অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ১৯

0
6012

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৯

খুব সকালে সাদিদ নীলাকে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলেছে। তাই নীলার আধখোলা চোখে মৃদু রাগের আভাস। সে বারবার ঝিমাচ্ছে। আর সাদিদ তাকে টান দিয়ে তুলছে।

— ‘ এটা কি পাখি? এবার অন্ততপক্ষে উঠ। ‘
— ‘ ইশশ বিরক্ত করছেন কেন? আমি মাত্রই ঘুমিয়েছি। তাই আমি এখন ঘুমাব। আপনি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছেন। তাই এখন আমি আপনার কোনো কথা শুনব না। ‘

বলেই নীলা আবারও বিছানায় এলেমেলো হয়ে শুয়ে পড়ল। সাদিদের এবার সত্যিই হাসি পাচ্ছে। নীলা ঘুমের ঘুরে এমনটা বলছে। নতুবা জেগে থাকলে সে কখনও সাদিদের সাথে এমনটা করবে না। সাদিদ বেশ ভালোই বুঝতে পাড়ছে। কিন্তু সেও যে নিরুপায়। সাদিদ ঘড়িতে সময় দেখল। ৩ বেজে ৪০ মিনিট। এখন হোটেল থেকে বেরুতে না পাড়লে আসল সৌন্দর্যটা মিস হয়ে যাবে। যা সাদিদ দার্জিলিং এসে কোনোভাবেই চাইবে না। তাই সে কম্বলের উপর দিয়েই নীলাকে শক্ত করে চেপে ধরল। নীলার দম প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। সে দ্রুত চোখ খোলে তাকাল। নিজের উপর সাদিদকে দেখে রাগীস্বরে বলল,

— ‘ এসবের কোনো মানে হয়? ‘

সাদিদ হাসল। একটু ঝুকে এসে নীলার রাগে লাল হওয়া নাকটাতে চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ মানে হয় কি হয় না, সেটা ঘুম থেকে উঠলেই বুঝতে পারবে। ‘
— ‘ আমি ঘুমের জন্য চোখ খোলতে পাড়ছি না। প্লিজ এখন ঘুমাতে দিন। ‘
— ‘ না পাখি। এখন সম্ভব নয়। এসে না হয় আবার ঘুমিয়ে নিও। ‘
— ‘ তারমানে উঠতেই হবে? ‘
— ‘ জ্বি মহারাণী উঠতেই হবে। ‘

নীলা রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আবারও উঠে বসল। নীলার ঢুলুঢুলু মুখটা দেখে সাদিদ তার দুই গালে হাত রাখল। তারপর কপালে ভালোবাসার দীর্ঘ চুমু আঁকল। নীলা নতজানু হয়ে লাজুক হাসল। সাদিদ তাড়া দিতেই সে উঠে ওয়াসরুমে গেল। নীলাকে যেতে দেখে সাদিদও দরজা খোলে বাহিরে গেল। তানবীরদের রুমে বারকয়েক বার নক করতেই অর্ণব এসে দরজা খোলল। তার পিছু পিছু তানবীরও উঠল।

— ‘ রেডি হয়ে নে। আমরা একটুপরই বের হব। ‘
— ‘ সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুই এত ভোরে উঠতে পাড়লি? আমরা তো ভেবেছিলাম তোদের সাক্ষাৎ পাওয়া মুশকিল হবে। ‘

সাদিদ অর্ণবের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দেখে তার বাহুতে ঘুষি লাগাল। তারপর আবারও তাড়া দিয়ে হাসতে হাসতেই নিজেদের রুমে চলে আসল। আসার সময় প্রিয়তীদেরও ঢেকে আসার জন্য বলে গেল।
সবাই ইতিমধ্যে রেডি হয়ে নিচে নেমে এসেছে। ঠান্ডার মধ্যে এত ভোরে বাহিরে হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে। তাই সবাই বেশ মোটা কাপড়ের গরম জামা পরে বের হয়েছে।
খুব সকালে বের হতে হবে বিধায় তারা রাতেই ট্রেক্সি ঠিক করে রেখেছিল।
নীলা টেক্সিতে বসে বলে উঠল,

— ‘ এত সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছি আমরা? আরও পড়ে গেলে কি হতো? এতো সকালে কেউ কোথাও যায়? ‘

নীলার কথায় সাদিদ হাসল। তাকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,

— ‘ টাইগার হিল। খুব সুন্দর একটা জায়গা পাখি। তোমরা দেখলেই বুঝতে পারবে। আর সকালে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, আমরা টাইগার হিলের সানরাইজ দেখব৷ এবং সেটাতো লেইট করে গেলে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া লেইট করলে তোমরা হয়তো দেখতেই পারবে না। কেননা সেখানে গেলেই দেখবে কতশত লোকের উপস্থিতি। লেইট করে গেলে ভালোভাবে দাঁড়ানোর জায়গাই পাবে না। ‘
— ‘ ওহ্ আচ্ছা। ‘

নীলা আর কিছু বলল না। সাদিদের মুখের কথাটাই তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য। সুতরাং এখানে আর কিছু বলার থাকতেও পারে না।
প্রচুর ঠান্ডায় তাদের টেক্সি টাইগার হিলের উদ্দেশ্য ছুটে চলছে। তারা কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল এত ভোরেও অসংখ্য গাড়ি রাস্তায় চলছে। গাড়ির সংখ্যা দেখে সত্যিই অবাক হতে হচ্ছে। নতুবা এমন ভোরে কোনো স্থানে যাবার জন্য টুরিস্টদের এতো ভিড় সত্যিই চোখে পড়ে না। সবাই হয়তো সৌন্দর্যে ভরা টাইগার হিলের উদ্দেশ্য-ই যাচ্ছে। নীলা গাড়ির জানালার গ্লাস দিয়ে রাস্তার অগণিত হলুদবাতিগুলো দেখছে।

