অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ১০

0
6618

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১০

— ” উমম উম…

শান্ত অনবরত বিছানায় দাপাদাপি করছে। সাদা বস্তুটা তার মুখ শক্ত করে চেপে ধরেছে। মুখ দিয়ে বিন্দুমাত্র আওয়াজ বের করবার সামর্থ্য শান্তর নেই। অপরদিকে অন্ধকারে এত ভয় পেয়ে শান্ত ঘেমে-নেয়ে একাকার।

— ” উনতাবিছুম ইনতামিচু উতমাহু। ”

হঠাৎ ভয়ংকর ককর্শ কন্ঠ শুনে শান্ত এবার কেঁদেই দিলো। তার জীবনের বোধহয় আজ-ই শেষদিন। সাদা বস্তুটা মাথা খানিক এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে আবারও গর্জে উঠল,

— ” তিতবাহ ইনতামিতু উসজিনা শান্তর বাচ্চা। ”

— ” উমম উম..

— ” তুই শাস্তি পাবি। ”

সাদা ভূতের নিজস্ব ভাষা ছেড়ে হঠাৎ বাংলা ভাষায় নেমে আসাতে শান্ত কিছুটা অবাক হলো। কিন্তু অবাকের মাত্রা ভয়ের থেকে অনেক কম। কি করবে বা কি করা উচিত শান্তর মাথায় আসছে না। সে আকুতি জানাতে চাইল,

— ” ছে.. ছে..

সাদা ভূত এবার খানিকটা সহায় হয়ে তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো।

— ” প্লি..জ, প্লিজ ছে..ড়ে দিন। ”

— ” তুই শাস্তি পাবি। আর শাস্তি হচ্ছে আমি আজ রাতে খাইনি, তাই তোকে এখন খেয়ে ফেলব। ”

— ” না..

শান্ত সাহস সঞ্চয় করে চেঁচাতে গেলেই সাদা ভূত আবারও তার মুখ চেপে ধরল।

— ” সবসময় রাজা হাঁসের মতো এমন চেঁচাস কেন? এইজন্যই তোকে খেয়ে ফেলব। ”

শান্ত কেঁদে দিয়ে কিছু বলতে চাইলে, সাদা ভূত আবারও হাত খানিকটা ঢিলে করে দিলো।

— ” দোহায় লাগি, আমা..কে ক্ষমা করে দিন। আর জী..বনে কখনও চেচামেচি করব না। ”

— ” গুড গার্ল। ”

এমা সাদা ভূত দেখি ইংরেজিও পারে! শান্তকে ভয়ার্ত অবস্থার মধ্যে থেকেও, তার অবাক চাহনি দেখে সাদা ভূত তাকে জোরে ধমকিয়ে উঠল,

— ” গুড গার্লকে এবার খেয়ে ফেলব। উমা খুব টেস্টি হবে। ”

শান্তর শরীরের ঘ্রাণ একবার শুকে নিয়ে ভূতটা জিহ্বা দিয়ে আওয়াজ করতে লাগল। শান্ত বেচারি বাঁচার জন্য যে দোয়া পরবে এইটুকুও গুলিয়ে ফেলছে। সে আবারও কাঁদতে কাঁদতে ভূতের কাছে আকুতি জানাল,

— ” দয়া করে আমাকে খাবেন না। আমি এখনও বিয়ে করিনি। ইনফেক্ট আমি এখনও ক্রাশও খাইনি। ওহ্ সরি একটা খেয়েছি, তাও হবু দুলাভাইয়ের উপর। ”

সাদা ভূত এবার হেসে ফেলল। কিন্তু পরমুহূর্তেই কাশতে কাশতে নিজের গলা পরিষ্কার করে বলল,

— ” তুই দেখি হতভাগী! আর আমি অবলাদের খাই না। তাতে রুচি আসে না। এইজন্য তোকে আমি ক্ষমা করতে পারি। ”

— ” আপনি মহান। আপনার হৃদয় কোমল। আপনার ন্যায় এমন ভূত সব জায়গায় সৃষ্টি হোক। ”

— ” চুপ, দাঁত ফেলে দিব। তুই আমাকে ভং মারিস! ঠাটিয়ে মারব একচড়, একচড়েই তোর মাড়িখালি। ”

