অন্তহীন💜 পর্ব-১২ ১৩

0
2807

#অন্তহীন💜
#পর্ব_১২+১৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন

স্নিগ্ধ সকালের নরম ঘাসের উপর চরণ ফেলে হাঁটতে ব্যস্ত কিশোরী। তার থেকে কিছু টা দূরে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে সেই চরণের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন। বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে!
ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বসে পড়ে চৈতি। প্রহন দ্রুত এগিয়ে আসে।ডান পায়ের তালু কেটে গেছে ধারালো কিছুতে।গল গল করে রক্ত ঝরতে শুরু করে।
চৈতি অসহায় দৃষ্টিতে প্রহনের দিকে তাকায়। প্রহন ঘাসের উপর হাঁটু গেড়ে বসে দূর্বা ঘাস হাতের তালুতে ডলে নিয়ে চৈতির পায়ের কাটা অংশে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ পর রক্ত পড়া বন্ধ হয়। প্রহন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখটা চুপসে গেছে।চোখে এখনো ভয়। প্রহন চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“কিচ্ছু হয়নি পিচ্চি। সামান্য কেটে গিয়েছে। ভালো হয়ে যাবে।ভয় পেয়ে ও না।”

প্রহনের আনন থেকে নেত্র জোড়া সরিয়ে নেয় চৈতি। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই কাটা জায়গায় টান খায়।তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে প্রহন খম করে চৈতির হাত ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“এত দূর্বল হলে চলবে না।স্ট্রং হতে হবে।”

চৈতি অবাক হয়ে প্রহনের দিকে তাকিয়ে আছে।”কতো পাষান মনের মানুষ উনি।পা কেটে যাওয়ার পর ও এইভাবে দাড় করিয়ে দিল?”

প্রহন চৈতির অনেকটা কাছে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
“পিচ্চি তোমার আর্মি ক্যাপ্টেন সাহেব কিন্তু অনেক স্ট্রং। তোমাকে ও তার মতো হতে হবে।এত সামান্য বিষয় নিয়ে ভয় পেয়ে দূর্বল হলে কিন্তু চলবে না।”

চৈতি কিছু বলে না। চৈতির উত্তরের অপেক্ষা করে না প্রহন। সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ করে চৈতির কী হলো বুঝতে পারছে না সে। শুধু এইটুকুই বুঝলো,
“জীবনের পথ চলায় এমন হাজারো বিপদ আসবে। শরীর থেকে রক্ত ঝরবে। কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতে দূর্বল হওয়া যাবে না। এতে ক্ষতি হবে। মারাত্মক ক্ষতি!”
দাঁতে দাঁত চেপে কাঁটা পায়ের উপর ভর করেই হাঁটতে থাকে চৈতি। হোক কষ্ট তাতে কি? কষ্টের ফল মিষ্টি হয়। পেছনে ফিরে তাকায় প্রহন। চৈতির উদ্বেগ দেখে খুশি হয়।
চৈতির দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করেই মনে মনে নিজেকে নিজেই কথা দেয় প্রহন,
“হও তুমি ইমম্যাচিউর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।তোমাকে আমার মনের মতো করেই ম্যাচিউর করে তোলার দায়িত্ব আমি নিলাম পিচ্চি।”
কঠিন হৃদয়ের করা প্রতিজ্ঞার কথা কখনো জনা হবে কী নরম হৃদয়ের অধিকারীনির?হয় তো হবে। আবার নয় তো না।

চৈতি প্রহনের দিকে তাকিয়ে ব্যথাতু্র কন্ঠে বলে উঠে,
“হাঁটতে পারছি না আর।পায়ে ব্যথা করছে।”

“পারছি না বললে হবে না পিচ্চি।পারছি না,পারি না, পারবো না,হবে না, সম্ভব না, এমন শব্দ গুলো তোমার জীবনের ডিকশোনারি থেকে মুছে দাও।একে বারে মুছে দাও। এখন থেকে,এই মুহুর্ত থেকেই।”

