অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ ০৯

0
7115

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ০৯

শান্ত ভিজে শরীরে রুমে প্রবেশ করতেই কিছুটা অবাক হলো। নীলাকে এমন স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎকন্ঠা স্বরে বলল,

— ” এভাবে মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ”

নীলা প্রশ্নের উত্তর দিলো না। মাথার মধ্যে ইতিমধ্যে প্রশ্নের পাহাড় জমে সেখানে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। তারমধ্যে আরেকটা প্রশ্নের জায়গা এই মুহূর্তে নীলা করতে চাচ্ছে না। চুপচাপ রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তাদের রুমটা সাদিদের পাশেই পরেছে। তাই এই বারান্দা থেকে ঐ বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। নীলা একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কারণহীন এক স্থির দৃষ্টি। শান্ত প্রিয়তী ততক্ষণে শুকনো জামা পরে টুকটাক গল্প করছে। তাদের গল্পের কিছু অংশ নীলার কর্ণকোহরে এসে ভারি খাচ্ছে। কিন্তু নীলার তাতেও কোনো নড়চড় নেই। তার স্থির দৃষ্টি সামনের রুমের বারান্দায়।

— ” রাগ তুলিস না তানবীর। পরে মাইর খাইয়া বুজ পাবি না…

তোয়ালে দিতে বারান্দায় এসেছিল সাদিদ। পাশেই নীলাকে এমন স্থীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও তাকালো। নীলার তাতেও কোনো নড়চড় না দেখে, সাদিদ এবার একটু কেশে গলা পরিষ্কার করল,

— ” নীলাঅঞ্জনা? ”

সাদিদের ডাকে নীলা হুঁশ ফিরল। তাকে আবারও সামনে দেখে নীলার এবার প্রচন্ড লজ্জা লাগল। সে আর কিছু ভাবতে পারল না। এক দৌড়ে রুমে ঢুকল।
সাদিদ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে হেসে দিলো। তারপর নিজেও রুমে ঢুকল।

— ” তা কি ঠিক করলি? ”

— ” কি নিয়ে? ”

— ” এরমধ্যে ভুলে গেলি? রাতের প্ল্যান। ”

— ” দেখ এরমধ্যে আমি নেই। অর্ণবকে বল। ”

— ” হেতেরে বইলা লাভ কি? হেতে তো প্রিয়ু ছাড়া শ্বাসও নেয় না। কোনদিন না নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া মইরা যায়। ”

— ” এই তোর সমস্যা কি? সব কথার মধ্যে প্রিয়ুরে টানস ক্যান। ”

— ” বিকজ সী ইজ চুলকানি। তারে দেখলে আমার শরীর চুলকায়। ”

— ” অর্ণব থামতো। সারাদিন খালি তোরা লাগালাগি করিস। ”

— ” আমি কি করলাম? সবসময় তো হে শুরু করে। ”

— ” নয়তো কি করতাম হা…

— ” দোস্ত চুপ কর। এমনিতেই আমার মেজাজ খারাপ। তারউপর তোদের এই নয়ছয় বিরক্ত লাগছে। ”

— ” কুল বয়ের হট হবার কারণ কি? ইজ এভরিথিং ওকে? ”

— ” নট ওকে। যতক্ষণ না সবগুলোকে তুলে আছাড় না দিতে পারছি ততক্ষণ শান্তি হচ্ছে না। ”

— ” যাক অবশেষে এবার তাহলে আমরা একটু নিস্তার পেলাম। নতুবা তোর প্রেয়সীর তদারকিতে কাজ-টাজ ফেলে সময়-অসময়ে আমাদের দৌড়াতে হতো। ”

— ” বালা কথা মনে কইছস। দে এতবছরের বডিগার্ডগিরির সবটাকা ফেরত দে। মাসে মিনিয়াম বিশহাজার ধরলেও লাখখানেক হইয়া যাইব। ”

