গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৫
ক্লান্ত শাহেদ বসার ঘরে পা রাখতেই থমথমে নীরব পরিবেশ দেখে ভ্রুজোড়া খানিকটা কুঁচকালো। অতঃপর সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই শায়লা রহমানের সঙ্গে দেখা হওয়াতে বলেই ফেলল,
— ‘ মা, এত নীরব পরিবেশ যে? ‘
শায়লা রহমান ছেলের কথার অর্থোদ্বার সহজেই করতে পারলেন। তাই অমায়িক হেসে প্রতিউত্তরে বললেন,
— ‘ যে সর্বদা পরিবেশ গরম রাখে তিনি যে আজ গাল-মুখ ফুলিয়ে বসেছেন। তাহলে পরিবেশ নীরব থাকবে না-তো কি থাকবে? ‘
শাহেদ খানিকটা মাথা ঝুঁকিয়ে হাসল। তারপর মায়ের থেকে আসার অনুমতি নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখতেই নজর পড়ল সোনালি চুলের ছোট্ট নাদুসনুদুস বাচ্চাটার গাল ফুলানো মুখে। বিছানার মাঝখানে বসে সে মুখ ফুলিয়ে ড্যাবড্যাব চোখে নিচে তাকিয়ে রয়েছে। পাশ থেকে নিধি এতক্ষণ অনবরত চেষ্টা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে এখন তারপাশেই বসে পরেছে। শাহেদকে আসতে দেখে নিধি এবার উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এসে হাতের অফিস ব্যাগটা নিয়ে নম্রস্বরে বলে উঠল,
— ‘ আপনি ফ্রেশ হন। আমি ফ্রিজ থেকে আপনার লেবুর শরবতটা নিয়ে আসি। ‘
— ‘ আচ্ছা। ‘
শাহেদ ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে আবারও বিছানায় বসা ছেলের দিকে তাকালো। নিধি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে মৃদু হাসল। অতঃপর মৃদু হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। শাহেদ ফ্রেস না হয়েই প্রথমে ছেলের দিকে এগিয়ে গেল। কিছু না বলেই হুট করে ছেলের ছোট্ট পায়ের উপর মাথাটা রেখে শুয়ে পড়ল। নিজের ছোট্ট বাচ্চার থেকে আরও বাচ্চাস্বরে আবদার করে বসল,
— ‘ আব্বা, চুলগুলো টেনে দাও। ‘
— ‘ আমি রেগে আছি পাপা। ‘
শাহেদ নিঃশব্দে মৃদু হাসল। ছেলের পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল,
— ‘ তাই নাকি? দেখি আমার আব্বাটা কেমন রেগে থাকতে পারে। ‘
ছোট্ট শাদমান এবার হেসে কুটিকুটি। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য বিছানায় হেসে দাপাদাপি খাচ্ছে। শাহেদ কিছুক্ষণ পর তাকে বুকের উপর টেনে আনলো৷ পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— ‘ রাগ কমেছে আব্বা? ‘
শাদমান এবার চোখ তুলে তাকালো। একপলক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও বুকে মুখ গুঁজল। অভিমান নিয়েও দুইহাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অভিযোগের কন্ঠে বলল,
— ‘ পাপা পঁচা, পবাই পঁচা। ‘
— ‘ হুম সবাই পঁচা। আমার আব্বাটাকে নিয়ে আমরা কেউ যাইনি। আমরা ভুলেই গিয়েছি আমার বাবাটাও বড় হয়ে গিয়েছে। তাকে এসব বড়দের কাজকর্ম থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তাই না আব্বা? তাই আমার আব্বাটার রাগ করা জায়েজ। সে শুধু ভালো। বাদবাকি সবাই ভীষণ পঁচা। কিন্তু এখন এই পঁচা পাপাটা কি করলে আমার বাবাটার মন ভালো হবে? ‘
— ‘ জানি না৷ ‘
— ‘ তাহলে আমার বাবা কি জানে? ‘
— ‘ জানি না। ‘
শাহেদ এবার উচ্চস্বরেই হাসল। শাদমান মাথা উঠিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বাবার দিকে তাকালো। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বাবার হাসিটা তার বিন্দুমাত্র পছন্দ হয়নি। তাদের বাপ-ছেলের আদরঘন মান-অভিমানের মধ্যেই নিধি গ্লাসে শরবত নিয়ে রুমে আসলো। শাহেদকে এখনও অফিস ড্রেসে দেখে দ্রুত বলল,
— ‘ একি! আপনি এখনও ফ্রেস হননি কেন? বাহির থেকে এসেই ছেলের সাথে লেগে গেলেন? ‘
নিধির কথায় শাদমান বাবাকে আরও শক্ত করে দুইহাতে ধরল। তা দেখে নিধি খানিকটা রাগী চোখে তাকালেও শাহেদ প্রাণভরে হাসল। অতঃপর মাথা নামিয়ে ছেলের কপালের সাইডে স্নেহের চুমু খেল। নিধি একটা হতাশাজনক শ্বাস ফেলে আলমারি থেকে শাহেদের কাপড় নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শাহেদ একপলক তার দিকে তাকিয়ে শাদমানের কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ‘ আব্বা, তোমার একটা খেলার সাথী হলে কেমন হয়? ‘
