গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৭ 💕❤💕
রাত ততটা হয়নি। কিন্তু শীতের প্রকটে যেন প্রকৃতিতে হীম শীতলভাব। গায়ে কাটা দেওয়ার অবস্থা। কিন্তু আজকে শান্তর যেন প্রকৃতির এই ভিন্ন আবহাওয়ার তাপে শরীর হীম হচ্ছে না। বরং তানবীরের মুখ নিঃসৃত একেকটা বাক্য যেন তাকে পুরোপুরি ঠান্ডা বরফে পরিণত করছে। এই চঞ্চল – বেপরোয়া ভাব নিয়ে চলা ছেলেটা যে নিজের মন গহীনে এত কষ্ট চেপে রেখেছে সেটা হয়তো তানবীর আজ নিজের মুখে না বললে শান্ত কখন-ই বিশ্বাস করতো না। সত্যিই মানুষকে কখনও উপর দিক দেখেই চরিত্র এঁকে ফেলা বোকামি। কার ভিতরে কি সুপ্ত অবস্থায় লোকায়িত আছে সেটা কেবল তারা-ই ভালো জানে। শান্ত তার কাঁপা হাতটা তানবীরের কাঁধে রাখল। তানবীর মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই সে আকুতিভরা কন্ঠে বলল,
— ‘ অনেক বলেছেন৷ অনেকটুকু জেনেছি। আর জানতে চাই না৷ প্লিজ এসব মনে করে নিজেকে আর কষ্ট দিবেন না। ‘
— ‘ বলা যে প্রয়োজন। নতুবা তোমাকে ধোয়াশায় রেখে নিজে শান্তি পাব না৷ ‘
— ‘ আমার কোনোকিছু নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ‘
— ‘ কিন্তু আমার যে আছে। ‘
তানবীরের হঠাৎ দৃঢ় গম্ভীর কন্ঠে শান্ত ধমে গেল। তার বিরুদ্ধে আর কোনো বাক্য উচ্চারণ করতে পারল না। তানবীর সামনের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আবারও অতীতের স্মৃতি আওড়াতে লাগল,
— ‘ সেই মমতাহীন মহিলা শুধু আমাকে নষ্ট করেই ক্ষান্ত থাকল না৷ আমার শেষ সম্বলটুকুও আমার থেকে কেঁড়ে নিলো। ‘
তানবীরের কন্ঠস্বর এবার যেন আটকে যেতে চাইছে। এই নির্মম সত্য কথাটা তার গলা দিয়ে বাহির হতে চায়ছে না। সে অবশেষে জোর খাটিয়ে বলে উঠল,
— ‘ আমার বাবাকে আমার থেকে কেঁড়ে নিয়েছে উনি। আমাকে পুরোপুরি এতিম বানিয়ে দিয়েছে। ‘
শক্ত হৃদয়ের আদলে গড়া ছেলেটে যেন এবার চুপসে গিয়েছে। ছেলেদের কান্না হয়তো এই সমাজের চোখে বেমানান। তাই নিঃশব্দে গাল বেয়ে কষ্টের বিষাদময় অশ্রুকণাগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগল। শান্ত এই পরিস্থিতিতে কিভাবে সামলাবে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। তার চোখজোড়াতেও জলধারা এসে ভিড় জমিয়ে। সে স্বান্তনার ভরসা দিয়ে নিজের হাতটা তানবীরের বাহুতে রাখল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চাইল। যেন নিঃশব্দেই বলে দিচ্ছে আমি আছি। আর কেউ না থাকলেও আমি আছি।
তানবীর মলিন মুখে ঈষৎ হাসল। শান্তর নরম কোমল হাতটা টেনে এনে নিজের মুঠিদ্বয়ে আবদ্ধ করলো। খানিকটা গলা কেশে পরিস্কার করে বলল,
— ‘ মায়ের এই বিশ্বাসঘাতকায় বাবার কিছু যায় আসেনি। সে এমনটাই সবার চোখের সামনে প্রকাশ করতো। বড়রা দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বললেও অকপটে নাকচ করতো। খুবই স্বাভাবিক চলাফেরা ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন সেটা কখনও বুঝতে দেননি। এক দিকে আমাকে সামলিয়েছেন। নিজের সব দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু শরীরও যে মনের সঙ্গে পরিপূরক। তাই বেশিদিন এই অভিনয় চালিয়ে যেতে পারেননি। আকষ্মিক মেজর হার্ট অ্যাটাকে বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমি না তখন পুরোপুরি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। জানো, বাবার মৃত্যুতে কান্না পর্যন্ত করতে পারিনি। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছিলাম দমটা গলা অব্দি এসে আঁটকে যাচ্ছিল। সেই সময়টা সাদি-অর্ণব পুরোটা সময় আমার পাশে থাকত। পড়াশোনাসহ সবকিছু বাদ দিয়ে আমার বাসাতেই পড়ে থাকত। আমিও কোনোরূপ বাঁধা দিতে পারতাম না। নিজেকে তখন কেবল একটা প্রাণহীন জড়বস্তু মনে করতাম। কিন্তু এইভাবে তো আর দিন চলবে না৷ তাই দাদি জোর খাঁটিয়ে আমাকে আমাদের দাদার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। দাদি দাদার ভিটে ছেড়ে আমার সাথে ঢাকায় এসে থাকতে পারবে না। আর মা-বাবা ছাড়া একটা ছোট ছেলের পক্ষে একা জীবন কাটানোও সম্ভব নয়। তাই আমাকেও একপর্যায়ে তার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কাছে হার মেনে চাঁদপুরে যেতে হলো। সাদি-অর্ণবও তাতে বেশ খুশি হয়েছিল। যাক তাহলে অবশেষে আমার এই অবস্থার কিছু একটা উন্নতি হবে।
দাদির সাথেই চাঁদপুরে থাকতে লাগলাম। নিজের ভিতরকার উগ্র মনোভাবটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। একেবারে চুপচাপ বাক্যহীন একটা ছেলেতে পরিণত হতে লাগলাম। দরকারেও কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হতো না। বৃদ্ধ দাদি বহুত চেষ্টা করতো আমার মন ভালো করার। কিন্তু তারপরও আমি যেন আমার রঙহীন দুনিয়াতেই মগ্ন থাকতাম৷
অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে দাদি এক মস্ত বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
