের মারশিয়াদ।প্রহর ফাকা গলায় বলে–

“জান!!
দেখেন না রাহান ভাইয়া কী সব বলছে।আপনি তাকে কিছু বলেন না। কেনো সে এমন করছে!!

মারশিয়াদ কাউকে দেখে না।মারশিয়াদ ঠান্ডা পায়ে এগিয়ে আসে।প্রহর এর সামনে এসে ওর হাতে একটা চিঠি দেয়।

“এটা আপনার রাহান ভাইয়া আপনাকে দিতে বলেছে।”

প্রহর চিঠি টি হাতে নেয়।তা খুলে।তাতে আছে—
পাশে থাকা অদৃশৃ আজরাহান এর শব্দ কানে আসছে প্রহর এর।ওর দৃষ্টি সেই চিঠি তে।

“কি রে রসগোল্লা!!কাঁদছিস তুই।একদম কাঁদবি না।তুই কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।কি করতাম বল!!অনেক চেষ্টা করেছি।তোর সাথে থাকতে।কতো বার তোর কাছ গিয়ে ফিরে এসেছি।আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিলো না প্রহরিনী।সময় মিথ্যে ছিলো।কি করে জড়াতাম তোকে আমার এই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর সাথে।আমি যে তোকে ভালোবাসি।তোর ওই নাকের ডগায় ঘেমে যাওয়া মুক্তোর দানা আমাকে রাতরাত ভর ঘুমাতে দিতো না!তোর শরীরের ওই মিষ্টি গন্ধ আমাকে ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে দিতো না!তোর ভেজা চুলের ওই সৌরভ আমাকে প্রতি মুহূর্তে পাগল করে দেয়!!আমি পারি নি তোকে ছেড়ে যেতে।আমি সবসময় তোর সাথে থাকবো।উপরওয়ালার সাথে লড়ে আমি নিজেকে জিতিয়েছি।আমার যে হৃদয়ে শুধু তোর বিচরন আমি সেই হৃদয় মারশিয়াদ কে দিয়েছি।আমি বাঁচবো ওর মধ্যে।তুই যতবার ওকে ভালোবাসবি আমি তোকে অনুভব করবো।তুই যতবার ওর কাছে যাবি আমাকে খুজে পাবি।আমার অস্তিত্ব কে বিলীন হতে দিস না প্রহর।আমার সত্ত্বা কে তুই বাঁচা।পারবি না প্রহরিনী????

নিস্তব্ধ প্রহর এর শ্বাস আটকে যায়।এখনই সে নিঃশ্বাস আটকে মারা যাবে।নিরবতায় আচ্ছন্ন হসপিটালের ক্যাবিন মুহুর্তেই এক গগনবিদারী কান্নার সাক্ষী হয়।পাগলের মতো হাত পা ছুড়তে থাকে প্রহর।ওর কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে যায় বিশুদ্ধ বাতাস।যেনো আলোর প্রদীপ নিভিয়ে কেউ অন্ধকার গহ্বরে তাকে নিমজ্জিত করেছে।আজ আকাশ কেপে উঠছে প্রহর দীর্ঘশ্বাসে।বদ্ধ ঘরের প্রতিটি দেয়াল আজ সঙ্গি হয়েছে তার বুক ফাটা আর্তনাদে।যেনো কেউ ওর বুকের হৃদপিন্ড টাকে ছুরিকাঘাত করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে।চিৎকার করে প্রহর খামছে ধরে মারশিয়াদ এর বুকে।

“কেনো কেড়ে নিলেন আপনি আমার রাহান ভাইয়া কে??কেনো নিলেন?কেনো নিলেন??

