অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৪৪

0
4200

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৪

গায়ে উচ্চমাত্রার জ্বর, পা কেটে রক্ত গড়গড়িয়ে বের হচ্ছে এমতাবস্থায় বিয়ের শেরওয়ানি পরিহিত অবস্থায়, সাদিদ এলোমেলো পায়ে ঢাকার রাস্তায় নিজের প্রিয়তমার খোঁজে বের হয়েছে। নিজের বর্তমান করুণ পরিস্থিতিতে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। কেননা নিজের দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়? এতটাই দিশেহারা যে প্রিয়তমার খোঁজে বের হওয়ার জন্য যে পকেটে টাকা লাগবে সেই খেয়ালটুকু তার মধ্যে এখন নেই৷ আর না আছে সুশীল মানবজাতীর অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস পায়ের জুতো। তার অবস্থা এইমুহূর্তে একেবারে খাপছাড়া। পিচ ঢালা রাস্তায় কাটা নগ্ন পা-জোড়া যেন সামনে এগুতেই চাইছে না। তারপরও সে পা-জোড়া টেনে টেনে খুঁড়িয়ে সামনের দিকে হেঁটে চলেছে। তার দৃষ্টি ভীষণ এলোমেলো। তাই সামনে যে তীব্র বেগে গাড়ি ছুটে আসছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখ ঝলসে দিতেই সে হাতদুটো দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। কিন্তু ভয় পাওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষ্মণ তার মধ্যে প্রকাশ পেল না। আর না ভয়ের প্রতিধ্বনি হয়ে মুখ ফুটে কোনো করুণ আর্তনাদ বের হলো। বর্তমান পরিস্থিতি যেন তার নিকট সকল ডর-ভয়ের উর্ধে।
সেকেন্ড সময় ব্যয় হতেই লাস্ট মোমেন্টে এসে থেমে যাওয়া গাড়িটে হতে উল্কার গতিতে কেউ বেড়িয়ে আসলো৷ আর চোখের পলকেই ধিরিম-ধারিম সাদিদের পিঠে কয়েকটা লাগিয়ে দিলো।

— ‘ হারামি, আর একটু হইলেই গাড়ির চাক্কার নিচে পরতি। মন্ডা কইতাসে এহন ইচ্ছা কইরাই চাক্কার নিচে ফালাইয়া দেই। ‘

সাদিদ ঝাপসা চোখে তানবীরের মুখপানে তাকালো। মেয়ে হলে বোধহয় কাছের মানুষের সান্নিধ্যে পেয়ে এইমুহূর্তে ডুকরে কেঁদে উঠত। কিন্তু সে যো ছেলে। আর এই সমাজে ছেলেদের কান্না করা নিষিদ্ধ। বুকে পাথর চেপে মরে গেলেও তার কান্না করা যাবে না। জন্মের পর থেকে এমনটাই তারা জেনে এসেছে।
তাই সাদিদও কাঁদলো না। শুধু প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথেই যেন মাথাগরম তানবীরের মাথাটাও ঠান্ডা হয়ে গেল। রাগটা কমে আসলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। শুধু হালকা করে পিঠ চাপড়ে বিনাবাক্যে স্বান্তনা দিলো। ভাঙা গলায় সাদিদ বাচ্চাদের ন্যায় বলে উঠল,

— ‘ দোস্ত আমার কলিজাটা কই? আমি যে আর পারছি না। কতটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে অথচ সে আমার সাথে নেই। কোথায় সে? আমার যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ‘

তানবীর তার এমন কথায় কষ্ট পেলেও বুঝতে দিলো না। বরাবরের মতোই অনুভূতিহীন কন্ঠে তেঁতে উঠল,

— ‘ আসছে আমার মজনু। তোর কলিজা কলিজার জায়গাতেই আছে। বিশ্বাস না হইলে বল, বুকের পাঁজর ভেঙে কলিজা বাহির করে দেখাই। ‘

সাদিদকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে কােমড়ে হাত বেধে তানবীরের এমন খাপছাড়া কথাতে কষ্টের মধ্যেও সাদিদ মৃদু হেসে ফেলল। বুকে পরপর কয়েকটা ধাক্কা দিয়ে বলল,