আমার ছোট ফুফির পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল। তাই দাদির জরুরি তলবে দাদার বাড়িতে এসে উপস্থিত। সঙ্গে তার স্বামীসহ ছেলে-মেয়ে সবাই।
গ্রামে এখনও বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। কানাঘুঁষাতে আইনের কান পর্যন্ত গেলে হয়তো আটকে যায়। কিন্তু এখনও আইনের আগোচরে এমন অগণিত ঘটনা ঘটে আসছে৷ আমার দাদি যদিও তখনকার যুগ অনুসারে শিক্ষিত ছিলেন তারপরও আমার এই অবস্থায় অশিক্ষিতদের মতন-ই কাজ করে বসেন।
সবাইকে উপস্থিত রেখে তার ঘোষণা জানান দেন যে, ফুফির বড় মেয়ে যে কি-না আমার-ই সমবয়সী তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়া হবে। এবং সেটা ঐদিন-ই।
ফুফি-ফুফা প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে মেনে যায়। হয়তো কেউ কেউ বুঝিয়েছে বাবা-মায়ের অবর্তমানে সব ধন-দৌলত আমার। তাই সম্পত্তির লোভে হোক আর যায় হোক বিয়েতে তারা আর না করতে পারেনি।
বিয়ে নিয়ে সবার এতো ব্যস্ততার মধ্যে আমি নির্বাক ছিলাম। হ্যাঁ বা না কিছুই বলিনি। শুধু দাদিকে এতটুকু বলেছিলাম আমার জীবনে কোনো মেয়ের অস্তিত্ব আমি রাখতে চাই না। তাই এই বিয়ে আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু দাদি তাতে ঘোর অমত পোষণ করেন। আমাকে মৃত্যু বাবার কসম দিয়ে বিয়েতে রাজি হতে বলে৷ তখন আর আমি না করতে পারিনি। কেননা তখন আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দোহায় আমাকে দেওয়া হয়েছিল।
গ্রামের মানুষজন এমনকি কাকপক্ষীর অনুপস্থিতিতে একেবারে সাধারণভাবে কাজি ঢেকে আমাদের বিয়েটা পড়ানো হয়। তখন যেহেতু দুইজনই অপ্রাপ্তবয়সের ছিলাম, তাই আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ে সম্ভব হয়নি। শুধু ধর্মমতে বিয়েটা হয়।
আমার সদ্য বিবাহিত বউয়ের সাথে আমার তখনও কোনোরকম কথাবার্তা হয়নি। এমনকি সেইদিন রাতেও না। পুরোটা রাত আমি গ্রামের ক্লাবঘরে কাটিয়ে পরের দিন দুপুরবেলায় বাড়ি ফিরি। কিন্তু অবাক করার বিষয় ছিল কেউ আমাকে এই নিয়ে কিছু বলেনি। আমিও তাই আর মাথা ঘামায়নি।
এরপরের দিন-ই দাদি বউসহ আমাকে ঢাকায় ফিরে আসতে বলেন। আমি কিছুটা অবাক হলেও কোনোরূপ প্রশ্ন করেনি। আসলে কিছু জানা বা বুঝার তখন একেবারেই ইচ্ছে ছিল না।
তাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসলাম৷ গ্রামের মেয়েদের এইট-নাইনে উঠলেই বিয়ে দেওয়ার অগণিত ঘটনা রয়েছে। তাই আমার বউয়ের এই নিয়ে খুব একটা জড়তা দেখতাম না। সবটুকু জড়তা কেবল আমার মধ্যেই কাজ করতো। কেননা কম বয়সী মেয়েদের বিয়েটা অনেক হলেও কমবয়সীদের ছেলেদেরটা সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র পরিসরের।
আমি ঢাকায় ফিরেছি জেনে সাদি-অর্ণব সেদিনই বাসাতে এসে হাজির। কিন্তু আমার সাথে তাদের-ই সমবয়সী এক ছোট্ট মেয়েকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক জেনে তারা যেন বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। পরে অবশ্য এই নিয়ে তারা অনেক হাসাহাসি করে। আমার প্রাক্তন বউ, মানে কেন প্রাক্তন বলছি সেটা একটু পরেই জানতে পারবে। সে গ্রামের মেয়ে হলেও বেশ মিশুক ছিলো। অর্ণব, সাদিদ সাথে খুব সহজেই ভাব জমে গেল। যেহেতু আমাদের তিনজনের-ই সামনে পরীক্ষা ছিল তাই গ্রুপে পড়া শুরু করি। আগে আমি অনিচ্ছা প্রকাশ করলে শুধু সাদি-অর্ণব জোর খাটাতো। কিন্তু তখন তাদের সাথে নতুন করে যুক্ত হয় প্রিয়তী, আমার কিশোরী বউ। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও মুখ বুঁজে সহ্য করার চেষ্টা করতাম৷ কিন্তু একসময় বিরক্ত হয়ে অকারণেই তার সাথে রাগারাগি করতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর দূরসম্পর্কেরও কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে নিজের দুনিয়াতে এবং আমি নিজের দুনিয়াতে মগ্ন থাকতাম। একসাথে থাকবো কি, নিজের ত্রি-সীমাতে তাকে আমার সহ্য হতো না। এমনকি আমার রুম তো দূরে থাক দ্বিতীয় তলাতে তার উঠা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। এভাবেই দিন কাটতে থাকে। সে চাকর-বাকর আর পড়াশোনা নিয়েই সারাদিন সময় পার করত। দেখতে দেখতে আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসলো। আর তাকে গ্রামে ফিরে যেতে হলো। কেননা সে তখনও গ্রামের স্কুলেই রয়েছিল। আমিও আগ বাড়িয়ে টান্সফারের কথা তুলেনি। কেননা তাকে সহ্যই করতে পারতাম না। তাই যত দূরে থাক ততই যেন ভালো।
সে যেদিন পরীক্ষার জন্য গ্রামে ফিরে যাবে তখনই কেবল একবার সাহস করে আমার রুমে পা দিয়েছিল। আমি তখনও রেগে কয়েকটা কটু বাক্য শুনাতে পিছুপা হয়নি। কিন্তু জানো, সে একদম রাগ করেনি। কিন্তু তার চকচক করা চোখ আমার নজর এড়াতে পারেনি৷ সে নিজের মতো করে পরীক্ষার জন্য শুভকামনা এবং আমাকে নিজের যত্ন নেবার কথা বলে চলে গেল।
কয়েকটা দিন গায়ে মাখলাম না। কিন্তু একটা সময় বাড়িতে খানিকটা একাকিত্ববোধ করতে শুরু করি। প্রথমে কারণটা স্বীকার করতে না চাইলেও পরে মেনে নিতে হয় আমি প্রিয়তীকে মিস করছি। কেননা সবতো আগের মতোই রয়েছে। কেবল প্রিয়তী অনুপস্থিত। তারপরও তাকে ফোন বা দেখা করার চিন্তা মাথাতেও আনেনি। একপ্রকার নিজের উপর জোর খাটিয়ে পরীক্ষাগুলো শেষ করলাম।
