অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৩৬

0
4210

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৬

গুলশানের এক কনভেনশন সেন্টারে ঝাঁক ঝমক পূর্ণ পরিবেশে প্রিয়তী আর অর্ণবের রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গলে সবাই উপস্থিত হতে পারেনি। তাই যেন ঢাকার আয়োজনে সবাই সেটা পুষিয়ে নিয়েছে। বেশ জনসমাগম চারপাশে।
সবাই সদ্য বিবাহিত কাপলকে বিয়ের সংবর্ধনা দেওয়াতে ব্যস্ত। প্রিয়তী অর্ণবও সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে অর্ণবের দুষ্টু হাসিটা প্রিয়তীর নজর এড়াচ্ছে না। সকাল থেকেই প্রিয়তীকে তার এই বাঁকাহাসিতে অনবরত লজ্জার সাগরে হাবুডুবু খাইয়ে যাচ্ছে। আর প্রিয়তীও দমবন্ধ করে সাগরের পানিতে ডুবে চলেছে।
সে এবার না পেরে কনুই দিয়ে অর্ণবের পেটে খোঁচা দিলো। কিছুটা রাগীস্বরে বলল,

— ‘ আরেকবার তোমার এই বিটকেল মার্কা হাসি দেখলে দাঁত ফেলে দিব। ‘
— ‘ তাই বুঝি? এত জোর? কিন্তু গতরাতে..
— ‘ একদম চুপ। আর একটা বেশি কথা বললে ঠোঁট সেলাই করে দিব। ‘

বলেই সে এলেমেলোভাবে মুখ লুকিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা চালালো। কিন্তু সফল হয়েও যেন ব্যর্থ। কেননা অর্ণব তার লালরঙা লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া রক্তিম মুখখানা ততক্ষণে দেখে নিয়েছে। তাই আবারও তার ঠোঁটের কোণ বিস্তৃত হলো।

.

ছোট্ট শাদমানের রাগ যেন এতক্ষণে পুরোপুরি দমেছে। ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো নিয়ে সে অনবরত বড়দের মাঝে বিচরণ করে যাচ্ছে। ছেলের হাসি মুখখানা দেখে নিধি-শাহেদ দম্পতির ঠোঁটের কোণেও সরু হাসির রেখা। শাহেদ তো না পেরে বলেই উঠল,

— ‘ বুঝলে নিধি, এখন মনে হচ্ছে যত ব্যস্ততাই হোক না কেন ছেলের জন্য হলেও মাঝেমধ্যে কোথাও বেড়িয়ে আসা দরকার। আমাদের নিজেদের ব্যস্ততার ভিড়ে ছেলেটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। দেখ আজ বেড়িয়ে আসাতে কতটা খুশি। ‘

নিধি ঠোঁট এলিয়ে হাসল। নিঃশব্দেই যেন তার উত্তর শাহেদের প্রশ্নের বিপরীতে হ্যাঁ-বোধক জবাব দিয়ে দিলো। শাদমানকে এদিক-সেদিক টইটই করতে দেখে নীলা পাশ থেকে এগিয়ে আসলো। হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে বলল,

— ‘ এই যে পুঁচকো এদিক-সেদিক কি? ব্যাথা পাবে তো। ‘
— ‘ হোয়াট ডু ইউ মিন বাই পুঁপকো? আ’ম নট পুঁপকো খালামণি। আ’ম শাদমান ইবনে হোসাইন। ডোন্ট কল্ মি পুঁপকো। ‘

নীলা চোখ বড়বড় করে শাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এইটুকুখানি একটা পিচ্চি, কিন্তু কথা দেখ!
সাদিদ নীলার পিছনেই ছিল। তাই দুইজনের সবটুকু কথোপকথন শুনে বেশ উচ্চস্বরেই সে হেসে ফেলল। তার হাসির আওয়াজে নীলার এবার হুঁশ ফিরেছে। সে গাল ফুলিয়ে পিছনে তাকালো। সাদিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মুখশ্রীর হতাশার ভাব যেন আরও কয়েকদাপ বেড়ে গেল। এখন নিশ্চিত সাদিদ তাকে এইটা নিয়েও পঁচাবে। হলোও তাই৷ সাদিদ সামনে হেঁটে এসে শাদকে নিচ থেকে কোলে তুলে নিলো। তারপর শাদের গালদুটো আস্তে করে টেনে দিয়ে বলল,

— ‘ হ্যাঁ সেইটাই তো। কিন্তু এটা কি আর তোমার খালামণি বুঝবে বাবা? সে তো নিজেই পিচ্চি। তাই সবাইকেও তার মতো পিচ্চি-পাচ্চি মনে করে। ‘

শাদমান বিজ্ঞদের মতো সাদিদের কথাতে মাথা উপর নিচ করল। অর্থাৎ কথাটা তার মনে ধরেছে। তার খালামণি আসলেই ছোট মানুষ। নীলা তাদের কান্ড দেখে গাল ফুলিয়ে বলল,

— ‘ একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। আমি মোটেই পিচ্চি নই। যথেষ্ট বড় আমি। পুরোপুরি এডাল্ট। ‘
— ‘ হ্যাঁ সেটা তো অবশ্যই। নতুবা কি আর পিচ্চির সাথে এডাল্টদের কাজকর্ম করা যায়? তুমি হলে এডাল্ট, কিন্তু পিচ্চি এডাল্ট। ‘

