অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৪৬

0
4465

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৬

দুর্বিষহ কয়েকটা দিনের যাত্রা কাটিয়ে সাদিদ এখন পুরোপুরি দিশেহারা। এতদিন নিজ মনকে কোনোভাবে স্বান্তনার বাক্য শুনালেও এখন আর ধৈর্য্য কুলিয়ে উঠছে না৷ এখন পর্যন্ত দেশের আনাচে-কানাচেতে নিজের সর্বোচ্চ উদ্যোগে নীলার খোঁজ চালিয়েছে সে। কিন্তু নীলার সম্পর্কে সামান্য ক্লু পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এটাও স্বাভাবিক। কেননা কোনো নিখোঁজ ব্যক্তিকে খোঁজে পাওয়া গেলেও যে ব্যক্তি নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু তারপরও সাদিদ হার মানতে চায় না। সবাই এতো বলার পরও সে বিরামহীনভাবে তার প্রাণপাখির খোঁজ অব্যহৃত রেখেছে। সাদিদ ধৈর্য্য রাখতে না পেরে মিরপুরের রাস্তায় গাড়ি ঘুরালো। দুইদিন আগেও নীলার পরিবারের সাথে এই নিয়ে তার কথা হয়েছে। কিন্তু আজকে সে আবারও মিরপুরের রাস্তা ধরেছে। আরিফ মাহমুদকে ইতিমধ্যে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। তাই তারা সবাই এখন বাসাতেই রয়েছে। ঘণ্টা দুইয়েক ডাইভ করে সে নীলাদের মিরপুরের বাসার সামনে এসে পৌঁছালো। দুইবার কলিংবেল চাপতেই নিধি এসে দরজা খোলে দিলো। এইসময় দরজার সম্মুখে সাদিদকে দেখে সে একটু অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। বিনয়ের সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করতে বললো।

— ‘ শাদ কোথায়? ‘

সাদিদের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিধি মলিন হাসলো। বাচ্চাটা বাবা ছাড়া কিছু বুঝে না। আর সেদিনের পর নিধি আর পদ্মলয়ায় ফিরে যায়নি। এককথায় ফিরে যাবার কোনো রাস্তা ছিল না। শায়লা রহমান এখনও প্রচন্ড ক্ষেপে রয়েছেন। হসপিটালে থাকাকালীন-ই নিধিকে দুই-চার কটুকথা শুনাতে পিছুপা হয়নি। তাই শাহেদ একপ্রকার বাধ্য হয়ে বলেছে আরিফ মাহমুদের শরীর ভালো না হওয়া অব্দি যেন তাদের সাথেই নিধি থাকে। নিধি স্বামীর মনোভাব বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। শাহেদ তাকে কোনোরকম কটুকথার সম্মুখীন করতে ইচ্ছুক নয়। আর পদ্মলয়ায় নিয়ে গেলে নিধিকে এখন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন অবশ্যই হতে হবে। তখন না পারবে মায়ের সাথে উচ্চ গলায় কথা বলতে। আর না পারবে নিধির কষ্ট সহ্য করতে। আর মাকেও এই মুহূর্তে বুঝিয়ে বলে লাভ হচ্ছে না। সে তার রাগ কমাতে পারছে না। নীলাসহ তার পুরো পরিবারের উপর উনার ভীষণ রাগ জমেছে। তাই বাধ্য হয়ে শাহেদকে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে। নিধিও চুপচাপ সেটা মেনে নিয়েছে। কেননা সে তো অবুঝ নয়। পরিস্থিতি সবটাই বুঝতে সক্ষম। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা কি এসব বুঝে? সে তার বাবাকে চায়। শাহেদও মাঝেমধ্যে এসে সময় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলের তাতে পোষায় না। সে আরও চায়। নিধি সেসব মনে করে নিঃশব্দে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। গলায় স্বাভাবিকতার চেষ্টা নিয়ে বলল,