কিন্তু রাগ তখন হলো যখন দাদির কাছ থেকে জানতে পারলাম প্রিয়তী না-কি ঢাকায় আসবে না। পরীক্ষা শেষ তারপরও কেন আসবে না এই বিষয়টা আমি একদমই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই কোনোকিছু চিন্তা না করে সেদিন-ই ডাইভার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশ্য রউনা দিলাম। আমাকে হঠাৎ চাঁদপুর দেখে সবাই খানিকটা অবাক হলেও আমার অগোচরে মিটমিটিয়ে হাসছিল। সেগুলো একপ্রকার দেখেও পাত্তা দেয়নি। তার পরের দিন প্রিয়তীকে সহ ঢাকাকে ফিরে আসি। আমার এককথাতেই প্রিয়তী হাসিমুখে চলে আসতে রাজি হলো।
তারপরের দিনগুলো যেন বেশ স্বাভাবিক কাটতে লাগলো। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের কোনোরকম উন্নতি না হলেও অবনতির চেয়ে অনেকটা ভালো। প্রিয়তী সবসময় বড় মানুষের মতো আমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করত। কি লাগবে না লাগবে এসব নিয়ে পিছনে ঘুরঘুর করতো। আগে এসবে বিরক্ত হলেও তখন আর হতে পারতাম না। কেন যেন না চাইতেও ভালো লাগত। আপন বলতে কেউ ছিল না তো, তাই প্রিয়তীর অল্প খেয়ালটুকুতেই ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করে।
অল্প অল্প ভালোলাগা, অল্প অল্প মুগ্ধতায় একসময় তার মায়াতে পরে যেতে বাধ্য হলাম। কিন্তু তখনও স্বীকার করেনি। চলতে দিয়েছিলাম যেভাবে চলছিল।
আমাদের রেজাল্টও ততদিনে পাবলিশ হয়ে যায়। আমরা চারজন-ই ভালো গ্রেডে পাস করলাম। এবার আমার ইচ্ছেতেই প্রিয়তীসহ আমরা একই কলেজে এডমিশন নিলাম। কিন্তু গ্রুপ আলাদা হওয়াতে কলেজে আমাদের একসাথে সময় খুব কম-ই কাটত। এটাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যাটা উপলব্ধি করি প্রিয়তীর মনোভাব দেখে। কেননা কলেজে এডমিশন নেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই প্রিয়তী যেন হুট করেই পাল্টে যেতে শুরু করে। আগে যেমন আমার সাথে সময় কাটানোর জন্য বাহানা খুঁজে চলত, এখন আমি পাশে থাকলেও সে উধাও। আমাদের রেগুলার ল্যাবে কাজ থাকত। তাই প্রিয়তীকে বলতাম ডাইভার নিয়ে চলে যেতে। কিন্তু সে একরোখা হয়ে না করত। আর আমার ছুটি হলে একেবারে আমাকে নিয়ে বাসায় আসত। প্রথমে তার কথা ভেবে না করলেও পরে যেন আমিও এটাতে অভ্যস্ত হতে লাগলাম। মেয়েটা নিজেকে আমার অভ্যাসে পরিণত করেছিল। যার ধরুন একটা মুহূর্ত তাকে ছাড়া ভালো লাগত না৷
কিন্তু এই মেয়েটাই এখন ছুটি হলে বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হতে শুরু করত। তাই কলেজে অদেখা, আসা-যাওয়াতে অনুপস্থিতির জন্য আমাদের মধ্যে বেশ দূরত্ব চলে আসে। বাসাতেও প্রিয়তী রুম থেকে বের হতো না৷ আর আমিও কখনও ওর রুমে পা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতাম না। তাই কখনও ডেকে এনে কথা বলা বা গল্প করা হতো না। সময় যত বাড়ছিল দুইজনের দুরত্ব যেন ততই বহুগুণে বেড়ে চলছিল। আর আমাকে বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হয়েছিল যে আমি তার প্রতি দুর্বল। পবিত্র সম্পর্ক বলে না অন্যকিছু সেটা আমার জানা ছিল না। কিন্তু মানতে আমি বাধ্য ছিলাম, নিজের বিবাহিত বউয়ের প্রতি আমার ততদিনে টান তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাকে আমি চাই। ‘
তানবীর থামল। এতক্ষণ একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে সবটা বলছিল। এখন ঘাড় ঘুরিয়ে শান্তর মুখপানে তাকালো। মেয়েটার মুখটা মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। তানবীর সেটার কারণ সম্পর্কেও অবগত। কিন্তু করার কিছু নেই। সত্য বরাবরই তিক্ত হয়। আর সেটা যদি তিক্ত অতীত সেটা তা আরও ভয়াবহ। কিন্তু মাঝপথে এসে থেমে গেলে যে হবে না৷ অতীতের জন্য নিজের বর্তমানকে ঠকানো উচিত নয়। আর সেটা যদি হয় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তাহলে সেখানে ধোয়াশার রেশ পর্যন্ত থাকতে দেওয়া ঠিক নয়। নতুবা বারবার এই অতীতের বিষাক্ত তিক্ততা এসে ভবিষ্যৎকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যাবে। তাই সে আবারও বলতে লাগল,
— ‘ কিন্তু আমি চাইলেই তো সবকিছু হবে না। প্রিয়তীরও আমাকে চায়তে হবে। কিন্তু তার আচরণে এমন কিছুই আর অবশিষ্ট দেখতে পেতাম না। নিজের আপন পরিবার বলতে কেউ ছিল না। তাই আপনের থেকেও আপন দুই বন্ধুকেই তখন নিজের সমস্যাটা খোলে বলি। তারা সবকিছু শুনে প্রিয়তীর সাথে সরাসরি কথা বলতে বলে৷ কেননা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা আর বাকিসব সম্পর্কের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সামান্য কিছু ভুল-বোঝাবুঝি, মান-অভিমানের জন্য পাহাড় সমান দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাই সেই সমস্যাগুলোই কখনও নিজেদের মধ্যে আসতে দেওয়া ঠিক নয়। আর আসলেও যত দ্রুত সম্ভব সমস্যার সমাধান বের করা উচিত। তাই আমিও এমটাই ঠিক মনে করলাম। প্রিয়তীর সাথে কথা বলতে হবে৷ দুইজনে বসে কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলোর পথ খুঁজতে হবে।