বলেই ভূত আবারও হাসল। শান্ত এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভূত মহাশয়কে পরখ করছে। এতক্ষণ ভয়ে ছিল বিধায় অন্যকিছু মাথায় আসেনি। কিন্তু এখন আসছে। ভূত মহাশয়ের কথাগুলো কার সাথে যেন মিলে যাচ্ছে। আর হাসির আওয়াজটা যেন আরও বেশি। কিন্তু এইমুহূর্তে তার মাথা কাজ করছে না।
সাদা ভূত শান্তর এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা বুঝতে পেরে আবারও ধমকে উঠল,

— ” বেয়াদব, ফাজিল। তুই কি এখন ভূতের সর্দারের উপরও ক্রাশ খাবি নাকি? ”

আচমকা ধমকে শান্তর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ব্যঘাত ঘটল। নিজের ভাবনাকে ভুল ভেবে সে ভূতের কাছে আকুতিভরা কন্ঠে বলল,

— ” না, না ক্ষমা করুন। অবুঝ আমি, বুঝতে পারিনি। আপনি রাগ করবেন না। আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিন। ”

— ” আচ্ছা, তুই যেহেতু অবুঝ তাই তোকে আমি ক্ষমা করতে পারি৷ কিন্তু একটা শর্তে। ”

— ” ভূত মহাশয় আমি সব শর্তে রাজি। ”

— ” খুব ভালো। তাহলে শুন, আজ থেকে ‘ত’ নামধারী সকল সুদর্শন যুবককে দেখলেই তুই তাদেরকে কদমবুসি করবি। তাদের চরণ স্পর্শ করতে দ্বিধা করবি না। ”

কিছুক্ষণ থেমে আবারও সাদা ভূত বলে উঠল,

— ” এই শর্ত যথাযোগ্যভাবে পালন করলে তোর শাস্তি মওকুফ করা হবে। ”

এই বলে ভূত মহাশয় উনার গুরত্বপূর্ণ বক্তব্যের ইতি টানলেন।
রুম অন্ধকার, সাদা ভূতের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু জানালার পর্দার ফাঁকফুকুরে যতটুকু আলো রুমে আসছে, তাতে উনার চলনে-ডলনে যে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সেটা ঠিকই বুঝা যাচ্ছে।
শান্তর না চাইতেও এখন ভূতের উপর প্রবল সন্দেহ হচ্ছে। যদিও ভূতের উপর মানুষের সন্দেহ করা যুক্তিসঙ্গত নয়, কিন্তু তারপরও শান্তর হচ্ছে। বিশেষ করে ‘ত’ বর্ণের নাম উল্লেখ করাতে সন্দেহটা আরও জোরদার হচ্ছে।
কিন্তু সে কোনো সন্দেহের সমাধান খোঁজে পাচ্ছে না। শান্তকে এমন চুপচাপ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভূত আবারও গর্জে উঠল,

— ” বেয়াদব মেয়ে, তুই এমন পিকে মুভির আমির খানের মত তাকাচ্ছিস কেন? দাঁত ফেলে দিব। ”

শান্ত এবার ভয় পেল না। বরং বুকে হাত বেঁধে সেও ধমকে উঠল,

— ” আধুনিক যুগের ভূত, তুই না আমি তোর দাঁত ফেলে দিব। ”

সাদা ভূতের হঠাৎ কাশি উঠে গেল। পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে, সে স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলো।

— ” আচ্ছা, আচ্ছা তুই হতভাগী মেয়ে। তাই আজকের মতো তোকে ক্ষমা করে চলে যাচ্ছি। ”

বলেই ভূত মহাশয় বিছানা থেকে নামতে গেলেই সে আটকে গেল। কেননা শান্ত ভূতের গলায় শক্ত করে দুইহাত দিয়ে চেপে ধরেছে।

— ” আরে বেয়াদব মেয়ে, তুই করছিস কি? আমি দম আটকে মরে যাবতো। ”

— ” তাই বুঝি, ভূতেরও দম আটকে যায়? আমার জানা মতে ভূতসমাজের সদস্যরা তো মরে যাবার পর-ই ভূত হয়। ”