সাদিদ এবার মাথা চুলকে হাসল। বন্ধুগুলো মাথায় রাগ নিয়ে থাকতে দেয় না। এইটা-সেইটা বলে মেজাজ ঠিক করে ছাড়বেই।

লাঞ্চের টাইমে আবারও সবার দেখা পাওয়া গেল। সাদিদ টেবিলে বসে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু নীলার কোনো ছায়া পর্যন্ত দেখে যাচ্ছে না। তাই খাওয়ার অযুহাত নিয়ে বলল,

— ” ভাবীমণি, নীলাঅঞ্জনা কোথায়? লাঞ্চ করবে না? ”

— ” ওর নাকি মাথা ধরেছে তাই আসেনি। আম্মু মাত্রই রুমে খাবার নিয়ে গেছে। ”

— ” ওহ্। ”

সাদিদের হাত চলছে না। তখন কি বেশি হয়ে গেল? কিন্তু সে আর কি করবে, রাগটা যে কমছিল না। তখন নীলাকেই রাগ নিয়ন্ত্রণে আনবার জন্য একমাত্র অবলম্বন মনে হয়েছে।
সাদিদ তেমন খেল না। জুস খেয়ে উঠে দাঁড়াল।

— ” কিরে খাবি না? ”

— ” মা খিদে নেই। একটু পরে খেয়ে নিব। তোমরা লাঞ্চ করো। ”

সাদিদ কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। রুমে এসেও শান্তি নেই। অস্বস্তিরতায় ঠিকভাবে বসাও যাচ্ছে না।
সাদিদ দরজা ঠেলে পাশের রুমের দিকে হাঁটা ধরল।

নীলা খাবার সামনে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। তার কিছুই ভালোলাগছে না। লজ্জা-জড়তা যেমন ঘিরে ধরেছে, সাথে এসে যুক্ত হয়েছে অগণিত প্রশ্ন।
সাদিদের এমন অদ্ভুত ব্যবহার নীলা বুঝে উঠতে পারছে না। তারপর কিছুক্ষণ আগের সেই স্পর্শ! নীলার মাথা পুরোপুরি হ্যাং মেরেছে। একবার পজিটিভ কিছু চিন্তা করলেই দ্বিতীয়বার নেগেটিভের ছড়াছড়ি।
এমতাবস্থায় দরজায় নক পরল। নীলা ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল,

— ” দরজা খোলা আছে। ভিতরে আয়। ”

চিন্তায় এত মগ্ন যে শান্ত যে রুমে আসেনি নীলার সেদিকে খেয়াল নেই। সাদিদ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে নীলার পাশে বসল। খাবার এখনও প্লেটে দেখে গম্ভীরস্বরে বলল,

— ” খাওনি কেন? ”

নীলা হকচকিয়ে ফিরে তাকালো। সাদিদকে পাশে দেখেই আবারও পূর্বের ন্যায় লজ্জা পেল। কিছুটা ইতস্ততবোধ নিয়ে মাথা নিচু করে বলল,

— ” খেতে ভালো লাগছে না। ”

— ” আমি খাইয়ে দিব। ”

সাদিদের কথা শুনে নীলার বিষম উঠে গেল। পাশের টেবিল থেকে পানি নিয়ে সাদিদ এগিয়ে দিতেই, নীলা ঢকঢক করে পানি শেষ করল। নীলার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সাদিদ নিজে প্লেট হাতে নিলো। বিনাবাক্য নীলার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরল।

— ” হা করো। ”

নীলাও বিনাবাক্য মুখে খাবার নিলো। শকে বোধহয় উপস্থিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। সাদিদ-ই প্রথম বলল,

— ” সময় দিয়েছি বিধায় সারাজীবন পার করে দিবে? ”

— ” মানে? ”