শাহেদ মাথা তুলে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তার বাবার দিকে তাকালো। অর্থাৎ বিষয়টা সে বুঝতে পারেনি। শাহেদ আবারও নিচুস্বরে বলল,
— ‘ যে তোমার সাথে সারাদিন খেলবে। তোমার আর বাসায় একা একা লাগবে না৷ এমন একটা পুতুল হলে কেমন হয়? ‘
— ‘ পুতুল? ‘
— ‘ হ্যাঁ পুতুল। একটা পুতুল বুনু। ‘
— ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ লাগবে। আমার পুতুল বুনু লাগবে। ‘
শাহেদ ছেলের হাসিমুখ দেখে হাসল। তারপর আবারও নিধির দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ‘ তাহলে মা-কে গিয়ে বলল একটা পুতুল বুনু এনে দিতে। ‘
শাদমান খুশিতে আত্মহারা হয়ে দ্রুত বাবার বুক থেকে উঠে গেল। সব রাগ-অভিমান ভুলে গিয়ে খুশিতে জর্জরিত হয়ে মায়ের কাছে দৌড় লাগাল। সারাদিন পর ছেলের হাসি মুখখানা দেখে নিধিও আবেগে আপ্লূত হয়ে তাকে কোলে তুলে বুকের সাথে আগলে নিলো। মাথায় চুমু খেয়ে আদুরে গলায় ডাকল,
— ‘ আমার বাবাটা। ‘
শাদমান হাসিমুখেই মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ মাম্মা, আমার চাই। ‘
— ‘ কি চাও বাবা? ‘
— ‘ আমার পুতুল বুনু চাই। ‘
নিধি কয়েকমুহূর্ত নিষ্পলক দৃষ্টিতে শাদমানের খুশিতে উপরে পড়া মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে শাহেদের দিকে তাকাতেই তাকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখল। নিধির আর বুঝার বাকি নেই এইসবের পিছনে আসল কারসাজি কার। নতুবা ছোট্ট ছেলের মুখে এমন কথা আসবে কেন? সে কিছুটা রাগীস্বরে শাহেদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে তাকে শাসাল। অতঃপর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— ‘ এখন না বাবা। তোমাকে অনেকগুলো গাড়ি কিনে দিব। ‘
— ‘ না মাম্মা। আমার শুধু পুতুল বুনু চাই। ‘
— ‘ এসব কি? ছেলের ভালো মাথাটা এসব ঢুকিয়ে নষ্ট করতে চাইছেন কেন? ‘
— ‘ আরে নষ্ট কোথায় করলাম? সত্যিই তো। আমাদের শাদের খেলার সাথী হিসেবে একটা বোন হলে খারাপ হয় না৷ ‘
— ‘ ধ্যাত। আপনিও না। ‘
নিধি কথাটুকু বলেই শাদমানকে নিয়ে বিছানায় গিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। শাহেদ তার চোখ-মুখ না দেখেও বুঝতে সক্ষম বউ তার এই মুহূর্তে হেব্বি লজ্জা পাচ্ছে। সে আর তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইল না। তাই গলার টাইটা ঢিলে করতে করতে বিছানায় নামিয়ে রাখা কাপড়গুলো হাতে নিয়ে ফ্রেস হতে চলে গেল। শাদমান বাবার গমনপথের দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও মায়ের মুখপানে তাকিয়ে নরম কন্ঠে আবদার করল,
— ‘ মা, আমার পুতুল বুনু চাই। ‘
নিধি মৃদু হাসল। কিন্তু তার আবদারকৃত প্রশ্নের কোনোরূপ উত্তর না দিয়ে মাথায় দৃঢ় চুমু দিলো। তারপর বুকে আগলে নিয়ে ছেলের মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
__________________
রাতের আধার বাড়ছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রিয়তীর বুকের ধুকপুকানি। তার আর অর্ণবের সম্পর্ক পরিবার অব্দি জানা ছিল। যার দরুন প্রিয়তী বেশ অনেকবার এই বাড়িতে যাতায়াত করেছে। সুযোগের সৎ ব্যবহার করে প্রেমিক পুরুষের বসবাসকৃত রুমটাও দর্শন লিস্টে নাম করিয়েছে। কিন্তু কখনও এতটা ভয় করেনি৷ যখনই এসেছে মুগ্ধ দৃষ্টি সবকিছু অবলোকন করেছে। কিন্তু আজ সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এত সুন্দর ফুলে ফুলে সজ্জিত কক্ষটি তার মুগ্ধতায় নিজেদের জায়গা করতে অক্ষম। তার সবটুকু মুগ্ধতা রীতিমতো ভয়ের নিচে চাপা পড়েছে। ভয়ে তার এসির মধ্যেও কপাল বেয়ে ঘাম ছুটে চলেছে। সে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে কপাল আর ঘেমে যাওয়া নাকটা আবারও মুছে নিলো।