এমনটাই মনোভাবনা সাজিয়েছিলাম। প্রিয়তী আগেই বাসায় চলে গিয়েছিল। তাই আমরাও কলেজ শেষ করে বাড়ির পথে রউনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু পথিমধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমরা তিনজনই থমকে গিয়েছিলাম। নিজের কানকেই তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
প্রিয়তী আর আমার বিয়ে সম্পর্কে কলেজের কেউ জানত না। শুধু আমাদের একসাথে আসা যাওয়াতে রিলেটিভ মনে করতো। আর আমরাও কখনও সম্পর্কের বিষয়ে খোলাসা করিনি। কিন্তু সেদিন আমাদের ক্লাসের-ই কয়েকজন প্রিয়তীকে জড়িয়ে একটা ছেলের সাথে আজেবাজে বকছিল। তাদেরকে না-কি প্রায়-ই কলেজের পিছনের গাছতলায় দেখা যায়। কয়েকজন না-কি লুকিয়ে তাদেরকে বেশ আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছে। এসব নিয়েই কয়েকজন বেশ হাসাহাসি করছিল। যেহেতু আমাদের সম্পর্কে কিছু জানে না তাই অকপটেই বন্ধু হিসেবে আমার সামনেই কিছু বিশ্রি কথা বলে ফেলছিল। সাদি-অর্ণব আমার পাশেই ছিল। তাই সেখান থেকে একপ্রকার জোর খাটিয়েই নিয়ে আসে। আর অনবরত বুঝাতে থাকে শুনা কথায় কান না দেওয়ার জন্য। প্রিয়তীর সাথে সরাসরি যেন এই নিয়ে আলোচনা করি।
মাথা গরম করে গিয়েছিল। তারপরও বহুত কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বাসায় আসি। কোনোদিন যা করিনি বাধ্য হয়ে সেদিন সেই কাজটাই করে বসি। বাসায় ফিরে নক না করেই সোজা প্রিয়তীর রুমে ডুকে পরি। যেহেতু নক করেছিলাম না তাই প্রিয়তীও বুঝতে পারেনি। সে সদ্য গোসল করে বেড়িয়েছিল। ওড়নাটা বিছানায় রাখা। তাকে প্রথম এই অবস্থায় দেখে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিলাম। শত হলেও তখনতো আর ততটা ছোট নয়। নিজের বিয়ে করা বউকে এই অবস্থায় দেখলে কার মাথা ঠিক থাকে? ভিতরে অস্থিরতা চরম ছিল। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিলাম না। প্রিয়তীও আমার হঠাৎ এমন আগমনে বেশ বিব্রতবোধ করছিল। তাই আমি যেই কথা বলতে এসেছিলাম সেটা আর বলা হলো না। চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে আসি। কিন্তু নিজের মধ্যকার অস্থিরতা কোনোভাবেই কমছিল না। একতো প্রিয়তীর সাথে সরাসরি কথা হলো না, দ্বিতীয়ত রুমে ঘটে যাওয়া সেই পরিস্থিতি। বারবার প্রিয়তীর সেই অবস্থাটা চোখের সামনে এসে আমাকে বেশ বিরক্ত করছিল। সেদিন আর দুইজনের কেউ কারও সামনে আসিনি। আমি নিজের কারণটা সম্পর্কে অবগত। কিন্তু প্রিয়তীরটা জানা ছিল না। রাতটা আমার বেশ কষ্টে পার হয়। সবকিছু ভেবে অতঃপর আমি নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নিব। বাকি দশটা কাপলের মতো আমিও এখন প্রিয়তীকে নিজের পাশে চাই। তার সান্নিধ্যে চাই। তাকে আর দূরে রাখার মনমানসিকতা আমার নেই।
এইভেবে নিজেকে খুব হালকা লাগছিল। বেশ খুশিও ছিলাম৷ অন্যদিন তাড়াতাড়ি কলেজে যেতে হলেও সেদিন আমি বসে থেকেই প্রিয়তীকে নিয়ে একসাথে বের হই। নিজের মনকে সামলাতে না পেরে প্রথমবার প্রিয়তীর হাতটা নিজের হাতের মুঠিতে নিয়েছিলাম। আমার মধ্যে ভালোলাগা কাজ করছিল। কিন্তু প্রিয়তীর চোখে-মুখে সেটা পরখ করতে পারলাম না। বরং সেখানে ছিল যেন আতংকের ছাপ।
কিন্তু সে হাতটা সরিয়ে নেয়নি। পুরোটা রাস্তা গাড়িতে চুপচাপ বসেছিল।
আমাকে হাসিখুশি দেখে সাদি-অর্ণবও ভেবেছিল আমাদের মধ্যে বোধহয় সবকিছু ঠিক আছে। তাই তারাও নিজেদের ক্লাসে মনোযোগী হলো। কিন্তু আজকেও ক্লাসের পিছন থেকে কিছু ছেলের ফুসুরফাসুর শুনে আমাদের দৃষ্টি সেদিকে গেল। তারা গতকালকের ছেলেগুলো-ই ছিল৷ তাই না চাইতেও আমার মন সেদিকে ছুটছিল। কিন্তু তাদের কাছে গিয়ে যেসব দেখি আমার যেন মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা। প্রিয়তীর সাথে আমাদের-ই সিনিয়র একজনের ঘনিষ্ঠ কিছু মুহূর্তের ছবি নিয়ে তারা হাসাহাসি করছিল। মাথা তখন আর ঠিক নেই। সজোরে তাদের ফোনটা নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে মারি। আর যা হবার সেটাই হলো৷ মারামারি, কথা-কাটাকাটিতে একসময় আরও তিক্ত কিছু কথা সামনে চলে আসে। আমিও আর একমুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করিনি৷ এইসব ক্লিয়ার না হলে আমি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাব। তাই দৌড়ে কলেজের পিছনে গাছতলায় যাই। আমার পিছনে পিছনে সাদি-অর্ণবও ছুটে আসে। ছেলেগুলো মিথ্যা বলেনি।
আমার-ই চোখের সামনে আমার-ই বউ অন্যকারও বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। শুধু এতটুকুই নয়। তারা একে-অপরের মধ্যে নিজেদের উষ্ণতা বিলিয়ে দিতে ব্যস্ত।
এই অবস্থায় দুইজনকে দেখে আমার পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছিল। আবারও পরকীয়া!