— ‘ ঘুমিয়েছে। ‘
— ‘ ওহ্ ‘

কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল। তারপর সাদিদই বলে উঠল,

— ‘ আমি একটু আঙ্কেলের সাথে কথা বলবো। ‘
— ‘ বাবা রুমেই আছে। এসো আমার সাথে। ‘

সাদিদকে নিয়ে নিধি দরজায় এসে দাঁড়াতেই নার্গিস খাতুনের নজরে আসলো। সুদর্শন ছেলেটার এমন উষ্কখুষ্ক মলিন মুখশ্রী তার একেবারেই সহ্য হচ্ছে না। আর সেখানে অসহ্যের মাত্রাটা যে আরও তীব্র। কেননা এসবের পিছনে কোনো না কোনোভাবে তিনিও দায়ী। শত হলেও উনি মেয়ের মা। তিনি স্নেহভরা কন্ঠেই ডাকলেন,

— ‘ আরে সাদিদ যে। এসো বাবা। দাঁড়িয়ে আছো কেন? ‘
— ‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আঙ্কেল কি ঘুমিয়ে পরেছে? ‘
— ‘ হয়তো। শরীরটা তেমনটা ভালো নয়। তাই বোধহয় চোখ লেগে গিয়েছে। তুমি বসো আমি এখনই ডেকে দিচ্ছি। ‘
— ‘ তাহলে থাক আমি না-হয় পরে আসবো। ‘

নার্গিস খাতুন তার কথা শুনলো না। আরিফ মাহমুদকে হালকা স্বরে ডাক দিতেই তিনি চোখ খোলে তাকালেন। নার্গিস খাতুনকে কিছু জিজ্ঞাসা করার পূর্বেই তিনি বললেন,

— ‘ সাদিদ এসেছে। ‘

আরিফ মাহমুদ ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকালেন৷ সাদিদকে দেখে বরাবরের মতোই মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললেন,

— ‘ এসো বাবা। ‘

সাদিদ ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসলো। কোানো বণিতা না করে সোজাসাপটা বলে উঠল,

— ‘ আঙ্কেল আমি আবারও নীলাঞ্জনার মিসিং কেসটা নিয়ে এসেছি। জানি ঐদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তারপরও আমি চাই আপনারা আবারও বিষয়টা ভেবে দেখুন। আমার নীলাঞ্জ.. না মানে ও এমনটা করতে পারে না। আমার দীর্ঘ বিশ্বাস এর পিছনে কোনো না কোনো কারণ অবশ্যই রয়েছে। এবং সেই কারণটা একমাত্র নীলাঞ্জনাই বলতে পারবে। তাই সর্বপ্রথম তাকে খোঁজে বের করা প্রয়োজন৷ এবং সেই জন্য আমাদের আইনি সহযোগিতা চায়। প্লিজ আমাকে পারমিশন দিন। আমি নীলাঞ্জনার মিসিং কেইস সাবমিট করতে চাই। ‘

আরিফ মাহমুদ সাদিদের মুখপানে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এতো মায়া জড়ানো মুখটা যে দেখলেই পরাণটা জুড়িয়ে যায়৷ অথচ এই ছেলেটাকেই তার অবুঝ মেয়েটা ছেড়ে পালিয়েছে। এটাও তাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। তিনি হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারও একই কথা বললেন,

— ‘ দেখ বাবা, তোমাকে আমি সেইদিনও একই কথা বলেছি। মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে এটা এমনিতেই মা-বাবা হিসেবে আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয়। তারউপর এখন যদি পুলিশে গিয়ে এসব জানাজানি হয় তাহলে যতটুকু সম্মান বাকি আছে ততটুকুও হারাবো। বাবা, জীবনে আর কিছু কামাই করি আর না করি কিন্তু সম্মানটা ঠিকই কামিয়েছি। আর আমাদের মতো উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য সম্মানের উপরে কিছু হয় না। তাই আমি অন্ততপক্ষে পুলিশকে এরমধ্যে জড়াতে চাই না। বাকিটা এবার তোমার ইচ্ছে। আর কেউ না জানুক আমরা তো এটা অস্বীকার করতে পারব না। নিজের স্ত্রীর যেকোনো স্বীদ্ধান্ত তুমি নিতে পারো৷ ‘

