অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৪৭

0
5214

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৭

ডক্টরের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। রুগী দেখতে এসেছে নাকি জীবন হারাতে এসেছে সেটা বুঝা মুশকিল। চারপাশে এতো এতো গার্ড দেখে তিনি ভয়ে শুকনো একটা ঢুক গিললেন। নীলার শারীরিক কন্ডিশন জেনে তানহা এবং ইমরান দু’জনই এখানে হাজির হয়েছে। ইমরান এবার অধৈর্য্যে গলায় বলে উঠল,

— ‘ এই ডক্টর, এতক্ষণ কি দেখেন? কি হয়ছে ওর? ‘
— ‘ আপনি কে হোন উনার? ‘
— ‘ তোর জম হই। যেটা বলছি সেটার উত্তর দে। ‘
— ‘ স..রি সরি। আসলে সি ইজ প্রেগনেন্ট। দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা তিনি। ‘

ডক্টরের মুখ নিঃসৃত শব্দটা পুরো রুমের উপর দিয়ে যেন ভূমিকম্পের মতো প্রবাহিত হলো। নীলার দুর্বল চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। তার কাঁপা হাতটা মুহূর্তেই পেটের উপর এসে অবস্থান করলো। আর গাল বেয়ে গড়াতে লাগল নোনাজলের ধারা। তানহাও অবাক। নীলা প্রেগনেন্ট? কিন্তু কিভাবে কি?
ইমরান নিজেও অবাক। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে তার শরীর রাগে কেঁপে উঠল। সে নিচু হয়ে মুহূর্তেই নীলার চুল টেনে ধরল৷ আচমকা এতো জোরে চুলে টান পড়াতে নীলা ব্যাথায় কুঁকড়ে গেল। চোখভরে জল বেড়িয়ে আসতে লাগলো৷ পেটের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে সে দুইহাতে নিজেকে ইমরানের থেকে ছাড়াতে চায়ছে। কিন্তু ইমরান সেটা হতে দিচ্ছে না।

— ‘ পেট বাঁধিয়ে বসে আছিস? হ্যাঁ পেট বাঁধিয়ে? আর আমি যখন একটু ছুঁতে চাইলাম তোর গায়ে ফোঁসকা পরে! চরিত্রহীনা মেয়ে৷ তোর মতো মেয়েকে নিয়েই তোর বাপ-মা আমার পরিবারকে ফিরিয়ে দেয়? আমার পায়েরও যোগ্য নস তুই। ‘

বলেই সে নীলার চুলের মুঠিটা জোরপূর্বক ঝাকিয়ে ছেড়ে দিলো। নীলা কাত হয়ে একপাশে পড়ল৷ মহিলা ডক্টরটা তাকে ধরতে যেতে চায়লেই আশেপাশের পেয়াদাদের দেখে সাহস করতে পারলেন না। তিনি শুধু নিচু কন্ঠে বললেন,

— ‘ এইসময় উনার সাথে এমন করবেন না। প্রেগন্যান্সির এটা খুব রিক্সি টাইম। সামান্য একটু ভুলে মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে। ‘