যা আমার সোনালী অতীতের বিনষ্টকারী, সেটা আবারও আমার বর্তমানকে জ্বালিয়ে দিতে চলে এসেছে? আর পারছিলাম না। শরীরে রীতিমতো আগুন জ্বলছিল। আমাদের উপস্থিতি ততক্ষণে তারাও বুঝে যায়। আর প্রিয়তী সেখানে আমাকে দেখে রীতিমতো বেশ ঘাবড়ে যায়। কিন্তু আমি কোনো রিয়েক্ট করিনি। শুধু সবার সামনেই টেনেহিঁচড়ে তাকে গাড়িতে এনে ফেলি। চারপাশ থেকে অনেক প্রশ্ন আসলেও সেগুলোর উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না।
বাসায় এনে সোজা তাকে আমার রুমে নিয়ে যাই। এতক্ষণের পুষিয়ে রাখা সবটুকু রাগ-ক্ষোভ তাকে আঘাত করে যেন কমাতে চেষ্টা করি। অন্য সময় হলে নিজের কাছে অনুতপ্ত হতাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে রাগে আমার শরীর রীতিমতো কাঁপছিল। প্রিয়তী প্রথম অবস্থায় ভয়ে চুপ থাকলেও যখনই আমি রেগে গিয়ে তার গায়ে হাত তুলি তখন আর নিজের রাগটা ধমন করতে পারেনি। এককথায় – দুইকথায় আমাদের সম্পর্কটার সেদিন-ই ইতি ঘটে। কেননা প্রিয়তীর ভাষ্যমতে মেহেদী ভাইয়ের সাথে সে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে। আমি যখন প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক জেনেও সে কিভাবে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে? তখন সে খুবই স্বাভাবিক স্বরে বলেছিল,
— ‘ এটাকে কোনো সম্পর্ক বলে? বিয়ে হয়েও তুমি আমার থেকে দশহাত দূরত্ব বজায় রেখে চলো৷ আমিও একজন মেয়ে। ছেলে সান্নিধ্যে আমিও চাই৷ কিন্তু নিজের স্বামী যদি এতটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে তাহলে যে বাহিরে যেতে বাধ্য। ‘
আমার তখন তার কথাগুলো জাস্ট আগুনের মতো লাগছিল। যার তাপ সহ্য করা ভীষণ কষ্টদায়ক। এটা কোনো কথা? আমাদের দুইজনের তখন অল্প বয়স। তারউপর আমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে তার সবটুকুই প্রিয়তীর জানা। তাহলে কিভাবে আমার সামান্য একটু দূরত্বে সে নিজের জীবনে অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দিবে? কেন? অল্প একটু সময় অপেক্ষা করলে কি হতো? এমন তো নয় যে আমাদের বিয়ের বয়স পার হয়ে গিয়েছে! নরমালি যেই সময়ে ছেলেমেয়েদের সম্পূর্ণ মনোযোগ পড়াশোনা নিয়ে থাকে সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাদের বিয়েটা হয়। তাহলে তখনই কি আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করে দেওয়া উচিত ছিল? আমার এত কেনোর উত্তরেও প্রিয়তীর মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখিনি৷ বরং সে বেশ গম্ভীর ভাবে নিজের প্রতিউত্তর জানিয়েছে, গ্রামে তার বয়সী মেয়েদের না-কি বিয়ে হয়ে বাচ্চা-কাচ্চা পর্যন্ত হয়ে যায়। সেখানে তার স্বামী যদি একবাড়িতে থেকেও হাজার মাইল দুরত্বে থাকে তাহলে সে পরকীয়াতে যাবে না তো কে যাবে?
এমনটাই তার সোজাসাপটা উত্তর ছিল।
আর তাতেই যেন আমাদের সম্পর্কটা শুরু হবার আগেই অনলের দহনে পুড়ে ছারখার হলো।
বড়দের কানে কথাটুকু গেলে তারা আমাকে বুঝিয়েছে প্রিয়তীকে ভালোভাবে বুঝাবে। স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কে এমন টুকিটাকি ঝামেলা নাকি হয়। কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। স্ত্রীর হাজার সমস্যা নিয়ে সংসার করা যায়। কিন্তু আর যাই হোক চরিত্রহীন স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করা যায় না।
যেহেতু আমাদের বিয়ের সময়ে রেজিস্ট্রি হয়নি তাই বিচ্ছেদের সময়ে এতসবের ঝামেলার দরকার ছিল না। কিন্তু আমি আর কোনোরকম ঝামেলা রাখতে রাজি ছিলাম না। নিজ দায়িত্বে আমাদের প্রাপ্তবয়স হলে ধর্মমতে এবং আইনিভাবেও তালাক সম্পূর্ণ করি। ‘
তানবীর থেমে গেল। এতক্ষণের সবগুলো বাক্য এতটায় বিষাক্ত ছিল যে তার গলা ধরা আসছে। অতীতটা যেন আমারও এসে শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। শান্তর মুখেও শব্দ নেই। সবসময় দুষ্টুমি খুনসুটিতে মেতে থাকা একটা ছেলের হাসিখুশি মুখের পিছনে যে জীবনের এতটা তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সেটা হয়তো তানবীরকে না দেখলে কখনও বিশ্বাস করতে পারত না। সত্যিই মানুষের ভিতর না দেখে যারা বাহির যাচাই করে থাকে তাদের এই মনোভাব বর্জন করা উচিত।
দীর্ঘ শব্দহীন মুহূর্তের পর তানবীর ঘাড় ফিরিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। তার মুখভঙ্গি দেখে বুঝা যাচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিটা সেও সহজে মেনে নিতে পারছে না। তারপরও সে তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
— ‘ তাহলে এখন বলো, পারবে এইরকম একটা ছেলের সাথে নিজের ভবিষ্যৎ এগিয়ে নিতে? তোমার মা-বাবা রাজি হবেন আদরের মেয়েকে এইরকম একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে? পারবে আমার এতগুলো তিক্ততা মেনে একটা এতিম ছেলেকে নিয়ে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতে? ‘
শেষ বাক্যটুকুতে শান্তর যেন দম আটকে যাবার অবস্থা। কি বলছে তানবীর এগুলো?
সে তানবীরের মুখে হাত চেপে ধরল। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। ভরা আত্মবিশ্বাসের কন্ঠে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলল,
— ‘ পারব। আমি সবকিছু পারব। কিন্তু আর কখনও যেন নিজেকে এতিম বলে উল্লেখ করতে না দেখি। আমি আছি না? তাহলে এতিম কিভাবে হলেন? ‘
তানবীরের বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেলে। এতক্ষণের যে শ্বাসগুলো গলা পর্যন্ত এসে আটকে ছিল এখন যেন সবগুলো নিজেদের উল্লাসে বেড়িয়ে আসতে চায়ছে। তানবীর নিজের মুখের উপর শান্তর হাতটা সরিয়ে নিলো। নিজের দুইহাতের মুঠিতে শান্তর নরম হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞাসা কন্ঠে বলল,
— ‘ কিন্তু তোমার পরিবার? তারা কি আমার সম্পর্কে এতসব জেনে রাজি হবে? তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। আমি ছেলেটাই এমন। ‘
— ‘ ওহ্। এবার কিন্তু আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। শুনুন, লাইফে কিছু ইন্টারেস্টিং বিষয় থাকা প্রয়োজন। পরিবার ঝামেলা না করলে ভালো। আর যদি করে তাহলে আরও বেশি ভালো। নাতি-নাতনীদের বুড়ো বয়সে গল্প শুনানোর মতো কিছুতো থাকা প্রয়োজন। ‘
বলেই শান্ত দুষ্টু হেসে ভ্রুজোড়া নাচালো। দুষ্টুর শিরোমণি তানবীর যেন এবার চুপসে গেল। বলে কি এই মেয়ে!