এরিমধ্য দরজা উন্মুক্ত হবার আওয়াজে প্রিয়তী ভয়ার্ত চোখে একপলক সেদিকে তাকালো। অর্ণবকে চোখের সামনে দেখে তার ভয় যেন আরও দ্বিগুণ হলো। অতি চেনা পরিচিত মানুষটাকেও যেন এই মুহূর্তে ভীষণ অপরিচিত মনে হচ্ছে।
অর্ণবের কাছে প্রিয়তীর ভয়ার্ত দৃষ্টি আড়াল হলো না। সে নিঃশব্দে মৃদু হেসে বিছানায় বসা তার লাল টুকটুকে রক্তজবার কাছে এগিয়ে গেল। প্রিয়তী আরও নতজানু হয়ে বসতেই অর্ণব এবার একটু রসিকতার স্বরে বলে উঠল,
— ‘ ইশশ এখন আসছে লজ্জা পেতে। এতক্ষণ তো নিজের বিয়ে নিয়ে রীতিমতো নাচানাচি করছিলে। ‘
প্রিয়তী একবার চোখ তুলে তাকালো। অন্যসময় হলে জোর গলায় সে এর প্রতিবাদ জানাতো। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের জান বাঁচানোর চিন্তা আগে করছে। দমটা বোধহয় গলা অব্দি এসে আটকে রয়েছে তার। যে কোনো সময় নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার জোগাড়। অর্ণব তার ভাবভঙ্গি দেখে বিষয়টা আঁচ করতে পারছে। তাই তাকে সহজ করার জন্য প্রিয়তীর ডানহাতটা নিজের মুঠিতে নিলো। হালকা চেপে ধরে নরম স্বরে বলল,
— ‘ এত ভারী শাড়ি-গহনা পরে এখনও বসে আছো কেন? গিয়ে ফ্রেস হয়ে নাও। তাহলে ভালো লাগবে।’
প্রিয়তী দ্বিমত পোষণ করল না৷ চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু অর্ণব পিছন থেকে হাত ধরতেই সে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো। অর্ণব তা দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। রক্তহীম করা কন্ঠে আওড়াল,
— ‘ শুভ্র রঙের কিছু পরবে। নতুন শুরুটা শুভ্রের সাথে করতে ইচ্ছুক। ভেবে নাও এটা আমার রঙিন স্বপ্নগুলোর মধ্যে আরেকটা রঙহীন ইচ্ছা। ‘
প্রিয়তী লজ্জায় আরও কুঁকড়ে গেল। সে পারছে না দৌড়ে অর্ণবের ত্রি-সীমানার বাহিরে প্রস্থান করতে। অর্ণব হাত ছেড়ে দিতেই সে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। শরীরে পরিহিত গহনাগুলো খুলতে নিলেই অর্ণব এসে পিছন থেকে তার উষ্ণ হাতটা তার কাঁধে রাখল। মুহূর্তেই আবেশে প্রিয়তীর চোখজোড়া পিটপিট করে বন্ধ হতে চাইছে। অর্ণব আয়নায় সেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। চোখগুলো তার ক্রমশ ঘোলাটে হচ্ছে। কিন্তু আপাতত নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সে একএক করে প্রিয়তীর শরীরের সবকটা গহনা খুলতে সহযোগিতা করল। অতঃপর কাজ সমাপ্ত করে মোহনীয় স্বরে বলে উঠল,
— ‘ এবার যাও। আর, আর জলদি এসো। আমি অপেক্ষা করছি। ‘
ছোট্ট একটা বাক্য। কিন্তু তাতে যেন প্রিয়তীর অবস্থা কাহিল করার সবটুকু সামর্থ্য রয়েছে। সে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না৷ একপ্রকার দৌড়ে ওয়াসরুমে ছুটল। অর্ণব সেদিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে হাসল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
— ‘ পাগলি। ‘
অল্প কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যেই প্রিয়তী ফ্রেস হয়ে বের হলো। রুমে চোখ বুলিয়ে অর্ণবকে কোথাও না দেখে যেন সে হাফ ছেড়েছে। কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা স্থায়ী হতে পারল না। কেননা অর্ণব তার পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠে বারান্দা থেকে প্রিয়তীকে ডাকছে। প্রিয়তীর শরীরে আবারও কম্পন অনুভব হতে লাগল। সে কাঁপা পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। অর্ণব তার পাঞ্জাবির পকেটে দুইহাত ঢুকিয়ে সটান হয়ে শূন্য আকাশপাণে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়ানো৷ প্রিয়তী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে সে নিঃশব্দে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের দুইহাত প্রিয়তীর হাতের উপর দিয়ে রেলিং ধরে তাকে বাহুবন্ধনে আটকে নিলো। প্রিয়তীর ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। তাই প্রিয়তীর কাঁধে নিজের থুতনি রেখে মৃদু কন্ঠে বলল,