— ” সর্দারদের মরতে হয় না। কিন্তু তুই এখন সত্যিই আমাকে মেরে ফেলবি। ছাড় বলছি। ”

কে শুনে কার কথা শান্ত নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সাদা ভূতের গলা আটকে ধরেছে।
ভূতবাবাও শক্তি প্রয়োগ করছে কিন্তু ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। অপরদিকে তার দম এসে গলায় আটকেছে।
তাই সাদা ভূত এবার হুমড়ি খেয়ে শান্তকে নিয়ে বিছানায় পরল। শান্ত তারপরও গলা না ছাড়াতে সে এবার কোনোমতে নিজের পরিধেয় কাপড়টা খোলতে লাগল।
মুখটা কোনোভাবে খোলে ভূত মহাশয় আটকে যাওয়া গলায় বলল,

— ” শা..ন্তর বাচ্চা গলা ছাড়। তুই আমা..কে সত্যিই মেরে ভূত বানিয়ে দিবি। ”

শান্ত হঠাৎ চমকে উঠল। সে ভূতের গলা ছেড়ে পিছন থেকে সামনে আসতেই তার চোখ ছানাবড়া।

— ” আপনি? ”

তানবীর অনবরত কাশতে লাগল। শান্ত সবকিছু ভুলে গিয়ে দ্রুত লাইট জ্বালিয়ে দিলো। পাশের টেবিল থেকে পানি এনে দিতেই, তানবীর ঢকঢক করে গ্লাস খালি করল।

— ” তুই মেয়ে না অন্যকিছু? এভাবে কেউ গলা চেপে ধরে? ”

শান্ত এতক্ষণ মানবতা দেখালেও এবারে ক্ষেপে গেল। সে বিছানায় লাফ দিয়ে উঠে বালিশ হাতে নিয়ে, ধুমধামে তানবীরকে একচুট লাগাতে শুরু করল।

— ” এই ফাজিল মেয়ে…

শান্তকে পায় কে। তানবীরকে একাধারে অগণিত বালিশ মাইর শুরু করল। তাকে থামাতে তানবীর জোর করে তাকে আঁকড়ে ধরল।

— ” ছাড়ুন বলছি। বেয়াদব ছেলে আমার হাত ছাড়ুন। ”

শান্ত নিজেকে ছুটাতে পাগলামি করতেই তানবীর তাকে বিছানায় ফেলে চেপে ধরল।

— ” চুপ। আর একটা আওয়াজ করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ”

— ” তোর থেকে খারাপ কেউ হতেও পারবে না। ছাড় আমাকে কুত্তার লেজ, বিড়ালের লেজ, গরুর লেজ…

— ” সব লেজ কেন? পুরোটা কেন নয়? ”

— ” তুই পুরোটার যোগ্য না। ছাড় বলছি। ”

তানবীর এবার হেসে ফেলল। সে শান্তকে ছেড়ে পাশে শুয়ে পেট ধরে হাসতে লাগল। শান্ত তেড়ে এসে আবারও মারতে গেলে তানবীর তাকে দুইহাতে আঁকড়ে ধরল।

— ” পুরোপুরি পাগল। ”

— ” তোর থেকে কম। আমাকে ভয় দেখিয়েছিস, এতবড় সাহস! ”

তানবীর তারপরও হাসতে লাগল। যা দেখে শান্তর রাগ তরতর করে বাড়ছে।
হঠাৎ তানবীর রাগে ফোঁসফোঁস করা শান্তর দিকে একদৃষ্টিতে তাকালো। শান্তর অবশ্য সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত।
আচমকা তানবীর শান্তকে একপ্রকার ধাক্কা মেরে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। তাকে আর কোনোকিছু না বলতে দিয়ে, সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
শান্ত খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও পরক্ষনেই রাগে গর্জে উঠল,

— ” কোথায় যাচ্ছিস? সাহস থাকলে আবার আয়। তোর হাড়গোড় ভেঙে আমি ভূতেদেরকে চল্লিশার দাওয়াত খাওয়াব। ”

___________________

নদীর পাড়ের শীতল বাতাশে গা ক্রমশ শিহরিত হবার জোগাড়। নীলা চঞ্চল দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে দেখছে। মুখে তার বিস্তৃত হাসি।