এতটুকু বলে তিনি চুপ থাকলেন। সাদিদ মাথা নিচু করে রয়েছে। রাগ হচ্ছে তার। প্রচুর রাগ হচ্ছে। তাদের দিকটা ভাবতে গেলে হয়তো ঠিক, কিন্তু সাদিদের এখন সেসব ভাবতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। তার মাথায় কেবলমাত্র নীলার চিন্তা। অন্য কোনোকিছু এই মুহূর্তে তাকে বশ করতে পারবে না। না লোকসমাজ, না তথাকথিত তাদের সম্মান। তার নীলাকে চায়, সেটা যেভাবেই হোক।
সে বিনাবাক্য উঠে দাঁড়ালো। কোনোকিছু না বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু দরজায় এসে হঠাৎ থেমে গেল। কিন্তু পিছনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু গম্ভীর থমথমে কন্ঠে বলল,

— ‘ আমি জানি না আপনারা কিভাবে সামান্য একটা চিঠির উপর ভিত্তি করে ওকে এতটা ভুল বুঝতে পারেন। মানলাম সে চলে গিয়েছে। তবুও সে কেন চলে গিয়েছে? তার পিছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো কারণ রয়েছে। সেটা আমি তার স্বামী হয়ে হলফ করে বলতে পারছি আর আপনারা মা-বাবা হয়ে এতোটা পরের মতো আচরণ করতে পারছেন? আল্লাহ না করুক আমার পাখি বড্ড সরল, বড্ড নরম৷ কোনোদিন যদি এসব জানতে পারে তাকে আমি সামলাতে পারব না৷ আর সেই মুহূর্তে তার চোখে যদি একবিন্দু অশ্রুকণার রেষ আমি পাই, তাহলে আপনাদের কাউকে আমি ছাড়বো না৷ আমি ভালো কিন্তু আমার পাখিকে যারা কষ্ট দিবে তাদের জন্য খুব খারাপ। সেটা যদি তার জন্মদানকারী মাতা-পিতা হয় তাহলে তাদের জন্যও। ‘

সাদিদ চলে গেল। রুমের তিনজন মানুষ এখনও স্তব্ধ। কি বলে গেল সাদিদ এতক্ষণ? এটাও সম্ভব? শান্ত শিষ্ট ছেলেটা যে এমন সাধারণ ভাষায়ও ভয়ংকর হুমকি দিয়ে গেল সেটা যেন তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। আবার নিজ মনে বারবার প্রশ্নেরা উঁকি ঝুঁকিও দিচ্ছে। সত্যিই কি তাদের কোথাও ভুল হচ্ছে? তারা কি সত্যকে আড়াল করে ভুলের পিছনে ছুটে চলেছে?

_________________

দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে নীলা। এতটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে যে গলা দিয়ে আর স্বর বের হচ্ছে না। নিজের শারীরিক দুর্বলতার সাথে সাথে যোগ হয়েছে আতংক, ভয়। প্রিয়মানুষ ভুল বোঝার ভয়। গত দুইদিনে তানহার সাথে তার দুইবার দেখা হয়েছে। সেটা ছিল মাত্র কিছু মুহূর্তের জন্য। সবাই যে তাকে বিশ্বাসঘাতক-দুশ্চরিততা বলে মেনে নিয়েছে এটাই বারবার বাঁকা হেসে বলে গিয়েছে। তার সাদিদ? তার ভালোবাসা? সেও নীলাকে ভুল বুঝেছে? কেবলমাত্র একটা চিঠিকে বিশ্বাস করে সে নীলাকে অবিশ্বাস করেছে? তাদের ভালোবাসা এতটা ঠুনকো, যে সামান্য কাগজের টুকরো তাদেরকে আলাদা করে দিবে?
নীলা চোখ বন্ধ করেই মলিন হাসলো। তার বন্ধ চোখের পাপড়ি বেয়ে পড়া অশ্রুজলে ভিজে গেল গাল।

— ‘ আপনার আর দোষ কোথায়? আমাকে এভাবেই যে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। আপনারা হয়তো আমার কপি করা হেন্ডরাইটিং দেখেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন৷ তারউপর তাদের মতো মুখোশ পরা শত্রু যে আমাদের আশেপাশে রয়েছে সেটা কি আপনারা ভাবতে পারবেন? পারবেন না। আমিও তো ভাবতে পারছি না। মানুষ এতো খারা…