দার্জিলিং শহরের সর্ব উচ্চ স্থান হচ্ছে টাইগার হিল। এখানে ভ্রমণে এসে যদি টাইগার হিলের সানরাইজ না দেখেন সেক্ষেত্রে বিশাল কিছু মিস করে যাবেন। সারা পৃথিবী জুড়ে টাইগার হিল বিখ্যাত এর অসাধারণ সানরাইজের জন্য। এছাড়া এখান থেকে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট দেখা যায়। সমুদ্র তল থেকে প্রায় ৮ হাজার ৪৪২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই জায়গাটি দার্জিলিং থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সানরাইজের সময় টারগার হিল থেকে অপূর্ব রঙের খেলা দেখা যায়। পূর্ব দিগন্তে যখন লাল সূর্যের উদয় হয় তখন উত্তর দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া যেন জ্বলে উঠে। রূপালী চূড়া যেন সোনালী রূপ ধারণ করে। আর তার সামনে নিচের দিকে তাকালে দেখতে পারবেন তখনও রাত রয়ে গিয়েছে। দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়িতে তখনও ইলেকট্রনিক আলো জ্বলছে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। স্বচোখে না দেখলে উপলব্ধি করা কঠিন।
টাইগার হিলে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর ৪টার দিকে। সম্ভব হলে আরও আগে। কেননা সময়মতো উঠতে না পাড়লে প্রচুর গাড়ির লাইনের পিছনে পড়তে হবে। এবং এরকমও হতে পারে শেষের এক কিলোমিটার পথ আপনাকে হেঁটে উঠতে হবে। তার ফলস্বরূপ ভালো পজিশন পাওয়া যাবে সানরাইজের ভিউ দেখার জন্য। কেননা টাইগার হিল জায়গাটিতে বরাবরই প্রচুর লোকের সমাগম দেখতে পাওয়া যায়। তাই যত তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে বেরুতে পারবেন তত তাড়াতাড়ি এখানে পৌঁছাতে পারবেন। এবং খুব সুন্দর ভিউ দেখতে পারবেন। দার্জিলিয়ের এত ঠান্ডায় এত সকালে ঘুম থেকে উঠা একটু কষ্টসাধ্য। কিন্তু একটু কষ্টের জন্য এমন একটা অবিজ্ঞতা মিস করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই সাদিদও একটু কষ্টের জন্য নীলাদের এই সুযোগটা মিস করতে দিতে চাইল না।

অবশেষে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য তারা পৌঁছে গিয়েছে। নীলা আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। সে নীলার দিকেই তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। আসলে সাদিদ সত্যিই বলেছিল। এখানে এত ভোর বেলাতেও লোকসমাগমের অভাব নেই। প্রচুর টুরিস্ট ইতিমধ্যে এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। সাদিদরাও তাড়াতাড়ি আসাতে সানরাইজ দেখার জন্য ভালো একটা জায়গা পেল। নীলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে সাদিদ পূর্ব আকাশে দৃষ্টি দিলো। প্রিয়তী-অর্ণব, তানবীর-শান্ত সকলেই দলবেঁধে বাকিদের মতো সূর্যাদয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পূর্ব আকাশে লাল সূর্যের দেখা মিলতে লাগল। আর উপস্থিত সবাই আনন্দ-উচ্ছাস করতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এই সুন্দর মুহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দি করতেও বাদ পড়ল না। নীলা সূর্যাদয়ের এমন সুন্দর দৃশ্য চোখের সামনে দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে সাদিদের বুকে হেলে পড়ল। চক্ষু তার খুশিতে ম্লান হলো। সাদিদ সবটাই বুৃঝতে সক্ষম। তাই সে মৃদু হেসে নীলাকে আরও শক্ত করে নিজের বাহুবন্ধনে বন্দি করল। নীলা মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ করতে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ অসাধারণ! ‘
— ‘ এখনও ঘুম থেকে জোর করে তোলার জন্য রাগ করে থাকবে? ‘

নীলা সাদিদের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,

— ‘ কখনও না। এমন সৌন্দর্য দেখার জন্য এমন শতঘুমকে ভেঙে উঠতেও আমি দ্বিধা করব না। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পাড়ছি না। নিজেকে বাকরুদ্ধ মনে হচ্ছে। ‘

সাদিদ আবারও হাসল। সত্যিই নীলাকে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে হবে না। কেননা কিছু জিনিস ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানো দায়। সেটা উপলব্ধি করে নিতে হয়।
সাদিদ নীলার সাথে সাথে অর্ণব-প্রিয়তী এবং তানবীর-শান্তও সমানতালে টাইগার হিলের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
শান্ত আবেগে আপ্লূত হয়ে পাশে থাকা তানবীরের হাত চেপে ধরল। তানবীর সাথে সাথে শান্তর ধরে রাখা হাতের দিকে তাকালো। শান্তর অবশ্য সেদিকে বিশেষ কোনো খেয়াল নেই। সে টাইগার হিলের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। তানবীরও আবার সামনের দিকে তাকালো। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি।