— ” খুব সুন্দর। ”

সাদিদ হাসল। সে নীলার হাতটা মুঠোতে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
তীরে একটা ছিপ নৌকা বাঁধা। কি ফুল ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু নৌকাটা পুরোটা জুড়ে ফুল দিয়ে সাজানো।

— ” এসব কি? ”

— ” কেন? ভালোলাগছে না? ”

— ” সেটা কথা নয়। এসবের মানে নি? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। ”

সাদিদ আবারও হাসল। নীলা এখনও চোখ বড় বড় করে তীরে বাঁধা নৌকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সাদিদ প্রথমে নৌকায় উঠে হাত বাড়িয়ে দিলো।

— ” উঠে আস। ”

নীলা চমকিত দৃষ্টি নিয়েই নৌকায় উঠল। সাদিদ তাকে সাবধানে নিয়ে নৌকার অপরপাশে বসিয়ে দিলো। হাঁটু গেড়ে নিচু হয়ে নীলার হাতদুটো নিজের হাতে নিলো।

— ” সেদিন বলেছিলাম না, নৌকায় বেড়াবে কি-না? পরে ঐ অবস্থার জন্য কথাটা রাখতে পারিনি। তাই আজকে এইসব আয়োজন। ”

নেভারল্যান্ডের সেদিনের কথা মনে হতেই নীলা মাথা নিচু করল। কি একটা পরিস্থিতিতে তারা সেদিন পড়েছিল! সাদিদ নীলার থুতনিতে হাত দিয়ে নিচু করে রাখা তার মুখটা উপরে তুলল।

— ” আজ আবার পুর্ণিমা। পুর্ণিমার রাতে কথা রাখতে পারলে মন্দ হয় না। তাই এতরাতে এখানে নিয়ে আসলাম। তোমার খারাপ লেগেছে? ”

নীলা নিঃশব্দে হাসল। সামনের ব্যক্তিটা কি বুঝে না? নীলার জন্য এইমুহূর্তটা কতটা মধুর।
নীলার ঠোঁটে হাসি দেখে সাদিদ উঠে দাঁড়াল। কেননা সে নিজের উত্তর পেয়ে গেছে। সাদিদ এককদম যেতেই নীলার ডাক,

— ” আপনি কোথায় যান? ”

— ” কোথায় আর যাব? মাঝিভাইকে ছুটি দিয়েছি। তাই আজকের জন্য তোমার নৌকার মাঝি সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার। ”

— ” আপনি মজা করছেন না তো? ”

— ” আমাকে দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে? আ’ম সিরিয়াস। ”

— ” আপনি নৌকা চালাতে পারেন? ”

— ” আজকেই ফাস্ট। ”

নীলা খানিক শুকনো কাশল। সাদিদ নিজের মত বানিয়ে নিয়েছে, তাই তাকে বলেও লাভ হবে না।
সাদিদ বৈঠা হাতে নিয়ে অপরপাশে বসল। প্রথম কয়েকমিনিট তাকে বেশ বেগ পেতে হলো। এদিকে যেতে চায়লে নৌকা ঐদিকে যায়।
এই সময়টুকু নীলা হেসে কুটিকুটি।

— ” এত হাসার কি হলো? স্বাভাবিক একটা বিষয়। ”

— ” স্বাভাবিক বিষয় বিধায় হাসি আটকাতে পারছি না। ইংল্যান্ডে এতবছর পড়াশোনা করে এসে কেউ নৌকা চালাচ্ছে, এমনটা সচারাচর চোখে দেখি না। তাই হাসি কন্ট্রোল হচ্ছে না। ”

— ” তাহলে সেটা বলো। এত কষ্ট করে হাসার দরকার কি? আমাকে বললেই তো হাসির রাস্তা বন্ধ করে দিব। কি আসব নাকি? ”

নীলা বুঝল না, তাই সে সাদিদের দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু সাদিদের নিচের ঠোঁট কামড়ানো দেখে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিজের মনেই আওড়ালো,

— ” অসভ্য পুরুষ। ”

— ” জোরে বলো। গালিগালাজ জোরে করতে হয়। ”