বলেই সাদিদ ঠোঁট এলিয়ে বাঁকা হাসল। নীলা দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কেউ এসব শুনলে কি ভাববে? অথচ দেখ এই অসভ্য ছেলে কি সুন্দরভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। নীলা সাদিদকে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে তার মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। আপাতত এই নির্লজ্জ পুরুষের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
সাদিদ নীলার গমনপথের দিকে তাকিয়ে আবারও হেসে ফেললো। এই মেয়েটার রাগ, অভিমান, লাজুকলতার সব রূপই সাদিদকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। কতবার যে একি মানুষের প্রেমে পড়া যায় এটা হয়তো সাদিদ থেকে শেখা উচিত।
শাদমান এখনও সাদিদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ তার হাসির রহস্য তার নিকট বোধগম্য নয়।
সাদিদ সেটা পরখ করে আবারও তার গাল টেনে ধরল। এবার শাদমান ভ্রুজোড়া বাঁকিয়ে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ পাপু গাল ছিঁড়ে যাবে। ‘
— ‘ বাহ্ বাবাটা দেখি খুব বুঝে। ভাবছি তোকে ঐ পিচ্চি মেয়েটার আরেকটার পিচ্চি দিয়ে দিব। ‘
— ‘ পিপ্পি, পিপ্পি এতগুলো পিপ্পি! ‘
— ‘ নারে বাপ। পিপ্পি না এটা হচ্ছে পিচ্চি বউ। কিরে, আমার রাজকন্যাকে সামলে রাখতে পারবি তো? ‘
— ‘ রাজকন্যা? ‘
— ‘ সেটা আমার৷ তোর হবে রাজরাণী। কিরে বাপ পারবি তো? মাইয়া কিন্তু আমার কলিজা। কলিজার টুকরোটারে তোরে দিয়ে দিবার কথা বলতাসি। ভাবতে পারিস কতবড় কথা? ‘

শাদমান আবারও বিজ্ঞদের মতো মাথা উপর নিচ করলো। অর্থাৎ সে বুঝতে পারছে এটা অনেক বড় কথা।
সাদিদ তার ভাবভঙ্গিতে খুশি হয়ে আদরে পিঠ চাপড়ে দিলো। অতঃপর কোলে নিয়েই সামনে এগিয়ে গেল। ছোট্ট শাদ অপরপাশে দাঁড়ানো নীলার দিকে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকালো। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করল,

— ‘ কলিজার টুকরা। ‘

__________________

শান্ত হালকা হলদেটে সাদার মিশ্রণে তৈরি গাউনের ডাবল স্লিভের একটা পার্ট নিয়ে অনবরত নড়িয়ে চড়িয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি তার পাশে দাঁড়ানো মোবাইল গিলে খাওয়া ছেলেটার দিকে। সে যে তার নজরে পড়তে এতশত কাঠখড় পোড়াচ্ছে সেই দিকে এই ছেলের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে একধ্যানে মোবাইলে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে।
শান্ত গতকাল অব্দি খুশিতে আটখানা ছিল। তার পরনের এই ড্রেসটা তানবীর-ই তার জন্য পাঠিয়েছে। তানবীরের থেকে এতবড় সারপ্রাইজ পেয়ে তার যেন রাত আর শেষ হয় না। কখন নিজেকে তার দেওয়া উপহারে তানবীরের সামনে দাঁড় করাবে এই অপেক্ষাতে যেন তার প্রহর কেটেছে। কিন্তু এখন?
যার জন্য এতটা অস্থির ছিল সে পুরোপুরি স্বাভাবিক। এমনকি হিসেবের থেকে একটু বেশি-ই স্বাভাবিক। সে শান্তকে এখন পর্যন্ত চোখ তুলে ভালো করে দেখেছে কি-না এটাতেই চরম সন্দেহ। গতকাল অব্দি যার রোমান্টিকতার কথা চিন্তা করে শান্ত লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছিল, আজ তার এমন বেপরোয়া ভাব দেখে নিমেষেই তানবীরের প্রতি বিরক্ত হয়ে নিজের মনেই আওড়াল,

— ‘ শেষমেশ কি-না এমন একটা নিরামিষ মার্কা ছেলে কপালে জুটল! ‘

বিড়বিড়িয়ে লাভ হয়নি৷ কেননা তানবীর নিজের কানের তীক্ষ্ণতার বলে খুব সহজেই সেটা শুনে নিয়েছে। সে মুখটা অপরপাশ ঘুরিয়ে শান্তর চক্ষুর আড়ালে চেপে রাখা হাসিটুকু বের করে দিলো।
অতঃপর সবসময়কার ন্যায় বিরস কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ভদ্র পোলা। তাই সঠিক সময় ব্যতিত নিজেকে প্রমাণ করতে পারুম না৷ একবার বিয়েটা হোক তারপর হাড়েহাড়ে বুঝাব আমিষ নাকি নিরামিষ। ‘
— ‘ আর বিয়েটা কবে হবে? ‘

শান্ত কথার পিছে কথাটা বলে নিজেই জিহ্বায় কামড় দিলো। মাত্রই কি বলে ফেলল ভাবতেই লজ্জায় তার শরীর হীম হয়ে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু যার সাথে চোখ মেলাতে সে এতটা লজ্জা চেপে ধরেছে সে ভাবলেশহীন। একেবারে অনুভূতিহীন হয়ে শান্তর মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। আচমকা তানবীরের এমন মুখশ্রী নজরে আসতেই লজ্জার সাথে এবার অনুতপ্ততাবোধও শান্তকে চেপে ধরেছে। একটু আগে কি বলেছে ভাবতেই তার নিজের কাছেই বড্ড খারাপ লাগছে। না জানি তানবীর এখন কেমন অনুভব করছে?
তানবীর মাথা নিচু করে শান্তর হাতটা চেপে ধরল। কি মনে করে আবার হুট করেই সেটা ছেড়ে এককদম পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর খুব নরম কন্ঠে বলল,