নীলার নিচুস্বরের অভিযোগ গলায় আটকে গেল। সে খুকখুক করে কাশতে শুরু করলো। এরা এতটা নির্দয় যে একফোটো পানিও দেয় না৷ নীলার গলা শুকিয়ে মরুভূমি। খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখ বেয়ে তেষ্টায়, ক্ষুদায় ঝরঝরিয়ে পানি বেয়ে পরছে। চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসতেই দরজা খোলার আওয়াজ পেল। সে তাকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঝাপসা চোখে স্পষ্ট দেখতে পারছে না।
তানহা সাথের ছেলেটার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ দিয়ে আসো। ‘

বলেই সে পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে বসলো। ছেলেটা নীলার সামনে গিয়ে একটা খাবারের প্লেট আর একগ্লাস পানি রাখলো। সে ঝাপসা চোখে খাবারের প্লেট আর তানহার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল,

— ‘ তোকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না। আবার খুনি হতেও মনে সায় দেয় না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে বাঁচিয়ে রাখছি৷ দ্রুত খেয়ে নে। ‘

নীলার এমন কথায় কান্না পাচ্ছে। খাবার নিয়ে কখনও তাকে এমন করে কেউ বলেনি। উল্টো কতো আদর-যত্নে খাওয়ার জন্য বলতো। আর সাদিদ? ইশশ! যেন পেট নীলার নয়, তার। সবসময় তার খাবারের পিছনে পরে থাকতো। আর নীলা সেসময় মনে মনে কতোশত রাগ পুষতো। সুখের স্মৃতির পাতাগুলো মনে হতেই নীলার ঝাপসা চোখজোড়া আবারও ঝাপসা হয়ে দাঁড়ালো। সে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে শুকনো খাবারের প্লেটটাই তুলে নিলো। ঢকঢক করে পুরো পানিটুকু খেয়ে নিলো। গলা কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ভাতের সাথে ডাল। নীলা প্রচন্ড ক্ষুদায় সেটাই তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ পারলো না। দুই লোকমা খাবার মুখে দিতেই তার ভেতর থেকে সব গুলিয়ে উঠতে লাগলো। নীলার চোখ-মুখ আচমকা কুঁচকে এলো। কিছুসময় নিজের সাথে কি হচ্ছে সেটা বুঝে উঠতে পারলো না। মিনিট দুই-এক পার হতেই খাবারের প্লেটের উপরই গড়গড়িয়ে বমি করলো। পেটে কিছু নেই। তারপরও লাগাতার দুইবার বমি করে একেবারে নিস্তেজ হয়ে সো মেঝেতে মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখগুলোও বন্ধ হয়ে আসলো।
তানহাসহ সাথের ছেলেটা আকষ্মিক এমন কান্ডে হতবাক। কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে তাদের একটু সময় লাগলো। মুহূর্তেই তানহার ঘা গুলিয়ে আসলো। বমির গন্ধে আর এক সেকেন্ডও বসতে পারলো না। নাক চেপে বাহিরে বের হলো। বাহিরে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতেই একজন মেয়ে গার্ড এগিয়ে আসলো। এতগুলো ছেলের মাঝে নীলাকে একা রাখতে তানহা অনিচ্ছুক। তাই সে এই ব্যবস্থা করেছে। আজকাল শত্রুও বোধহয় ভিন্ন ভিন্ন রূপধারণ করতে পছন্দ করে। তাইতো এতো নির্দয়তার মাঝেও একটুখানি চিন্তা। সে দ্রুত পায়ে কাছে এসে জানতে চাইল,

— ‘ ম্যাম আর ইউ ওকে? ‘

তানহা আরও কয়েকবার দম নিয়ে বলল,

— ‘ হ্যাঁ ঠিক আছি। কিন্তু ভিতরের মেয়েটা ঠিক নেই। বমি করে পুরো রুম গন্ধ বানিয়ে দিয়েছে। তারউপর নবাবজাদি খাবারও নষ্ট করেছে। ‘

মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

— ‘ বোধহয় অতিরিক্ত ক্ষুধায় হঠাৎ খেয়ে বমি হয়েছে। দুইদিন যাবত তো তেমনকিছুই দেওয়া হয়নি৷ তাই…

সে থেমে গেল। তানহা কটমট চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে অপ্রস্তুত হলো। খানিকটা ইতস্ততবোধ হচ্ছে। কিন্তু নীলাকে সে দেখেছে। এমন মায়াভরা একটা মেয়ের সাথে এতো অত্যাচার তার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু সে নিজেও দুর্বল। পেটের দায়ে এসব জঘন্য কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু মায়াতো এতো সহজে কাটার নয়। তাই সে সাহস নিয়ে বলল,