নীলা লজ্জা পেল। জিরাফের কান বললেও ভুল হবে না। নীলা ইতস্ততবোধ নিয়েই বলল,

— ” এতদূর যে চলে আসলাম কেউ যদি জানতে পারে? আপনি আগে বললে ভালো হতো। ”

— ” এতরাতে কে জানবে? আর জানলেও সমস্যা কি? ”

নীলা নখ খুঁটতে লাগল। সাদিদ নীলাকে পর্যবেক্ষণ করে আবার বলল,

— ” তোমার সমস্যা হলে বলতে পার। ”

— ” না, আমি নিজের জন্য বলিনি। ”

— ” কিন্তু বলার তো কথা। মোটামোটি অপরিচিত একটা ছেলের সাথে এতরাতে একা আছ, সমস্যা অবশ্যই হবার কথা। ”

নীলা উত্তর দিলো না। কথা সত্য হলেও নীলার মাথায় একবারও এইসব আসেনি। কেন জানি সাদিদকে সে অবিশ্বাস করতে পারে না। বারবার নিয়ন্ত্রণহীন মনটা জোর গলায় এক কথায় বলে, এই ছেলেটা নিজের জীবন থাকতে নীলার ক্ষতি করবে না। এমনকি কাউকে ক্ষতি করার চেষ্টা অবধি করতে দিবে না।

— ” আমাকে ভয় করছে না? যদি তোমার এই একাকিত্বের সুযোগ নেই? ”

সাদিদের এমন কথায় নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। কিন্তু মুখে উত্তর দিলো না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই দিয়ে ফেলেছে।
নীলাকে লাজুক হাসতে দেখে সাদিদও হাসল। বৈঠার আঘাতে নদীর পানিতে ছলাত ছলাত আওয়াজ হচ্ছে। অনেকটা সময় বৈঠা চালিয়ে সাদিদ নৌকা প্রায় মাঝ নদীতে নিয়ে আসলো। আশেপাশের ঘরবাড়ি-গাছগুলোকে এখান থেকে বেশ ছোট দেখা যাচ্ছে। পুর্ণিমার চাঁদের আলোতে নৌকাটা বেশ উজ্জ্বল। সাদিদ এবার বৈঠা রেখে উঠে দাঁড়াল। মাঝ বরাবর এসে নীলাকে ডাকল।

— ” এখানে আস। ”

নীলাও আস্তে পা ফেলে এগিয়ে আসলো। সাদিদ মৃদু হেসে নীলাকে নিয়ে মাঝ নৌকায় বসল। নৌকাটার পুরো পাটাতন ফুল দিয়ে আবৃত। নীলা নাকের কাছে ফুল নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকতে গেলে সাদিদ বলল,

— ” লাল গোলাপ এবং রজনীগন্ধা। ”

— ” এসবের কি দরকার ছিল? ”

সাদিদ উত্তর দিলো না। ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসল।
নীলা আর সাহস করে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেল না। এই ছেলের সাথে কথা বললেই লজ্জা দেয়।
দু’জনই চুপচাপ মাঝ নদীতে বসে আছে। দৃষ্টি উপরের ঐ পূর্ণিমার চাঁদে। কিছু সময় পর সাদিদ আস্তে করে লম্বা হয়ে নৌকায় শুয়ে পরল।
মাথার নিচে ডানহাত দিয়ে বলল,

— ” কতক্ষণ বসে থাকবে? তুমিও শুয়ে পরো। ”

নীলা বসেই থাকল। কিভাবে শুবে সেইটাই চিন্তা করছে। পাশাপাশি শুতে পারবে না। আর অপরদিকে মাথা দিয়ে শুতে গেলে সাদিদের দিকে পা থাকবে। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু। তাই নীলা স্থির হয়ে বসেই থাকল।

— ” কি হলো? আস। ”

— ” আমি এখানেই ঠিক আছি। ”

সাদিদ নীলার কথা শুনল না। হেঁচকা টানে নিজের কাছে আনল। আচমকা এমন করাতে নৌকা খানিকটা নড়েচড়ে উঠতেই নীলা বিচলিত হলো। সে সাদিদের বাহুর শার্ট খামচে ধরল।