— ‘ কি হয়েছে? এতো নার্ভাস কেন? ‘
প্রিয়তীর কন্ঠনালী আটকে রয়েছে। অর্ণবকে নিজের এত কাছে পেয়ে তার গলা দিয়ে শব্দ বের করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পরেছে। অর্ণব আবারও একই প্রশ্ন করলে প্রিয়তী আটকে যাওয়া গলায় বলল,
— ‘ কি..ছু না। এমনি। ‘
— ‘ ওহ্ তাই বুঝি? কিছু-ই না? তুমি সত্যিই পুরোপুরি ঠিক আছো? ‘
বলেই প্রিয়তীর কাঁধ থেকে মসৃণ চুলগুলো একপাশ করে আলতো করে নিজের অধর ছুঁয়ে দিলো। প্রিয়তী এবার না পেরে সামনে ঘুরে আঁখিদ্বয় বন্ধ করে অর্ণবের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো। অর্ণব চাপা হেসে তাকে নিজের শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। আর প্রবল ভালোবাসায় প্রিয়তমার চুলের ভাঁজে দৃঢ় চুম্বন আঁকলো।
মুহূর্তেই চাঁদটা যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে প্রিয়তীর ন্যায় নিজের লজ্জা নিবারণে ব্যস্ত। অর্ধচন্দ্রের আলোকরেখাও যেন আজকে রাতের জন্য নিজের ছুটি নিতে ব্যস্ত। কেননা আজ যে রজনীর নিস্তব্ধতার চাদর পেরিয়ে প্রেমিক মনের এক হবার রাত। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ভালোবাসার উষ্ণতায় একে অপরের মাঝে হারিয়ে যাবার রাত।
____________________
নীলা এমনিতেই ঘুম কাতুরে। তারউপর আজকে সারাদিন মেঘেদের আনাঘোনা ছিল। যার দরুন প্রকৃতিতে এখন নীলার মতো শীতকাতুরে মানুষের জন্য প্রায় হীম হীম ভাব৷ সে ইতিমধ্যে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। সাদিদ অফিসে গিয়েছে। সুতরাং নীলার সাথে তার আর ফোনে বার্তা-আলাপ করার সময় হয়ে উঠবে না। কেননা সাদিদ আর যায় করুক কিন্তু রাত জেগে নীলাকে ফোনে বিরক্ত করে না। এগারোটা অব্দি ঠিকঠাক। কিন্তু এরপরে ভুলেও সে নীলাকে ফোনে আটকে রাখবে না। বরং নীলা কোনো কারণবশত ঘুমাতে লেইট করলে বকা খাওয়া মিস যায় না। আর ইতিমধ্যে ঘড়ির কাটা দশটা পেড়িয়ে প্রায় এগারোটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। তাই সাদিদ যে আর ঘুমের মধ্যে বেঘাত ঘটাবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। সেইজন্য এইমুহূর্তে জেগে থেকে মশার কামড় খাবার কোনো মানে হয় না। নীলাও বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে ঘুমানোটাকেই সঠিক মনে করল।
নীলার ঘুমটা প্রায় লেগে এসেছিল। আর তখনই কাঁচা ঘুমের সর্বনাশ ঘটিয়ে পাশ থেকে ফোনটা বিরক্তিরস্বরে বেজে উঠল। নীলা ঘুমন্ত অবস্থাতেই ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল। প্রথমবার বেজে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু বিরক্তির রেশে নীলা সেটা ধরল না। কিন্তু আবারও কানের কাছে অনবরত নিজের উপস্থিতি জানান দিতেই সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করেই হাতড়িয়ে ফোনটা তুলল। স্ক্রিনে নাম না দেখেই কিছুটা বিরক্তি মাখা কন্ঠে আওড়াল,
— ‘ আসসালামু আলাইকুম। কে? ‘
ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটি নিঃশব্দে হাসল। মেয়েটার ঘুমঘুম কন্ঠে যেন অ্যালকোহল মিশ্রিত। যা সাদিদকে গভীর নেশায় বুদ হতে বাধ্য করে। এই মুহূর্তে প্রাণপাখিটার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার নিজেকে বড্ড অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই যেন ভালোবাসার লোভ জিনিসটা এসে তাকে এই মতবাদ ফিরিয়ে নিতে আবদার জানাচ্ছে। কেননা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে বলেই তো সে এই স্নিগ্ধ মুগ্ধতায় বুদ হতে পেরেছে। ক্ষীণ মুহূর্ত হোক কিন্তু দিনশেষে সাদিদকে একরাশ প্রশান্তি দেবার জন্য সহায়তায় হাত বাড়িয়েছে। তাহলে মাঝেমধ্যে এমন অপরাধ করতে দোষ কোথায়?
— ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনার বর বলছি মহারাণী। ‘
— ‘ বর? ‘
নীলা দ্রুত চোখ খুলল। ফোনটা চোখের সামনে আনতেই তাতে প্রিয় মানুষটার নামটা ভেসে উঠল। নীলা আবারও সেটা কানে নিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,
— ‘ আসলে আমি দেখেনি। চোখ না খুলেই..
— ‘ পাখি, এক্সপ্লেইন করতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। ‘
— ‘ অহ্। আপনি এইসময়? এখনও ঘুমাননি? ‘
— ‘ আর ঘুমাতে পারলাম কই? একজন তো আমার ঘুমসহ যাবতীয় সবকিছু নিয়ে একেবারে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ‘
— ‘ মিথ্যা কথা। আমি মোটেই নাক ডাকি না। ‘
— ‘ তাহলে এই রকম হালুমের মতো ঘন ঘন শ্বাস টানে কে? ‘
— ‘ ঐটাতো আপনি কাছে…
নীলা পুরো বাক্যটার ইতি না টেনেই থেমে গেল। ফোনের অপরপাশে সাদিদের চাপা হাসির আওয়াজ পেয়ে নীলা নিচুস্বরে বিড়বিড়িয়ে উঠল,
— ‘ অসভ্য। ‘
— ‘ তোমার বর-ই। ‘
নীলা আর ঝগড়াঝাটিতে যেতে চাইল না। নতুবা এই নির্লজ্জ ছেলে কোন কথাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে সেটা তার আন্দাজশক্তির বাহিরে।
নীলাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাদিদও তাকে এই মুহূর্তে জ্বালাতনের মনোভাব ত্যাগ করল। অনেকটা নীরবতার পর নম্রস্বরে ডাকল,
— ‘ পাখি। ‘
— ‘ জ্বি? ‘
— ‘ অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে। তাই আমার আশাটা ঠিক মনে হচ্ছে না। তুমি কি একটু নিচে আসবে? ‘
নীলা কোনোরূপ প্রশ্ন করতে পারল না৷ আর না কারণ জানতে চাইল৷ শুধু মাথা নিচু করে নিচুস্বরে সমর্থন জানিয়ে বলল,
— ‘ আসছি। ‘
সাদিদ ফোন রাখল। তার ঠোঁটের কোণে সরু একটা হাসির রেখা। নীলা রুম থেকে বেড়িয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসলো৷ আয়নায় দাঁড়িয়ে মাথার ঘোমটাটা ঠিক মতো টেনে দিলো। এলোমলো চুলগুলোকে কানের পিছনে দিয়ে আরেকটু গুছিয়ে নিলো। অতঃপর আরেকবার আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলল। সে অজান্তেই বউদের মতো কাজ করছে। স্বামীর যেন চোখ জুড়িয়ে যায় সেই অনুপাতে নিজেকে তৈরি করতে চায়ছে। আপনমনে লাজুক হেসে সে গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। মা-বাবার এতক্ষণে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য নিঃশব্দে তাদের রুমের সামনে পা বাড়াল। সবকিছু নীরব দেখে যেন সে হাফ ছাড়ল। নতুবা মা-বাবার সামনে নিচে যেতে হলে বড্ড লজ্জা পেত।
নীলা গেইট পেড়িয়ে বড় রাস্তায় পা রাখতেই গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো সাদিদকে চোখে পড়ল। শরীরে এখনও তার অফিসিয়াল ড্রেস। নীলা তাকে একপলক দেখেই বুঝল সে এতরাতে সোজা অফিস থেকে বের হয়ে এসেছে। মুহূর্তেই স্ত্রীর স্বভাবসূলভ স্বামীর অতিরিক্ত ক্লান্ততায় রাগ লাগলেও, পরমুহূর্তেই সাদিদকে মিষ্টি হাসতে দেখে সেটা নিমিষেই গায়েব হলো। সাদিদ ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ঝুলিয়ে তার দিকে নিজের দুইহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীলা খুশিতে একপ্রকার ছুটে গেল। কাঙ্খিত জায়গাতে মুখ লুকিয়ে যেন স্বস্তি পেল৷ সাদিদও পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে যেন প্রশান্তির শ্বাস টানল।
