অনুভূতিতে তুমি পর্ব-১৫

0
2880

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৫

নিয়ম অনুযায়ী আজকের দিন টা মেহেরিন আর নির্ঝর চৌধুরী বাড়িতেই থাকবে। অতঃপর আগামীকাল তারা খান বাড়িতে পৌঁছাবে যেটা মেহেরিন নির্ঝরের নামে করে দিয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে অনেক রাত করেই সবাই বের হয়। নিরব মেহেরিন কে বিদায় দিয়ে চলে যায়। অতঃপর নির্ঝর আর মেহেরিন গাড়িতে চড়ে। তাদের মাঝখানে বসে অর্ণব!

চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মেহেরিন’র কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে অর্ণব। মেহেরিন অর্ণব কে কোলে নিয়েই নামে। নীলিমা ঘরের বউ আর ছেলেকে বরণ করে ঘরে ঢুকায়। মেহেরিন কে নিয়ে যায় নির্ঝরের ঘরে।‌ পুরো ঘরটা চারদিকে ফুল ছড়িয়ে আছে। ফুলের গন্ধে মো মো করছে চারদিক। বিছানার মাঝে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। মেহেরিন ঘরে ঢুকে গেলেও নির্ঝর এখনো পারে নি। সবাই আটকে রেখেছে তাকে টাকার জন্য। নির্ঝর কাজিন আর বন্ধুরা মিলে ফন্দি এঁটেছে। বেচারা নির্ঝর ভাঙা হাত নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদ বলে উঠে,

“টাকা ছাড়!

“আমার কাছে কোন টাকা নেই।

ঈশান বলে উঠে,
“আজকের দিনে কিপ্টামি ছাড়!

নির্ঝরের এক কাজিন বলে,
“ভাবি কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি টাকা দাও আর চলে যাও।

আরিফ বলে উঠে,
“টাকা ছাড়া কিন্তু ঘরে ঢুকতে দেবো না।

নির্ঝর হেসে বলে,
“আচ্ছা!

বলেই উল্টো পথে হাঁটা ধরল। সবাই অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। ফরহাদ নির্ঝরের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো দরজার কাছে।‌ সবাই একসাথে চেঁচিয়ে বলল,

“কিপ্টা!

“😒

“টাকা দে!

“বললাম তো টাকা নেই, আর আজ রাতে ঘরে না ঢুকলেই কিছু হবে না। এরপর থেকে সারাজীবন আমার সাথেই থাকবে।

বলেই নির্ঝর আবারো চলে যেতে নিল। সবাই ঘিরে ধরল ওকে। নির্ঝরের কাজিন বলে উঠে,

“টাকা না দিয়ে তুই বের হ তো দেখি। একটা হাত ভাঙা আছে একটা পা কিন্তু এখন ভেঙে দেবো।

“তোরা তো রীতিমতো হুমকি দিচ্ছিস এবার।

ফরহাদ নির্ঝরের ঘাড়ে হাত রেখে বলে,
“না এসব ছোট খাটো ব্যাপারে কোন কাজ হবে না। কিছু বড় একটা করতে হবে।

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কি?

ফরহাদ চেঁচিয়ে দরজার কাছে যেতে যেতে বলে,
“ভাবি ভাবি.. দেখো তোমার বর কেমন কিপ্টামি কর….

তার আগেই নির্ঝর মুখ চেপে ধরে ফরহাদের।
“আরে আরে কি করছিস ভাই..

সাথে সাথে সবাই চেঁচিয়ে উঠলো…
“ভাবি…

নির্ঝর বলে উঠে,
“আরে আরে দিচ্ছি, দিচ্ছি, টাকা দিচ্ছি! তোরা থাম সবাই!

তৎক্ষণাৎ থেমে গেল সবাই। জোরে জোরে হেসে উঠলো। নির্ঝর ফরহাদের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে গুনতে লাগল। ঈশান চট করে টাকা গুলো ছিনতাই করে দৌড়। তার পিছু পিছু সবাই দৌড়। নির্ঝর চেয়েও কাউকে আটকাতে পারল না। তার সব টাকা নিয়ে সবাই উধাও!

নির্ঝর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ঢুকবে এখন! দরজা দিকে হাত বাড়াতেই তার হাত কাঁপতে লাগল। নির্ঝর নিজের হাত ঝাড়া দিল। ব্যাপার কি হাত কাঁপছে কেন তার। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল হাতের দিকে। হুট করেই মনে পড়ল তার হার্টবিট বাড়ছে। আশ্চর্য! কি হচ্ছে এসব। কেমন অন্য এক অনুভূতি!

