#অন্তহীন💜
#পর্ব_১১
#স্নিগ্ধা_আফরিন
বিষ্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে প্রহনের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলে টা। চৈতি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কিছুই বলার নেই তার।যা বলার সব কিছুই তার আর্মি সাহেব বলে দিবে।
ছেলেটা এক নজর চৈতির দিকে তাকিয়ে প্রহনের দিকে তাকালো।কন্ঠে বিষ্ময় নিয়ে বললো,
“উনি বিবাহিত? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”
প্রহন মুচকি হেসে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“আমি ওর হাসব্যান্ড।”
প্রহনের কথা শুনে ছেলেটার মুখের ভাব বদলে গেল।কত আশা করে চৈতির সামনে এসে ওর প্রশংসা করলো সিঙ্গেল জীবনের ইতি টানবে বলে। কিন্তু কী একটা অবস্থা? মেয়েটার ও বিয়ে হয়ে গেছে?প্রেম করার আগেই ছোট খাটো একটা ছ্যাকা খেলো ছেলেটা।
মাথা নিচু করে “সরি” বলে প্রহন কে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে। ছেলেটার এহেন কান্ডে হাসে প্রহন।
চৈতির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,
“আম্মুর কাছে থাকতে পারো না? এত দূরে একা দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?”
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,”আমারই খেয়াল ছিল না। অনেক দিন পর পুরোনো সখীকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছিলাম।”
প্রহন চৈতির হাতটা শক্ত করে ধরলো। রেদোয়ান চৌধুরীর কাছে যেতে যেতে বললো,
“সুন্দরী পিচ্চি বউ আমার। একটু দেখে রাখবা না? বিয়ে বাড়ীতে কত ছেলেই আছে। পটানোর চেষ্টা করবে। শেষে বউ যদি আমার পটে যায় তখন এই আমার কী হবে ভেবে দেখেছো?”
প্রহনের কথা শুনে চৈতি ধীর গলায় উত্তর দিলো,
“আমি এমন না।”
“আচ্ছা। তাহলে আপনি কেমন ম্যাডাম? বলেন একটু শুনি।”
“জানি না।”
“আহ প্রহন! মেয়েটা কে আর কিছু বলিস না।”মিসেস ইয়াসমিনের কথার প্রতি উত্তরে প্রহন বলে,
“পিচ্চি কে না। আমি তোমাকে বলেছি কথা গুলো।”
“বাদ দে এই সব কথা।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কন্ঠে বিরক্তি। প্রহন ও আর কথা বাড়ালো না।
হলুদের পর্ব শেষ হতে বেশ রাত হবে।রেদোয়ান চৌধুরীর শরীর টা খারাপ। বেশি দেরি না করে ১০টার দিকেই বাড়ি ফিরে আসে প্রহনরা।শাড়ি পড়ে থাকতে দম আটকে যাচ্ছিল চৈতির।শাড়ি বদলে সেলোয়ার কামিজ পরে বিছানায় বসে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো। চৈতির এহেন কান্ডে প্রহন হেসে বললো,
“হিমালয় পর্বতের চূড়ায় উঠে ছিলে মনে হয়।এত হাঁপাচ্ছো কেন পিচ্চি?”
চৈতির সোজা সাপ্টা উত্তর,
“শাড়ি পড়তে অবস্ত না আমি।”
“তাহলে পড়েছো কেন?বলে ছিলাম না শাড়ি বদলে অন্য কিছু পড়ে যাওয়ার জন্য? তখন বড় মুখে কী বলেছো,’শাড়ি সামলাতে না পারলে আপনাকে সামলাবো কী করে?’আম্মু আব্বুর সামনে কথা টা বলে কতটা লজ্জায় ফেলেছিলে আমাকে বুঝতে পারছো তুমি?”
প্রহনের সব কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো চৈতির। কিছুই ঠিক মতো বুঝলো না। প্রহন বিছানায় শুয়ে পড়লো।বিড় বিড় করে বললো”আহ শান্তি।”
“পিচ্চি লাইট অফ করে ডিম লাইটটা অন করে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে।”
প্রহনের কথা মতো চৈতি লাইট অফ অন করে বিছানায় গিয়ে প্রহনের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।পাশ ফিরে প্রহন এক নজর চৈতির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আজ রাতেও ঘুমানো হবে তার।ঘুমালেই বিপত্তি।জেনে শুনে বিপত্তি ঘটালে এতে মহা পাপ হবে। ভীষণ পাপ!
বিছানার সাথে বন্ধুত্ব টা ছোট বেলা থেকেই খুব গাঢ় চৈতির। বিছানায় আয়েশ করে গা এলিয়ে দিলেই চোখ জুড়ে নিদ্রা এসে ভীড় জমায়।নেত্র জোড়া বন্ধ হয়ে আসে আপনাআপনি।দ্রুতই পাড়ি জমায় তন্দ্রার দেশে।
গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন নবিনা কিশোরীর ঘুমন্ত আনন জুড়ে ছেয়ে আছে এক রাশ মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষেরা তার প্রিয়তমার সব কিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পায়। তাদের কথা বার্তা, ঘুমন্ত মুখোশ্রি, তাদের ছোট ছোট ভুল গুলো, তাদের হাঁটার ছন্দে ও যেনো থাকে এক আকাশ সমান ভালো লাগা।প্রেমিকের মন অলিন্দের সব টুকু জায়গা জুড়ে প্রেমিকার বসবাস থাকে।
আচ্ছা,স্বামী নামক প্রেমিকের চোখের ঘুম যে নবিনা কিশোরী কেড়ে নিয়েছে সে কথা কী কখনো জানা হবে তার?নাকি অজানায় হারিয়ে যাবে সেই সত্য গুলো? দূরে বহুদূর যেখান থেকে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রহন চৈতির দিকে তাকাতে চায় না। মস্তিষ্ক ঝংকার দিয়ে উঠলো,তাকাবি না প্রহন।এতে অন্যায় হবে।ঘোর অন্যায়!