নীলা আতংকিত চেহারা নিয়ে দুইহাতে নিজের পেট চেপে ধরল। আর ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে একেবারে দেয়ালের সাথে চেপে বসলো। সে অনবরত মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে না করছে। কারো এতে মায়া জন্ম না হলেও উপস্থিত ডক্টর এবং তমা মেয়েটার ভীষণ খারাপ লাগলো। নীলার নিশ্চুপতাও তারা বুঝতে পারছে। কিন্তু চেয়েও কিছু করতে পারছে না।
ইমরান নিজের রাগ মেটাতে চেয়ারে জোরে একটা লাথি দিলো। সত্যি কথা বলতে তার সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে নীলার ভার্জিনিটি নিয়ে। সে ভার্জিন নয় এটা যেন ইমরানের বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ নীলার প্রতি ভালোবাসা তার কোনো কালেই ছিলো না। কেবলমাত্র মেয়েদের প্রতি তার ঝোঁক বরাবরের মতোই একটু বেশি ছিলো। নীলা যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে মায়ের সাথে তার নানু বাড়িতে যায় তখনই তার উপর ইমরানের বদ নজর পড়েছিল। এরআগে দেখাসাক্ষাৎ কম হওয়াতে নীলার মুখোমুখি তেমন একটা হয়নি সে৷ আর নীলারাও পড়াশোনা, বাবার ব্যস্ততা সব মিলিয়ে খুব একটা নানুবাড়ির দিকে যায় না৷ সেবারই নীলার পরীক্ষা শেষ, তারউপর নানার জন্য মসজিদে মিসকিন খাওয়াবে বিধায় সব মামারা মিলে আয়োজন করলো। মোটামোটি সবাই সেখানে উপস্থিত হলো। নীলা তখন কৈশোর পেরিয়ে সবেমাত্র শরীরে যৌবনের ঘ্রাণ লাগিয়েছে। তাই ইমরানের খারাপ নজর খুব সহজেই তার ভরাট শরীরে পরে যায়। নানার মিলাদের দিন সন্ধ্যায় কারেন্ট না থাকাতে সবাই মিলে উঠোনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। নীলাও সেখানে উপস্থিত ছিলো। পানি পিপাসা পাওয়াতে সে জায়গা ছেড়ে খাওয়ার রুমের দিকে যাচ্ছিলো। এটাই যেন ইমরানের জন্য মূখ্য সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে বহুক্ষণ যাবত এমন একটা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশেষে পাখি যখন নিজ দায়িত্বে খাঁচায় বন্দি হতে চেয়েছে তাহলে সে আটকাবে কেন?
রুমে লাইট বলতে ছোট একটা চার্জার লাইট জ্বলছিল। নীলা পানি খেয়ে যেই না পিছু ঘুরতে গেল ইমরান হাত টেনে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরেছিল। নীলার কোমড়ে একহাতে চেপে ধরে আঙুল দিয়ে গালে স্লাইড করতে করতে বলেছিল,