সানরাইজের পর ধীরে ধীরে টাইগার হিলের লোকসমাগমও কমতে লাগল। সাদিদরা টেক্সির কাছে চলে আসলো। নীলার মুখে এখনও উপচে পড়া খুশি।

— ‘ এবার যাত্রা কোথায়? ‘
— ‘ আমরা এখন যাব রক গার্ডেন। কাকু আপ রক গার্ডেন চালিয়ে। ‘

টেক্সি ডাইভার সাদিদের অনুমতি পেয়ে রক গার্ডেনের উদ্দেশ্য গাড়ি ছুটালো।
রক গার্ডেন নামটাই নীলার কাছে বেশ অন্যরকম লাগছে। না জানি দেখতে কেমন হবে। নীলার ভাবুকতা দেখে সাদিদ তার গালে টুকা দিলো। নীলা তার দিকে ফিরে হেসে ফেলল।

— ‘ মহারাণী, কি চিন্তা করেন? ‘
— ‘ চিন্তা করছি দার্জিলিং শহরটা এত সুন্দর কেন? আমিতো বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। ‘

সাদিদ এবার নীলার কাছে এগিয়ে আসলো। সামনের সকলের দিকে একপলক তাকিয়ে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ সৌন্দর্য তো বাকরুদ্ধ হবার জন্যই। কিন্তু আমার পাখিটার সৌন্দর্য যে আমার চোখে আরও বেশি আরও প্রকট। আমিও তো প্রতিবার বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আমার কি হবে? ‘

নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। সাদিদ সবসময়-ই এমন করে। নীলাকে লজ্জা দিতে সে কখনও পিছুপা হয় না।
টেক্সি যত চলতে লাগল রাস্তার আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে তারা ততই মুগ্ধ হতে লাগল। বলা বুঝানো কঠিন। কিন্তু রক গার্ডেনে যাওয়ার পথের এই রাস্তাটুকুর সৌন্দর্যে বলে শেষ করা যাবে না।
রক গার্ডেন যতটা সুন্দর ঠিক তার থেকেও বেশি সুন্দর এই দশ কিলোমিটার পথ। চারপাশে চা বাগানের সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দিতে বাধ্য। এই পঁচিশ মিনিটের রাস্তাটি খুব সক্রিন্ন এবং খাঁড়া। কিন্তু এই রাস্তা থেকে দার্জিলিয়ের পাহাড় শ্রেণীর ভিউ অসাধারণ। যারা ফটোপ্রেমিক তারা নিঃসন্দেহে কয়েকদফা গাড়ি থেকে নেমে এর সৌন্দর্য ক্যাপচার করতে চাইবেন। কেননা রাস্তাটা আসলেই মনোমুগ্ধকর।
সাদিদ টেক্সি ডাইভারকে বলে গাড়ি থামাল। তারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এই অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকন করল। প্রিয়তী তো ফটোপ্রেমী। তাই অর্ণবকে দিয়ে নিজের অগণিত ছবি তুলল। বেচারার চেহারা দেখার মতো ছিল। সাদিদরাও তুলল। নীলাকে সাথে নিয়ে সে এই জায়গাটারও সৌন্দর্য ক্যাপচার করল। শান্ত- তানবীরও ছবি তুলল। তানবীরের মনটা বড্ড নিশপিশ করছে শান্তর সাথে এই মনোরম সৌন্দর্যে ভরা জায়গাটার স্মৃতি জমিয়ে রাখতে। কিন্তু কিছু একটা জড়তার জন্য মুখ ফুটে বলে উঠতে পাড়ছে না। তাই সে এবার খানিকটা বুদ্ধি খাটাল,

— ‘ দোস্ত চল, সবাই কিছু গ্রুপ ফটো তুলি। ‘
— ‘ হুম মন্দ হয় না। ‘

সবাই একসাথে কতগুলো ছবি তুলল। আর তানবীরও এবার সুযোগে শান্তর পাশে দাঁড়িয়ে কতগুলো স্মৃতি জমিয়ে নিলো।
তারা আবারও টেক্সিতে চড়ে বসল। কিছুসময় পরই আঁকাবাঁকা পাহাড়ের রাস্তা পার হয়ে তারা চলে আসলো কাঙ্ক্ষিত রক গার্ডেন। অপূর্ব এক দৃশ্যপট।
পাহাড়ের বিশাল বিশাল পাথরকে স্তরে স্তরে কেটে এই রক গার্ডেন তৈরি করা হয়েছে। এই কারণে এটিকে রক গার্ডেন বলা হয়। এখানে অনেকগুলো ঝর্ণা দেখতে পাবেন। যেগুলো কিছু প্রাকৃতিক এবং কিছু কৃত্রিমভাবে বানানো হয়েছে। এটি দার্জিলিং শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অনেকটা নিচু এলাকায় অবস্থিত। এখানে অপূর্ব একটা ঝর্ণা রয়েছে যেটা অনেক উঁচু থেকে নেমে এসেছে। নিচে থেকে বুঝা যায় না উপরের কোন জায়গা থেকে ঝর্ণার সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য এটি দেখার জন্য সিঁড়ি বেয়ে অনেকটাই উপরে উঠতে হয়। উপরে উঠাটা কষ্ট সাধ্য হলেও এর পুরস্কার পেয়ে নিরাশ হবেন না। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সেখানে যথেষ্ট জায়গা এবং ফুলের বাগান রয়েছে। চাইলে উপর থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারবেন। এই গার্ডেন বা পার্কটি সকাল ১০ থেকে বিকাল ৪টা অব্দি খোলা থাকে।