কিন্তু পরমুহূর্তেই উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। তার বউ যদি তার মতো না হয় তাহলে কিভাবে হবে?
শান্তও হাসছে। এতক্ষণ তানবীরকে স্বাভাবিক করতে এতসব অকপটে বললেও এবার বেশ লজ্জা লাগছে। যার ধরুন তার মুখশ্রীতে লাজুক আভা ফুটে উঠেছে।
তানবীর তার মুখপানে তাকালো। তার লজ্জা পাওয়ার কারণ সবটাই বুঝতে পারল। সে হাসিমুখে শান্তর কাঁধ আগলে তাকে নিজের বুকে নিয়ে আসলো। শান্তও চুপচাপ তানবীরের বুকে মাথা রাখল। অনেকটা সময় নীরবে কেটে গেল। শুধু দুটি মানুষ অনুভব করলো নিজেদেরকে। অনুভব করলো একে অপরের অস্থির হৃদস্পন্দনকে।
তানবীর মাথা নিচু করে শান্তর মাথায় গভীরভাবে চুমু খেল।
শান্ত যেন লজ্জায় আরও গুটিয়ে গেল। এরিমধ্য শান্তর ফোনে তার বাবার কল আসাতে কাপলযুগলের প্রেমঘন মুহূর্তে বিগ্ন ঘটল। তানবীর ছেড়ে দিতেই শান্ত উঠে দাঁড়াল। তানবীরও উঠে দাঁড়াল। শান্ত কয়েককদম সামনে এগিয়ে কল রিসিভ করবে তার আগেই পিছন থেকে তানবীরের রাশভারি কন্ঠ শুনে থেমে গেল,
— ‘ এই মেয়ে শুন। ‘
শান্ত যেন একটু চমকে উঠল। এতক্ষণের এতো গম্ভীর কথাবার্তার পর এমন কন্ঠ শুনে চমকিত ভাবটা সত্যিই লুকাতে পারল না। তানবীর তার দৃষ্টি বুঝল। কিন্তু পূর্বেকার ন্যায় একি স্বরে বলল,
— ‘ আমি কিন্তু তোকে ভালো-টালোবাসিনা। নির্ঘাত ফেঁসে গেছি। ‘
শান্ত প্রথমে থতমত খেলেও পরমুহূর্তে হেসে ফেলল। কিন্তু নিজের হাসিটাকে দমন করার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে বলে উঠল,
— ‘ আর শুনুন, আমিও কিন্তু আপনাকে ঐসব ভালো-টালোবাসিনা। নির্ঘাত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি। ‘
দুইজনই হাসল। কিন্তু কারও হয়তো বুঝার বিন্দুমাত্র বাকি নেই যে এই হাসিতে কতটা তৃপ্তি লোকায়িত। কতটা প্রশান্তি মিশ্রিত৷
_______________
রাতের ঢাকা বরাবরই নীলার বেশ পছন্দ। দিনের কোলাহল শেষে রাতের এই নিস্তব্ধতাটুকুই যেন এখানে বসবাসরত মানুষগুলোকে একটু শান্তিতে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। নীলা গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে অপলক দৃষ্টিতে নীরব রাস্তাটার সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
আচমকা গাড়ি ব্রেক করাতে নীলার দৃষ্টিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো। সে পাশ ফিরে ডাইভিং সিটে বসা সাদিদের মুখপানে তাকালো। তার নীরব দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছে এখানে কেন থামিয়েছেন। সাদিদ নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে গেল। নীলার পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে কথা নেই বার্তা নেই তাকে কোলে তুলে নিলো।
— ‘ আরে, আরে কি করছেন কি? কোলে নিচ্ছেন কেন? ‘
সাদিদ প্রতিউত্তর জানালো না। চুপচাপ নীলাকে কোলে নিয়েই গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলল। নিজে প্রথমে সীটে বসে নীলাকে তার কোলো বসালো৷ নীলা যেন নীরব দর্শক। এইছেলের হুটহাট কর্মকান্ড তার এখনও মাথায় আসে না।
নীলাকে কপাল কুঁচকে রাখতে দেখে সাদিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। একহাতে নীলার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরল। আরেকটা হাত নীলার ঘাড়ে রাখল। এতক্ষণ নীলা কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও এখন যেন বুঝার আর বাকি নেই৷ সাদিদের ঐ চোখজোড়া-ই যেন নীলাকে তার উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। সাদিদের মনোভাব বুঝে উঠতে পেরে নীলা সরে যেতে চাইল। কিন্তু সাদিদ কি নিজের পাওয়া না বুঝে এত সহজে ছাড়বে?
নীলার খোলা চুলগুলোকে আলতো হাতে মুঠো করে সাদিদ অধরজোড়া মিলিয়ে নিলো। নীলা ক্রমশ শিহরিত হয়ে সাদিদের পিঠ আঁকড়ে ধরতে চাইল। নিস্তব্ধ সড়কে যেন শুধু একজোড়া দম্পতির উষ্ণ নিঃশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। সাদিদের তৃষ্ণা যেন থামবার নাম নেই৷ এই রমণীর সান্নিধ্যে আসলে যেন তার পিপাসা শুধু বাড়তেই থাকে। শুধু যেন আরও চাই, আরও চাই৷ নীলার শ্বাস আঁটকে আসছে। তাই দম ফেলার জন্য সাদিদকে মৃদুভাবে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। সাদিদের যেন এবার রাগ লাগল। এই মেয়েটা সবসময় এমন করে। নিজেতো কখনও আগ বাড়িয়ে কাছে আসেই না, যখন সাদিদ কাছে টেনে নিতে চায় তখনও তার যতসব বাঁধা। তাই কিছুটা রাগ নিয়েই সে নীলার ঠোঁটে জোরে কামড় বসাল। তারপর এক ধাক্কায় দূরে ঠেলে দিলো।
নীলার ঠোঁট একদিকে জ্বলছে আর অপরদিকে সাদিদের এই রাগ। সে কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল। অতঃপর সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝতে পেরে আর কষ্ট পেল না৷ নিঃশব্দে হেসে সাদিদের গা ঘেঁষে বসল। সাদিদ তাকালো না পর্যন্ত। বরং একটু সরে বসল। নীলার এই মুহূর্তে চরম হাসি পাচ্ছে। সাদিদের এই ছোট্ট রাগ-অভিমানগুলো নীলার বড্ড কিউট লাগে। ইচ্ছে করে গালগুলো জোরে টেনে দিতে৷ কিন্তু এখন এমনটা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই নিজের মধ্যকার ইচ্ছেকে দমন করে আবারও সাদিদের পাশে বসল। সাদিদ এবার রাগ সামলাতে না পেরে গাড়ির দরজা খোলে বেড়িয়ে যেতে লাগল। নীলা দ্রুত তার হাত চেপে ধরল। সাদিদ রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই সে একটা শুকনো ঢুক গিলল। ভয়ে কাচুমাচু হয়ে সাদিদের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। সবটুকুই যেন সাদিদের রাগ ভাঙানোর নিনজা টেকনিক। কিন্তু সাদিদ এইসবের ধার ধারল না৷ আবারও হাত ছাড়িয়ে নিলো৷ সবসময় এইসব ভালো লাগে না৷ আর সবসময় এসব সহ্য করার মুডও থাকে না। ভালোবেসে কাছে টানলে যদি ছুটাছুটি শুরু করে এমনটা সহ্য হয়? তাও যদি সেটা নিজের বিয়ে করা বউ?