— ‘ বাহ্, কি শরীর বানিয়েছিস রে? শহরে থেকে থেকে বুঝি আমাদের গ্রামের ছেলেদের মাথা খাওয়ার ধান্দা? ‘
— ‘ ছিঃ ভাইয়া, কি বলছো এসব? প্লিজ ছাড়ো। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ‘
— ‘ ইশশ ছিঃ বলিস কেন? তোরা শহুরে মেয়েগুলোতো ছেলেদের শরীরের উষ্ণতা পেতে হুড়মুড়িয়ে থাকিস। আমি কিছু জানি না বলছিস? ‘
তার ক্রমাগত অসভ্যতাপনায় একদিকে নীলার যেনন অস্বস্তি চেপে ধরেছিল অপরদিকে প্রচন্ড ঘৃণা। তাইতো ইমরান যখন হুট করে কিছু না বলে নীলার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে চাইল, নীলা আর কিছু না ভেবে তার গালে সজোরে থাপ্পড় মারে। সেইসময় ছোটো খালামণি খাবার রুমে আসছিলেন। ফলে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তিনি বুঝতে পারে। পরে এটা নিয়ে নানারকম কথাবার্তা হয়। দোষটা যেহেতু ইমরানেরই বেশি তাই তার মা-বাবা চেয়েছিল এসব জানাজানির চেয়ে ভালো ছেলে-মেয়ে দুইজনের হাত এক করে দেওয়া। কিন্তু বেঁকে বসে নীলার বাবা-মা দুইজনই। সবার সামনে এটা প্রকাশ না করলেও তাদের মনে ছিল মরে গেলেও আদরের মেয়ের হাত এমন চরিতহীন ছেলের হাতে তুলে দিবে না৷ সেখানে অর্থ-সম্পদের কোনো কারণ তারা দেখায়নি। শুধু বলেছে থাক ছেলে মানুষ তারা। ভুল একটা হয়ে গিয়েছে। আমরা এটাকে বাদ দিলেই হয়। নীলার বাবার কথায় পরিস্থিতি তখন স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হতে পারেনি ইমরান৷ কিভাবে তাকে শিক্ষা দেওয়া যায় তার মাথায় বরাবরই এটা ঘুরতো। কেননা এই ঘটনার পরেও ইমরান তার বাবা-মাকে দিয়ে নীলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। কিন্তু নীলার পরিবার সেটা নাকচ করে। তাই জেদ আরও চেপেছিল ভালো করে। নীলাসহ এই পরিবারের মানসম্মান কিভাবে রাস্তায় নামাবে এটাই তার চিন্তা থাকতো। কিন্তু কেন যেন এতো চেষ্টা করেও নীলার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সবসময় কেউ যেন অদৃশ্য থেকেও নীলাকে রক্ষা করে যেত৷ তাইতো ঢাকায় থেকেও অনেকবার নীলাকে উঠিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু সে বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। অদৃশ্য শক্তির কাছে তার পরাজয় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তাইতো যখন নীলার এনগেজমেন্ট পার্টির পরেরদিন তানহা তাকে এই প্রস্তান দেয় সে একসেকেন্ড সময় নষ্ট না করে হ্যাঁ করে দেয়। তানহা পার্টিতে খুব ভালোভাবেই ইমরানকে লক্ষ্য করেছিল। তার দৃষ্টি কেবল নীলাতেই স্থায়ী ছিলো। তখন তার ভুল ধারণা জন্মেছিল ইমরান হয়তো নীলাকে পছন্দ করে। তাই যদি কোনোভাবে ইমরানের কাছে নীলাকে গচ্ছা দেওয়া যায় সাদিদ পুরোপুরি তার হবে। তাইতো পার্টির পরেরদিনই দুইজন একত্রে হাওয়া হয়েছিল। আর সে বাসায় জানিয়েছে রিফ্রেসমেন্টের জন্য বেড়িয়েছে। কিন্তু তারা এখানে নির্ভুল প্ল্যান সাজাতে ব্যস্ত ছিল। সবটাই যেন কাকপক্ষীর নজরের বাহিরে থাকে সেই হিসেবেই সকল প্ল্যান করেছে। আর তারা সাকসেসফুল তাদের কাজে। নীলাকে বাসা থেকে অপহরণ পর্যন্ত, চিঠি এবং এখানে নিয়ে আসা অব্দি এখন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি৷ আর না আশা করা যায় পারবে। কেননা তারা সাজিছেই প্ল্যানটা এমনভাবে।
ইমরান পূর্বের কথা মনে করে আরও রেগে গেল। নিজের রাগ কমাতে সে দেয়ালে পরপর দুইটা ঘুষি দিলো৷ তারপরও রাগ যেন ক্ষণে ক্ষণে তরতর করে বাড়ছে শুধু। সে পিছন ফিরে নীলার দিকে তাকিয়ে আবারও বিরক্তিকর ভাব ফুলিয়ে তুললো। কোথায় সে ভেবেছিলো নীলার আত্মসম্মান হরণ করে তাকে বেশ লাঞ্ছিত করবে। কিন্তু তার আগেই মিষ্টিতে কেউ ভাগ বসিয়েছে এটা যেন তার হজম হচ্ছে না। সে মুখে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করলো,

— ‘ ধ্যাত। ‘

হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে তানহা পাগলের মতো হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে যেন পেটে খিল ধরে যাবার অবস্থা তার। উপস্থিত সবাই অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এখানে হাসির কি হয়েছে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না৷ কিন্তু নীলার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। বাচ্চার অস্তিত্ব জানার পর থেকেই সে ভয়ে চুপসে রয়েছে। এই হৃদয়হীন পাষাণ মানুষগুলোর মধ্যে তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে ভয়ার্ত-চিন্তিত। তানহা হাসতে হাসতেই চুপসে যাওয়া নীলার দিকে একপলক তাকালো৷ তাতে যেন তার হাসির পরিমাণ আরও বাড়লো। সে নীলার দিকে আঙুল তুলে বিদ্রুপ স্বরে বলল,