— ‘ শালা, তুই আর শুধরাইলি না। ‘
— ‘ কলিজা বাহির করে দিতে পারলাম না বলে দোস্ত থেকে শালা হইয়া গেলাম? এতো জলদি পদন্নোতি! কিন্তু বোনতো নাই। আর বিনা পাওনাতে এই তানবীর স্বান্তনা বাক্য গ্রহণ করবে না৷ আগে বইন বিয়া দে তারপর শালা-মামা সব ডাইকো৷ ‘

বলেই সে দাঁত কেলিয়ে হাসল। সাদিদ হাসতে হাসতেই তাকে আরও কয়েকটা উত্তম-মাধ্যম লাগালো।

— ‘ আরে থাম ভাই, থাম। সারাদিন না খাইয়াও এতো জোর কোথায় থেকে আহে? শরীর তো না যেন হাতি। ‘
— ‘ আর তুই হইলি হাতির চিরন্তন শত্রু কুমির৷ বিনা দাওয়াতে চলে আসিস। ‘
— ‘ এই ছেলে, কি বলতে চাও? তানবীর আর বিনা দাওয়াত? ওহ্ এসব শুধু স্বপ্নে কল্পনা করা যায়। ‘

তানবীরের ভাব দেখে সাদিদ ঠোঁট কামড়ে হাসল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবারও চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে গেল। তানবীর তার মুখশ্রী দেখে ভিতরের মনোভাব আঁচ করতে পারল। কিন্তু সান্ত্বনা বাক্য না বলে আবারও খানিকটা রাগীস্বরে বলল,

— ‘ শালা তোর লাইগা রাতে ঘুমাইয়াও শান্তি নাই। সারাদিন জ্বালাইয়া রাতেও জ্বালাইতে চইলা আহছ। ‘
— ‘ তোকে কখন জ্বালাইলাম? ‘
— ‘ বাহ্ বহুত সুন্দর। খুন কইয়া বলছে আমি অপরাধী নই। লাথি দিমু হারামি। আন্টির ফোন পাইয়া ঘুৃম থেকে দৌড়াইয়া আইছি। দেখ হয়তো পুরো ঢাকার রাস্তায় ইতিমধ্যে তোকে খোঁজে বের করার গ্যাং বার হইয়া পরছে। ‘

মায়ের কথাটা শুনে সাদিদের মনটা আবারও তিক্ততায় ভরে উঠল। কানগুলো যেন এখনও সেইসব কটু বাক্য হজম করতে পারছে না। গলায় এসে আটকে রয়েছে। না হজম করা যাচ্ছে না গিলে ফেলা যাচ্ছে।
সে কোনো প্রতিউত্তর না করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। তানবীর সবটাই পরখ করেছে। শায়লা রহমান ফোনেই তাকে বাড়িতে কি কি করে এসেছে কান্না মিশ্রিত গলায় লাগাতার বলেছে। তাই বুঝার আর বাকি নেই। তাই ঐদিকে না গিয়ে সরাসরি বলল,

— ‘ পায়ের অবস্থা ভালো না। গাড়িতে উঠ। ‘
— ‘ লাগবে না। আমি ঠিক আছি। ‘
— ‘ দেখ সাদি, মাথা এমনিতেই গরম৷ তাই তুই আর ত্যাড়ামি করে গরম করিস না। ‘

সাদিদ তার সাথে কথা বাড়াতে চাইল না। আপাতত তার নীলাকে প্রয়োজন। একটা সেকেন্ডের মূল্যও অনেক। সাদিদকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যেতে দেখেই তানবীর ক্ষেপে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সাদিদের মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলো। আর সে সফলও। তাই কয়েককদম এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। সাদিদ মলিন চোখে-মুখে তার দিকে ফিরে তাকাতেই সে শীতল কন্ঠে বলল,

— ‘ পাগলামি করিস না ইয়ার। এভাবে পাগলের ন্যায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে নীলাকে খোঁজে পাবি? তাকে খোঁজে বের করার জন্য প্রথমে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে। এভাবে কোনো কিছুর সমাধান হবে না। উল্টো নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বি। ‘

এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে সাদিদ আর কিছু বলতে পারল না৷ সে যথেষ্ট বুঝদার একটি ছেলে। খারাপ পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলিয়ে নেবার যথেষ্ট দৃঢ় মনোবল রয়েছে। কিন্তু অতি আপন মানুষ অর্ধাঙ্গিনীর অনুপস্থিতি যেন তাকে বাচ্চাদের ন্যায় অবুঝ হতে বাধ্য করছে। সে চোখদুটো সরু রাস্তায় সীমাবদ্ধ করে রাখল। তানবীর এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। একপ্রকার জোরপূর্বক গাড়িতে টেনে এনে সামনে বসালো। গাড়িতে থাকা ফাস্ট এইড বক্স থেকে নিজেই হালকা ভাবে সেনিটাইজেশন করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। পুরো সময় সাদিদ কেবল নির্বাক শ্রুতা হয়ে ছিল। যেন আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতে তার কিছু যায় আসে না। কাটা জায়গায় যে ব্যাথানাশক পরাতে জ্বলছে এটাও যেন তার মুখভঙ্গিতে প্রকাশ পেল না। সর্বদা হাসিখুশি, দুরন্ত- চঞ্চল স্বভাবের ছেলেটার আকস্মিক এমন চুপসে যাওয়া যেন তানবীরের বুকে ভীষণ গাঢ় ক্ষত সৃষ্টি করছে। সহ্য হচ্ছে না ভাইয়ের এমন কষ্টে জর্জরিত মুখশ্রী। জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সবকিছু। তারসাথে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে ইচ্ছে করছে এর পিছনে জড়িত প্রত্যেকটা অস্তিত্বকে।

_____________________

মাথাটা বড্ড ভনভন করছে। মনে হচ্ছে কেউ বিশ কেজির মালামাল ছোট্ট মাথাটার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। শরীরটাও বড্ড মেজমেজ করছে। চোখদুটো খোলা সম্ভব হচ্ছে না৷ তারপরও নীলা জোরপূর্বক টেনে টেনে চোখগুলো খুলতে চাইল। ঝাপসা চোখে কিছু দেখতে পারছে না। যখনই হাত ঢলে চোখ পরিস্কার করার চেষ্টা করলো বুঝতে সক্ষম হলো এটা সম্ভব নয়। তার হাতদুটো পিছন দিক নিয়ে কোনো কিছু দিয়ে শক্ত পোক্ত ভাবে বাঁধা। মুখ দিয়ে কথা বের করতে গিয়েও আটকা পরলো। কেউ নির্দয়ভাবে তার মুখটাও শক্ত কাপড়ে বেঁধে দিয়েছে। শরীরের যন্ত্রণা বেড়ে মস্তিষ্কে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু হালকাভাবে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠতেই সে আতংকে উঠল।
আশেপাশে চোখ ঘুরাতেই নিজেকে এক অচেনা-অজানা, নির্জীব স্থানে আবিষ্কার করলো।
দিন না-কি রাত সেটা অনুমান করা যাচ্ছে না। বন্দি ঘরের পুরোপুরি স্বার্থকতা যেন এখানে রচিত। দরজা-জানালা এমনকি ভেন্টিলেটরের উপরও পর্দা দ্বারা ঢাকা। এমন একটা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করে নীলার যেন দমটা গলায় এসে আটকেছে। চোখজোড়া জলে টইটম্বুর। মুখ দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে মা-বাবাকে ডাকতে চাইছে। প্রিয় মানুষটাকে কাছে টেনে বুকটা জুড়াতে চাইছে। কিন্তু কিছুই পারছে না। মুখফুটে শুধু অস্ফুটস্বরের বুলি বের হচ্ছে। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাত-পায়ের বাঁধন আলগা করতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। একসময় শরীর আর কুলিয়ে উঠতে পারল না। দীর্ঘ সময়ে অনাহারে শরীর একেবারে নিস্তেজ হয়ে পরেছে। গলাটা কাঠফাটা দুপুরের ন্যায় শুকিয়ে গিয়েছে। মাথাটা চেয়ারে হেলিয়ে দিয়ে সে এবার অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

— ‘ পা.. পা. আ.. নি..