মারশিয়াদ কিছু বলতে পারে না।আকড়ে ধরে প্রহর কে নিজের সাথে।ভেজা কন্ঠে বলে—

“আমি আমার কথা রাখতে পারি নি কাজলচোখী।আমি আপনার রাহান ভাইয়া কে ফিরিয়ে আনতে পারি নি।আমি সত্যিই অপরাধী।”

মারশিয়াদ এর গা ঘেষেই বসে পড়ে প্রহর।

“কেনো করলেন আপনি এমন!!কী করে থাকবো আমি আমার রাহান ভাইয়া কে ছাড়া??
বলেন না জান,বলেন??

মারশিয়াদ কিছু বলে না।পুরুষের চোখের জল না কী কুয়ো খুড়ে জল বের করার মতো !!তাহলে আজ কেনো
তার চোখের জল নদীর মতো বইছে।

দেয়ালের প্রতিটি ইট যেনো প্রহর কে বলছে–

“প্রহরিনী,ভালোবাসিস আমাকে??
ভালোবাসিস আমাকে??
,
,
,
সাত বছর পর,,,

একটি ছোট্ট ছেলে হাটু ভেঙে বসে আছে একটি সান বাঁধানো কবরের সাথে।হাত দুটো ভাজ করে তাকিয়ে আছে।পিছন থেকে একটা মিষ্টি,ভারী, পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে তার কানে।

“আজরাহান!!

বাচ্চাটি পিছন ফিরে তাকিয়ে সেই সুদর্শন,শক্ত কাঠামোর লোকটি কে দেখে দাঁত বের করে মিষ্টি হাসে আর বলে–

“ইয়েস বাবাই।”

“এঞ্জেল কে দেখা হয়েছে??

“ইয়েস বাবাই।”

“তাহলে চলেন।মাম্মাই ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।”

“ওকে।”

ছোট্ট আছরাহান উঠে তার হাতের ব্যাগটা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।কবরটির ঠিক মাথায় একটা গন্ধরাজ লাগানো।ছোট্ট আজরাহান তার ছোট ছোট হাতে সেখান থেকে ফুল নিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে।
,
,
,
সবুজ ঘাসের উপর পা ভাজ করে বসে আছে নন্দিতা।ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে নুরাইসা।ওদের পিছনেই অর্ধ পাকা বিল্ডিং।পাঁচবছর আগে নুরাইসা ওর নিজের ভাগে পাওয়া প্রপার্টি বিক্রি করে একটা ছোট্ট স্কুল বানিয়েছিলো।আজরাহান এর স্বপ্ন পূরনের জন্য।পথশিশুদের বিনা পয়সায় এখানে পড়ানো হয়।মারশিয়াদ দু বছর আগেই এর এমপিও ভুক্ত করায়।যেনো সরকারি সাপোর্ট পাওয়া যায় আর এখানকার পড়া বাচ্চারা যেনো একটা ভালোমানের সার্টিফিকেট পেতে পারে।পথশিশুদের শিক্ষার পাশাপাশি এখান থেকে খাদ্য,বস্ত্র,চিকিৎসা এমন কি আজরাহান এর নামে করা এতিম খানায় কারো কারো থাকার ব্যবস্থা করা হয়।যার ফিনালসিয়াল পুরো হেল্প আসে মারশিয়াদ এর অর্গানাইজেশন থেকে।চিকিৎসার সম্পূর্ন দায়িত্ব শিহরন আর তার কলিগদের।

মারশিয়াদ এর মৃত্যু সংবাদে একদম ভেঙে পড়েছিলো ইনশিরাহ।তার সেই কষ্টের সারথি হয়েছিলো আশফিক।আজ সে তার লাইফ পার্টনারও।ওদের একটা মেয়ে আছে।নির্ধা আর শিহরণ এর ছেলে নির্ধারণ।