— ‘ একটু সাইডে আসবে? কিছু কথা ছিলো। ‘

শান্ত তানবীরের মলিন মুখটাতে নজর বুলালো। মনে হচ্ছে কথাটা সে জোরপূর্বক গলা দিয়ে বের করছে। বরাবরের মতো তার কন্ঠে বাউন্ডলে ভাবটা নেই। আর না আছে দুষ্টুমির কোনো বহিঃপ্রকাশ।
শান্ত সবসময় চাইত তানবীরের এই বেপরোয়া ভাবটার যেন উন্নতি ঘটে। শান্তর তার এমন আচরণে সমস্যা না হলেও তার মা-বাবা নিশ্চয়ই এমন বাউন্ডলে ছেলের হাতে নিজের মেয়ের হাত তুলে দিতে চাইবে না।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটু কষ্ট হলেও মা-বাবাকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তানবীরকে আর দশটা ছেলের ন্যায় গম্ভীর হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাকে এমন খাপছাড়া চরিত্রেই বেশি মানায়। বেশি গুছিয়ে নিতে গেলে একেবারে ভালো হবে না। যাকে বলে অতি ভালোই মন্দ হয়।
শান্তর এমন নীরবতায় যেন তানবীর ভীষণ আহত হলো। তার মাথায় আপাতত পজিটিভ কিছু আসছে না৷ সব যেন নেগেটিভের ছড়াছড়ি। শান্ত যে তার এমন শান্তশিষ্ট রূপে নিশ্চুপ এটা তার বিন্দুমাত্র মনের গহীনে আসছে না। আসছে শুধু ভয়াবহ কিছু তিক্ততার রেশ জনিত ঘটনা।
সে আবারও মলিন মুখে একি প্রশ্ন করল,

— ‘ কিছু বলছো না যে? আসবে একটু? ‘
— ‘ জ্বি। ‘

তানবীর যেন মলিন মুখেই কিঞ্চিৎ হেসে উঠল। তা দেখে শান্তর খুশি হবার কথা হলেও সে আবারও হতে পারল না৷ কেননা এই হাসি যে তানবীরের আসল হাসি নয়৷
তার হাসিতে প্রাণ থাকে। দুষ্টুমির আড্ডাখানা থাকে। সেখানে এই হাসি নির্জীব, প্রাণহীন। তাহলে কিভাবে খুশি হবে সে?
তানবীর তাকে নিয়ে কোলাহল থেকে বেশ অনেকটা দূরে এসে দাঁড়াল। একেবারে নীরব পরিবেশ বলা চলে।
তানবীর বারবার এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছে। সে যে কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত এটা শান্তর আর বুঝার বাকি নেই। তাই শান্ত নিজেই গলা কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল,

— ‘ কি বলতে চেয়েছিলেন? ‘
— ‘ না মানে..
— ‘ আপনি কি জানেন? আপনাকে এই ইতস্ততবোধে একেবারেই মানায় না? ‘

তানবীর যেন টেনশনের মধ্যেও নিঃশব্দে হেসে ফেলল। তারপর দিনদুনিয়া সবকিছু ভুলে হেঁচকা টানে শান্তকে নিজের বক্ষপিঞ্জরের উপর এনে ফেলল। একটা হাত তার চুলের মধ্যে দিয়ে গলিয়ে মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল।
শান্ত পুরোপুরি হতবাক। এই ছেলের হঠাৎ হঠাৎ কি হয় সেটা মনে হয় সে নিজেও জানে না। কয়েক সেকেন্ড গড়াতেই সে নিজের হুঁশে ফিরল। এবং তানবীরের কাজে বড্ড লজ্জা পেল। শরীরে ক্রমশ শিহরণ বয়ে চলেছে। অবশেষে দীর্ঘ নীরবতার চাদর সরিয়ে তানবীর শান্তকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েই চাপা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ এতদিন এই কথাটা মনে পড়লে রাগ লাগলেও আজ যেন নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। কখনও ভাবিনি এই ঘটনার জন্য এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু আজ আমার বড্ড ভয় হচ্ছে শান্ত। খুব বেশি। ‘

শান্ত অবাক হলো। বরং একটু বেশি-ই। এই ছেলেটার থেকে এইসব ভিতুমার্কা কথা একেবারেই আশা করা যায় না। সে প্রতিউত্তরে কিছু বলবে তার আগেই তানবীর আবারও বলল,

— ‘ আমার ভয়কে প্লিজ জয় হতে দিও না। আমার যে তোমাকে প্রয়োজন। একটু বেশি-ই প্রয়োজন। ‘
— ‘ আচ্ছা কি হয়েছে সেটা তো বলবেন? এভাবে বললে বুঝব কিভাবে? ‘

তানবীর এবার নিজের বাহুবন্ধন হালকা করে দিলো। শান্তর থেকে একটু পিছিয়ে কন্ঠে যথেষ্ট আড়ষ্টতা নিয়ে বলল,

— ‘ সবার লাইফেই একটা অতীতের পৃষ্ঠা থাকে। কারও হয়তো সেটা ফুলে সজ্জিত বাগান৷ আবার কারও হয়তো সেটা ধ্বংসাত্বক মরুভূমি। আমার জীবনেও একটা অতীতের ধ্বংসাত্বক পৃষ্ঠা রয়েছে। সেটা নিয়ে আমার কোনো হতাশা নেই। আর নেই কোনো পিছুটান। কিন্তু আজকে আমার ভয় হচ্ছে। অমূল্য কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়৷ যেই অতীতের রেশ আমি এখনও অব্দি টেনে যাচ্ছি তার-ই রেশ আমার বর্তমানে এসেও নাড়া দিচ্ছে। আমার থেকে আবারও খুশি কেড়ে নিতে চাইছে। ‘