নীলারা ঘুরে ঘুরে রক গার্ডেন পুরোটা দেখতে লাগল। রক গার্ডেনের আশেপাশে কোনো খাবার রেস্তোরাঁ নেই। তারা যথেষ্ট ভোরে রউনা দিয়েছিল। তাই সাদিদ সবার জন্য শুকনো খাবার হিসেবে কেক, বিস্কুট, চিপস, জুস নিয়ে এসেছিল। তারা সবাই গার্ডেনের-ই বেঞ্চে বসে হালকা নাস্তা করে নিলো। তারপরও পুরোটা গার্ডেন দেখা শেষে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ল।

তারা এবার চলল দার্জিলিং বিখ্যাত ট্রয় ট্রেনে রাইড করার জন্য।
তাই সাদিদরা আসলো দার্জিলিং হিমালায়ান রেলওয়ে। ১৮৭৯-১৮৮১ সালের মধ্যে এই রেললাইনটি তৈরি করা হয়েছিল। ভারতের নিঊ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তা ও বাঁকের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা ছোট্ট বাষ্প ইঞ্জিন চালিত ট্রেন দার্জিলিংয়ে পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ভারতের সবচেয়ে উঁচু রেল সার্ভিস হলো এই দার্জিলিং হিমালায়ান রেলওয়ে। এই টয় ট্রেন জার্নিটি দার্জিলিয়ে আসা টুরিস্টের জন্য এক অবর্ণনীয় অবিজ্ঞতা হয়ে থেকে যায়। “দার্জিলিং টয় ট্রেন” হিসেবেও পরিচিত এই ট্রেন জার্নি দার্জিলিং এর এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। ছোট ছোট কোচকে এই বাষ্পচালিত ইঞ্জিন টেনে নিয়ে খাঁড়া পাহাড়ে উঠছে।
আপনি আর কোথায় দেখতে পারবেন এমন নজরকাড়া সৌন্দর্য? অনেকেই কোলকাতাও বলিউডের বিভিন্ন মুভিতে এই ট্রেনের চারপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখেছেন।
তাই কোনোভাবেই এই স্পট ঘুরে দেখা এবং ট্রয় ট্রেনে উঠার অবিজ্ঞতা মিস করা উচিত নয়।
দার্জিলিং-ঘুম-দার্জিলিং এই জয় রাইডের ভাড়া পড়বে ১০০০ টাকা ডিজেল ইঞ্জিনের জন্য।
এবং বাষ্পচালিত বা স্টিম ইঞ্জিনের জন্য ভাড়া পড়বে ১৬০০ টাকা। এগুলো সবই ফাস্ট ক্লাস কোচ। পাঁচ বছরের কম শিশুদের জন্য টিকিটের প্রয়োজন হয় না।
সাদিদ আগেই টিকেট কেটে রেখেছিল। তাই তারা সকলে ট্রয় ট্রেনে উঠে বসল। নীলা ট্রেনে বসেই খুশিতে বলে উঠল,

— ‘ আমি এই ট্রেনের দৃশ্য শাহরুখ খানের একটা মুভিতে দেখেছি। হ্যাঁ মনে পড়েছে দিল ছে। একটা গান ছিল না? ছাইয়া ছাইয়া। এই গানটাতে। ‘

নীলার উৎসাহ এবং খুশি দেখে সাদিদসহ সবাই হাসল। নীলা তীক্ষ্ণ চোখে সবাইকে দেখছে। সে এখানে হাসির মতো কি বলেছে!

— ‘ হ্যাঁ দোস্ত আমিও দেখেছি। বোধহয় এই ট্রেনে চড়ে অনেক মুভি করা হয়েছে। অনেকগুলো মুভির দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে কিন্তু নাম একটারও মনে পড়ছে না। ‘

শান্তর কথায় সবাই আরেকদফা হেসে নিলো। তানবীর সুযোগটা মিস করতে চাইল না। তাই সে বেশ রসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ এইসব-ই হচ্ছে জ্ঞানের খেলা। মাথায় বুদ্ধি-সুদ্ধি না থাকলে এসব জিনিস মনে রাখা যায় না। ‘
— ‘ নিজে মনে হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর? ‘
— ‘ সেটা না হয়। কিন্তু জ্ঞানী। ‘
— ‘ খালি কলসি বাজে বেশি। ‘
— ‘ কলসিতে যথেষ্ট পানি রয়েছে। চোখের অভাবে দেখতে পাচ্ছ না। ‘
— ‘ আপনি কি আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি কানা বলছেন? ‘
— ‘ সেটাতো তুমি বললে। আমি কখন এই শব্দ উচ্চারণ করলাম? ‘

তানবীরের কথা শুনে সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে। শান্ত সবার দিকে অসন্তোষ দৃষ্টি তাকিয়ে পুনরায় তানবীরের দিকে তাকালো। সে নিশ্চয়ই এখন কিছু একটা বলে ফেলত। কিন্তু তানবীরের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে নিজেকে সংবরন করল। আজ কতদিন পর তানবীর তার সাথে ঝগড়া করছে। বিষয়টাতে রাগ করার কথা থাকলেও শান্তর রাগ হচ্ছে না৷ বরং খুব ভালো লাগছে। সে মনে মনে ঠিক করে নিলো তানবীরের ঝগড়ুটে রূপটাই তার প্রিয়। কিছু মানুষকে চুপচাপ মানায় না। তানবীরও ঠিক সেইরকম।
শান্ত হাসিমুখে ট্রেনের বাহিরে মনোযোগ দিলো। খুব সুন্দর দৃশ্য। মনে হচ্ছে কোনো বাস্তব ছবি চলছে। সে হাসিমুখেই জিজ্ঞাস করল,