— ‘ ম্যাম আবার কি নতুন করে খাবার দিব? না মানে..
— ‘ দিয়ে দিও৷ ‘

তানহা আর দাঁড়ালো না। রাগ নিয়েই কথাটা বলে গটগট পা ফেলে বেড়িয়ে গেল। মেয়েটা মৃদু হাসলো। তারপর নিজেই গিয়ে নীলাকে যতটুকু সম্ভব ফ্রেস করতে সাহায্য করলো। আর কিচেনে গিয়ে নতুনকরে খাবার আনলো। নীলা শুকনোমুখে মেয়েটার দিকে তাকাতেই সে ইশারায় খেতে বলল। শরীরটা বড্ড নিস্তেজ লাগছে। শরীরে যে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই সেটা নীলাও বুঝতে সক্ষম। তাই সে চুপচাপ খাবারের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু প্লেটের ঢাকনা উঠাতে গেলেই খাবারের গন্ধে আবারও ভিতরটা মুচড় দিলো। শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিয়ে সে তৃতীয়বারের মতো বমি করলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে নিলেই পাশ থেকে মেয়েটা এসে দ্রুত ধরল। সে নিজেও হতবাক। বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে তার সময় লাগলো, কিন্তু স্বাভাবিক লাগলো না। সে মাথায় চিন্তা নিয়েই নীলাকে ধরে ধরে মেঝেতে বসালো। তারপর গ্লাসের পানি এনে নাকে-মুখে ছিটিয়ে দিলো। কিন্তু তারপরও নীলাকে চোখ না খুলতে দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে নীলা জ্ঞান হারিয়েছে। সে দ্রুত মোবাইল বের করে কল লাগালো,

— ‘ ম্যাম তমা বলছি। মেয়েটার অবস্থা ভালো নয়। কিছু একটা করতে হবে নতুবা খারাপ কিছু হতে পারে। ‘
— ‘ কি বলতে চাচ্ছো তুমি? ‘
— ‘ আপনি যাওয়ার পর সে আবারও বমি করেছে এবং সেন্স হারিয়েছে। আমি পানি দিচ্ছি কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। আমার মনে হয় ডক্টর লাগ..

তানহা মেয়েটির মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে প্রচন্ড রাগ-আক্রোশভরা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ইডিয়ট! মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই? এই মুহূর্তে ডক্টরের কথা তুমি কোন মুখে বলো? জানো না ঐদিকে কি হচ্ছে? ‘
— ‘ সরি ম্যাম। কিন্তু মেয়েটা এভাবে থাকলে যখন তখন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আমি বোধহয় আপনাকে সেটা বুঝাতে পারছি। ‘

তানহা কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলো। অতঃপর বেশ গম্ভীরস্বরে বলল,

— ‘ঠিক আছে আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি ওর খেয়াল রাখো। ‘

তানহা কল কেটে দিলো। তার মাথায় চিন্তারা এসে ভিড় জমাচ্ছে। হ্যাঁ একটু দুর্বলতা মানা যায়। কিন্তু এইরকমভাবে বমি করার মানে কি? সে নিজেও তাকে ঐ অবস্থায় দেখেছে। সেইজন্য হিসাবটা মেলানো আরও কষ্টকর।

_____________________

তানবীর আর অর্ণব সাদিদকে চেপে ধরে রয়েছে। রাগে তার ফর্সা বর্ণের শরীর লালচে হয়ে গিয়েছে। সে অনবরত সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে। দুইজনে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েও তাকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সে আবারও রাগীস্বরে গর্জে উঠল,

— ‘ হেই অফিসার, কি ভাবিস তুই নিজেকে? তুই যত বড় পোস্টেই থাকিস না কেন, আমার পাখিকে নিয়ে বাজে কথা বললে তোর ঐ জিহ্বা আমি টেনে ছিঁড়ে নিবো। ‘