নির্ঝর মাথা ঝাকালো। ধুর! কি ভাবছে এইসব। এমন তো কিছু না। এই বিয়েটা শুধু’ই ১ বছরের জন্য! এরপর মেহু চলে যাবে তাকে ছেড়ে। এর মানে, এখন তার এসব ভাবা একদম নিরর্থক!

কিন্তু ভাবলে সমস্যা কি? হুট করেই কথাটা মাথায় চক্কর দিল। নির্ঝর হাত দিয়ে নিজের মাথায় বাড়ি মারল। বলতে লাগল,

“পাগল হয়ে গেছিস নির্ঝর!

হুট করেই দরজা খোলার শব্দ এলো। দরজা ভেতর থেকে খুলছে। নির্ঝর তাকিয়ে দেখল মেহেরিন দরজার অপাশে দাঁড়ানো। নির্ঝর পা থেকে মাথা অবদি দেখতে লাগাল তাকে। চোখ আটকে গেল তার চোখে। তার হরিণী চোখের মায়াজালে আটকে গেল নির্ঝর। ঘোর কাটল মেহুর আওয়াজে,

“নির্ঝর!

আনমনে বলে উঠে,
“হুম!

“ডাকছিলেন আমায়!

“হুম!

“কেন?

নির্ঝরের হুশ ফিরল। বলে উঠে,
“কই নাতো! তোমায় ডাকি নি আমি।

“এই যে বললেন হ্যাঁ!

“না মানে কিছু না। তো তুমি এখানে কিছু বলবে!

“হুম! আসলে…

বলেই মেহেরিন ঘরের ভিতর চলে গেল। নির্ঝর গেলো তার পিছু পিছু। নির্ঝর তাকিয়ে রইল পুরো ঘরের দিকে। নিজের ঘর এটা চিনতেই তার কষ্ট হচ্ছে। কি চমৎকার লাগছে পুরো ঘর। মেহেরিন কিছু বলতে নিবে, নির্ঝর তখন’ই বলে উঠে,

“এক রুমে ঘুমাবে, এই তো। তুমি চিন্তা করো না আমি পাশের রুমেই ঘুমাবো। তোমরা দুজন থাকো এখানে।

বলেই নির্ঝর দরজার দিকে আগাতে নেয়। মেহেরিন তখন বলে উঠে,

“না!

নির্ঝর দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকায় মেহেরিন’র দিকে..
“হুম!

“মানে আপনি এই রুম থেকে বের হবেন না। এখানেই থাকবেন।

“তোমার সাথে!

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আমাদের সাথে!

বলেই ইশারা ঘরে বিছানার দিকে। নির্ঝর তাকিয়ে দেখে বিছানার অর্ণব ঘুমিয়ে আছে। নির্ঝর বলে উঠে,

“ওহ তাই তো। তোমাদের সাথে!

মেহেরিন দুই হাত বাহুতে গুঁজে বলে,
“কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে।

“কি কাজ?

“বিছানার এই ফুল সরানোর কাজ। অর্ণব এসবের মাঝে ঘুমাতে পারবে না।

“কিন্তু আমার হাত তো..

“আপনাকে করতে বলি নি। আপনি অর্ণব কে নিয়ে সোফায় বসুন। ঘুমের মাঝে হামাগুড়ি খাওয়া ওর অভ্যাস। পরে গেলে আরেক বিপত্তি!

নির্ঝর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। অতঃপর অর্ণব কে নিয়ে এসে বসল সোফায়। তাকিয়ে দেখতে মেহুর কাজ।

মেয়েটা খুব চটপটে! দ্রুতই নিজের সাজগোজ খুলে ফেলল। সোফায় থাকা একটা শাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। দ্রুত বের ও হয়ে গেল। নির্ঝর অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ভেজা চুল গুলোই খোঁপা বেঁধে নিল। বিছানার সব ফুল সরালো তাও খুব যত্ন করে। লাল টকটকে শাড়িতে মেহুকে”ই একটা ফুটন্ত ফুল লাগছিলো। মনে হচ্ছিল এক ফুল সরাচ্ছে আরেক ফুল কে!

নির্ঝরের কাছে এসে অর্ণব কে কোলে তুলে শুইয়ে দিল বিছনায়। আবার জাগালো তাকে। তার পোশাক পাল্টে দিয়ে আবারো বিছনায় দিতেই অর্ণব ঘুম। শুধু একটি নজর নির্ঝর কে দেখে ড্যাডি বলে ডাক দিল।

নির্ঝর মেহেরিন কে না বলেই বাইরে গেল। মেহেরিন অর্ণব কে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে নির্ঝর উধাও। কথাটা এতো মাথায় নিলো না। অর্ণবের দু পাশে কোল বালিশ রেখে ফোন নিয়ে চলে এলো বেলকনিতে। কোন ইম্পর্ট্যান্টে মেসেজ থাকতে পারে তার জন্য!