— ‘ এই, এই মেয়েটার জন্য সাদি আমার ভালোবাসা প্রত্যক্ষাণ করেছে? সিরিয়াসলি! আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না সাদির চয়েজ এতটা নিম্নমানের হতে পারে। অবশ্য বেচারার আর কি-ই বা দোষ? প্রেমে পড়লে সবাই অন্ধ। যাকগে ব্যাপার না। আমি আছি না? আমিই তার চোখে আলো ফুটিয়ে দিব। কিন্তু আফসোস হচ্ছে এটা ভেবে যে, এই খুশির খবরটা তাকে এই মুহূর্তে আমি দিতে পারছি না৷ নতুবা সবাই আমাকেই দোষরূপ করতে পারে। ইশশ বড্ড দুঃখজনক ব্যাপার। ‘

বলেই সে আরও একদফা হাসলো। ইমরান এমনিতেই রেগে বোম৷ তারউপর তানহার কথাগুলো আগুনের উপর ঘি ঢালার কাজ করেছে। সে আবারও নীলার দিকে তেড়ে গেল। একহাতে দুইগাল শক্ত করে চেপে ধরতেই ডক্টর বাঁধা দিতে চাইল। কিন্তু সে তাকেও পরোয়া করলো না৷ ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে নীলার গাল চেপে গর্জে উঠল,

— ‘ চরিতহীনা। বল কোন নাগরের পাপ নিয়ে নিজের পেট বাঁধিয়েছিস? বল হারাম** কার পাপের ফল দিয়া সতিত্ব নষ্ট করেছিস, বল। ‘

অন্যসময় কেউ এমন কথা বললে নীলা লজ্জায় কুঁকড়ে যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে ইমরানের উপর ঘৃণায় তার দম আটকে আসছে। তার মুখের উপর থুথু ছিটিয়ে দিতে পারলে বোধহয় এই ঘৃণার পরিমাণ কিছুটা কম হতো। তাকে নিশ্চুপ দেখে ইমরান আরও রেগে গেল। বামহাতে নীলার নরম গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে বলল,

— ‘ চুপ করে আছিস কেন? বল। আমাকে কাছে ঘেঁষতে দেস না অথচ কার সাথে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরিছিস? কার অবৈধ্য সন্তান এটা? ‘

ইমরান যতোটা না গর্জে কথাটা বলল নীলা এর তিন ডাবল জোরে ইমরানের গালে কষিয়ে আবারও পূর্বেকার ন্যায় একটা থাপ্পড় লাগালো। সকলেই আচমকা চুপসে যাওয়া নীলার এমন কান্ডে স্তব্ধ। ইমরান গালে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে নীলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ করে এই মেয়ের এতটা সাহস কোথায় থেকে এসেছে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। ইমরান নিজের রাগ সামলে নীলাকে আবারও থাপ্পড় মারতে উদ্যত হতেই সে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে দেয়াল ধরে ধারালো। রুমের সবার দিকে আঙুল তুলে হুঁশিয়ার করলো,

— ‘ খবরদার। খবরদার যদি কেউ আমার বাচ্চাকে নিয়ে অপবাদ দিয়েছো তো। এতক্ষণ আমাকে বলেছো, সহ্য করতে কষ্ট হলেও করার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু আমার সন্তানকে জড়িয়ে বৈধতার কথা তুললে কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না৷ ‘

নীলার কন্ঠ নেমে আসলো৷ সে মলিন চোখে হাসলো। অতঃপর আলতো হাতে পেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,

— ‘ ও..ও আমার সন্তান। না. না ও তার বাবা-মায়ের সন্তান। আমাদের সন্তান। তার বাবামায়ের পবিত্র ভালোবাসার উপহার হিসেবে আল্লাহপাক আমার গর্ভে তাকে পাঠিয়েছেন। খবরদার যদি আর কখনও আমার সন্তানের বৈধতা দিয়ে বিচার করতে আসবে তো। ‘