কেটে গেল নিঃশব্দে কিছুক্ষণ। অতঃপর সাদিদ তার দুইগালে হাত রেখে মুখটা আঁজলাভরে ধরল। ছোট্ট খাড়া নাকটাতে টুপুস করে একটা চুমু খেয়ে নিলো। নীলা লজ্জায় চোখ নিচু করতেই সে বলল,
— ‘ লালরঙে পুরো বউ বউ লাগছে। আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা বউ। ‘
নীলা কিছু বলল না। আবারও লাজুকলতা হয়ে তার বুকে মাথা রাখল। সাদিদ বারকয়েক তার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
— ‘ কি জন্য এতরাতে ডেকে নিয়ে আসলাম সেটা জিজ্ঞেস করবে না? ‘
নীলা কোনো প্রশ্নবোধক শব্দ উচ্চারণ করল না৷ শুধু মাথা উঁচিয়ে সাদিদের চোখের গভীরে দৃষ্টি রাখল। যেন নীরবেই তার কথার উত্তর দিয়ে দিচ্ছে।
সাদিদ আবারও হাসল। অতঃপর প্রিয়তমার কপালের মধ্যেখানে আদরমাখা ভালোবাসার স্পর্শ দিতেই নীলা আবেশে চোখ বুজে নিলো।
সাদিদ তাকে নিঃশব্দে পাঁজাকোলে তুলে নিতেই সে হকচকিয়ে উঠল।
— ‘ কি করছেন কি? রাস্তার মাঝখানে এসব কি? ‘
— ‘ তোমার ভয় পাওয়ার কারণ যথাযোগ্য নয়। কেননা এতরাতে কাকপক্ষিও রাস্তায় উপস্থিত নয়। দূরে হয়তো একটা দুইটা কুকুর-বিড়াল পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা এসে অবশ্যই আমার কাজে বাঁধা প্রধান করবে না? ‘
— ‘ আপনি একটা ঘাড়ত্যাড়া। নিজের যা ভালো লাগে সেটাই করেন৷ ‘
— ‘ হুয়াট ডু ইউ মিন বাই ঘাড়ত্যাড়া? আমার ঘাড় কোন দিক দিয়ে ত্যাড়া মনে হচ্ছে তোমার? ‘
— ‘ এটা হচ্ছে স্বভাবের ত্যাড়া৷ ‘
নীলা বিরক্তিকর সুর টানল। এবার আর সাদিদ নিজের রাগ দেখাল না। চুপচাপ তাকে নিয়ে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে তাকে সিটে বসিয়ে দিলো। অতঃপর সে সামনের দরজাটা খুলে গাড়ির ফ্রন্টসিট থেকে একটা বক্স নিয়ে এসে পিছনে নীলা পাশাপাশি বসল। তারপর বিনাবাক্য তার কোলে মাথা দিয়ে বক্সটা নীলার হাতে ধরিয়ে দিলো। নীলা আকষ্মিক কান্ডে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এই ছেলের মতিগতি সে কিছুই ঠাহর করতে পারে না৷ সে কিছুটা চমকিত কন্ঠেই বলল,
— ‘ এসব কি? আর এই বক্সে কি? ‘
— ‘ এসব হচ্ছে আদর খাওয়া। আর বক্সে কি সেটা নিজেই দেখে নাও। ‘
ইশশ কি নির্লিপ্ত উত্তর। নীলা আর তার সাথে পাল্টা কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বক্স খুলাতে মন দিলো৷ আর অপরদিকে সাদিদ এতটুকু সময়ে পা উঠয়ে আরও আরাম করে শুয়ে পড়ল।
নীলা বক্সটা খুলতেই তার চোখ বেড়িয়ে আসার জোগাড়। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চোখ বন্ধ করে রাখা সাদিদের মুখপানে তাকালো। চমকিত ভাব নিয়েই প্রশ্ন ছুড়ল,
— ‘ আপনি কি ফুচকা ফাইভ স্টার থেকে নিয়ে এসেছেন? ‘
সাদিদ চোখ খুলল। খানিকটা কপাল কুঁচকে নীলার মুখের দিকে তাকালো। পুরোটা না বললেও অল্পতেই সে নীলার কথার অর্থোদ্বার করতে সক্ষম। তাই তার চোখে এই বিরক্তির রেশ।
— ‘ তোমার কি ধারণা এসব স্ট্রিট ফুড আমি তোমাকে এলাও করব? ‘
— ‘ তাই বলে এইরকম প্যাকেট-স্যাকেট করা ফুঁচকা? রেস্টুরেন্ট কতৃপক্ষ হয়তো প্যাকেট করতে গিয়েই তাদের বেস্বাদ জিনিসের স্বাদ আরও খানিকটা কমিয়ে দিয়েছে। ‘