— ‘ জিজু এই ট্রেন কোথায় যাবে? ‘
— ‘ আমরা মূলত ট্রয় ট্রেন রাইড করতে আসছি। সাথে দার্জিলিয়ের আরও দুইটা টুরিস্ট স্পট রয়েছে ঘুম এবং বাতাসিয়া লুপ। বাতাসিয়া লোপে এমনিতেও আসা যায়। কিন্তু আমরা ট্রয় ট্রেনে করে এই জায়গাগুলোও দেখতে পারব। কেননা যাত্রাপথে টয়-ট্রেন বাতাসিয়া লুপে দশ মিনিট বিরতি দেয়। আর ঘুম স্টেশনে দাঁড়ায় প্রায় আধঘন্টা। তাই আমরা আলাদাভাবে বাতাসিয়া লুপ আসিনি। কেননা বিরতির সময়টুকুতেই আমরা বাতাসিয়া লুপ আর ঘুম ষ্টেশন ঘুরতে পারব। ‘
— ‘ বাহ্ তাহলে গ্রেট হবে। ‘
— ‘ হুম সেটাই তো হওয়ার কথা। ‘

সাদিদের কথা শুনে যেন শান্ত-নীলার উৎসাহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা খুব গভীর দৃষ্টি নিয়ে
ট্রয় ট্রেনের চলমান বাহিরের দৃশ্যপটগুলো অবলোকন করছে।
ট্রয় ট্রেন কোথাও কোথাও এতটা ধীরে চলে যে, দেখা যায় পাশের ঘরবাড়ির বা স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা ট্রেনে লাফিয়ে উঠতে পাড়ছে এবং নেমেও যাচ্ছে। কিন্তু এখনকার ডিজেল ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে ইঞ্জিন বেশি শক্তিশালী এবং ট্রেনের গতিও তুলনামূলকভাবে বেশি। যদিও এখনকার বেশিরভাগ ট্রয় ট্রেন ডিজেল ইঞ্জিনে চলে। তারপরও জয় রাইড হিসেবে এখনও বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। সাদিদরা সবাই ট্রয় ট্রেনের এই মনোরম জার্নি উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রয় ট্রেন রাইডের সময় ছবির মতো কত পাহাড়, লোকালয় গ্রাম পিছনে ফেলে ছুটে চলে। আর সেসব গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চা এমনকি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষও আপনার দিকে হাত নাড়াতে থাকে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। তাই এই জার্নির স্বাদ নিতে হলে ট্রয় ট্রেন মিস করা উচিত নয়।

ট্রেন ধীরে গতিতে চলে আসে বাতাসিয়া লুপে। ট্রেন থামতেই সাদিদরা সবাই নিচে নেমে পড়ল। আজকে সকালের নাস্তাটা খুব ভারী হয়নি। তাই সবার-ই মোটামোটি ঘুরে এখন ক্লান্ত লাগছে। তারা দার্জিলিং বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড মোমো দেখতে পেল। তাই সবাই মোমো খাওয়া শুরু করল। সেদিন পেট ভরা থাকায় তেমন একটা খাওয়া হয়নি। তাই আজকে সবাই সেই হিসাবটা ভালোভাবেই পুষিয়ে
নিলো। নীলাতো হিসেবের থেকেও বেশি খেল এই সবজি মাংস দিয়ে বানানো পিঠা পুলি। বলাবাহুল্য সাদিদের খুশি কোন পর্যায়ে।
খেয়ে পেট ভরে তারা বাতাসিয়া লুপটা ঘুরে দেখতে লাগল।
বাতাসিয়া লুপ দার্জিলিং হিমালয়ান হেরিটেজ রেলওয়ের সমতল থেকে ৭৪০৭ ফুট ওপরে, দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরত্বে ভারতীয় রেলের সর্বোচ্চ রেল স্টেশন।
বাতাসিয়া লুপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা দেখার জন্য একটি চমত্‍কার দৃশ্য। হিল কার্ট রোডে (এনএইচ ৫৫) অবস্থিত। আপনি এর সকল গৌরবের মধ্যে দার্জিলিয়ের প্যানোরামিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
বাতাসিয়া লুপের উপর থেকে সমস্ত দার্জিলিং শহরটাকে দেখা যায়। একেবারে ৩৬০ডিগ্রি এঙ্গেলে। অসাধারণ সেই দৃশ্য বাতাসিয়া লুপটি মাউন্টেনের দর্শকদের দর্শনের জন্য আকর্ষণ করে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং অন্যান্য তুষারপাত হিমালয় পর্বতগুলি এবং দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথের অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং আশ্চর্য দেখায়। যেখানে প্রায় অজ্ঞাতসারে রেললাইনটি একটি বৃত্তের সাথে আলোচনা করে এবং উচ্চতায় 1000 ফুট নিচে নামায়।
বাতাসিয়া লুপের কেন্দ্রে একটি ওয়ার মেমোরিয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এই স্মৃতিসৌধটি জেলা সৈনিক বোর্ড, দার্জিলিং কর্তৃক সাহসী গোর্খা সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল। যারা স্বাধীনতার পর থেকে জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিল।