কিন্তু কেউ তার ডাকে এগিয়ে আসলো না। সে ঐভাবেই নিঃসঙ্গ তৃষার্ত অবস্থায় পরে রইল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বন্ধ দরজার অপরপাশ থেকে মৃদু আওয়াজ ভেসে আসতেই নীলা দুর্বল চোখজোড়া মেলে তাকালো। দরজা খুলেই কয়েকজন সুঠামদেহের পুরুষ অবয়বকে ভিতরে আসতে দেখেই নীলার বুকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে মুচড় দিয়ে উঠল। তবে কি প্রিয়মানুষটার আমানত সে আর রক্ষা করতে পারবে না? তার আমানতে অন্য কেউ ভাগ বসাবে? নীলার কলিজা পর্যন্ত বোধহয় ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। আর না দেহভঙ্গিতে কিছু প্রকাশ করা যাচ্ছে। শুধু মলিন ঝাপসা চোখগুলো দিয়ে যেন সামনের মানুষগুলোর কাছে ভিক্ষা চাইছে। তার সতিত্ব রক্ষা করার ভিক্ষা। নতুবা তাকে জানে মেরে দেবার ভিক্ষা। এই জীবনে যে সাদিদ নামক পুরুষ ব্যতিত আর কারো কাছে নীলা নিজেকে সর্পে দিতে পারবে না। তার থেকে যে মৃত্যু উত্তম। তার দেহের প্রত্যেকটা লোমকূপের উপরও যে সাদিদের অধিকার। আর নীলা জীবন থাকতে সেই অধিকারে অন্য কারো ভাগ সহ্য করতে পারবে না৷
কিন্তু তার এতো চাওয়া-পাওয়ার মূল্য কি তারা দিবে? কোমল হৃদয়ের নিষ্পাপ চাহনির মায়াতে কি তাদের হিংস্র হৃদয়ে দয়া জন্মাবে?
কালো পোশাক পরিহিত লম্বা চওড়া একটা পুরুষদিপ্ত শরীর নীলার দিকে এগিয়ে আসতেই নীলা অশ্রুসিক্ত চোখে নড়েচড়ে নিজেকে ছুটাতে চাইল। তার এমন হাবভাব দেখে দরজার পাশে দাঁড়ানো পিছনের পুরুষগুলো উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সামনের পুরুষটাও মুচকি হাসলো। সে খানিকটা নিচু হয়ে নীলার মুখ বরাবর মুখ নিয়ে আসলো।
কপাল বেয়ে গাল অব্দি ডানহাতের শাহাদাত আঙুল বুলিয়ে নীলার দিকে বিশ্রি নজরে তাকালো। লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাসভারী কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ সো হট। ‘

পিছনের বিশ্রি স্বরের হাসিগুলোতে আবারও চারপাশ মুখরিত হলো৷ আর নীলার শরীর ঘৃণায় ঘিনঘিন করে উঠল। সে মাথা ঝাকিয়ে হাতটা দূরে সরালো। তাতে সামনের পুরুষটা যেন বড্ড ক্ষেপে গেল। মেয়ে মানুষের এমন তেজ তার বরাবরই অপছন্দের। তাই সামান্য প্রত্যক্ষাণে চোখ-মুখ লাল করে সজোরে নীলার গালে থাপ্পড় বসালো। শক্ত হাতের থাপ্পড় এতটাই সজোরে পড়ল যে নীলা চেয়ারসহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। মুখ বাঁধা সত্বেও ব্যাথায় অস্ফুটস্বরে কুঁকিয়ে উঠল। বোধহয় দাঁতের সাথে ঠোঁটের ঘর্ষনে কোথাও কেটে গিয়েছে। তাইতো গালের সাথে সাথে ঠোঁটের কোণেও ব্যাথার আভাস পাচ্ছে। ঝাপসা চোখজোড়া আবারও নিভে আসতে লাগল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারলো না। নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে সে আবারও জ্ঞান হারালো।

— ‘ পাখি। ‘

পেইনকিলারের সাথে তানবীর বুদ্ধি করে ঘুমের ঔষধও খাইয়ে দিয়েছিল। নতুবা সে তার বন্ধুকে ভালোই চিনে। আবারও পাগলামি শুরু করতো৷ আর এইমুহূর্তে তারও সুস্থতা প্রয়োজন৷ কিন্তু এতো চেষ্টা করেও লাভ হলো না। সাদিদকে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে হঠাৎ এমন হকচকিয়ে বসে পরা দেখে তানবীরও উঠে বসল। পাশ থেকে পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে সাদিদের মুখের সামনে ধরল। কাঁধে হাত রেখে বলল,