সাদিদ একপলক মুখ উঠিয়ে নীলার দিকে তাকালো। কিন্তু উত্তর দিলো না। চুপচাপ খাইয়ে যাচ্ছে। নীলার মাথায় প্রশ্ন, মনে প্রশ্ন এমনকি পেটেও হাজার রকমের প্রশ্নের গড়াগড়ি। কিন্তু কোনো উত্তর নেই।
সাদিদ বিনাবাক্য খরচ করে প্লেটের সব খাবার শেষ করল। পানির গ্লাস মুখে তুলে দিতেই নীলা এবার গ্লাসে হাত রাখল। লজ্জা-জড়তা ভুলে আবেগমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল,

— ” উত্তর দিলেন না যে? ”

— ” কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া পাপ। সেসব উত্তর খোঁজে নিতে হয়। ”

— ” খোঁজে পাচ্ছি না। ”

— ” সত্যিই কি পাচ্ছ না? ”

নীলা হাত ছেড়ে দিলো। দৃষ্টি নিচে নিক্ষেপ করল। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল খানিকটা খুঁটে নিয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ” ভয় হয়। যদি উত্তর মিথ্যা হয়। কষ্ট সহ্য করতে পারি না। ”

— ” যদি কষ্ট সহ্য করতে না হয়? যদি উত্তর পছন্দের তালিকায় স্থান পায়? তখন? ”

নীলার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি দেখা গেল। সত্যিই যদি হয়। সত্যিই যদি ভালোবাসার মানুষটা তাকেও ভালোবাসে? নীলা ঠোঁটের হাসি বজায় রেখেই আবারও বলল,

— ” আমি চাই। এমনটা হোক আমি সেটা খুব করে চাই। ”

সাদিদ এবার হাসল, মিষ্টি হাসি। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠল,

— ” আজ পূর্ণিমা। সুইমিংপুলের ডানপাশে রাতে কেউ অপেক্ষা করবে। ”

সাদিদ বেরিয়ে গেল। নীলা অপলক দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার এখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দরকার নেই। এই মানুষটা সাথে থাকলে সে হাজারও প্রশ্ন ভান্ডারের নিচে চাপা পরতে রাজি। তারপরও যদি সেই মানুষটা পাশে থাকে, তাতেই নীলা সন্তুষ্ট।

— ” ইশশ কখন যে রাত হবে? ”

নীলা নিজেই হাসল। একসময় হাজির আওয়াজ বৃদ্ধি পেল। তারপরও সে হাসি থামাল না। সে আজ খুব খুশি। তাই হাসির আওয়াজও বেশি।

__________________

গায়ে হালকা চাদর মুড়িয়ে গুটিশুটি মেরে নীলা শুয়ে আছে। ঘণ্টাখানেক আগে থেকে সে শান্তকে বকবক থামিয়ে ঘুমাতে বলছে।
কিন্তু সে তার পকপকে ব্যস্ত। প্রিয়তী বয়সে বড় তাই তাকে কিছু বলা যাচ্ছে না। নীলা না পেরে এবার লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। ঘুমিয়ে পরার তীব্র অনুরোধ। কিন্তু তারপরও শান্তর মনে দয়া হলো না। সে এখনও তার ঐতিহাসিক গল্পে ব্যস্ত সময় পার করছে।

— ” এই তুই ঘুমাবি? ”

— ” তুই আমার ঘুমের পিছনে লাগছিস কেন? তুই ঘুমা, আমি পরে ঘুমাব। ”

— ” প্লিজ দোস্ত চল না ঘুমিয়ে পড়ি? ”

— ” অসম্ভব! ঘুম আসছে না ঘুমাব কিভাবে? ”

— ” মাথায় হাত বুলিয়ে দেব। কাছে আয়। ”

— ” ব্যাপার কি? তুই আমার ঘুমের পিছনে এমন হাতধুয়ে লেগেছিস কেন? ”

নীলা শুকনো কাশল। তারপর কন্ঠে স্নেহ-মমতা সবকিছু ঢেলে দিয়ে বলল,

— ” একা একা ঘুমাতে ভালো লাগছে না। কাছে আয়, একাসাথে ঘুমায়। ”