— ‘ গালদুটো এখন সত্যিই লাল করে দিব। ভালো জিনিসে রুচি হয় না। যতসব রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ধূলিকণা খেতে হুড়মুড়িয়ে থাকে। ‘
নীলা মুখ বাঁকিয়ে গাল ফুলালো। সাদিদ খেয়াল করল সেটা। কিন্তু এই মেয়েকে সে কিভাবে বুঝাবে রাস্তার পাশের এইসব জিনিস স্বাস্থ্যকর নয়। স্বাদে হয়তো বা মুখরোচক, কিন্তু তার ফলাফল একেবারে ভয়াবহ।
সাদিদ নিচে থেকে নীলার ফুলে উঠা গালে হাত দিলো। সে কিছুটা জোর নিয়ে হাতটা সরিয়ে অপরদিকে মাথা ঘুরালো। সাদিদ ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। অতঃপর নীলার একটা হাত নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে আঙুলগুলো ক্রমাগত নড়াচড়া করতে করতে সম্মোহনী গলায় বলে উঠল,
— ‘ অফিস থেকে বেড়িয়ে বাসায় যাওয়ার পথে ফুচকাওয়ালাকে দেখলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই একদল মেয়ে খুব মজা করে ফুচকা খেয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার পাশের বিধায় সেটা আনতে পারিনি। পরে গাড়ি ঘুরিয়ে ফুচকা পাওয়া যায় এমন একটা ভালো রেস্টুরেন্টে ডুকলাম৷ আমার পাখিটার যেন এসবে শরীর খারাপ না হয় সেইজন্য এই ব্যবস্তা। নতুবা এসব খাবার আমি কিন্তু তোমার খাওয়ার লিস্টে একদম রাখব না৷ সেটা তুমি না চাইলেও। এবং এটা শুধু বলার জন্য নয়। পুরোপুরি কার্যকর করা হবে। ‘
শেষের কথাগুলো সাদিদ বেশ গম্ভীরস্বরে বলে তারপর থামলো। নীলার এই মুহূর্তে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।
এক সে খুব ভালো করেই জানে সাদিদ তার সুস্বাস্থ্য নিয়ে বড্ড কঠিন মনোভাব পোষণ করে৷ নীলা কেঁদে কেটে সাগর বানালেও সে এসব অখাদ্য তাকে ছুঁতে দিবে না। তাই আজকে নিজ থেকে নিয়ে আসাতে নীলার কাছে এটা আকাশের চাঁদ পাওয়ার থেকে কম নয়। কিন্তু তখন হঠাৎ এমন প্যাকেট-স্যাকেটে মুড়ানো গুছিয়ে রাখা ফুচকা নামক খেলনা দেখে সে বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সাদিদের কথাশুনে বিরক্তিগুলো যেন হুড়হুড়িয়ে মাটির নিচে চাপা পড়ল।
কিন্তু একটা জিনিস চাপা পড়ল না। সেটা ভেবেই নীলা আপনশক্তিতে ভ্রু-বাঁকিয়ে শাসন কৃত গলায় বলল,
— ‘ ডাইভ করেন, না রাস্তায় মেয়ে দেখেন? চোখগুলো এতো এদিক-ওদিক যায় কেন? ‘
সাদিদ বিস্ফোরিত চোখে নীলার রাগী মুখশ্রীতে পলক ফেলল। তার এতো সুন্দর অনুভূতির সারমর্ম এই মেয়ে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে! সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
— ‘ সব বউ-ই এক। চরম সন্দেহপ্রবল। ‘
নীলা তার নিচুস্বরের বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা শুনে নিলো। তাই রেগে গিয়ে তার চুলে সজোরে টান দিয়ে বলল,
— ‘ আর সব বর-ই এক। মিচকে শয়তান। ‘
সাদিদ একপলক রেগে গেলেও পরমুহূর্তেই নীলার রাগে ফুলে উঠা হালকা লাল বর্ণের নাকটা দেখে নিজের রাগটা ভিতরে চেপে নিলো৷ অতঃপর শাস্তিস্বরূপ নীলার নাকটা জোরে টেনে দিলো।
— ‘ আউচ। আমি ব্যাথা পেয়েছি। ‘
— ‘ ব্যাথা পাবার জন্যই দিয়েছি৷ এরকম মাথামোটাদের মতো চিন্তা করলে এর থেকেও বেশি দিব। ‘
— ‘ খারাপ। অসহ্যকর খারাপ। ‘