নীলা বুঝতে পারল পরিস্থিতি এবার বেশ গরম। তাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুদ্ধি বাহির করার চেষ্টা করছে। কি করা যায়?
— ‘ আউচ। আমার ঠোঁট ব্যাথা করছে। বোধহয় রক্তও বের হচ্ছে। ‘
সাদিদ দ্রুত নীলার দিকে তাকালো। রাগ এখনও বজায় রেখেছে। তাই নিজের তীক্ষ্ণ চোখে সম্পূর্ণ ঠোঁট পরখ করল। অতঃপর রক্ত না দেখে নীলার অগোচরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সাদিদ আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলাতে নীলা এবার অভিযোগের কন্ঠে বলল,
— ‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি। খুব জ্বলছে। ‘
— ‘ জ্বলার জন্যই দেওয়া হয়েছে। ‘
— ‘ ইশশ কি নিষ্ঠুর! ‘
সাদিদ নীলার বাহু শক্ত করে ধরে হেঁচকা টান দিলো৷ কিছুটা গম্ভীর মিশ্রিত রাগী কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ আর তুমি? তুমি নিজে কি? সবসময় এসব ভালো লাগে? তুমি আমার স্ত্রী না? তাহলে আমার চাওয়া-পাওয়া তোমাকে বুঝতে হবে না? কেন সবসময় আমি-ই কাছে আসব? তুমি আসলে সমস্যাটা কোথায়? একবারও তো নিজে কাছে এসে দেখ না। উল্টো আমি যখন কাছে টানি তুমি এইসব শুরু করো৷ সবসময় কি একরকম মনোভাব থাকে? তোমার এইসব বুঝা উচিত না? ‘
সাদিদ নিজের বাক্যটুকু সম্পূর্ণ করেই নীলাকে আবারও ধাক্কা দিলো। আর বিড়বিড় করে বলল,
— ‘ পাষাণ একটা। ‘
নীলা নিচুস্বরটা শুনতে পেল। তখন তাল সামলাতে না পেরে গাড়ির দরজায় হালকা লেগেছে। ব্যাথাও খানিকটা পেয়েছে। কিন্তু আপাতত কোনো ব্যাথা গায়ে লাগছে না। মনে যে ব্যাথা সাদিদ তৈরি করেছে তার সামনে এগুলো খুব সামান্য।
সাদিদের থেকে এইসব শুনে নীলার কষ্টে বুকটা ফাটছে।
হ্যাঁ সে একটু অবুঝ৷ অনেকটা লজ্জায় মিইয়ে থাকে। তাই কখনও নিজে থেকে সাদিদের কাছে এগিয়ে যেতে পারে না। সাদিদ তো সবসময় বুঝে তার না বলা কথাগুলো। তাহলে আজ কি হলো?
কান্নাগুলো এসে গলায় দলা পাকাচ্ছে। আর নীলা
সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সেগুলোকে আটকে রাখার প্রয়াসে ব্যস্ত। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। গাল বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রুকণা ঝড়তে লাগল।
সাদিদের এদিকে খেয়াল নেই৷ সে চোখ বন্ধ করে ইতিমধ্যে সিটে হেলান দিয়েছে। প্রাণপাখিটার সাথে রাগ দেখিয়ে সে নিজেও পুড়ছে। চোখ বন্ধ থাকাতে নীলার ব্যাথাটুকুও দেখতে পায়নি৷ নতুবা হয়তো এতক্ষণে অস্থির হয়ে পড়ত। সাদিদ অভিমান করেছে। তাই নীলাও যদি এখন অভিমানের পর্ব নিয়ে বসে থাকে সেটা কি ঠিক হবে? কখনই নয়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, মান-অভিমান অবশ্যই হবে৷ তাই বলে একজনে রাগ করলে অপরজনকে তখন পানি হতে হয়। নতুবা ছোট্ট একটা বিষয় বৃহৎ আকারে গিয়ে দাঁড়ায়। নীলাও তাই করলো। চুপচাপ সাদিদের কাছে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখল। সাদিদ সাথেসাথেই চোখ খুলে তাকালো। নীলা কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ প্লিজ আপনার বুকটায় একটু মাথা রাখি? আমার নিজের বুকটা বড্ড ব্যাথা করছে। ‘
সাদিদের সব রাগ যেন মুহূর্তেই পানি হলো। দুইহাতে নীলাকে আঁকড়ে নিলো। চোখে-মুখে অগণিত আদর দিলো। আদর দিতে দিতে যেন একপ্রকার হাঁপিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তারপরও যেন প্রিয়তমার কষ্টগুলোকে একআকাশ ভালোবাসা দিয়ে দূর করতে চাইছে। এতক্ষণ কান্না আটকে রাখতে পারলেও এখন যেন সাদিদের ভালোবাসা পেয়ে সেটা আর সম্ভব হলো না। নীলা ডুকরে কান্না করে উঠল। সাদিদ তার কপালে চুমু খেয়ে বুকে আগলে নিলো। শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
— ‘ হুঁস। একদম কান্না নয়। ‘
কিন্তু চোখের পানি কি আর এসব মানে? নীলার কান্না থামছে না দেখে সাদিদ এবার আকুতিভরা কন্ঠে বলল,
— ‘ প্লিজ জান, আর কান্না নয়। আমি সরি বলছি৷ এভাবে রাগ দেখানোটা আমার ঠিক হয়নি। এবার চুপ করো। তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না পাখি৷ ‘
ধীরে ধীরে নীলার কান্নার বেগ কমে গেল। সে নিজেও নিচুস্বরে সাদিদের বুকে নাক ঘষে বলল,
— ‘ আমিও সরি। আপনি আর রাগ করে থাকবেন না। ‘
সাদিদ হাসল। নীলার মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
— ‘ আচ্ছা রাগ করব না। কিন্তু পাখি এবার কিন্তু আমি সিরিয়াসলি বলছি, তাই মনোযোগ দিয়ে শুনো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটাতে কিন্তু বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ তারপরও মানুষ হিসেবে সবার-ই কিছু চাহিদা রয়েছে। আর স্বামী হিসেবে তোমার কাছে অবশ্যই আমি কিছু আশা করি৷ এখন না হয় ঠিক আছে।