কথাটুকু বলে তানবীর চোখজোড়া দ্রুত নিচে নামিয়ে নিলো৷ শান্তকে নিজের অশ্রুসিক্ত আঁখিদ্বয় সে দেখাতে ইচ্ছুক নয়। শান্ত কয়েককদম এগিয়ে গেল। নিজেদের মধ্যে যতটুকু দুরত্ব তৈরি হয়েছিল সেটা মিটিয়ে লজ্জা ভুলে তানবীরের গালে নিজের কোমল হাতটা স্থাপন করলো। তানবীর সাথে সাথে চোখ তুলে তার চোখে চোখ রাখল। শান্ত কিঞ্চিৎ হেসে ভরসায় পরিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ইশশ এতো বিশ্লেষণ! এটাও আমাকে দেখতে হবে? ‘

তানবীরের ঠোঁটের কোণ সরু হলো। তাই দেখে শান্ত আবারও বলল,

— ‘ এমন করছেন কেন? বলেন না কি বলবেন? এতো আড়ষ্টতাবোধ আপনাকে মানাচ্ছে না। ‘
— ‘ যদি বলি আমি বিবাহিত। কারও জীবনের সাথে এককালে আমার জীবন জড়িত ছিলো৷ তারপরও কি এমনভাবে বলতে পারবে? এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারবে? ‘

তানবীরের গালে থাকা শান্তর হাতটা আচমকা নড়েচড়ে উঠতেই তানবীর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। সে জানত সত্যিটা স্বীকার করা এতোটা সোজা নয়। মুখে বলা যতটা সহজ কাজে বলা ততটা নয়।
কিন্তু তানবীর তো আর প্রেয়সীর বর্তমান মনোভাব বুঝতে পারছে না। সব নেগেটিভের কারখানা এসে তার মস্তিষ্কে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে বসেছে। নতুবা প্রেয়সীর চোখের ভাষা সে অবশ্যই পড়তে পারত।

— ‘ বলেছিলাম পারবে না। আর দেখলে তো এমনটাই হয়েছে। ‘

কথাটুকু বলে তানবীর পিছিয়ে আসতে চাইলেই শান্ত তার হাত টেনে ধরল। সে এই অবুঝ ছেলেটাকে কিভাবে বুঝাবে সে তার বর্তমান আর ভবিষ্যতের সবটা জুড়ে থাকতে চায়। অতীতের নামেমাত্র জায়গার জন্য নিজেকে কখনও সে এই ছেলেটার জীবন থেকে দূরে সরাতে পারবে না। কি করে বুঝাবে তাকে?
তানবীর যেন অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেল। যখনই শান্ত তার সবকথার পিঠে মোহনীয় স্বরে বলল,

— ‘ আচ্ছা বাদ দেন৷ আমি এই নিয়ে কিছু শুনতে চাই না৷ চলুন ঐদিকটাতে গিয়ে বসি। অনেক বাতাশ আসছে। ‘

সে আর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। তানবীরকে পিছনে ফেলেই সামনে হাঁটা দিলো। তানবীর এতো ভয়ানক সত্যের পিঠে এত স্বাভাবিক একটা কথা যেন কিছুতেই মানতে পারল না৷ মনে হচ্ছে এই কথাটা শান্তকে বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারেনি। মুহূর্ত কয়েক ব্যয় হতেই তানবীর দ্রুত পা চালিয়ে সামনে গেল। পিছন থেকে শান্তর হাতে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ঘুরালো। ক্রমশ চমকিত কন্ঠেই বলল,

— ‘ কি বলছো তুমি? আমার কথা ভালো করে শুনতে পেয়েছ তো? আমি কি বললাম এর অর্থ বুঝতে পারছো তুমি? এসব জানার পরও এতটা স্বাভাবিক কিভাবে? ‘

শান্ত চুপ করে থাকল। সে তানবীরকে বলতে চায় না যে তার অতীত সম্পর্কে ইতিমধ্যে সে অবগত। বললে হয়তো এক বন্ধুর প্রতি আরেক বন্ধুর বিশ্বাস নষ্ট হবে। সেটা শান্ত কিছুতে করতে পারবে না।
হয়তো বা কোনো এক বিকেলের অতীতের মধুর স্মৃতি স্মরণ করার সময় অকপটে বলে চমকে দিবে। তখন রাগ করার পরিবর্তে প্রাণের বন্ধুকে হাসতে হাসতে সে গালমন্দ করবে৷ কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে সত্যটা বললে হয়তো ভুল বুঝার সম্ভাবনা রয়ে যাবে। এতটা ধাক্কা শান্ত একেবারে তানবীরকে দিতে ইচ্ছুক নয়। তাই পূর্বেকার ন্যায় অতি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,

— ‘ সব শুনতে পেয়েছি। এবং এর অর্থও পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম। কিন্তু আপনার মনের সান্ত্বনার জন্য বলতে হচ্ছে যে, আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনোরূপ প্রশ্ন নেই। আমি শুধু আপনার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সবটা জুড়ে থাকতে ইচ্ছুক। বুঝতে পেরেছেন আপনি? আমি বললাম সবটা। মানে একবিন্দুও যেন নড়চড় না দেখি। ‘