কিছু মুহূর্ত সবাই স্তব্ধ হয়ে থাকলেও তানহা নীরবতা ভেঙে এগিয়ে আসলো। মুখে তার এখনও হাসির রেখা। নীলার কথাগুলোতে তার নেহাৎই আজগুবি মনে হচ্ছে। বিয়ের আগে বাচ্চা পেটে নিয়ে বলছে এটা নাকি বৈধ সন্তান! এটাতো হাস্যকর বিষয়ই। সে মুখে হাসি নিয়েই বলল,

— ‘ আহারে অবশেষে তাহলে মেয়েটা পাগলই হয়ে গেল। এতোটা নিচু কাজ করেও গলা উঁচিয়ে কথা বলছো! এজন্যই লোকে বলে ছোটলোকের বলা গলা। বিষয়টা কিন্তু একেবারেই সত্য৷ ‘

সে আবারও বিদ্রুপের স্বরে হাসলো৷ নীলার চোখে-মুখে রণমুর্তি ভাব ফুটে উঠেছে। এতক্ষণ নিজেকে দুর্বল লাগলেও এখন যেন মায়ের শক্তি তার শরীরের সব দুর্বলতা হরণ করেছে। সে তো মা, আর মায়েদের কখনও দুর্বল হতে নেই৷ সে পেটে হাত রেখে তানহার দিকে কয়েককদম এগিয়ে গেল। তেজি গলায় বলল,

— ‘ পাগল আমি হইনি, হয়েছো তোমরা৷ আর তোমাদের পাগলামি কিভাবে ছুটাতে হয় সেটা বাবুর আব্বু খুব ভালো করেই জানে। যখন জানতে পারবে তার গর্ভবর্তী স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তোমরা কি বাজে বাজে কথা বলেছো, সেই মুহূর্তের অগ্রীম স্মৃতি আমার চোখে ভাসছে। ইশশ তোমাদের মুখ দেখার মতো হবে। ওর বাবা কাউকে ছাড়বে না। সবকটাকে গুণে গুণে হিসাব ফেরত দিবে৷ উনি কিন্তু নিজের হিসাবে বড্ড পাকা। একচুল পর্যন্ত বাকিতে হিসাব রাখবে না। সো গাইস গেট রেডি। খুব শীঘ্রই তোমাদের কর্মের ফল ভোগ করবে। ‘

তানহা এসব বড় বড় কথায় ভীষণ রেগে গেল। এই মেয়ের হঠাৎ এতো সাহস হচ্ছে কিভাবে? এতগুলো মানুষকেও সে পরোয়া করছে না। তানহা নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না৷ রাগীস্বরেই বলল,

— ‘ মুখ যত বড় নয় কথা তত বড়! এতো যে পেটের সন্তানের অস্তিত্ব নিয়ে গর্ব করছিস, বাপ ছাড়াই সন্তানের এতো কদর? স্বামী ছাড়া সন্তানের জন্য এতো বড়াই? জানিস তো তোদের মতো মেয়েদেরকে এই সমাজ কি বলে? বে..
— ‘ বাকিটুকু বলে নিজের পাপের বোঝা আর বাড়িয়ো না আপু। উনি সহ্য করবে না। ‘
— ‘ এখনও মুখে খই ফুটছে! শুনিতো কে উনি? আমিও জানতে চাই কার বাচ্চার বাবার হয়ে তুই এতো বড় মুখে কথা বলছিস। বল শুনি৷ ‘

রাগে শেষোক্ত কথাটা বলতে তানহা চেঁচিয়ে উঠল। নীলা তাতে দমে গেল না। বরং প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে নীলাও জোর গলায় বলে উঠল,

— ‘ সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার। এই সন্তানের পিতার নাম সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার। বাবা-মায়ের পবিত্র ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সে এসেছে। ও আমাদের সন্তান। বুঝেছো তোমরা? ‘