— ‘ যেমনটাই হই, কিন্তু তোমারই৷ আর এমন উল্টো-পাল্টা চিন্তা মাথায় কিভাবে আসে? রাস্তায় শুধু মেয়ে নয়। তার সাথে টেও ছিল। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে বন্ধু টাইপ। আমার দৃষ্টি পুরো ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। না-কি শুধু একঝাঁক তরুণীদের মধ্যে। ‘
নীলা তারপরও শান্ত হলো না। স্বামীর ভাগের কথা আসলে সব স্ত্রীদের-ই বোধহয় বুঝ শক্তি লোপ পায়। সাদিদ এবার উচ্চশব্দেই হেসে ফেলল। নীলা তা দেখে কটমট দৃষ্টিতে তাকাতেই সে ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলে উঠল,
— ‘ পুরো গোয়েন্দাগিন্নির ক্যারেকটার প্লে করছো বউ। একেবারে একশতে একশ। ‘
— ‘ এবার কিন্তু সত্যিই চুল টুল ছিড়ে ফেলব। ‘
সাদিদ এবার উঠে বসল। প্রাণপাখির রাগ বিপদসীমার বাহিরে চলে যাবার পূর্বে থামিয়ে দেওয়া উত্তম। তাই অভিমানের পাল্লা নামিয়ে নিতে নীলার হাতে রাখা বক্সটা থেকে একটা ফুচকা নিয়ে সেটা নীলার মুখে পুরে দিলো।
আচমকা এমন আক্রমণে নীলা থতমত খেয়ে গেল। তাই এখন নিজেকে সামলাতে গালের ফুচকা চিবুতে লাগল। তার মুখের ফুচকা শেষ হতেই সাদিদ ভ্রুজোড়া নাচিয়ে প্রশ্ন করল,
— ‘ কি? টেস্ট কেমন? ‘
আসলেই স্বাদ বেশ ভালো। কিন্তু নীলা এইমুহূর্তে হার মেনে নিতে রাজি নয়। তাই সেও ব্যঙ্গস্বরে বলল,
— ‘ কি আমার ফুচকা তার আবার টেস্ট! আবার টকও দেননি? ওহ্ হ্যাঁ আপনার-ই বা কি দোষ? তারাতো ফুচকার মতো টকও প্যাকেট করে পাঠিয়েছে৷ আপনি কি এতশত বুঝেন না-কি? ‘
সাদিদ এবার কিছুটা মিইয়ে গেল। সে আসলেই এইসব খাবার সম্পর্কে অবিজ্ঞ নয়। তাই টক ছাড়াই ফুচকাটা নীলার মুখে তুলে দিয়েছে। সাদিদের লকটিয়ে যাওয়া ছোট্ট মুখটা দেখে নীলার এখন পৈশাচিক একটা আনন্দ হলেও তালমিলিয়ে কষ্টও হচ্ছে। মানুষটা কত কষ্ট করে এইরাতে তার জন্য ফুচকা নিয়ে এসেছে, অথচ সে কি-না এমন পা বাড়িয়ে ঝগড়া করছে!
নীলা মুহূর্তেই দমে গেল। বক্স থেকে একটা ফুচকা নিয়ে তাতে টকসহ সবকিছু দিয়ে সুন্দরমতন একটা ফুচকা বানিয়ে সাদিদের মুখের সামনে তুলে ধরল। সে সাথেসাথেই নাকচ করল,
— ‘ আমি এইসব খাই না। ‘
— ‘ আমি খাইয়ে দিলেও না? ‘
সাদিদ হাসল। আর না-বোধক কিছু উচ্চারণ করতে পারল না। চুপচাপ মুখে পুরে নিলো। আর সাথে সাথেই তার কপাল কুঁচকানো দেখে নীলা শব্দ করে হাসল। রাতের নিস্তব্ধতায় সেটা যেন রিনিঝিনি হয়ে সাদিদের কর্ণদ্বার অব্দি পৌঁছাচ্ছে। সে মুখে ফুচকা নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। নীলা সেটা দেখে ধীরে ধীরে ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে নিলো। অতঃপর আরেকটা ফুচকা সাদিদের দিকে তুলে দিলো। সাদিদ এবার হাত বাড়িয়ে সেটা নীলার মুখের দিকে ধরল। নীলাও চুপচাপ হাসিমুখে সেটা মুখে নিয়ে নিলো।
শেষ ফুচকাটা সাদিদ নিজেই নীলার মুখে দিয়ে দিলো। নীলা খেতে খেতে বলল,
— ‘ বাহ্ টেলেন্ট আছে। এক দেখাতেই পুরোপুরি রপ্ত করে ফেললেন? ‘
— ‘ কোনো সন্দেহ? ‘
নীলা গালভরে হাসল। সাদিদের ঠোঁটের কোণেও সরু হাসির রেখা। দিনশেষে হোক না কিছু টক-ঝাল-মিষ্টি ভালোবাসা। সবসময় ভালোবাসা প্রকাশে বিশাল কিছু নয়। চল্লিশ টাকার ফুচকা দিয়েও সেটা লক্ষ টাকার অভাব পূরণ করে। কিন্তু ভালোবাসার অভাব হলে তাতে কোটি টাকার রত্ম থাকলেও সেখানে অভাববোধ বাঞ্ছনীয়।
#চলবে…