তানবীর হাসল। প্রাণভরে মিষ্টি হাসল। এতটা সুখ যে তার ভাগ্য লেখা ছিল সেটা হয়তো সে কখনও কল্পনায় ভেবেও দেখেনি। কতকাল সে নিজের পোড়াভাগ্য নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করেছে। কতটা হতাশ হয়েছে। তাই যেন পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তা সবকষ্টের প্রতিধান হিসেবে তানবীরের ঝুলিতে এতটা সুখ কুড়িয়ে দিচ্ছে।
তাই বলাবাহুল্য ভাগ্যের উপরে কখনও হতাশ হতে নেই। কে জানে সামনে আপনার জন্য কি অমূল্য অপেক্ষা করছে? হয়তো আপনার ভাবনার থেকেও অধিক ভালো কিছু আপনার জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
তানবীর গভীর মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে শান্তর মুখপানে চোখ বুলালো। অতি সাধারণ মেয়ের আড়ালে কি অসাধারণ এক সত্তা। এইজন্যই বলে একজনকে দিয়ে বাদবাকি সবাইকে বিচার করা উচিত নয়। একজন মেয়ের জন্য যেমন পুরো মেয়েজাতীকে দোষারূপ করা অনুচিত, তেমনিভাবে একজন ছেলের কৃতকর্মের জন্য বাদবাকি ছেলেদের দোষারূপ করাও বেঠিক। তানবীর আজ মনে প্রাণে সেটা স্বীকার করতে চায়ছে। কেননা একটা মেয়ের জন্য সে এখন অব্দি পুরো নারী জাতিটাকেই ঘৃণার চোখে দেখে এসেছে।
সে আলতো করে শান্তর গালে হাত রাখল। গভীর আবেশে প্রেয়সীর কপালে ভালোবাসার চুম্বন আঁকলো। শান্তর চোখজোড়া যেন নিজ থেকেই বন্ধ হলো। দীর্ঘ চুম্বনের পর তানবীর তাকে ছেড়ে দিয়ে শান্তর ডানহাতটা মুঠো করে ধরল। নিঃশব্দে তাকে নিয়ে সামনে হাঁটা দিলো। শান্ত বিনাবাক্য তার পথ অনুসরণ করে গেল।
তানবীর তাকে নিয়ে এসে ছাদের রেলিং ঘেঁষে মেঝেতে বসে পরল। এবং শান্তর হাতে টান দিয়ে তাকেও নিজের সাথে বসিয়ে দিলো। শান্ত শুধু চুপচাপ তানবীরের করা কর্মকান্ডগুলো অবলোকন করে যাচ্ছে।
তানবীর শান্তর হাতের মুঠিটা এখনও ছাড়েনি। বরং আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে গলার স্বর খানিকটা নিচে নামিয়ে বলতে শুরু করল,

— ‘ আমি যখন মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম তখন-ই আমার বিয়েটা হয়েছিল। আমার…
— ‘ প্লিজ, প্লিজ আমি কিছু শুনতে চাই না। দরকার নেই পুরোনো স্মৃতি মনে করার। ‘
— ‘ কিন্তু আমি যে বলতে ইচ্ছুক। বরং কথাগুলো আরও আগেই তোমাকে বলে দেওয়া আমার উচিত ছিল। কিন্তু জানো তো বিগত দিনগুলোতে এতটা খুশি ছিলাম যে অতীতের তিক্ততাগুলো একেবারেই ভুলে বসেছিলাম৷ আজকে তুমি হঠাৎ বিয়ের কথাটা বলতেই টনক নড়ল। ‘
— ‘ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি অজান্তেই আপনার কাটা গায়ে আঘাত করে বসলাম। ‘
— ‘ পাগলি মেয়ে। তুমি ক্ষমা চাচ্ছ কেন? তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি আমার নিকট ফুলে সজ্জিত পবিত্র বাগান। তাতে বিন্দুমাত্র দাগ আমি দেখতে পাই না। তাই আমি আমার এই ফুলের বাগানের কাছে কোনো কিছু গোপন রাখতে ইচ্ছুক নয়। তোমার সবটা জানার অধিকার রয়েছে। ‘

শান্ত আর না বোধক কিছু বলতে পারল না। চুপচাপ তানবীরের কথার সম্মোহন স্বরূপ মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
শান্তর সমর্থন পেয়ে তানবীর এবার নিঃশব্দে মৃদু হাসল। অতঃপর আবারও বলতে লাগল,

— ‘ তুমি হয়তো জানো না। আমার মা নেই। ‘

শান্ত এবার চমকিত দৃষ্টিতে তাকাতেই তানবীর ভীষণ রকমের তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

— ‘ পৃথিবীতে অস্তিত্ব রয়েছে কি-না এটা জানতে চাইলে বলতে হবে আছে। কিন্তু আমার মনের কথা জানতে চাইলে বলব আমার মা নেই। আমার মা-বাবা সব হচ্ছে তৌহিদুর হাসান৷ তিনি-ই আমার সব। ‘

শান্ত যেন অবাকের উপরে অবাক হচ্ছে। অর্ণব শুধু তাদেরকে তানবীরের বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়টা সংক্ষিপ্ত আকারে বলেছিল। কিন্তু তানবীর এখন নতুন করে এসব কি বলছে?
শান্তর চমকিত দৃষ্টিটা তানবীরের নজর এড়ালো না। বিষয়টাই অবাক হওয়ার মতন। কিন্তু তারপরও সে নিজের মতো করে বলতেই থাকল,