অন্য দিকে বেপরোয়া মন বলে উঠে,
একটা বার একটা অন্যায় করলে কিচ্ছু হবে না প্রহন। কিচ্ছু না। মস্তিষ্কের বারনের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে মনের ডাকে সাড়া দিলো প্রহন।কাত হয়ে ঘুমন্ত মানবির আননের দিকে নেত্র জোড়া নিবিদ্ধ করে।
মন এক প্রশান্তি তে শান্ত হয়ে উঠে।আর মস্তিষ্কে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠে। আঁখি জোড়া বন্ধ করতেই দম আটকে আসে প্রহনের।নেত্র জুড়ে নিদ্রার আনাগোনা ও নেই। শোয়া থেকে উঠে বসে প্রহন। ঘুম হবে না তার।
কী এক অনলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে প্রহন? সেই উত্তর জানা নেই তার।আজ কাল নিজেকে বড্ড অচেনা মনে হয়। সেই গম্ভীর,রাগি প্রহন টা যেনো বিয়ের দিনই কোথায় হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রহনের কাছ থেকে।এ কী অদ্ভুত পরিবর্তন।একদম নতুন এক প্রহন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করছে সে।একদম নতুন!
চৈতির ঘুমন্ত মুখোশ্রীর দিকে তাকিয়ে প্রহন হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি শুধু তোমার মুখ পানে চেয়েই ঠের পাই কিশোরী, আমি আর আমার মাঝে সহস্র বছর যাবৎ নাই।মরেছি আমি! ভীষণ জ্বরে পুড়ে মরেছি।”
অজস্র শব্দের ভীড়ে, কয়েক টা শব্দ খুঁজে নিয়ে প্রহন একটি বাক্য সাজালো,”কেমন করে এমন হলো জানি না।”
নারী,যার কাছে পুরুষের কঠিন হৃদয় এক নিমিষেই গলিয়ে ফেলার অস্ত্র আছে।
সেদিন রাতে ও ঘুম হলো না প্রহনের। ঘুম না হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই।একটাই কারণ “চৈতি”।
বিভাবরী সবে তমস্রীর গাঢ় রেশ কাটিয়ে আদিত্যর রঙিলা প্রভায় মৃদু রাঙিন হয়ে উঠছে। দখিনা হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে ঘুমন্ত মানবীর অবাধ্য চুল। ইচ্ছে করেই দখিনের জানালাটা মেলে দিয়েছে প্রহন। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।ভোর হয়েছে যে। প্রহন চৈতির দিকে এগিয়ে গেল। খুব যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমন্ত চৈতিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
প্রভাতের শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশের মতো কন্ঠে চৈতি কে ডাকদিল।
“পিচ্চি উঠো।ফজরের নামাজ আদায় করে নাও।উঠো পিচ্চি।”
প্রহনের ডাক চৈতির শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।পিট পিট করে চক্ষু জোড়া মেলতেই প্রহনের মুখ খানি এত কাছ থেকে দেখে ঘাবড়ে গেল চৈতি। প্রহন তা বুঝতে পেরে সরে দাঁড়ালো। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে চৈতির দিকে না তাকিয়েই রাশ ভারি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“অযু করে ফজরের নামাজ আদায় করে নাও।”
চৈতি কে কথা টা বলা শেষ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল প্রহন।
তন্দ্রা ভাব কাটেনি চৈতির। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলাতে লাগলো। ঘুম ছাড়ানোর চেষ্টা। ঘুমের ঘোরেই হেলেদুলে হেঁটে ওয়াস রুমে চলে গেল। চোখের মধ্যে পানির ঝাপটা দিতেই ঘুম চলে গেল।
.
নামাজ পড়ে শেষ করে বেলকনিতে যায়।চার দিকে এখনো আবছা আলোয় আলোকিত। সূর্য এখনো তেজ দেখায়নি তার।দেওয়াল ঘড়িটা হঠাৎ করেই টুং টুং আওয়াজ করতে থাকে। চৈতি রুমে আসে।সবে মাত্র সকাল ছয়টা বাজে।
বেলকনিতে আবারো চলে গেল চৈতি।অন্তরীক্ষ জুড়ে নীলের আধিপত্য।মেঘ নেই বললেই চলে। আকাশ একে বারে পরিস্কার। চৈতির হঠাৎ খেয়াল হলো,
প্রহন সেই কখন রুম থেকে বেরিয়ে গেল এখনো ফিরেনি। কোথায় গেল? নিজের সাথেই নিজে প্রশ্ন করলো চৈতি।
ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানলো। সরদার সাহেবের শেখানো শিক্ষা। মাথায় কাপড় দেওয়া।অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে চৈতি। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে পা রাখতে যাবে তখনই কেউ বলে উঠে,
“কোথায় যাচ্ছো এত সকালে?”
চকিতে পেছন ফিরে তাকায় চৈতি। কাউকে দেখতে পেল না।আবারো কানে ভেসে আসলো,
“তোমার ডান পাশের রুমের ভেতরেই আছি আমি।রুমে যাও পিচ্চি।”
প্রহনের কথা শুনলো না চৈতি। বরং একটা আবদার করে বসলো।
“আপনার সাথে হাঁটতে নিয়ে যাবেন? সকালের এই সময়টায় খালি পায়ে হাঁটতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।”
চৈতির কথার উত্তরে প্রহনের বেপরোয়া মন বলে উঠে,
“মনে জমিনে খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছো।সে খবর রাখো চঞ্চলা হরিণী?”
চলবে,,,,,