সাদিদ নীলার হাতে হাত রেখে সামনে হাঁটছে। অর্ণব প্রিয়তীকে নিজের সাথে আগলে ফুসুরফাসুর করে কথা বলছে এবং বাতাসিয়া লুপের সৌন্দর্য অবলোকন করছে। তাদের এতো প্রেমের মধ্যে দুইজন ব্যক্তি শুকনো মরুভূমির ন্যায় হাহুতাশ করছে। শান্তর এসবে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট না থাকলেও ভালোবাসাময় কাপলযুগলের এত মধুর সময় কাটানো দেখে তার এখন বিন্দু বিন্দু আফসোস হচ্ছে। ইশশশ আফসোস।
তানবীরও হাঁটতে হাঁটতে শান্তর পাশে এসে দাঁড়ালো। শান্ত আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। তার চোখ-মুখের ভাব দেখে তানবীর-ই প্রথমে বলে উঠল,

— ‘ কি চিন্তা করো? ‘
— ‘ তেমন কিছু না৷ ‘
— ‘ তেমন কিছু না হলে কেমন কিছু? ‘

শান্ত মাথা নিচু করে হাসল। তারপর তানবীরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ‘ বলতে পারি যদি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। ‘
— ‘ বাহ্বা একটার উত্তর দিয়ে আরেকটা জানতে হবে? ‘
— ‘ জ্বি এমনটাই। ‘
— ‘ আচ্ছা তাহলে বলো দেখি। কি জানতে চাও। ‘
— ‘ আপনি কি এতদিন কোনো কারণে আমার উপর রেগে ছিলেন? ‘

তানবীর হাঁটা থামিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। মুহূর্তেই তার মুখটা গম্ভীর হলো। তারপরও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,

— ‘ কই নাতো। তুমি এমনিতেই এমনটা চিন্তা করছ। ‘
— ‘ সত্যি বলছেন? আমার কিন্তু এমনটা মনে হচ্ছে না। ‘
— ‘ তুমি কিন্তু রুলস ব্রেক করছ। তোমার কথা ছিল আমি একটা উত্তর দিলে তুমিও দিবে। এখন আরেকটা প্রশ্ন করলে দুইটা হয়ে যাবে। ‘

শান্ত হেসে ফেলল তার কথায়। সে হাসি মুখেই বলল,

— ‘ আচ্ছা তাহলে বলছি। আপনি কিন্তু হাসবেন না। ‘
— ‘ ওকে কোনো হাসাহাসি হবে না। ‘
— ‘ আসলে ওদের এতো প্রেম-ভালোবাসা দেখে না আমারও একটা প্রেমের জন্য মারাত্মক আফসোস হচ্ছে। নিজেকে কেমন কাঠখোট্টা মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি যে ক্রাশ-ই খেতে পারি না। তাহলে ক্রাশের পরবর্তী লেবেল প্রেম করব কিভাবে? ‘

তানবীর কিছুটা চমকিত দৃষ্টিতে শান্তর দিকে তাকালো। শান্ত তাকে হাসতে মানা করলেও সে এবার পেট ধরে হাসতে লাগল। শান্ত চোখ বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালো। যার অর্থ হাসাটা তার একদমই উচিত হয়নি। বরং কিছুটা কান্না করলে শান্তর বোধহয় খুশি লাগত।

— ‘ আপনি কিন্তু বলেছিলেন হাসবেন না। ‘
— ‘ সরি। কিন্তু কি করব? তোমার কথাটাই এমন যে আমি না হেসে পারলাম না। ‘

শান্ত রাগ দেখিয়ে সামনে হাঁটা ধরতেই তানবীর দ্রুত পা ফেলে তার হাতের কব্জিতে ধরল। শান্ত আচমকা তানবীরের এভাবে হাত ধরাতে অবাক দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে তাকালো।
তানবীর সেটা খেয়াল করে শান্তর হাতটা ছেড়ে দিলো। কিন্তু শান্তর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ প্রেম করতেও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। তোমার তো খালি মাথা। তাই এসব তোমার ভাগ্য নেই। ‘

বলেই তানবীর আবারও হাসতে লাগল। শান্ত এবার রাগে-দুঃখ-অপমানে তানবীরের পিছনে ছুটল। তানবীরও দুষ্টুমি করে দৌড় শুরু করল। মারতে পারুক বা বাঁচতে পারুক। কিন্তু দুইজনই জানে তারা একে অপরের সান্নিধ্যে পছন্দ করে। ঝগড়া লাগলেও দিনশেষে দুইজনই নিজের অজান্তেই একে অপরের পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু দু’জনই সেটা মানতে একেবারে নারাজ।

তারা ট্রয় ট্রেনে করে ঘুম স্টেশনটাও দেখল। ঘুম হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং হিমালয়ান পার্বত্য অঞ্চলের একটি ছোট্ট পার্বত্য অঞ্চল। এটি দার্জিলিং পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের আওতায় আসে। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ঘুম রেল স্টেশন ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। এটি ২,২৫৮ মিটার (৭,৪০৭ ফুট) এর উচ্চতায় অবস্থিত। যাত্রা বিরতিতে তারা ঘুম রেলওয়ে স্টোপেজটা দেখে নিলো। তারপর আবারও ট্রয় ট্রেনে চড়ে সৌন্দর্যে ভরা এই মনোরম দৃশ্যপটকে বিদায় জানাতে হলো।