নুরাইসা তার জীবন উৎসর্গ করেছে আজরাহান এর নামে।
ওদের জীবনের সেই দিন আসে সামান আর নন্দিতার বিয়ের দিন রাতে।নুরাইসাদের বাড়ির গেটের সামনে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো আজরাহান আর তার গুটিকতক পাড়ার বন্ধু।বাড়ির বা পাশের পিছনটায় দাড়িয়ে কথা বলছিলো নুরাইসা আর বান্ধবীরা।আজরাহান এর বন্ধুরা মজার ছলে ওকে টাস্ক দেয় যে নুরাইসা কে গিয়ে প্রপোজ করতে।আজরাহান প্রথমে রাজী হয়নি।টগবগে তরুনদের রক্ত নাকি গরম থাকে।তাই বন্ধুদের হাসি তামাশা মানতে পারে নি আজরাহান।ভুল তার সেখানেই ছিলো।ওরা সেখানে দাড়িয়ে যে কোল্ড ড্রিংস খাচ্ছিলো ওদের ই এক বন্ধু আজরাহান এর সাথে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তাতে ড্রাগস মিশিয়ে দেয়।কিছুক্ষনের মধ্যেই তার এফেক্ট শুরু হয়।আজরাহান নুরাইসার সামনে গিয়ে দাড়াতেই ওর নেশা আরো ঝেকে বসে।সদ্য যৌবনে পা রাখা নুরাইসা একটা গোলাপী রঙের ল্যাহেঙ্গা পড়েছে।চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোট ভর্তি লাল লিপস্টিক।লাল রঙ নাকি কামনার রঙ।আজরাহান এর নেশার্ত মস্তিষ্কে সেদিন কামনা ভর করেছিলো।ওর লাল লাল চোখ দেখে মুহুর্তে ই গায়েব হয়ে যায় নুরাইসার বান্ধবী রা।কিন্তু নুরাইসা!!

সে হয়ে যায় অন্য গ্রহের বাসিন্দা।আজরাহান এর ওই নেশার্ত চোখ যেনো ওকে গিলে খেয়ে নিচ্ছে।ধ্যান লেগে যায় ওর।নিজেকে ভাসমান মেঘ মনে হতে থাকে।সদ্য কলি থেকে ফোটা গোলাপ সে।তার কিশোরী মনের প্রথম জাগ্রত অনুভুতি।নুরাইসার কল্পনার শেষ হয় আজরাহান এর অধরের গভীর চুম্বনে।আজরাহান এর ঠোঁটের ভেজা স্পর্শ ওকে সেখানে বরফ করে দেয়।জীবনে প্রথম সে কোনো পুরুষের স্পর্শ অনুভব করেছে।নুরাইসার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেছে এক শীতল শিহরণ।যেনো বসন্তের আগমনে ফুল ফুলে ভরে উঠেছে তার দেহবরন।আর তার সুধা পান করতে ভ্রমর হয়েই আগমন ঘটেছে আজরাহান এর।ওর অধর ছাড়তেই বিস্মিত হয় নুরাইসা।আজরাহান হুট করেই কোলে তুলে নেয় নুরাইসা কে।ওদের বাড়ির পিছন দিকে পুরোনো জিনিসপত্র রাখার ঘরের নিয়ে যায় নুরাইসা কে।নুরাইসা শুধু স্তব্দ হয়ে সব দেখছে।তার মুখের ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে।আজারাহান সেখানের একটা গদির উপর ওকে বসিয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখতে থাকে নুরাইসা কে।কোনো শব্দ নেই দু একটা পোকার ডাক আর ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার অপেক্ষায় দুটি প্রানআত্না।আজরাহান ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ে যায় নুরাইসার একদম কাছে।নুরাইসা জানে না তার কী হয়েছে শুধু জানে যা হচ্ছে তা তার ভাবনা বাহিরে।ও মাথা রাখে গদির উপর।আজরাহান ওর নিজেকে অনেকটা কাছে নিয়ে আসে নুরাইসার।পরক্ষনেই আজরাহান ড্রাগস এর নেশায় বুদ হয়ে ঢলে পড়ে নুরাইসার উপর।দু হাতে আকড়ে ধরে নুরাইসা ওকে।ওর ঘন নিঃশ্বাস বুক ভারী করে তুলেছে নুরাইসার।সারারাত ওর বুকের উপর ই শুয়ে ছিলো আজরাহান।কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও নিজের চোখ বন্ধ করতে পারে নি নুরাইসা।অনুভব করেছে আজরাহান কে।