— ‘ দুঃস্বপ্ন দেখেছিস হয়তো। পানিটা খা। ‘

সাদিদ কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা নিয়েও রেখে দিলো। তার বুকটা অস্থিরতায় ফেটে যাচ্ছে। বারবার মন শুধু কু ডাকছে৷ আর দুনিয়ার যত খারাপ খারাপ ভাবনা এসে মন-মাঝারে ক্রমাগত উঁকি দিচ্ছে৷ এসি চলাকালীনও সে ঘেমে-নেয়ে একাকার। কাঁপা হাতে পুরে মুখ-গলা মুছে নিয়ে সে বিছানা ছেড়ে নামতেই তানবীর আটকে ধরে বাধা দিলো,

— ‘ একদম না। তুই একপাও এই রুম থাইক্কা বাহির করবি না৷ ‘
— ‘ মাথা গরম করিস না। ছাড় তানবীর। ‘
— ‘ কইলাম না কোথাও যাইতে পারবি না৷ আন্টি-আঙ্কেল আমার ভরসায় তোরে ছাড়ছে। আমি দুনিয়া উল্টাইয়া গেলেও তোরে এই অবস্থায় একা ছাড়ুম না। ‘

সাদিদ তার বকবকানির ধার ধারল না। হাত ঝটকা দিয়ে ছুটিয়ে বিছানা ছেড়ে নামল। খুঁড়িয়ে কয়েকপা এগোতে নিলেই তানবীর সামনে এসে দাঁড়ালো,

— ‘ ভাই আমার, দয়া কইরা কথাটা হুন। রাইত এহনও শেষ হয় নাই। এই সময়ে কই যাইবি? সকাল হোক আমিসহ তুই পুরো ঢাকা শহরে রাউন্ড মারমু। ‘

সাদিদ মলিন মুখে তাকালো। তার চোখজোড়া এতো ঝাপসা কেন হচ্ছে? কোনো পোকা-টোকা কি পরেছে? নতুবা এমন হবে কেন? আগে তো কখনও এমনটা হয়নি!
সে তানবীরের ডানহাতটা মুঠিতে নিয়ে ভাঙা স্বরে
বলে উঠল,

— ‘ বাধা দিস না দোস্ত। আমার বুকটা বড্ড ব্যাথা করছে। একবিন্দু শান্তি পাচ্ছি না। প্রাণপাখিটাকে একবার হলেও চোখের দেখা দেখতে চাই৷ সে সুস্থ আছে এটা যতক্ষণ না আমি জানতে পারব, ততক্ষণ শুয়ে-বসে কোনোকিছুতেই শান্তি পাব না। প্লিজ বাধা দিস না৷ ‘

এমন আকুতিভরা কন্ঠ শুনে তানবীরের হাতটা আলগা হয়ে আসলো। সাদিদ মলিন মুখে মৃদু হাসলো। খুঁড়িয়ে কয়েক কদম সামনে গিয়েই পিছনে ফিরল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,

— ‘ কিছু টাকা দে। ওয়ালেট-কার্ড সব বাসায় রেখে আসছি। ‘

তানবীর এবার ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। বিছানার পাশের ছোট্ট ড্রয়ার থেকে নিজের ওয়ালেটটা নিয়ে পুরোটাই সাদিদের হাতে ধরিয়ে দিলো। আর কার্ডের পিনকোড বলে দিলো।

— ‘ আরও লাগলে বলিস। ভালো কথা, তোর সাথে ফোন আছে? ‘
— ‘ কিছুই নাই৷ ‘
— ‘ এমন পকেটফারা দেবদাস হইয়া তুমি প্রেমিকারে খুঁজতে বাহির হও? আমরা দেইখা বুঝি দুনিয়ার মানুষ এগুলা বুঝবো? ‘
— ‘ কারো বুঝার ধার ধারি না৷ আর না কারো পরোয়া করি। আমার নিকট প্রাণপাখির উর্ধে কিছু নই৷ ‘