__________________

সাদিদরা বিকেলটা মলে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে আসলো। নীলা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠাতে হোটেলে ফিরেই সে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সাদিদ তার কান্ড দেখে হাসল। সে জানে এখন তালে বলেও কোনো লাভ হবে না। তাই সে ডিরেক্ট গিয়ে নীলাকে হেঁচকা টানে বসিয়ে কোলে তুলে নিলো। আচমকা এমন হামলায় নীলা হকচকিয়ে চোখ খোলল। চমকিত কন্ঠেই বলল,

— ‘ কি করছেন? ‘
— ‘ বউকে কোলে নিলাম। ‘
— ‘ সেটাই। কোলে নিয়ে কি করছেন? ‘

সাদিদ নীলার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তাকে নিয়ে সোজা ওয়াসরুমে ঢুকল। নীলার এতক্ষণে বোধগম্য হলো সাদিদ কি করতে চাইছে। তাই সে দ্রুত বলে উঠল,

— ‘ একটু পর ফ্রেস হবো তো। এখন একটু রেস্ট নিতে দেন। ‘
— ‘ সারাদিন বাহিরে ছিলে। শরীরে অনেক ময়লা। এখন ফ্রেস হয়ে একেবারে রেস্ট করো। তখন আমি বাধা দিব না। ‘

নীলা বুঝে গিয়েছে এই ব্যক্তিকে বলে কোনো লাভ হবে না। সে নিজের কথায় অনড়। তাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে জ্যাকেটে হাত দিলো। কিন্তু সাদিদকে এখনও বাহিরে যেতে না দেখে তার ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো। সে ভ্রু বাঁকা করে বলল,

— ‘ কি হলো দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ‘

সাদিদ তার কথার উত্তর না দিয়ে বাঁকা হাসল। সাদিদের ঠোঁটের কোণায় এই হাসি দেখে নীলা একটা ঢুক গিলল। তাকে এমন করে হাসতে দেখলেই নীলার কলিজা কেঁপে উঠে। নিঃসন্দেহে তার মাথায় কোনো শয়তানী খেলা করছে।
ঠিক যেমনটা ভাবা। সাদিদ ওয়াসরুমের দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর নিজের গায়ের জ্যাকেট, ট্রি-শার্টটা খোলে ফেলল। ধীরে পায়ে নীলার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। নীলা গায়ের টপস চেপে ধরে পিছিয়ে যেতে লাগল। সে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপনি এমন এগিয়ে আসছেন কেন? ‘
— ‘ আমিও তো বাহিরে ছিলাম৷ আমার গায়েও ময়লা আছে। তাই শাওয়ার নিব। ‘
— ‘ ওহ্ তাহলে আপনি আগে শাওয়ার নেন। আমি চলে যাচ্ছি। ‘

নীলা কথা শেষ করেই বাহিরে যাওয়া ধরতেই সাদিদ তার হাত টেনে ধরল। দুইহাতে নীলার কোমড় চেপে ধরে বলল,

— ‘ আগে-পরে দরকার কি? দুইজনে একসাথে করলেই তো হয়৷ ‘
— ‘ একসাথে? ‘

নীলা প্রায় চিল্লিয়ে বলে উঠল। নীলাকে এমন চেঁচাতে দেখে সাদিদ তাকে ওয়াসরুমের দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। তার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ কেন? একসাথে করলে সমস্যা কোথায়? আমরা বোধহয় আগে কখনও একসাথে করিনি? ‘

বলেই সাদিদ ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসতে লাগল। নীলার লজ্জায় গাল পুরো টমেটো হয়ে গিয়েছে। সাদিদ সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর আচমকা শাওয়ার ছেড়ে দিলো। সাদিদের শরীরে জিন্স ব্যতিত অন্য কিছু নেই। শাওয়ারের পানি তার চুল বেয়ে বেয়ে সমস্ত শরীরে পড়ছে। নীলাও ইতিমধ্যে ভিজে গিয়েছে। হালকা ঠান্ডায় সে মৃদু কাঁপছে। সাদিদ হাত বাড়িয়ে তার টপসটা খোলতে চাইলে নীলা দুর্বল হাতে তাকে বাধা দিলো৷ সাদিদও আর জোর করল না। কেননা সে ভালোই জানে নীলা এখনও পর্যন্ত সাদিদের সংস্পর্শে কতটা লজ্জা পায়। কিরকম কাচুমাচু করে। নীলা এবারও লজ্জায় এবং ঠান্ডায় মাথা নিচু করে রয়েছে। সাদিদ তার কানের পিছনে হাত দিয়ে তার মুখটা উঁচু করে ধরল। নীলার চোখ, ঠোঁট কাঁপছে। পানিতে ভিজে তার মুখে আরও স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। মুখের বিন্দু বিন্দু জল কণাগুলোকে দেখে সাদিদের বড্ড হিংসে হচ্ছে। হিংসুটে প্রেমিক তাদেরকে শাস্তি দিতে লেগে গেল।
সে নীলার ডান গালে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিলো। একে একে বাম গালসহ, কপাল, নাক, নীলার পুরো মুখে চুমু খেল। নীলা সাদিদের স্পর্শে বারবার কেঁপে উঠতে লাগল। সাদিদ তার বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নীলার ঠোঁটে স্পর্শ করতেই নীলা কেঁপে উঠে সাদিদের উন্মুক্ত বুকে হাত রাখল। সাদিদ নীলার অবস্থা বুঝতে পেরে তার বুকে রাখা হাতটা নিজের হাতে নিলো। তারপর নীলার দিকে তাকিয়ে তার হাতের পিঠে শব্দ করে চুমু খেল। নীলা লাজুক হেসে সাদিদের উন্মুক্ত বুকে মুখ গোঁজল। আবারও একটা হাত সাদিদের বুকে রাখতেই নীলা লজ্জায় লাল হলো। সে ভাবতেই পুলকিত হচ্ছে যে এই সুদর্শন পুরুষটা তার ব্যক্তিগত। নীলার অধিকার এই মানুষটার উপরে সবচেয়ে বেশি। তার স্বামী সাদিদ নামক এই পুরুষটা। নীলা মাথা উঁচু করে সাদিদের দিকে তাকালো। শাওয়ারের পানিতে সে চোখ খোলে রাখতে পাড়ছে না। পিটপিট করে চোখ খোলে রেখে সে আবেগময় কন্ঠে বলল,