নীলার কথাটা শেষ হতে না হতেই তানহা সজোরে তার গালে থাপ্পড় বসালো। নীলা আচমকা আক্রমণে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে মেঝেতে পড়ল। কাঠের চেয়ারের কোণা লেগে কপালের বেশ খানিকটা জায়গা কেটে গিয়েছে। মুহূর্তেই লাল বর্ণের তরল পদার্থ কপাল বেয়ে পড়তে লাগল। নীলা কপালে হাত দিয়ে রক্তের অস্তিত্ব টের পেয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল। সে নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না। বরং এখন তার সম্পূর্ণ ভয় তাদের ভালোবাসার প্রতিককে নিয়ে। সাদিদের অনুপস্থিতিতে তার আমানতকে সে রক্ষা করতে পারবে কি-না সেটা নিয়েই তার ভয়। এই মানুষরূপী অমানুষগুলোর মাঝে সে পারবে তো নিজের অনাগত সন্তানকে রক্ষা করতে?
তানহার রাগ যেন তার রক্তের মধ্যে মিশে গিয়ে জ্বলে উঠছে। সাদিদকে জড়িয়ে এসব সে একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। সে তেড়ে এসে আবারও নীলার ডানগালে থাপ্পড় বসালো। এতোটা জোরে ছিলো যে দাঁতের সাথে ঠোঁট লেগে খানিকটা কেটে গিয়েছে। উপস্থিত সবাই কেবল নীরব দর্শক। এতগুলো মানুষের সামনে বাচ্চা মেয়েটার উপর এতো এতো অত্যাচার হচ্ছে, অথচ সবাই নিশ্চুপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে চায়ছে। ইমরানও বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসেছে। তার এই মেয়ের উপর থেকে রুচি উঠে গিয়েছে। সে হাজারো মেয়ের বেলা অসভ্যতামী করুক তাতে কোনো খারাপ নেই। কিন্তু নীলার এমন কান্ডে সে যথেষ্ট বিরক্ত। নীলার শরীর এবার প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। একেতো না খাওয়া, তারউপর তাদের এমন নির্মম অত্যচারে নীলার চোখ ক্রমশ নেতিয়ে আসছে। সে মেঝেতে হেলে পরতে নিলেই তানহা তার বাহু খামচে ধরলো। নখ বোধহয় সুতি জামা বেঁধ করে বাহুতে এটে যাচ্ছে। ব্যাথায় নীলা দুর্বল চোখজোড়া মেলে ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তানহা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে প্রচন্ড ক্ষেপা স্বরে বলল,

— ‘ চুপ। আর একবার যেন তোর ঐ নোংরা মুখে আমার সাদির নাম না শুনি৷ সে আমার ছিলো এবং চিরকাল আমারই থাকবে। তোর মতো নোংরা মেয়ের সাথে তার পায়ের জোতাও যায় না। কোন সাহসে তুই তোর অবৈধ সন্তানের ভাড় আমার সাদির উপর চাপাতে চাস? কোন সাহসে? ‘
— ‘ ভালোবাসার সাহসে। স্ত্রীর অধিকারে। ‘
— ‘ স্ত্রী! ‘
— ‘ হ্যাঁ স্ত্রী। স্বামী হন উনি আমার। পুরো ধর্মীয় নিয়মানুসারে এবং নগদ দেনমোহরের পরিশোধে আমি উনার বিয়ে করা বউ। ‘

তানহার কানে যেন তব্দা লেগে রয়েছে। বউ, স্ত্রী, স্বামী, বিয়ে কথাগুলো যেন এখনও তার মাথার উপর দিয়ে ঘুরছে। তার সাথে সাথে রুমে উপস্থিত সবকটা মানুষের কানেও যেন বজ্রপাতের ন্যায় নীলার বাক্যগুলো ছিল। সবাই একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এতদিনতো জেনে এসেছিল বিয়ের আগে কনেকে অপহরণ করে তুলে এনেছে। আজ জানলো কি? মেয়ে না-কি পূর্বেই বিবাহীতা! আবার এখন বাচ্চাও হাজির!