“সিগারেটের প্রথম টান আর জীবনের প্রথম চুমুর অনুভুতি নাকি কখনো ভোলা যায় না।”

নুরাইসাও পারে নি।আজরাহান এর সেই স্পর্শ তার শরীরের সাথে মনকেও এক অদ্ভুদ সম্মোহনে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে।

“আপু,এমন কেনো হলো বলোতো।আজরাহান এর মনে এতোটা কষ্ট ছিলো আর ও কখনো কাউকে তার আঁচ পর্যন্ত লাগতে দেয়নি।”

নন্দিতা কিছুই বলে না।কী বলবে সে!!
আজরাহান হয়তো চলে গেছে কিন্তু ওর অস্তিত্ব গেড়ে রেখে গেছে সবার মনে।

“ও না হয় আমার শাহজাহান না হলো আমি সারাজীবন ওর মমতাজ হয়ে থাকবো।”

মুখের ভিতর নিজের ওড়নার এক পাশ ঘুজে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে নুরাইসা।
,
,
,
গাঢ় নীল রঙের শাড়ী পরিহিত সুশ্রী রমনি দাড়িয়ে আছে ডাইনিং টেবিলের প্রান্ত ঘেঁষে ।হাত থেকে নামিয়ে প্লেট রাখছে সে।সদর দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।ইষৎ রাগ আর অভিমানি কন্ঠে বলল–

“আপনারা আজও আমাকে না নিয়ে চলে গেলেন??

মারশিয়াদ মৃদু হাসলো।মায়া জড়ানো কন্ঠে বলে–

“যদি আপনি আমাদের সাথে সেখানে যান তাহলে কী আপনার প্রেমোমোহ আপনার সাথে দেখা করতে এখানে আসবে?

প্রহর ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।ছোট্ট আজরাহান দৌড়ে আসে।আর বলে–

“মাম্মাই!!

প্রহর প্রজ্জলিত মুখে মিষ্টি করে হেসে হাটু গেড়ে সে নিজের আঁচল মেলে ধরে ছোট্ট আজরাহান এর সামনে।ঝুড়ঝুড় করে ব্যাগে করে আনা ফুল গুলো ঢালতে থাকে প্রহর এর নীল আচলে।প্রহর বিনা বাক্য ব্যয়ে তা নিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে।আঁচল থেকে ফুল গুলো টেবিলের উপর রাখে।দীর্ঘ কালো চুলে খোপা করে নেয় প্রহর।শাড়ীর আচল ভাজ করে কাঁধে তোলে প্রহর।কোমড়ে হাত দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে–

“রাহান ভাইয়া,তাড়াতাড়ি ঘুজে দিন আমার খোপায়।”

প্রহর নিজ হাতেই খোপায় গন্ধরাজ ঘুজে নেয়।ইষৎ হেসে বলে—

“আপনি তাদের কে কেনো বলেন না আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে!!!
আপনি তাদের বলবেন যেনো পরের বার আমাকেও সাথে নিয়ে যায়।”

প্রহর আজরাহান কে বলেছিলো যেনো ওর প্রতি জন্মদিনে আজরাহান নিজ হাতে প্রহর এর খোপায় গন্ধরাজ ঘুজে দেয়।আজও আজরাহান এর জন্মদিন।এখন ছোট্ট আজরাহান করে সেই কাজ।