— ‘ কখনও ছেড়ে যাবেন না তো? ‘

সাদিদ আচমকা নীলার এমন কথায় খানিকটা ভরকে গেলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। মৃদু হেসে নীলার গালে হাত রেখে কপালে দীর্ঘ চুমু খেল। তারপর নীলার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ‘ তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এই হাতটা ধরার জন্য আমি কতগুলো দিন অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। আর আজ যখন এই হাতের মালিক আমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রাণপাখি। আমার রাজ্যের রাণী। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। তুমিই বলো সেই হাতটা আমি কিভাবে ছাড়ব? সম্ভব নয় পাখি। আমার পক্ষে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি কেবল তোমার সান্নিধ্যে চাই। তুমি ব্যতিত না অন্য কাউকে আমার প্রয়োজন নেই আর আমি চাইও না। আমি কেবল তোমাকেই চাই পাখি৷ শুধু তোমাকেই। আমার সব ভালোবাসা কেবল তোমার জন্যই বরাদ্দ। অন্য কেউ এর ভাগ পেতে পারে না। আমি সেটা কখনও হতে দিব না। ‘

নিজের স্বামীর মুখে নিজের জন্য এতটা গভীর ভালোবাসা দেখে নীলার চক্ষু খুশিতে ম্লান হলো। সে সাদিদের পিঠ শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। সেও যে চায়। নিজের সবটুকু দিয়ে নীলা শুধু সাদিদকেই চায়। আজ, আগামী এবং জীবনের বাকি সবকটা দিন।
সাদিদ অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়াতে এবার নীলাকে ছেড়ে টাওয়েল হাতে নিলো। নীলার চুলগুলো মুছিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ লজ্জাবতী লাজুকলতা, এবার ড্রেসটা চেইঞ্জ করে জলদি বাহির হন। ‘

নীলাকে বলে সাদিদ টাওয়েল জড়িয়ে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। নীলা আবারও লাজুক হাসল। শুকনো জামা পরে নীলা বের হতেই সাদিদকে দেখতে পেল। সাদিদ ইতিমধ্যে ড্রেস চেইঞ্জ করে পাতলা একটা সাদা ট্রি-শার্ট আর টাওজার পরে নিয়েছে। সে বিছানায় বসে ফোন টিপছে। নীলাকে বের হতে দেখেই মিষ্টি করে হাসল। দরজায় নক পরতেই নীলা দ্রুত ওড়না গায়ে দিয়ে ঠিকঠাক হলো। সাদিদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে হোটেল বয়কে দেখতে পেল। সে তাদের জন্য কফি অর্ডার দিয়েছিল। সাদিদ কফি নিয়ে বিছানায় বসল। নীলাকে কাছে আসতে বললে সে দ্রুত কাছে এসে বসল।
সাদিদ তাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকে হেলান দিয়ে বসাল। তারপর তার হাতে কফি মগ তুলে দিলো। তারপর নিজে একটা মগ নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। এই সময়ে কফিটা বড্ড প্রয়োজন ছিল। নীলার কফি শেষ হতেই সাদিদ তাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। নীলাকে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করতেই সে আচমকা বলে উঠল,

— ‘ আমরা তো কাল চলে যাব। তাই না? ‘

সাদিদের মনটা আচমকাই খারাপ হয়ে গেল। দার্জিলিং শহরের থেকে এবার সাদিদের কাছে নীলার অনুপস্থিতিটাই বেশি কষ্টদায়ক লাগবে। সাদিদ দুইহাতে নীলাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,

— ‘ আই উইল মিস ইউ পাখি। ‘

সাদিদের কন্ঠে কতটা আকুলতা মিশ্রিত ছিল নীলার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না। সে সাদিদের বুকে নাক ঘষে বলল,

— ‘ আমিও। খুব বেশি মনে পড়বে আপনার সাথে কাটানো এই সময়গুলো। ‘
— ‘ পাখি, আমার লাইফের মধুময় মুহূর্ত ছিল দার্জিলিয়ের এই সামান্য সময়টুকু। তোমাকে এতটা কাছে পাওয়া। জীবনের মধুময় ভালোবাসার মুহূর্ত দার্জিলিং আমাকে উপহার দিয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ এই দার্জিলিয়ের কাছে। ‘

নীলা হাসল। সত্যিই দার্জিলিং তাদের নতুন করে ভালোবাসা শিখিয়েছে। দিয়েছে জীবনের অতিব মধুময় মুহূর্তের কিছু স্মৃতি। তারা কৃতজ্ঞ এই দার্জিলিং শহরের কাছে।

#চলবে…

[ আমি শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ প্রিয়পাঠক। তাই দেরীটুকু ক্ষমা করবেন। দোয়াপ্রার্থী🙏 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here