তানবীর সাদিদের এমন সহজ স্বীকারোক্তিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো বাঁকা কয়েকটা কথাও মুখ উগলে বলে দিতো। কিন্তু আপাতত নিজের নির্লজ্জতাকে সঠিক সময়ের জন্য ধমিয়ে রাখল।
সাদিদ তানবীরের ওয়ালেট থেকে নগদ ক্যাশগুলো আর কার্ডটা নিয়ে সেটা তানবীরের হাতে ধরিয়ে দিলো।

— ‘ প্রিয় জিনিসগুলোকে সবসময় নিজের সাথে আগলে রাখতে হয়। ‘

বলেই সাদিদ দরজার বাহিরে পা বাড়ালো। তানবীর মৃদু হাসলো। আর সাদিদের কথাটার অর্থও ঠিকঠাক বুঝে নিলো। মৃদু হেসে ওয়ালেটটা খুলতেই বাবার ইয়াং বয়সের একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুহূর্তেই চোখজোড়া ঝাপসা হলো। আর তার ঠিক পাশেই শান্তর ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকা রাগী চেহারার একটা ছবি দেখতেই ঝাপসা চোখগুলোতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। চিকচিক করা চোখগুলো দিয়ে ছবিগুলোর উপর নজর বুলিয়ে সে গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার সংমিশ্রণে গঠিত অনুভূতি নিয়ে নিজ অধরযুগল ছুঁয়ে দিলো। অতঃপর দ্রুতপায়ে আলমারি খুলে ঝটপট দুইটা জ্যাকেট তুলে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। সাদিদ দরজার দিকে পা রাখতেই তানবীর পিছন থেকে ডেকে উঠল,

— ‘ মজনু, লাইলির খোঁজে বর সেজে বের হবা না-কি? তাইলে আবাল পাবলিকের খপ্পরে পরে গণদোলাই অব্দি নসিবে পইরা যাইবো৷ ‘

সাদিদ ঘার ফিরিয়ে তাকালো। ততক্ষণে তানবীর বাসার কাপড়ের উপর দিয়েই একটা জ্যাকেট পরে আরেকটা তানবীরের গায়ে ঢিল দিলো। পরমুহূর্তেই রসিকতার স্বরে বলে উঠল,

— ‘ প্রেমিকা পাও আর না পাও এই রাইতের বেলা রাস্তায় বাইর হইলে ডিসেম্বরের শীত প্রেমিকা অবশ্যই পাইয়া যাইবা৷ তাই বেশি মাথা না ঘামাইয়া পইরা ফেলাও। ‘

সাদিদ চুপচাপ পরে নিলো। দুষ্টু তানবীর একবার নিজের আর সাদিদের বেশভূষার দিকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে বলে উঠল,

— ‘ বাহ্ দোস্ত। তোর দেবদাস হওয়াতে আর কিছু লাভ না হইলেও বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক উন্নতি হইয়া গেছে। কালই দেখবি নিউ ফ্যাশন হাউসগুলোতে তোর আর আমার এই ফ্যাশনের রিক্রিয়েট করার দুম পরবো। পাজামার সাথে জ্যাকেট আরেকদিকে টু কোয়ার্টারের সাথে জ্যাকেট। নাইস কম্বিনেশন ডুড। ‘

বলেই সে দাঁত কেলানি দিলো। সাদিদ মুহূর্তেই নিজের পুরোনো ফর্মে ব্রেক করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— ‘ ফাউল কথা কইয়া সময় নষ্ট আর মাথা নষ্ট করলে একটা দাঁতও দাতের জায়গায় থাকবো না৷ ‘
— ‘ শালা চেতস ক্যান? ভালা কথার দাম নাইক্কা৷ ‘