— ‘ মা-বাবা আর তাদের একমাত্র সন্তান হিসেবে বেশ হাসিখুশি আনন্দের সাথেই আমার দিন কাটছিল। উচ্চবিত্ত হওয়ার কারণে ছোট থেকেই কোনোকিছুর অভাবে পরতে হয়নি। বলতে পারো চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়েছি। কিন্তু আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে যখন আমি ক্লাস সেভেনে অধ্যায়ন করি তখনই বাবা ব্যবসায় ভীষণ বড় রকমের লস খায়। এতবড় কোম্পানিটা নিমেষেই গড়িয়ে যেতে সময় লাগল না। ব্যাংকে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স থাকাতে সাংসারিক কোনো সমস্যা তখনও দেখা দেয়নি। কিন্তু ঢাকার মতো এমন একটা জায়গায় এতো বিলাসবহুল পরিবেশে চলতে হলে বেশ অর্থের প্রয়োজন। মা বাবার মতো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলো৷ কিন্তু বাবার তেমন একটা ইচ্ছে ছিল না বিধায় মা কখনও বাহিরে চাকরি করেনি। বাবার কোম্পানিও তখন দেউলিয়া প্রায়। তাই বাবাকে রাজি করিয়ে মা চাকরি করার পারমিশন নেয়। বাবার অবস্থা তখন এমন একটা পর্যায়ে ছিল যে না করার সামর্থ্য ছিল না। যার দরুন মাকে আর মানা করতে পারেনি। বেশ কয়েকটা মাস ভালোই চলছিল। মায়ের উপার্জিত আয়ে সাংসারিক অবস্থা তখন আরও ভালো। সেই জন্য বাবা হয়তো একটু স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারছিলেন। মন ভালো থাকলে কাজের গতিও ভালো থাকে। তাই পুনরায় দ্বিগুণ উদ্যোগে বাবা ব্যবসার হাল ধরতে লেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু সব ভালো হয়েও যেন ভালো হলো না। মায়ের অবাধ চলাফেরার বিষয়টা বাবার প্রথমে নজরে না আসলেও আস্তেধীরে নজরে এসে গেল। কেননা এমনও দিন যেত মায়ের কোনো দেখা আমি পেতাম না৷ সারাদিন বাবার সঙ্গও পাওয়া যেত না। তাই অধির আগ্রহে মায়ের পথ চেয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু দশটা বাজে, এগারো বাজে মায়ের আসার নাম নেই। যেই জায়গায় মায়ের অফিস টাইম পাঁচটায় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। পুরোটা সপ্তাহ আমি মায়ের দেখা পেতাম না। কেননা মা এতো রাতে বাড়ি ফিরত যে আমার মতো ছোট্ট ছেলের পক্ষে জেগে থাকা সম্ভব হতো না। আবার মা লেইট করে ঘুমাতে যেতেন বলে সকালে আমি দেখা করার সুযোগ পেতাম না৷ কেননা মায়ের কড়া বারণ ছিল তার ঘুমে যেন কেউ বেগাত না ঘটায়। তাই আমিসহ কারও সাহস কুলাতো না মায়ের ঘুমে ডিস্টার্ব করার। তাই আবারও মায়ের আদর ব্যতিত স্কুলে যেতে হতো।
সাদি-অর্ণব আমার ছোট্ট বেলার ফ্রেন্ড। তাই স্কুলের সময়টুকু তাদের সাথে বেশ ভালোই কাটতো। কিন্তু দিনশেষে বাড়িতে ফিরে আসতাম এক আকাশ কষ্ট নিয়ে। কেননা বাড়িতে চাকর বাকরের কমতি না থাকলেও ভালোবেসে আগলে রাখার মানুষের বড্ড অভাব বোধ করতাম। মা-বাবার অভাব কি অন্য কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব? সারাদিন ছোট্ট একটা ছেলে চাকর বাকরের হাত ধরে সব করতো৷ বাবা হয়তো আমার মনোভাব বুঝতে পারতেন। কিন্তু হাতে কিছু করার থাকতো না। শুধু বাসায় ফিরে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার হাত টুকু ধরে চুপ করে বসে থাকতেন। একটা সময় শত কাজ থাকার পরও কেবলমাত্র আমার জন্য বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা শুরু করে। সেই যেন আমার একলা জীবনে আবারও আনন্দের দেখা মিলতে শুরু করলো। আমরা বাপ-ছেলে সন্ধ্যার পর থেকে ঘুমানোর আগপর্যন্ত অনেক খেলা খেলতাম। টিভিতে বিভিন্ন হাসির কাটুন আর ছবি দেখতাম। বলতে পারো সময়টাকে পুরোপুরি হাসি আনন্দের মধ্যে দিয়ে ব্যয় করতাম। মায়ের অভাবটা পূরণ না হলেও বাবা যেন তার আদরে কমতিটুকু মুছিয়ে দিতে স্বার্থক ছিল।
কিন্তু এবারও যেন আমার আনন্দে কালোগ্রহণ লেগে গেল। বাবার সাথে মায়ের প্রায় ছোট ছোট জিনিস নিয়ে ঝগড়া বাড়তে লাগল। বাবার দিনশেষে আমার জন্য যেই হাসিটুকু বরাদ্দ রাখত সেটা যেন ক্রমশ-ই ঝগড়াঝাটির নিচে চাপা পড়ল। আমার ছোট মস্তিষ্ক এতসব ঝামেলা বুঝতে পারত না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারতাম আমাদের হাসিখুশি পরিবার আর আগের মতো নেই৷ পরিবর্তনের ছোঁয়া তাতে ইতিমধ্যে বেশ জোরালো ভাবেই লেগেছে। ‘

তানবীর জোরে একটা শ্বাস টানল। অনেকটা তিক্ত কথা সে আবারও মুখ ফুটে বলেছে। শান্ত অস্থির দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কিন্তু পানি বা সফটডিক্স জাতীয় কিছু পাচ্ছে না৷ তাই সে উঠতে নিলেই তানবীর পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো।

— ‘ কোথায় যাও? ‘
— ‘ মানে.. আপনার জন্য পানি নিয়ে আসি। ‘
— ‘ না লাগবে না৷ তুমি বসো। ‘
— ‘ বেশি সময় লাগবে না। যাব আর..
— ‘ বললাম না লাগবে না। শুধু তুমি থাক তাহলেই হবে। ‘

শান্ত আর দ্বিমত পোষণ করতে পারল না। চুপচাপ আবারও তানবীরের পাশ ঘেঁষে বসল। কিন্তু তানবীরের নিকট অনুরোধের সহিত আবদার করল,