— ” ভয় পেয়েছ? ”

— ” হঠাৎ এমন করাতে একটু পেয়েছি। ”

সাদিদ এবার আস্তে করে একটু সাইড হয়ে, নিজের বামহাতটা সোজা করে রাখল। নীলার বাহুতে ধরে তাকে নিজের হাতের উপর শুইয়ে দিলো।
সাদিদের সাথে এমনভাবে শুয়ে থাকতে নীলার খুব লজ্জা লাগছে। তাই উঠে বসতে চেয়ে আটকে যাওয়া গলায় বলল,

— ” আমি বসব। শুতে ভালো লাগছে না। ”

সাদিদ নীলার উঠে যাওয়ার অর্থ বুঝতে পারল। কিন্তু তারপরও শুনল না। নীলাকে জোরে টেনে এনে নিজের পাশে শুইয়ে দিলো। সাদিদের এত নিকটবর্তী হয়ে নীলার শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে।
সাদিদ এবার সোজা থেকে বাম কাঁধ হলো। নীলার অবস্থা কাটিল, সাদিদের গরম নিঃশ্বাসগুলো তার চোখে-মুখে এসে ঠিকরে পরছে। চোখের পাতা অনবরত টিপটিপ করছে, দৃষ্টি এলেমেলো।
সাদিদ মৃদু হাসল। নীলাকে নিজের আরকটু কাছে টেনে তার গালে হাত রাখল। গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতেই নীলা চোখ খিঁচে বন্ধ করল। তার পুরো শরীরে ঝড় বয়ছে।

— ” এখনও কি উত্তর নিয়ে ভয় আছে? আমাকে নিজের এত কাছে দেখেও কি দ্বিধা থাকবে? ”

নীলা এবার পিটপিট করে চোখ খোলল। সাদিদ এখনও নীলার গালে আলতো করে হাত বুলাচ্ছে। নীলাকে চোখ খুলতে দেখে সাদিদ মিষ্টি করে হাসল। মাথা নিচু করে নীলার কপালে নিজের উষ্ণ ঠোঁট স্পর্শ করে আদর দিলো।
নীলা সাদিদের কাঁধ খামচে ধরে নিজের মধ্যকার কম্পনটা থামাতে চাইল।
সাদিদ কপাল থেকে মুখ সরিয়ে নীলার চোখের দিকের তাকালো। চাঁদের আলোয় নীলার মুখের লালাভ বর্ণ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু তার চোখ-ঠোঁটের কম্পন দেখে সাদিদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তার প্রাণপাখি লজ্জা পাচ্ছে।
সাদিদ আবারও হাসল। নিস্তব্ধ রাতে তার মৃদু স্বরে হাসির আওয়াজটা চারপাশে শোনা গেল। সাদিদকে হাসতে দেখে নীলা আরও লজ্জা পেল। কাঁধ হয়ে শুয়ে অপরদিকে মুখ ঘুরাল।

কিছুসময় নীরবতায় কেটে গেল। কিন্তু আচমকা নিজের কোমড়ে সাদিদের শক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই, নীলা নৌকার পাটাতনে রাখা ফুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে পিষতে লাগল।
সাদিদ নিজের হাত নীলার কোমড় গলিয়ে পেটে এনে ঠেকাল। পেট জড়িয়ে ধরে তাকে একটানে নিজের বুকে এনে ঠেকাল।
নৌকা আচমকা নড়ে গিয়ে দোল খেতে লাগল। নীরবতায় আচ্ছন্ন থাকা সেই পরিবেশে সামান্য দোলের শব্দটা কানে প্রচন্ড লাগল। নীলার শরীর থরথর করে কাঁপছে। এতো গভীর হয়ে এই জীবনে কোনো পুরুষের সান্নিধ্যে সে আসেনি। সাদিদ-ই প্রথম ব্যক্তি যে নীলার এতটা কাছে এসেছিল। কিন্তু তখন বয়স অল্প। কৈশোর পেরিয়ে আসতে পারেনি। সেই সময় সাদিদের স্পর্শগুলো শরীরে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি।
কিন্তু এখনতো সে প্রাপ্তবয়স্ক। যুবতীর ন্যায় সমস্ত শরীরজুড়ে তার শিহরণের ঢেউ।
তাই সাদিদের স্পর্শগুলো তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় তুফান তুলছে।
নীলার এই অবস্থার মধ্যেই সে তার পায়ে সাদিদের পায়ের স্পর্শ পেল। নীলার শরীরে রাতের পরনের হালকা টপসের সাথে প্লাজো সালোয়ার। পায়ের উন্মুক্ত স্থানে সাদিদের পায়ের ঘর্ষনে নীলা কাঁপা হাতে নিজের জামা খামচে ধরল।
সাদিদ নীলাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে, পায়ে পা দিয়ে স্লাইড করছে। দুইজনের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দগুলো নিস্তব্ধতাকে চিড়ে বের হয়ে আসছে। সাদিদ খালি পা হঠাৎ নীলার হাঁটুর একটু নিচে এসে থেমে গেল। নীলাকে ধরে রাখা হাতটাও এখন ঢিলে হয়ে গেল।
আচমকা নীলাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে, সাদিদ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। মাথার চুলগুলো বারকয়েক টেনে নিয়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে নীলার দিকে তাকালো।
নীলা অনবরত কাঁপছে। সাদিদ এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে নীলার সালোয়ারটা ঠিক করে দিলো।

বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা। দু’জনই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিব্রত। একজনে লজ্জায় আর আরেকজন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে। আরও কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সাদিদ আবেগময় কন্ঠে ডেকে উঠল,

— ” প্রাণপাখি? ”

নিস্তব্ধতায় সাদিদের মায়াভরা নিচুস্বরটা যেন নীলার বুকে গিয়ে লাগল। সে দ্রুত চোখ খোলে সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদের চোখ-মুখ ভীষণ মলিন দেখাচ্ছে।
নীলার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। তারপরও সাদিদের এমন চেহারা দেখে সে উঠে বসল।
জড়তা নিয়েই বলল,

— ” কি হয়েছে আপনার? ”

সাদিদ উত্তর দিলো না। টান মেরে নীলাকে নিজের বুকে নিয়ে আসলো। শক্ত করে দুইহাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরল। তার শরীর মৃদু কাঁপছে। নীলা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সাদিদকে তার কাছে এখন অস্বাভাবিক লাগছে। সাদিদ নীলাকে বুক থেকে উঠিয়ে তার মুখটা আঁজলাভরে ধরল। অসহায় চোখে বলে উঠল,

— ” এবারও আমাকে ভুল বুঝবে?
কিন্তু বিশ্বাস করো কিছুক্ষণ আগে যা…
মানে, আমি সেটা ইচ্ছে করে করিনি। তোমাকে দেখলে আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনা। যেমনটা অতিতেও হয়েছিল। প্লিজ এবার রাগ করো না। ”

নীলা উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল সাদিদকে কি বলা উচিত। নীলার নীরবতা যেন সাদিদকে আরও যন্ত্রণা দিচ্ছে। সে নীলার মুখটা আবারও উঁচু করে ধরে বলল,

— ” প্রাণপাখি, এবারও রাগ করবে? ”

নীলা এবার লাজুক হাসল। সত্যিটা বলতে মুখে আটকে আসছে, তারপরও আটকে যাওয়া গলায় বলল,

— ” তখনতো ছোট ছিলাম এসব বুঝতাম না। কিন্তু এখন…

এতটুকু বলেই সে সাদিদের চোখের দিকে তাকালো। কি বলছিল ভাবতেই সে নিজেই লজ্জা পেল। সাদিদ-ই বলল,

— ” এখন? ”

— ” মানে.. আসলে আমি রাগ করিনি। আপনাকে অনুতপ্ত হতে হবে না। ”