একজন আইনের লোককে এতো বড় কথা বলায় মুহূর্তেই পুলিশ স্টেশনে হইচই লেগে গেল। যেই অফিসারটাকে উদ্দেশ্য করে রাগের মাথায় সাদিদ এসব বলেছে সে এসে এলোপাতাড়ি সাদিদকে আক্রমণ করলো। সাদিদ মুখ থুবড়ে মেঝেতে পরেছে। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে হাতের মুঠি শক্ত করে পাল্টা মার দিতে গেলেই অর্ণব এসে সামনে দাঁড়ালো,

— ‘ সরে যা অর্ণব। আমিও দেখবো এই হারামি কি করতে পারে। আমার পাখিকে নিয়ে খারাপ কথা বলে আবার আমাকেই আঘাত করা! সামনে থেকে সর। ‘

অর্ণব সরে দাঁড়ালো না। উল্টো দুইজনে জোর খাঁটিয়ে তাকে থানা থেকে বের করলো। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে তানবীরের উদ্দেশ্য অর্ণব বলে উঠল,

— ‘ সাদিকে কোনোভাবেই বের হতে দিবি না। আমি দুই মিনিটে আসছি৷ ‘

বলে সে দ্রুত পায়ে থানার ভিতরে গেল। আল্লাহ না করুক আজকে খারাপ কিছু একটা ঘটে যেত। এখনও বিপদ পুরোপুরি কাটেনি। সাদিদের বর্তমান মানসিক অবস্থা আর তাদের সম্পূর্ণ পরিচয় জানিয়ে যদি কোনোভাবে ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়া যায়। নতুবা আইনের লোকের সাথে এমন দুর্ব্যবহারের জন্য সাদিদকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। সে দ্রুত পায়ে অফিসারের কাছে চলে গেল।
এদিকে সাদিদ অনবরত গাড়ির দরজায় ঘুষি মেরে নিজের রাগ দমাতে চায়ছে। কিন্তু কোনোভাবেই রাগটা যেন পরছে না। শরীর আগুনের মতো জ্বলছে তার। সে আচমকাই জোরে চিৎকার করে উঠল,

— ‘ পাখি! ‘

দরজা জানালো বন্ধ থাকাতে পুরো শব্দটা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। সাদিদ মাথা হেলিয়ে দিলো। তার নিজেকে বড্ড অসহায় অসহায় লাগছে।
তানবীর তার ঘাড়ে হাত রাখলো। অন্যসময় হলে থানার ভিতরের সাদিদের পাগলামি নিয়ে দুই-চার কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু এই মুহূর্তে পারছে না। বিগত দিনগুলোতে এই ছেলেটার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে সে স্বয়ং নিজে তার সাক্ষী। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম নিজের যাবতীয় সব কাজ বাদ দিয়ে সে পাগলের মতো এখানে-সেখানে নীলার খোঁজ চালিয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট, অলিতে-গলিতে গিয়ে নীলার ছবি দেখিয়ে তাকে দেখেছে কি-না জিজ্ঞেস করেছে। বলতে গেলে আইনি সহযোগিতা ছাড়া ব্যক্তি হিসেবে কাউকে খোঁজে বের করার কোনোরকম গাফিলতি করেনি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে এবং এখনও করছে। আজকে নীলাদের মিরপুরের বাসা থেকে বেড়িয়ে সোজা পুলিশ স্টেশনে মিসিং রিপোর্ট করতে এসেছিল। তার এখন ফ্যামিলির রেপুটেশন নিয়ে ভাবার সময় নেই৷ নীলাই তার জন্য সর্বপ্রথম। কিন্তু থানাতে এসে হলো আরেক ঝামেলা। পুলিশ অবশ্যই সবকিছু জেনে তারপর রিপোর্ট ফাইল করবে। সেইজন্যই নীলার সম্পর্কে সবকিছু জানতে চেয়েছে। সাদিদ কোনো মিথ্যা বলেনি৷ নীলার বিয়ের আসর থেকে নিখোঁজ ধরে চিঠির সবকিছু বলেছে। সবশুনে অফিসার প্রথমেই সাদিদদের বোকা বলে অক্ষায়িত করে৷ আজকাল মেয়েরা তার প্রেমিক পুরুষের হাত ধরে অহরহ বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নীলা চিঠি লেখে সব জানিয়ে যাওয়ার পরও সাদিদদের এমন মিসিং ফাইল করাতে হাসাহাসিও করেছে৷ একসময় একজন নীলার নাম জড়িয়ে কটু বাক্য উচ্চারণ করতেই সাদিদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। চেপে রাখা রাগের বশে অফিসারের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসে।
তানবীর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর সাদিদের কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,