শান্ত গলে গেল। প্রিয়তীকে গুডনাইট বলে বিছানায় শুয়ে চাদর টানল।
টিক টিক করে ঘড়ির কাটা বারোটা পেরোতেই, নীলা শান্তর হাতটা নিজের উপর থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মুখের চাপা হাসি যেন বাহিরে না চলে আসে তাই মুখ চেপে ধরে আছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে শান্ত-প্রিয়তীকে ভালোভাবে পরখ করল। না, দেখে মনে হচ্ছে দু’জনই গভীর ঘুমে আছন্ন।
নীলা শরীরে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। মনে আনন্দের ঢেউ নিয়ে গুটিগুটি পায়ে দরজা ঠেলে বাহিরে আসলো।
রিসোর্ট এখন পুরো নিরিবিলি। কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ, গা ছমছম করছে। নীলার বরাবরই ভূতে ভয়। এই উন্নত মানের রিসোর্টে ভূত থাকে না এমন হাজারটা স্বান্তনা ইতিমধ্যে নিজেকে দেওয়া শেষ। তারপরও মন-মস্তিষ্ক ভয়ে জড়সড়। নীলা ভয়ার্ত চোখেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল।
সুইমিংপুলের পাশে আসতে পেরে সে নিঃশব্দে হাসল। এতক্ষণের ভয়-ডর সব চলে গিয়েছে। সাদিদ ডানপাশে বলেছিল তাই ঐ দিকে গেল।
কিন্তু সাদিদকে দেখতে পেল না। এদিক-ওদিক পর্যবেক্ষণ করেও যখন সাদিদের দর্শন পাওয়া গেল না, নীলার বুক চিড়ে তখন কষ্টের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

— ” উত্তরটা হয়তো সাধ্যের বাহিরে। আমিই বোকা কি বলল আর কি বুঝে খুশি হয়ে গেলাম। ”

একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নীলা যাবার জন্য পিছন ঘুরল। কিন্তু পারল না, পিছন থেকে হাতে টান পরল।
সাদিদ তাকে কোনোকিছু না বলেই টেনে নিয়ে যেতে লাগল। নীলার কি অনুভূতি হচ্ছে সেটা সে নিজেই আন্দাজ করতে পারছে না। শুধু পায়ে পা মিলিয়ে সাদিদের পিছনে যেতে লাগল।
সাদিদ একেবারে রিসোর্টের বাহিরে গিয়ে থামল। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল,

— ” গেইটের লোকদের ম্যানেজ করতেই এসেছিলাম। তোমাকে রাত বলেছি বিধায় এত লেইট করবে কে জানে? আর তারাও গেস্টদের নিরাপত্তার জন্য এতরাতে বের হতে দিবে না। তাই রিকোয়েস্ট করতে হয়েছে। ”

— ” আমাকে এসব বলতে হবে না। ”

— ” তাই বুঝি? ”

বলেই সাদিদ এগিয়ে আসলো। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে নীলা চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো। সাদিদ মৃদু হেসে বুকে হাত বেঁধে বলল,

— ” তাহলে তখন ঐসব বলার মানে কি? ”

নীলা দৃষ্টি নত করল। মানে সাদিদ তার কথাগুলো শুনে নিয়েছে। সাদিদ আবারও নীলার হাতের মুঠো ধরতেই নীলা দ্রুত তাকালো।

— ” অনেক অন্ধকার। পরে গিয়ে ব্যাথা পাবে, এই রিক্স আমি নিতে রাজি নই। ”

সাদিদ কথাটা গম্ভীরস্বরে বললেও নীলার অত্যধিক ভালো লাগল। মুখে হাসি নিয়ে সে সাদিদের দেখানো গমনপথ অতিক্রম করতে লাগল। সাদিদ পাশ ফিরে নীলাকে দেখল। পুর্ণিমার চাঁদের আলোয় নীলার মুখের হাসি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সাদিদ হাত বাড়িয়ে একহাতে নীলাকে জড়িয়ে নিলো।
নীলা চোখ বড় করে তাকাতেই নিজেই বলল,