কিন্তু বাবা আসার পর যখন তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব তখন? সারাদিন ব্যস্ততায় কাটিয়ে সবসময় হয়তো মন-মেজাজ ঠিক নাও থাকতে পারে। তখন যদি তোমাকে আমার প্রয়োজন হয়। একান্ত কাছে চাই৷ আর সেইসময় যদি তুমি এমনটা করো আমার মাথা কি ঠিক থাকবে? হয়তো বা রাগ দেখাব না। কিন্তু যদি দেখায় তাহলে কষ্টটা কে পাবে? একদিকে তুমিও পাবে আরেকদিকে আমিও পাব। তাই আজ বাধ্য হয়ে এই কথাগুলো বলছি। তুমি যদি মাঝেমধ্যে এমনটা করতে তাহলে আমি হয়তো বলতাম না। কিন্তু তুমি এই কাজটা সবসময় করো। ‘
সাদিদ এবার থামল। নিচে তাকাতেই নীলাকে নতজানু হতে দেখল৷ অর্থাৎ সে নিজের সবসময়কার কথাগুলো ভেবেই অনুতপ্ত হচ্ছে। সাদিদ ছোট্ট একটা শ্বাস টানল। তারপর নীলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আবারও বলল,
— ‘ পাখি, তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। জীবনপথের সবটুকু পথ আমি তোমাকে নিয়েই পাড়ি দিতে চাই। তাই একদিনের প্রসঙ্গ হলে হয়তো বা এভাবে বললাম না। কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে। কেননা তুমি এখনও বড্ড অবুঝ৷ সবগুলো মানতে পারলেও কিছু কিছু হয়তো আমার তোমাকে বলে দেওয়া উচিত। যেগুলো তুমি চেষ্টা করলেই শুধরিয়ে নিতে পারবে৷
মেয়েরা বরাবরই ছেলেদের তোলনায় লাজুক হয়। সেই জায়গায় তো আমার বউ আরও একদাপ এগিয়ে। ‘
— ‘ আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। ‘
— ‘ চুপচাপ যা বলছি শুনো। কথা না বুঝে কথা বললে মাইর দিব। ‘
— ‘ হুহ্ মাইর। মামার বাড়ির আবদার? ‘
— ‘ না গো সুন্দরী। আপনার জামাইয়ের আবদার। এখন আরেকটা কথা বলে বাধা দিলো মেরে তক্তা বানাবো। ‘
নীলার আর সাহসে কুলালো না কিছু বলার। এই ছেলের বিশ্বাস নেই৷ সাদিদ তাকে চুপসে যেতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকালো। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলা উচিত। তাই আবারও বলল,
— ‘ তাই বলছি লজ্জা অবশ্যই পাবে৷ কিন্তু তাই বলে সবসময় যে লজ্জাকেই প্রাধান্য দিবে এটাতো ঠিক নয়৷ আমি তোমার স্বামী। তাই দিনশেষে আমারও কিছু চাওয়া আছে৷ যেগুলো পূরণ করার জন্য দিনশেষে অবশ্যই আমি তোমার কাছেই আসব। তখন যদি তুমি নিজের এই অবুঝপনায় আমাকে দূরে সরিয়ে দাও সমসময় কি আমি মেনে নিতে পারব? মানুষ হিসেবে রাগতো সবার-ই রয়েছে। তাই আমারও হয়তো বা রাগ লাগবে৷ তখন তোমার সাথে আজকের মতো খারাপ ব্যবহার করে ফেলব। যেটা আমি কখনও চাই না৷ আমি বরাবরই চেষ্টা করব এমনটা কখনও না করার। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তোমারও তো কিছু দায়িত্ব রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী যদি দায়িত্বটা ভাগাভাগি করে নেই তাহলেই না সংসারটা সুখের হবে। তাই নয় কি? আর তাছাড়া আরেকটা কথা কি জানো? স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক। তাই যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেটা সময় থাকতেই নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নেওয়া উচিত। যেন কখনও সেই সমস্যা সমাধানের সঙ্গী হিসেবে তৃতীয় পক্ষ না আসতে পারে। বুঝেছেন মহারাণী? ‘
নীলা মাথা উপর নিচ করল। অর্থাৎ এমনটাই৷ সাদিদ যেমন তার দিকটা খেয়াল করে। নীলাও সবসময় না পারুক কিন্তু সাদিদের দিকটা খেয়াল করার চেষ্টা করা তার অবশ্যই উচিত। আর আজ না হোক কাল তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি যে ঘটবে না সেটা কে বলতে পারে? তাই সময় থাকতেই নিজেদের সমস্যা একে-অপরের সহায়তায় মিটিয়ে ফেলা উচিত।
সাদিদ মৃদু হাসল। নীলাকে বুকে চেপে ধরে বলল,
— ‘ এইতো আমার পাখিটা বুঝে গিয়েছে। এখন দেখি ঠোঁটটা। আহ্ লাল হয়ে রয়েছে। এখনও ব্যাথা আছে? ‘
— ‘ বেশি না অল্প। ‘
সাদিদ হাসল। আলতো করে ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিলো। বরাবরের ন্যায় বলল,
— ‘ ব্যাথাটুকু শুষে নিয়েছি। আর যন্ত্রণা হবে না। ‘ ‘
নীলা হেসে ফেলল। সাদিদও মৃদু হাসল। সাদিদ তাকে আবারও বুকে আগলে নিয়ে খনিকের জন্য আঁখিদ্বয় বন্ধ করল। একটু অবুঝ, একটু চঞ্চল। কিন্তু দিনশেষে যেন এই মেয়েটাতেই যেন সাদিদ প্রশান্তি খুঁজে পায়। আর সে এটাতেই খুশি৷ আর সারাজীবন যেন তারমধ্যেই প্রশান্তি অনুভব করতে পারে এমনটাই নিজের কাছে তার একমাত্র চাওয়া।
চলবে…