মারশিয়াদ দরজায় দাড়িয়ে সব দেখছে।গত সাত বছর ধরে সে এইসব দেখছে।দুইবছর লেগেছে প্রহর এর স্বাভাবিক হতে।কিন্তু এখনো প্রহর আজরাহান কে অনুভব করে ওর আশেপাশে।ওর মস্তিষ্কের একটা অংশ জুড়ে এখনো ওর রাহান ভাইয়ার বসবাস।প্রচন্ড শকড ছিলো প্রহর।ডক্টর বলছে ওর চিকিৎসা করালে হয়তো ওর স্মৃতি থেকে আজরাহান এর সমস্ত স্মৃতি মুছে যাবে।কিন্তু মারশিয়াদ তা করেনি।যেই মানুষটা তার সবকিছু তাকে দিয়ে গেছে সে কী করে তার অস্তিত্ব মুছে দিবে!!!
কখনো কখনো এমন হয়েছে ওদের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেও প্রহর আজরাহান কে ওর আশেপাশে অনুভব করে।মারশিয়াদ তাতে বিচলিত হয় না।নরম পায়ে এসে দাড়ায় ওর পাশে।স্মিত হাসি দিয়ে বলে—

“কাজলচোখী,কী বলল আপনার প্রেমোমোহ??

প্রহর ভ্রু কুঞ্চি করে বলে–

“বলবো না।”

মারশিয়াদ ওকে নিজের বুকে টেনে নেয়।নিজ বাহুতে আবদ্ধ করে।প্রহর শান্ত হয়ে থাকে।

“জান!!

“বলেন কাজলচোখী।”

“আমাকে ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবেন।আজ তো রিপোর্ট দিবে।”

“যাবো।”

“বাবাই,তুমি মাম্মাই কে আদর করছো??

মারশিয়াদ কোলে তুলে নেয় আজরাহান কে।ওর গালে,কপালে চুমু খেতে থাকে।প্রহর ও নিজের ছেলে কে আদর করতে কার্পণ্য করে না।মিষ্টি কন্ঠে আজরাহান বলে—

“বাবাই,এঞ্জেল কে শুধু মাম্মাই কেনো দেখতে পায়??

মারশিয়াদ আজরাহান এর গালে এক গভীর চুমু দিয়ে বলে–

“কারণ,আপনার মাম্মাই সবচেয়ে বেশি আপনার এঞ্জেল কে ভালোবাসে।তাই শুধু সে তাকে দেখতে পায়।”

“আমিও তো এঞ্জেল কে ভালোবাসি।”

“হুম।কিন্তু আপনার মাম্মাই থেকে বেশি না।”

“তাহলে,আমি বড় হয়ে এঞ্জেল কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবো।ওকে মাম্মাই???

“ওকে,মি.আজরাহান কারীম।

আজরাহান,প্রহর আর মারশিয়াদ এর চার বছরের ছেলে।কারো জীবন থমকে নেই ।সময়ের সাথে জীবনও তাল মিলিয়ে তাদের পদযুগল বাড়িয়েছে সামনে।প্রহর দ্বৈত জীবন কাটায়।আজরাহান এর অস্তিত্ব এখনো ওর অন্তরের অন্ত:পুর এর একমাত্র সম্রাট।সেখানে কারো অধিকার নেই।

ওরা আজরাহানদের বাড়িতেই থাকে।সেই ঘরেই যেখান থেকে এই ভালোবাসার অঙ্কুরোদ্গম হয়।কুহেলিকা এখন আর আগের মতো কথা বলে না।সারাক্ষন জানালার পাশ দিয়ে চোখ গলিয়ে গন্ধরাজ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে।যেনো এখনি এসে আজরাহান বলবে—

“কুইন,ভালো আছো?ভালো আছো??