— ” কেবল ধরে রেখে ব্যালেন্স করতে পারছি না। হাত-পা ভাঙবে এই রিক্স নিতে পারব না। ”

নীলা এবার হাসি আটকাতে পারল না। খানিকটা উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সাদিদও হাসছে, কিন্তু নিঃশব্দে।

— ” আপনি এমন কেন? ”

— ” কেমন? ”

— ” ভূতের মতো। ”

সাদিদ বুঝেও না বুঝার ভান ধরাতে নীলা এবার বিরক্ত হলো। খানিকটা চাপা রাগ নিয়ে কথাটা বলল। সাদিদ আচমকা নীলাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কোমড় চেপে ধরল। নীলা হতচকিয়ে সাদিদের মুখের দিকে তাকালো।

— ” তাহলে ভূতের মতো খেয়ে ফেলি? ”

সাদিদের মুখের ভঙ্গি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। নীলা খানিকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে নিলে সাদিদ আরও চেপে ধরল।

— ” কি হলো উত্তর দাও। ভূতের মতো হলে তাদের ন্যায় গাপুসগুপুস খেয়ে ফেলি? ”

নীলার এবার ভয় হচ্ছে। লোকমুখের নানান কথার মধ্যে ভূত-প্রেতের আছড় বলে একটা কথা প্রচলিত। এই অন্ধকার, শুনশান গাছগাছালির মধ্যে থেকে কোনো ভূত-পেত্নী সত্যিই সাদিদকে আছড় করে ফেলে নিতো?
নীলার ভয়াতুর দৃষ্টি ক্রমশ বাড়তে লাগল। কেননা সাদিদ তার দিকে নিজের মুখ এগিয়ে আনতে লাগল।
সে কি সত্যিই নীলাকে আজ খেয়ে ফেলবে নাকি?

— ” প্লিজ আমাকে খা..বেন না। ”

মুহূর্তেই নীলা ভাসমান অবস্থায় নিজেকে খোঁজে পেল। কি হলো এইটা?
সাদিদ কি তার পা খেয়ে নিয়েছে নাকি? নতুবা পা কোথায়?
নীলা বোকার মতো পা নাড়াতে লাগল।

— ” পা খায়নি। এমন নড়াচড়া করলে ঠিক-ই খেয়ে নিব। ”

— ” হুটহাট কোলে নেন কেন? ”

— ” ব্যাথা পেয়ে পা ভাঙবে এই রিক্স আমি নিতে পারব না। ”

নীলার লজ্জা লাগছে। এমনভাবে কারও কোলে উঠলে লজ্জা যে লাগার-ই কথা। তারউপর ছেলে হলেতো আরও বিপদজনক। নীলা কন্ঠে জড়তা নিয়ে বলল,

— ” নিচে নামিয়ে দিন, আমি পরব না। ”

সাদিদ পাত্তা দিলো না। উল্টো নীলাকে আরেকটু শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
অদ্ভুত ভালোলাগায় নীলার শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। একটা ছেলে একটা মেয়েকে এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায় কোলে নিয়ে হাঁটছে। বিষয়টা মেয়েটার জন্য লজ্জা, এমনকি ভয়ংকর লজ্জাজনক। কিন্তু নীলার ভালোলাগছে। লজ্জা লাগলেও ভালোলাগার পরিমাণটার ওজন সেক্ষেত্রে অনেক বেশি।

হলুদবাতি লাগানো স্থির হয়ে দাঁড়ানো এক রিক্সার সামনে এসে সাদিদ থামল। নীলাকে রিক্সার সিটে বসিয়ে দিতেই চালক বলে উঠল,

— ” ভাইজান মেলা রাইত কইরা লাইছেন। বহুহখন ধইয়া বইয়া আছি। ”

— ” মামা ক্ষমা করবেন। ইচ্ছে করে দেরী করিনি, এই ম্যাডামের জন্য লেইট হলো। ”

— ” আইচ্ছা আফনি ভন ওহন এমনোই দেরী অইয়া গেছে। ”