— ‘ আচ্ছা যাব না। কিন্তু আমি আর কিছু শুনতে চাই না৷ আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই৷ ‘
— ‘ কিন্তু আমার যে আছে। আমার মতে তোমার এই কথাগুলো জানা উচিত। এমনকি আরও অনেক আগে। শুধু আমার কারণে তুমি এসব সম্পর্কে এখনও অবগত নও। আমি আর নিজের ভুলের মাত্রা বাড়াতে চাই না। সত্য জানার পর তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই আসল বিষয়। ‘
— ‘ শুনুন, এতক্ষণ বহুত বলেছেন। কিন্তু এই নিয়ে একটা কথাও শুনতে ইচ্ছুক নই। আপনার অতীত যতোই তিক্ততাময় হোন না কেন, এই শান্তা ইসলামের সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না ইনশাআল্লাহ। বিশ্বাস না হলে বাজি ধরতে পারেন। নিঃসন্দেহে আপনি হেরে যাবেন। ‘

তানবীর খানিকটা ঠোঁট বাঁকালো। যেন জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখল। কেননা মন হাজারবার মানতে চাইলেও যে পরিস্থিতি মানতে দেয় না৷ শান্ত এখন অকপটে যেসব কথাবার্তা বলে ফেলছে হয়তো সবটা জানার পর এতটা নিঃসংকোচে বলতে পারবে না৷ এটাই তো হওয়া উচিত। তাই তানবীর ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে আবারও নিজের অতীতের পৃষ্ঠা উল্টালো,

— ‘ অতঃপর একদিন কানাঘুষাতে শুনলাম মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে নাকি উকিলের কাছে তারা গিয়েছেন। সেই বয়সে ডিভোর্সের কারণে পারিবারিক পার্শ্বঃপ্রতিক্রিয়া না জানলেও এর অর্থ বুঝতাম৷ তাই মা-বাবার আলাদা হয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না৷ খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবকিছু বাদ দিয়ে মা-বাবার কাছে আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসলাম৷ বাবাকে যখন মাকে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য না করতাম বাবা তখন কেবল নিঃশব্দে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকতেন। কিন্তু মায়ের সম্পর্কে কিছু বলতেন না৷ আর না বলতেন তাদের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ডিভোর্স নিয়ে কিছু৷ আমিও হাল ছাড়িনি। বাবা না হোক মাকে অবশ্যই মানিয়ে নিতে পারব। তাই রাত জেগে মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ মা বাসায় ফিরার পর থেকেই তার কাছে গিয়ে ছোট্ট মনের অনুরোধ জানাতে থাকলাম।
কিন্তু বাবার মতো মায়ের মুখে কোনো অসহায়ত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হতো না৷ সেখানে কেবল একরাশ বিরক্তির ছোঁয়া দেখতে পেতাম। কিন্তু তারপরও আমি পিছু ছাড়িনি৷ একদিন না হয় একদিনতো মেনে যাবে-ই৷ নিজের সন্তানের এমন আকুল অনুরোধ রক্ষা করবে না এমন মা কোথায় আছে?
কিন্তু আমার মা আমাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করলো৷ আমার ছোট্ট মনটাকে ভেঙে দিয়ে আমার গায়ে হাত তুলে বসল। বাবা তখন বসার ঘরেই ছিলেন। আর আমার কান্নার আওয়াজে দৌড়ে এসেছিলেন। আমার অবস্থা আর মায়ের রাগী মুখশ্রী দেখে বাবার উপস্থিত পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই এতদিনের নিজের জমানো সবটুকু রাগ উজার করে দিয়ে আমার সামনেই মায়ের গায়ে হাত তুলেছিলেন। সেদিনের বাবা-মায়ের কথাগুলো আমি এখনও ভুলতে পারি না,

— ‘ চরিতহীন মহিলা, খবরদার যদি তুই আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার সাহস দেখিয়েছিস তো। এতদিন তোকে শুধু মুখে বুঝিয়েছি। কিন্তু আমার ছেলের গায়ে সামান্য একটা আঁচড় লাগলে আমি তোর ছাল শুদ্ধ তোলে নিব। মনে রাখিস তোর সাথে যতটুকু ভদ্রতা বজায় রেখেছি সবটুকু আমার ছেলের কারণে। কেননা হাজার হলেও তুই তার গর্ভধারী মা। তাই এতটুকু সম্মান তোকে দিতে আমি বাধ্য। কিন্তু নিজের সীমানাতে থাক। নতুবা আমি সম্পর্কের লেনদেন ভুলে যাব। ‘
— ‘ এত যে ছেলে ছেলে করছো তোমার পুরুষত্ব আমার জানা আছে। ডক্টর সাফ সাফ বলে দিয়েছে আমার আর বাচ্চা না হওয়াতে সম্পূর্ণ দোষ তোমার। তারপরও এত গলার জোর কোথায় থেকে পাও? তার উপর আবার আমার গায়ে হাত তুলেছ। জামাল জানতে পারলে তুমিসহ তোমার চৌদ্দ গুষ্টিকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে। ‘
— ‘ তাহলে বল গিয়ে তোর প্রেমিকপুরুষকে। আমিও দেখি সে কেমন বীরপুরুষ। যার কি-না এমন একটা নিষ্পাপ ছেলের কাছ থেকে তার মাকে কেঁড়ে নিতে বুক কাপেঁনি। আমার কথাতো না হয় বাদ-ই দিলাম। ‘
— ‘ অবশ্যই সে বীরপুরুষ। তোমার মতো নয়। তার এনার্জি তোমার থেকে হাজারগুণ…

তানবীর হাতের উল্টোপিঠে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখযুগল মুছে নিলো। তখন হয়তো সবগুলো কথার অর্থ পুরোপুরি না বুঝতে পারলেও এখন সবকিছুই পরিস্কার।
সেই জন্য হয়তো কষ্টের মাত্রাটা আরও বেশি। মা হয়ে সন্তানের সামনে কিভাবে এসব কথা অকপটে বলে ফেলে? ভীষণ আশ্চর্য লাগে!