___________________

প্রয়োজনীয় কার্ড, নগদ ক্যাশ, পাসপোর্ট এবং ফোনটা পকেটে নিয়ে বাসা থেক বের হতে নিলেই শায়লা রহমান পিছন থেকে সাদিদকে ডেকে উঠলেন। সাদিদ থামলো কিন্তু পিছনে ফিরলো না। তার মা তাকে এই মুহূর্তে কি বলতে পারে সেটা সে অনুমান নয় বরং গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে। শায়লা রহমান ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে বেশ বিরক্ত হলেন। এই কয়েকদিনে তার ছেলেটা তার দুটো কথা শুনে দেখেনি৷ মা হিসেবে সম্মান রক্ষাতে মুখের উপর কথা বলে না৷ কিন্তু কথা শুনেও না৷ এক মহা ঝামেলায় পরেছেন তিনি।

— ‘ কি ব্যাপার? এই সময় কোথায় যাচ্ছিস? ‘

সাদিদ দেয়াল ঘড়িতে একনজর তাকালো৷ পাসপোর্ট এবং কিছু টাকার প্রয়োজন না পরলে এই মুহূর্তে সে ভুলেও বাসায় আসতো না৷ যেহেতু মুখোমুখি হতেই হয়েছে তাই উত্তরও দিতে হবে। সে সামনে তাকিয়ে সোজাসাপটা জবাব দিলো,

— ‘ নীলাদের গ্রামের বাড়ি। ‘
— ‘ কি? কি বললি তুই? ‘
— ‘ যা শুনতে পেয়েছো ঠিক তাই বলেছি৷ আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। ‘
— ‘ খবরদার সাদি। যদি এই রাতে চট্টগ্রামের পথে রউনা দিস তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ‘
— ‘ এই মুহূর্তে তোমার চেয়ে খারাপ কেউ হতেও পারবে না মা। তোমার সম্মান আমার কাছে কতো উঁচুতে সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তেমনিভাবে নীলাঞ্জনার প্রতি রয়েছে স্বামী হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব। বিপদের সময় আত্মীয় স্বজনদের পাশে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। কিন্তু তুমি কি করছো? এতটা নির্দয় তো আমার মা হতে পারে না। তুমি এই মুহূর্তে আমার মা নও। তুমি কেবল আভিজাত্যের চাদরে ঘেরা মিসেস হাসিবুর রহমান। আমার মা এতটা পাষাণ হতে পারে না। ‘
— ‘ যা আমি পাষাণ-ই। নিজ সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে যদি আমাকে পাষাণের উপাধি দেওয়া হয় তাতে আমার আপত্তি নেই৷ ‘

সাদিদ পা ফেলে কয়েককদম এগিয়ে আসলো। শায়লা রহমানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মায়ের মুখটা আঁজলাভরে ধরে কপালে চুমু দিলো। এতক্ষণ নিজের মধ্যে ধরে রাখা ঝাঁঝালো রূপটা তিনি আর দেখাতে পারলেন না। ছেলের আদরমাখা মমতায় তার বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে দিলেন। সাদিদ তাকে সযত্নে বুকে আগলে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ এইতো আমার মা। এতদিন আমার এই মা টা কোথায় ছিলো? ‘

ছেলের আদর পেয়ে মায়ের মন আরো গলে গেল। কিন্তু তিনি মুখে কিছু বলতে পারলেন না। সাদিদ তার মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ভালোবাসি মা। খুব ভালোবাসি। ভালোবাসার সাথে সাথে শ্রদ্ধাও ভীষণ করি৷ তাই এমন কাজ করো না যাতে করে মুখ ফিরিয়ে রাখতে হয়। ‘

শায়লা রহমান মাথা তুলে অভিমানী নজর দিতেই সাদিদ তার মাথায় চুমু দিলো। মায়ের অভিমানের পাহাড়টা গুড়িয়ে দিতে পরমুহূর্তেই বুকে আগলে ধরল। অতঃপর বলল,