সাদিদও এবার সিটে চড়ে বসল। নীলা কেবল নীরব দর্শকের ন্যায় তাকিয়ে সবটা দেখল। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
নীলা অন্যমনস্ক থাকায় রিক্সার ঝাঁকুনিতে পরে যেতে নিলেই সাদিদ দ্রুত আগলে নিলো। রাগীস্বরে ধমকে উঠল,

— ” খেয়াল কোথায় থাকে? এখনই পরে যেতে। ”

বলেই পেছন দিয়ে একহাত নিয়ে নীলার কোমড় চেপে ধরল। সাদিদের এমন স্পর্শে নীলার শরীর কেমন যেন করছে। তাই মাথা নিচু করে বলল,

— ” ছেড়ে দিন। এবার ভালোভাবে ধরে রাখব। ”

সাদিদ ছাড়ল না। এমনকি নীলাকে ধরতেও দিলো না। টান মেরে নিজের পাশে নিয়ে আসলো। কোমড়ে হাত চেপে রেখে একেবারে নিজের শরীর ঘেঁষে বসাল।
নীলার অবস্থা খারাপ। সাদিদের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ নীলাকে ক্রমশ নড়বড়ে করে দিচ্ছে। ছেলেটা এমন কেন? পুরো শরীর অসার করে দেয়।

— ” আরেকটু নড়লে কিছু একটা করে বসব কিন্তু। ”

— ” কি.. কি.. করবেন? ”

নীলার লেগে যাওয়া কন্ঠ শুনে সাদিদ ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। কানের পাশের চুলগুলো পিছনে গুঁজে দিয়ে মুখ লাগিয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ” যুবক-যুবতীর রিক্সায় হুড তোলা নিষেধ। আর তুললে সেটা গভীর কিছু। আমি সেই গভীর কিছুই করব। ”

নীলা জামা খামচে ধরল। সাদিদের গরম নিঃশ্বাসগুলো এসে তার কানে-গলায় লাগছে। শরীর ক্রমশ শিহরিত হয়ে উঠছে।
নীলা ভদ্র মেয়ের মতো নড়াচড়া থামিয়ে দিলো। একেবারে স্থির কাঠ হয়ে বসল।
সাদিদ দুষ্টু হেসে নীলার কানের লতিতে ঠোঁট স্পর্শ করল।
নীলা চোখ-মুখ খিঁচে অন্যদিকে তাকালো। তার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। সাদিদ মুখ তুলে নীলাকে এমন অবস্থায় দেখে মৃদু হাসল। নিজের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিয়ে, আবছা অন্ধকারে নীলার লজ্জামাখা মুখটা দেখতে লাগল।

__________________

ঘুমের মধ্যে কেউ চাদর ধরে টানাটানি করাতে শান্ত আবারও টান মেরে শরীরে চাদর দিলো।
কিন্তু এতো মহাবিপদ! বারবার চাদর চলে যাচ্ছে।
শান্ত ঘুমে চোখ বন্ধ রেখেই জড়ানো কন্ঠে বলল,

— ” নীল বেবি, চাদর টানিস না। শীত লাগে। ”

কিন্তু না আবারও চাদর টানাটানি। বিরক্তিতে শান্ত ঘুমের মধ্যেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল।

— ” লাথি খাস না। রাতেরবেলা এমন টানাটানি করতাছস ক্যান? ”

কিন্তু আবারও চাদরে টান পরতেই শান্ত রেগে গিয়ে উঠে বসল। কিন্তু একি! রুম পুরো অন্ধকারের রাজ্য। সবুজ আলোর ডিম লাইটাও নেই। জানালার পর্দাগুলোও টানা দেওয়া। এককথায় রুমের মধ্যে আলোর বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা নেই। রুমের এমন ছমছমে অবস্থায় শান্তর কিছুটা ভয় লাগল। হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে নীলাকে খোঁজতে লাগল। কিন্তু নীলার কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না।
শান্তর এবার ঠান্ডার মধ্যেও ঘাম ছুটতে লাগল। কাঁপা স্বরে ডেকে উঠল,