— ‘ কুল ডাউন ইয়ার। নিজেকে সামলা। ‘
— ‘ পারছি না দোস্ত। আমি আর পারছি না। আমার পাখিকে ছাড়া আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। তাকে যে আমার প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। ‘

সাদিদের কন্ঠ ধরে এসেছে। সে আর অর্ণবের আসার অপেক্ষা করতে পারলো না। ধরা গলায় প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলল,

— ‘ গাড়ি ডাইভ কর। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ আই সেইড স্টার্ট দ্য কার। ‘

এতক্ষণের শান্ত সাদিদের হঠাৎ এমন গর্জনে তানবীর কিছুটা থমকে গেল। তাকে বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে না দিয়েই সাদিদ একপ্রকার ধাক্কিয়ে তাকে ডাইভিং সিট থেকে সরালো। সেকেন্ড সময় না ব্যয় করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দৃষ্টির বাহিরে চলে গেল। অপরদিকে ফাঁকা রোডে তানবীর ফ্যালফ্যালিয়ে সাদিদের গাড়ি চলে যাওয়া দেখলো। কি হলো বিষয়টা?
সাদিদ প্রচন্ড অস্থিরতায় গাড়ি ডাইভ করছে। নামেমাত্র শান্তি তার মাঝে নেই। এসি চলাকালীনও ঘেমে অস্থির। সে বাম হাতে শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খোলে দিলো। তারপরও শান্তি লাগছে না। সে মাঝরাস্তায় জোরে গাড়ি ব্রেক কষলো। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখগুলো ঢলে নিলো। তার বড্ড কান্না পাচ্ছে। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। কান্নাটা হয়তো তার সাথে বেমানান তাই সে জোরপূর্বক নিজের কান্না চেপে রাখতে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু কান্না দূর করতে পারলেও ভিতরের কষ্টটা যে দূর করতে পারছে না। কষ্টগুলো চেপে গিয়ে দমবন্ধ লাগছে। শেষ সম্বল হিসেবে সে পকেট থেকে ফোনটা বাহির করলো। পুরো গ্যালারি ভরা নীলার বিভিন্ন মুহূর্তের স্মৃতি দ্বারা। অর্ণবের বিয়েরকার একটি ছবির উপর এসে সাদিদ থামলো। নীলাকে সাদিদ এখানে-ওখানে দৌড়াদৌড়ির জন্য একটু বকা দিয়েছিল। আর সেটাতেই সে গাল, ঠোঁট, নাক ফুলিয়ে রেখেছিল। সাদিদ রাগ কমাতে গিয়ে উল্টো তার রাগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। গালদুটো জোরে টিপে ধরেছিল। আর তাতেই নীলা রক্তিম গালে সাদিদের উপর রণমুর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্যামেরাওয়ালা তখনকার এই মোমেন্টটা তাদের অগোচরে ক্যাপচার করেছে। পরে সাদিদকে দেখাতেই সে চট করে নিজের কাছে সেটা সংরক্ষণ করেছিল। এখনও তার চোখের সামনে সেই ছবিটা। সে আঙুল দিয়ে নীলার রাগী মুখশ্রীতে নজর বুলালো। ভীষণ মায়া আর নিচুস্বরে বলল,

— ‘ প্রাণপাখি, কোথায় তুমি? দেখো না তারা সবাই কিসব বলছে? তুমিই বলো তোমাকে নিয়ে এসব কি আমি সহ্য করতে পারব? কেন তারা বুঝতে চায়ছে না? আমার পাখি কখনও তার সাদিদকে ছেড়ে যেতে পারে না৷ তুমিই বলো পারে কি? ‘

সাদিদ কৃত্রিম মুখশ্রী থেকে কয়েক মুহূর্ত উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো। তারপর নিজেই বলে উঠল,

— ‘ না পারে না। কোনোভাবেই পারে না। আমার পাখি তার সাদিদকে ভীষণ ভালোবাসে। আমিও আমার পাখিকে ভালোবাসি। খুব খুব খুব বেশিই ভালোবাসি। ‘

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here