খানিকক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দে পেছনে তাকাল মেহেরিন। তোয়ালে নিয়ে এক দিয়ে মাথা মুছছে সে। অন্য হাত টা ব্যান্ডেজ করা। বাসর রাতে কোন ছেলে এমন ও থাকে তার জানা ছিল না।

নির্ঝর অর্ণবের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মেহুর কাছে এলো। মেহেরিন বলে উঠে,

“চেঞ্জ করতে গিয়েছিলেন।

“হুম ভাবলাম আমার সুযোগ তাই! ফরহাদ হেল্প করল।

“ওহ!

“খাবে কিছু?

“না আমার ক্ষিদে নেই।

“তো,‌ঘুমাবে না।

“হুম দেরি হবে, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন অর্ণবের পাশে।

“কোন পাশে ঠিক বলোতে!

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নির্ঝর হেসে বলল,
“না মানে ডান পাশে নাকি বা পাশে!

“যে পাশে ইচ্ছে হয় গিয়ে শুয়ে পড়ুন।

“আচ্ছা!

বলেই নির্ঝর এক পা আগাল। আবারো এক পা পিছিয়ে এসে বলল,
“তুমি কিন্তু একটা মতবলবাজ মেয়ে!

মেহেরিন কথাটা শোনার পর থমকে গেল। এটা নিরু দি বলতো। নির্ঝর বলে উঠে,
“না মানে.. তোমার সাথে এক রুমে থাকতে বললে তো তাই। নিশ্চিত এর মাঝে কোন মতলব আছে বলে মনে হচ্ছে।

মেহেরিন ফোনের দিকেই তাকিয়ে,
“কোন মতলব নেই, বাড়ি ভর্তি মেহমান! কেউ দেখে ফেললে হাজারো কথা উঠতো তাই!

“ওহ আচ্ছা!

“হুম!

নির্ঝর মাথা নেড়ে এবার দুই পা আগালো। কিন্তু পরক্ষণেই দুই পা পিছিয়ে আবারো এলো। মেহেরিন নির্ঝরের আসাটা অনুভব করল। তবুও কিছু বলল না। নির্ঝর’ই কিছুক্ষণ পর বলে উঠে,

“আচ্ছা তোমার ঘুমাতে কতোক্ষণ লাগবে।

“অনেকক্ষণ!

“আর কতোক্ষণ এখন তো প্রায় মাঝরাত! ভোর অবদি জাগবে।

“জানি না!

“আচ্ছা তুমি কি আজ ঘুমাবে না।

“জানি না!

“আচ্ছা!

বলেই নির্ঝর আগাল। এবারও পিছুতে যাবে তখন’ই মেহেরিন ফিরল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“সমস্যা কি বলুন তো!

“সমস্যা আমার না তোমার হবে।

“মানে!

“মানে হলো!

বলেই নির্ঝর মেহেরিন’র কাছে এলো। হুট করেই মেহেরিন’র চুলের খোঁপা টা খুলে দিল। মেহেরিন একটু অবাক হলো। নির্ঝর বলে উঠে,

“ভেজা চুল বেঁধে রাখলে চুল নষ্ট হয়ে যাবে। তবে তোমার চুল গুলো সুন্দর!

মেহেরিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। শীতল বাতাস বয়ে গেল। মেহেরিন’র ভেজা চুল গুলো এসে তার মুখে বাজল। নির্ঝর হেসে মেহেরিন’র চুল গুলো কানে গুঁজে দিয়ে মেহেরিন’র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আর বিশেষ ভাবে তোমার হরিণী চোখ নজরকাড়ানো!

মেহেরিন সেই হরিণী চোখের পাতা ফেলে ফেলে নির্ঝর কে দেখতে লাগল। নির্ঝর হেসে বলল,

“গুড নাইট মেহু!

বলেই নির্ঝর চলে গেল। মেহেরিন সেদিকেই তাকিয়ে রইল। নির্ঝর এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর তৎক্ষণাৎ ঘুমে ঢোলে পড়ল। মেহেরিন রুমে এসে দেখে নির্ঝর আর অর্ণব দুজন দুটো কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মেহেরিন ঘরের বাতি নিভালো। এসে আবার দাঁড়াল বেলকনিতে। আজ রাতেও রাত জাগা পাখি হয়ে জেগে থাকবে সে। ঘুম আসবে না আজ রাতেও। আর মেহেরিন ঘুমাতেও চায় না। রাতের আকাশের তারা গুনেই আজকের রাত টা পার করবে সে! আকাশ টা আজ পরিষ্কার। খুব সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আজ আকাশে। হয়তো আকাশ টাও জানতো আজ রাত তার সঙ্গী হবে চাঁদ! এই চাঁদের সাথে গল্প করেই শেষ হবে এই রাত..

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here