— ” নী..ল? ”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে একটু পিছিয়ে গিয়ে আবারও ডাকল,

— ” নী..ল আছিস? দিদি..ভাই? এই দিদিভাই। ”

শান্তর এবার সত্যিই প্রচন্ড ভয় লাগছে। নীলা-প্রিয়তীর নিঃশব্দতা যেন ভয়ের মূল কারণ। এখন গলা দিয়ে আর শব্দও বের হচ্ছে না। হাত বাড়িয়ে ফোন খোঁজতে লাগল, কিন্তু দরকারের সময় কিছুই পাওয়া যায় না। শান্তর ভয়ে
কন্ঠ লেগে আসছে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। কোনোমতে বলল,

— ” কে..উ কথা বলো আ..মার ভয় করছে। ”

কথার পিঠে কোনো উত্তর আসলো না, কিন্তু সাদা কাপড়ে মুড়ানো একটা বস্তু এগিয়ে আসতে লাগল। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সাদা বস্তুর মাথার পাশে লাল রঙের বৃত্তাকার দুটো লেজার লাইটের আলোর ন্যায় জ্বলতে লাগল।
শান্ত পিছাতে পিছাতে একেবারে বিছানার পাশের দেওয়ালে লেগে গিয়েছে। শরীর তার মুহূর্তেই ঘেমে চুবচুবা। এখন আর কথাও গলা দিয়ে বের হচ্ছে না। বড্ড পানি পিপাসা পাচ্ছে।
সাদা বস্তু এগিয়ে এসে এবার শান্তর বিছানার সামনে দাঁড়াল। শব্দহীন মাথা দুই-একবার উপরনিচ করল। শান্ত কাঁপা হাতে মুখ শক্ত করে চেপে ধরে আছে। প্রাণপণ ইচ্ছা উপস্থিত বস্তু যেন তাকে না দেখতে পায়।
বস্তুটি এসে শান্তর বিছানার কিনারায় বসল। সাদা বস্তু স্থির হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।
শান্ত কি এখন দৌড় দিবে? নাকি সাদা বস্তুর পাশে এভাবেই শ্বাসরুদ্ধ করে বসে থাকবে?

সাদা বস্তু কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানায় উঠতে লাগল। চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় সে বিছানায় পা গুটিয়ে উঠতে লাগল।
শান্তর চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার গলা কাঠ, ভিতর শুকিয়ে মরুভূমি। শব্দ কি এইমুহূর্তে ‘শ’ উচ্চারণ করাও সম্ভব নয়। জন্তুটি এগিয়ে এসে শান্তর মুখ বরাবর বসল।
শান্ত দুইহাতে শক্ত করে মুখ চেপে নিঃশ্বাস সম্পূর্ণ বন্ধ করার চেষ্টায়। শরীর ঘেমে একাকার।
সাদা বস্তু কিছুক্ষণ শান্তর সামনে বসে থেকে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পরল।
সময় যেতে লাগল সাদা বস্তু বিন্দুমাত্র নড়েচড়ে না। শান্তও স্থির। দমবন্ধ হয়ে আসছে। এখান থেকে যেতে হবে নতুবা আজ এখানেই তার শেষ নিঃশ্বাস হবে।
শান্তর সাহসে কুলাচ্ছে না। সে নড়লেই বস্তু টের পাবে। কিন্তু তার দম এসে গলায় আটকে রয়েছে। যে কোনো সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে।
শান্ত মুখে হাত চেপেই বিছানা থেকে লাফ দিতে গেল। কিন্তু পারল না, কেননা সাদা বস্তু উঠে বসে তার হাত চেপে ধরেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে কেবলমাত্র একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ ভেসে আসলো।

— ” মইরা গেলা..ম! ”

#চলবে…

[ পাঠকগণ আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের ভালোলাগা মন্দলাগাগুলো জানতে আগ্রহী। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here