নীলা আর কিছু বলতে পারল না। এতটুকুই বহুত কষ্টে মুখ দিয়ে বের করেছে।
সাদিদ নীলার লাজুক মুখ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ হাজারটা খারাপ চিন্তা তার মাথায় চলে এসেছিল।
সে এবার চিন্তা মুক্ত হয়ে আবারও নৌকায় শুয়ে পরল। মুখে আর কোনো কষ্ট বা অসহায়ের ছাপ নেই।
নীলা কি করবে বুঝতে পারছে না। তাই চুপচাপ বসেই রইল।
সাদিদ এবার আর হাতে নয়, নীলাকে কাছে টেনে নিজের বুকে নিয়ে আসলো। আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে নীলার মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে লাগল।
সাদিদের বুকের তীব্র হৃদ স্পন্দনের আওয়াজ নীলার কানে স্পষ্ট আসছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই বুক থেকে নিরাপদ এবং শান্তির জায়গা আর হতে পারে না। তার এইমুহূর্তে খুব ইচ্ছে করছে সাদিদের বুকে চুমু খেতে৷ কিন্তু লজ্জায় লাল হয়ে চুমুর চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। নীলা মুখ উঠিয়ে একবার সাদিদের দিকে তাকালো।
সাদিদ বুঝতে পেরে নিজেও নীলার দিকে তাকালো।

— ” কিছু বলবে? ”

নীলা ডানে-বামে মাথা নাড়ল। সাদিদ মৃদু হেসে নীলাকে আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” প্রাণপাখি জানো? তোমাকে নিয়ে রাত জেগে একসাথে চাঁদের আলো দেখব, এমনটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল। আজ যখন তুমি আমার এতটা কাছে তখন কেন জানি বর্তমান অবস্থাকেও স্বপ্ন-ই মনে হচ্ছে। এটা যে বাস্তব সেটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। পাখি একটা চিমটি কাটতো। ”

— ” না, না আমি এসব পারব না। ”

সাদিদ নীলার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসতে হাসতেই তার নাকটা আলতো করে টিপে দিলো। এবার নীলারও খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল।
দুইজনই খুনসুটিতে চাঁদ দেখা উপভোগ করছে।

— ” রিসোর্ট ফিরে যাবে? ”

নীলার খুব ইচ্ছে করছে বলতে, থাকি না রাতটুকু। বেশতো লাগছে। কিন্তু মুখে সেটা বলতে পারল না।

— ” চলুন। অনেকসময় পেরিয়ে গেছে। ”

সাদিদ উঠে বসে নৌকাটা তীরে নেবার জন্য বৈঠা হাতে নিলো।
তীরে এসে নীলাকে সামধানে নিচে নামিয়ে চলে আসতে নিলেই নীলা বলে উঠল,

— ” ফুলগুলো সরাব না? ”

— ” ফুল সরাব কেন? ”

— ” মানে এভাবেই থাকবে? সকালে যদি মাঝিভাই এসে নৌকায় ফুল দেখে, তাহলে কি মনে করবে? ”

— ” কি আর মনে করবে…

সাদিদ হঠাৎ কথা থামিয়ে দিলো। নীলার দিকে তাকালে সে দ্রুত দৃষ্টি নত করল। সাদিদ ঠোঁট কামড়ে হাসল। কিন্তু তারপরও নীলার লাজুক মুখটা আবারও দেখার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে।
তাই হেঁচকা টানে নীলার কোমড় চেপে ধরল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিচেল গলায় বলল,

— ” যেটা স্বাভাবিক সেটাই মনে করবে। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় এটাই যে, স্বাভাবিক বিষয়টা আমাদের মধ্যে হয়নি। বড্ড দুঃখের বিষয়। ”

নীলা লজ্জা পেয়ে সাদিদকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাল। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই সাদিদ হাসতে হাসতেই বলল,

— ” আরে পাখি কই যাও? মাত্রই না বললে নৌকার ফু্ল পরিষ্কার করবে। এখন আমাকে কাজে সহযোগিতা না করে কোথায় যাচ্ছ? ”

নীলা লজ্জারাঙা মুখেই পিছিয়ে আসলো। সাদিদের দিকে একবারও না তাকিয়ে নৌকার ফুলগুলো সরাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। সাদিদ আড়চোখে সবটাই পরখ করছে। আর নীলার অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে। তার লজ্জাবতী লাজুকলতা।

#চলবে…

[ প্রিয় পাঠকগণ নানুমণি, মামা-মামানি, ভাই-বোনদের সমাবেশ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত রয়েছি। তাই গল্পের অংশ দিতে রাত হয়ে গেল। প্লিজ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here