নাহ।আজরাহান বলে না।প্রহর কে দেখলে কেনো যেনো ওর মনের চাপা কষ্ট বেড়ে যায়।তাই ওকে এড়িয়ে চলে।নিশ্চল সে।এখন আর তার কাউকে হারানোর ভয় নেই।যাকে হারানোর ভয় তাকে এক ঈর্ষান্বিত মা এ পরিনত করেছে তাকে সে হারিয়ে ফেলেছে।পাগলেরর মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো তার।সামলানো বড্ড মুশকিল ছিলো।
কিন্তু ছোট্ট আজরাহান এর জন্মের পর যেনো সে তার প্রান ফিরে পেয়েছে।নিজের বুকে আকড়ে রাখে ওকে।সারাদিন,সারারাত।এ যেন আজরাহান এর পুনর্জনম।মারশিয়াদ এর ঔরসে আজরাহান জন্ম হলেও ওর চোখ,মুখ যেনো আজরাহান এর প্রতিবিম্ব।

সানায়া ওর শশুড় শাশুড়ি কে ফিরিয়ে এনেছে।এখনো বৃষ্টিস্নাত রাতে খিচুড়ি আর ভুনা মাংস রান্না করলে মনে হয় আজরাহান দৌড়ে এসে বলবে–

“কর্ণপিশাচি,খাওয়াবে না আমাকে???

চোখের জলে ভাসে সানায়ার আচল।

সানোয়ার আহমেদ প্রায়ই যায় আজরাহান এর কবরের পাশে।নিজের যে দু হাতে ওকে হাটি হাটি পা পা করে হাটতে শিখিয়েছে সেই হাতেই তার আদর্শ ছেলেকে ওই অন্ধকার কবরে শুইয়ে এসেছে।কী সে যন্ত্রনা তা শুধু সেই বাবা ই জানে!!!মারশিয়াদ ও আসে তার সাথে।তার সত্ত্বা।

সামানের এখন পুরো ধ্যান তার পরিবার।নিজেকে বদলে নিয়েছে সে।এখন সেও এক ছেলের বাবা হয়েছে।
বদলেছে সময় বদলেছে সবকিছু।
,
,
চাঁদের আলোয় ধরনী রুপালি সাজে সজ্জিত হয়।মনোরম সেই দৃশ্য।অবাধ্য চাঁদ তির তির করে তার আলোর পসরা নিয়ে ঢুকে পড়ছে ওদের ঘরে।মারশিয়াদ এর বুকে মাথা দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রহর ।তীব্র গন্ধরাজ এর গন্ধে ঘুম ভেঙে যায় প্রহর এর।শান্ত কন্ঠে বলে–

“জান,জান!!

মারশিয়াদ ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে–

“হুম।”

“সে এসেছে।”

“যান আপনি।সে তো আপনাকে কখনো ছেড়ে যায় নি।সে সবসময় আপনার সাথে আছে।কারণ সে যে আপনার #অদ্ভুত_প্রেমোমোহ_তুমি।
তাকে বলবেন,তার প্রহরিনীও আসতে চলেছে।”

“হুম।”

প্রহর উঠে বসে।শাড়ীর আচল ভালো করে টেনে সামনে তাকায়।তার দিব্যদৃষ্টি তার প্রেমোমোহ এর চোখে।আজরাহান স্মিত হাসে।তার প্রহরিনী ভালো আছে।আজরাহান পা বাড়ায় ব্যলকনির দিকে।প্রহর নির্মল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

ঊর্ধ্বমুখী হয় আজরাহান।আজ আজরাহান আকাশ দেখে।ভালোবাসার আকাশ।ঝলমলে তারা যার একটাই চাঁদ।

“পৃথিবীর এক অদ্ভুত জিনিস হলো ভালোবাসা।নশ্বর পৃথিবীর এক অবিনশ্বর সত্ত্বা সে।ভালোবাসা কখনো হারায় না।ভালোবাসা কখনো নষ্ট হয় না।ভালোবাসা রূপ বদলায়।সব রুপেই ভালোবাসা মহীয়ান।”

______________সমাপ্ত___________

(যারা পড়বেন সবাই মন্তব্য করবেন ।নেগটিভ অর পজেটিভ ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here