— ‘ জানো, সেদিন বাবা আমাকে জোর করে মায়ের রুম থেকে নিয়ে এসেছিল। মায়ের পিছন থেকে আরও কথা শুনা যাচ্ছিল। সেগুলোর সবকিছুই আমার বয়সের জন্য ঠিক ছিল না৷ তাই বাবা বাধ্য হয়ে মায়ের কথার মাঝপথে আমাকে নিয়ে চলে আসে। তারপর আমার রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা লক করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,

— ‘ লক্ষ্মী ছেলে আমার, ঘুমিয়ে পর। সকালে আবার স্কুল আছে। ‘
— ‘ বাবা, মা ঐসব কি বলছিল? ‘
— ‘ আর একটাও কথা নয়৷ চুপচাপ বিছানায় আস। আমি আজ তোকে ঘুম পারিয়ে দিব। ‘

তানবীরের চোখজোড়া আবারও ম্লান হয়ে আসলো। আজ তার এতো কান্না পাচ্ছে কেন? সাথে সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষ উপস্থিত বলে? হবে হয়তো। তানবীরের কাছে তো এমনটাই মনে হচ্ছে।

— ‘ তারপর থেকে বাবা-ই আমার সবকিছু হয়ে উঠেছিল। মায়ের কাছে যেতে চাইতাম৷ কিন্তু মা যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠত। তাই বাবা আমাকে সবসময় চোখে রাখার চেষ্টা করতেন৷ নিজের কাজের বাহিরে সবটুকু সময় আমার জন্য বরাদ্দ ছিল। এইভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।
আর একদিন অবশেষে আইনিভাবে মা-বাবার বিচ্ছেদও ঘটে গেল। আমি কেবল নীরব দর্শক ছিলাম। বাবারও মুখেও ছিল অসহায়ত্বের ছাপ। কিন্তু মা দিব্বি ছিল। আর সেদিনই প্রথমবারের মতো আমি শেখ জামাল চৌধুরীকে দেখতে পেয়েছিলাম৷ মা খুশিতে গিয়ে তাকে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরেছিল। তার যে একটা সন্তান এসব নিজের চোখে দেখছে এদিকে তার বিন্দুমাত্র নজর নেই। সে ব্যস্ত নিজের পরকীয়ার সম্পর্কে। বাবা কোনোদিন তাদের ডিভোর্স নিয়ে আমাকে কিছু বলেনি৷ কিন্তু লোকজনের কানাঘুঁষাতে জানতে পারি মায়ের অফিসের বস ছিলেন এই জামাল চৌধুরী। আর তার সাথেই মা নিজের ছেলে-স্বামীকে ভুলে গিয়ে পরকীয়াতে লিপ্ত হয়েছিল। যার শেষ পরিণতি হাসি-খুশিতে ভরা একটা পরিবারের অকাল মৃত্যু।
মায়ের এই বিশ্বাসঘাতকার পর বাবা হঠাৎ-ই যেন অসুস্থ হতে শুরু করে। একসময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরে। তারপরও আমাকে সামলাতে ভুলেনি৷ নিজে খাওয়ার আগে আমাকে পাশে রাখত। মা-বাবার সবটা দায়িত্ব যেন বাবা একাই পালন করতে উঠেপড়ে লেগেছিল।
কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল আমার বেপরোয়া ভাব ততটাই বেড়ে যাচ্ছিল। সেটা বাবার অনাদরে নয়। বরং বাবার এই করুন অবস্থাতে৷ না চাইতেও মায়ের করা কৃতকর্মের প্রতি আমার ঘৃণা জাগতে শুরু করে। তারপর এই কর্ম করা ব্যক্তির উপর। একসময় জন্মদাত্রী মা-ই আমি নিকট পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হলো৷
বাবা আমাকে বুঝাতেন। মায়ের ভালো কাজগুলো সবসময় আমার চোখের সামনে তোলে ধরতেন। আমাকে মায়ের পজিটিভ দিকগুলো দেখিয়ে শান্ত রাখতে চাইতেন।
কিন্তু যত বড় হচ্ছিলাম আমি যেন আরও উগ্র হতে শুরু করি৷ একসময় সেটা বাবাসহ সব বন্ধু বান্ধবের নজরে পর্যন্ত চলে আসে। এক নারীর উপর ঘৃণা পোষণ করে আমি পুরো নারূজাতটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করি৷ এর থেকে আমার লেডি টিচার্সগুলোও বাদ পরেনি। ‘

শান্ত চোখ বড় বড় করে তানবীরের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। কি ভয়ানক কথাবার্তা। তানবীর তার অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলল,

— ‘ হ্যাঁ এমনটাই৷ আর সবকিছু বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু টিচার্সদের সাথে এমন উগ্র ব্যবহারে বাসায় রীতিমতো বিচার আসতে শুরু করে। বাবার তখন মাথায় হাত। মা হয়ে পেটের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একি খেলা খেলল তিনি, এটাই বাবা বুঝতে পারত না৷
কিন্তু সবার চিন্তার অবসান ঘটল। এক নারী জীবন ধ্বংস করল, আবার আরেক নারী এসেই যেন আমার জীবনটা শুধরিয়ে দিতে শুরু করল। জানতে চাইবে না সেই মহান নারীটির নাম কি? আমিই বলছি তোমাকে।
প্রিয়তী, প্রিয়তী জাহান। আমার জীবনের দ্বিতীয় প্রধান নারী ভুমিকা।

#চলবে..

[ প্রিয়পাঠক, আজকের সম্পূর্ণ অংশটা পড়লেই হয়তো বুঝতে পারবেন কেন আমার সময় লেগেছে। তারপরও যদি কোনোরূপ অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে সেগুলো নিরদ্বিধায় বলতে পারেন। আমার কোনোরকম মন্তব্য থাকবে না। 🐦💙]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here