সাদিদ বিরক্তিকর শ্বাস টেনে দরজা খুলে এগিয়ে গেল। এই ছেলেটা যে তার মুড ভালো রাখার জন্য এতসব আজাইরা আলাপ করছে এটা সে ভালোই বুঝে৷ তারপরও চুপ থাকলো। কি করে বুঝাবে তার মুড, মন, শরীর সবকিছুই একশো তে একশো হয়ে যাবে কেবলমাত্র তার প্রাণপাখির আগমনে৷ যতক্ষণ না সে হাজির হচ্ছে পৃথিবীর কোনোকিছু সাদিদকে শান্ত করতে পারবে না। আর না তার ভিতরকার দহন থামাতে পারবে।
তানবীর নিজেই ডাইভিং সিটে বসল। সাদিদকে এইমুহূর্তে এসবে একদম বিশ্বাস করা যাবে না। নতুবা দেখা যাবে সে গাড়ি নয় পক্ষিরাজ ভেবে উড়াল দিতে চাইবে৷ তানবীর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সাদিদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— ‘ সবতো বুঝলাম। কিন্তু যাবিটা কই? কোথায় থাইক্কা শুরু করুম? ‘
— ‘ যেইদিকে চোখ যায়। নিদিষ্ট কোনো গন্তব্য নাই। বলতে পারিস প্রয়োজন পরলে পুরো বাংলাদেশের আনাচে-কানাচেতে চক্কর কাটবো৷ ‘
— ‘ গাড়ির তেল কি তোর বাপ দিবো? ‘
— ‘ বাপ না দিক তার ছেলে দিবো। ‘

তানবীর বিরক্তির রেশ টেনে মনে মনে সাদিদের চৌদ্দ গুষ্টির পিন্ডি চটকালো। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সায়দাবাদ ক্রস করতেই সে অধৈর্য্য গলায় বলল,

— ‘ হারামি, তুই আসলে কোনদিকে যাইতে চাস বলবি? এমন কইয়া ঘুরলেই কি মাইয়া আইসা রাস্তার সামনে তোর জন্য দাঁড়াইয়া থাকবো? ‘

সাদিদ জানালার বাহির দিয়ে ক্রমাগত অস্থির চোখজোড়া বুলিয়ে নিলো। রাতের শেষভাগের আঁধারে স্পষ্ট কোনোকিছু বুঝা মুশকিল। তারপরও নিয়ন আলোর কৃপায় যতটুকু দেখা যাচ্ছে সেটার সে পূর্ণ উশুল তুলতে চায়৷ এমতাবস্থায় তানবীরের কথাটা শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে নিজেও বিরক্তিকর
আওয়াজ তুলে বলল,

— ‘ এতকথা কস ক্যান? চুপচাপ থাকলে কি পেটে কৃমি দৌড়াদৌড়ি করে? চুপচাপ ডাইভ কর। তোর গাড়ির চাকার যতক্ষণ হায়াত আছে কন্টিনিউসলি চালাইয়া যা৷ ‘
— ‘ এহন আইসো আমার লাগে তেজ দেহাইতে? এতক্ষণ তো আমারে ছাড়াই দৌড় দিছিলা। শেষমেশ এই তানবীর আর তার গাড়ির কাম লাগলো তো? ‘
— ‘ তুই যে কি পরিমাণ বেহায়া সেটা আমার থেকে কে ভালো জানে? বিনা দাওয়াতে যে হাজির হবি এটা কি নিমন্ত্রণ করে জানতে হইবো? ‘

তানবীর হেসে ফেলল। সামনের থেকে টিস্যু বক্সটা তুলে কথার শাস্তিস্বরূপ সজোরে সাদিদের উপর ফেলল। সাদিদ অন্যমনস্ক থাকায় পিঠে এসে লাগল। চোখ গরম করে তাকাতেই সে ফকফকা দাঁতগুলো দেখালো।
সাদিদ আর কিছু বলল না। আবারও বাহিরে নজর দিলো। বন্ধুগুলো তার ভাইয়ের ন্যায়। ডিপ্রেশন যেন ঘিরে না ধরে তাই তারাই চারপাশ থেকে ঘিরে রয়েছে। সাদিদ আকাশের পানে তাকিয়ে নিঃশব্দে সেই আকাশের প্রতিনিধিত্ব করা অসীম ক্ষমতার অধিকারীর নিকট কৃতজ্ঞতা জানালো। মানুষজাতি বরাবরই লোভি প্রকৃতির। তাই সাদিদও সেই জাতির অভ্যাসসুলভ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে আবারও হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিলো। চেয়ে নিলো তার পাখিটাকে। একটিবার তার সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য নিঃশব্দে আকুতি জানালো। একটিবার বুক পাঁজরে শক্ত করে আবদ্ধ করার তীব্র মনোভাসনা জ্ঞাপন করলো।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here