— ‘ তেমনিভাবে নীলাঞ্জনাকেও আমি ভীষণ ভালোবাসি মা। সে শুধু আমার ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সঙ্গে রয়েছে তার প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য। নিজের দায়িত্ব থেকে পিছুপা তারাই হয় যারা কাপুরষ। আর আমিতো কাপুরষ নই, আর না তোমরা আমাকে তেমন শিক্ষা দিয়েছো৷ তাই মা, আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দাও। ভালোবাসার মানুষকে যে শুধু ভালোবাসলেই হয় না। বিশ্বাসও করতে হয়৷ আমি নীলাঞ্জনাকে বিশ্বাস করি মা। সাথে নিজের ভালোবাসার উপরও প্রচন্ড বিশ্বাস করি। কেবলমাত্র একটি চিঠি হাতে পেয়ে আমি তার উপর থেকে নজর সরিয়ে নিতে পারব না। আমার বিশ্বাস সে আমাকে কখনও ছেড়ে যেতে পারবে না৷ যদি কখনও এমনটা সত্য হয়ে দাঁড়ায় তার পিছনেও নির্ঘাত কোনো সত্যতা লুকিয়ে রয়েছে। এবং আমাকে এখন সেই সত্যিটুকুই খুঁজে বের করতে হবে৷ যার জন্য নীলাঞ্জনাকে আমার প্রয়োজন। তাই আমাকে যেতে দাও মা। ‘

সাদিদ তাকে ছাড়িয়ে দ্রুত সদর দরজা পেরিয়ে বেড়িয়ে গেল। শায়লা রহমান ছেলের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সে আর পিছু ডাকবে না৷ এরপরও নিজের ভুল বুঝতে না পারলে তিনি নিজেকে হয়তো কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না। সাদিদ তার চোখে অপার ভালোবাসার এক নিদর্শন তুলে দিয়ে গিয়েছে। ছেলের এমন মনোভাবে সে মা হয়ে গর্বিত। কতজন ছেলে তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে এতটা ভাবে? সবাই যখন তার বিপরীতে তারপরও কিভাবে ঠাঁই আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?
ছেলেটা চলে গিয়েছে। নতুবা তিনি তাকে ডেকে এনে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতেন,

— ‘ এতোটা ভালো কবে বাসলি বাপ? তোর মাও তো হয়তো এতটা ভালোবাসার গভীরতা দেখেনি, যতটা না আজ তোর চোখে নীলার জন্য ভালোবাসা প্রবাহমান। ‘

.

সাদিদ ক্যাব ডেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য চলতে শুরু করলো। বাহিরে মৃদু হাওয়া বয়ছে। ঝিরিঝিরি বাতাশে আধখোলা জানালে দিয়ে মৃদু বাতাশ এসে সাদিদের সিল্কি চুলগুলোকে ক্রমাগত নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যদিও চুলগুলো বড্ড নির্জীব-এলোমেলো। কয়েকদিনের অবহেলা, অযত্নে যেন তারাও নিজেদের প্রাণ হারিয়ে বসেছে। সাদিদের সেদিকে খেলায় নেই৷ সে শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। মনে চলছে ঝড় সাথে হাজারো চিন্তা। চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা শুনে অর্ণব এটাকে সম্পূর্ণ বোকামি বলেছে। শত হলেও নীলা যদি পালিয়েই গিয়ে থাকে তাহলে ধরা পরার জন্য নিশ্চয়ই নিজের এলাকায় যাবে না?
কিন্তু সাদিদ তারপরও সেখানে যেতে চায়। নীলার যাওয়ার মতো যায়গা রয়েছে এমন কোনো স্থান সে বাদ রাখতে চায় না৷ আশার শেষ বিন্দু পর্যন্ত সে যাবে। প্রয়োজন পরলে শুধু চট্টগ্রাম নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গায় সে নীলার খোঁজ চালু রাখবে। তবুও তার প্রাণপাখিকে সে খোঁজে বের করতে চায়। শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে তার এতটুকুই প্রার্থনা যেন নীলা যেখানেই থাকুক না কেন ভালো থাকুক। অন্ততপক্ষে সাদিদ তাকে খোঁজে বের করা অব্দি তাকে যে ভালো থাকতেই হবে৷

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here