বিষ্ময় নিয়ে তাকায় চৈতি।”কি বলছেন কী উনি এ সব? মাথা ঠিক আছে তো?”
মনে মনে বললো চৈতি। মুখে প্রকাশ করলো না। প্রহন চৈতি কে রেখেই বাড়ির ভেতরে চলে গেল। প্রহনের এহেন কান্ডে হতভম্ব চৈতি। ছোট্ট হৃদয়ে এক আকাশ অভিমান এসে ভীড় জমালো।স্বামী নামক মানুষটির জন্য।”আপনি একবারে বাজে আর্মি সাহেব।একে বারেই খারাপ। ভীষণ খারাপ!”

নবিনা কিশোরীর সলাজ অভিমান গাঢ় হবার আগেই কী সেই অভিমান ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারবে প্রহন? অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করতে পারবে তার চঞ্চলা হরিণীর হৃদয় জুড়ে বয়ে যাওয়া অভিমান নামক ঝড়ের?
এক পা দু’পা করে এগিয়ে যায় চৈতি।খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন তরিঘরি করে ছুটে আসতেই বাঁধ সাধলো প্রহন।কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
“ওর লড়াইটা ওকেই লড়তে হবে আম্মু।”

মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কীসের লড়াই? এইটুকু মেয়ের আবার কার সাথে লড়াই লাগলো?”

“জীবনের লড়াই আম্মু।”

“মানে কি প্রহন? ক্লিয়ার করে বলো। এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা আমার পছন্দ না।”

মায়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রহন।
“এই পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা এত সহজ না।পতি পদে পদে বিপদ উৎ পেতে থাকে।হাজারো বাঁধা কাটিয়ে পথ চলতে হয়।আর সেই বাঁধা কাটানোর জন্য দরকার আত্মবিশ্বাস এর। চৈতির পা কিছুটা কেটে গেছে। চাইলে আমি ওকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু এতে করে পরবর্তীতে ওর নিজের ক্ষতি হবে। এমন করলে ধীরে ধীরে আমার, তোমার কিংবা অন্য কারো প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে ও।যা আমি চাই না।ওর সকল প্রকার নির্ভরশীলতা ওর নিজের কাছে।অন্যের কাছে না। সবাই অনেক জ্ঞান দিবে। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে আসবে না।আসে না কেউ।‌”

প্রহনের কথায় মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হাসেন। তার ছোট্ট সেই প্রহন আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে।কত কিছু কতো সহজেই বুঝতে পেরে গেছে। ভেতরে এসেই সোফার উপর বসে পড়লো চৈতি।একটা বারের জন্য ও প্রহনের দিকে তাকালো না। মিসেস ইয়াসমিন এগিয়ে গেলেন তার দিকে।
চৈতি ধীর কন্ঠে বললো,
“ভালো মা পানি খাবো।”

মিসেস ইয়াসমিন ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি এনে চৈতির হাতে দিলো।
থেমে থেমে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে সোফায় শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। প্রহন রুমে গিয়ে ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে এসে চৈতির পাশে গিয়ে বসলো।
চোখ বন্ধ চৈতির।মনে হচ্ছে ২০০ মিটার পথ দৌড়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস ফেলছে।

প্রহন সোফা থেকে উঠে চৈতির পায়ের কাছে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে চৈতির কেটে যাওয়া পা হাঁটুর উপর রেখে ডেটলে ভেজানো তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে সেভলন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। চৈতির কোনো সাড়া শব্দ নেই।সে চুপ করে চোখ বন্ধ করে আছে।

প্রহন উঠে দাঁড়ালো। চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,
“নাস্তা করে প্যারাসি টেমল খেয়ে নিবা পিচ্চি। তাহলে আর ব্যথা করবে না।”

প্রহনের কথা শুনে খুব রাগ হলো চৈতির।মনে মনে প্রহন কে ইচ্ছে মতো বকলো।”কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো একটু ধরে নিয়ে আসলে?এত কষ্ট তো হতো না আমার।”

কিশোরী চৈতির মনে অন্য ভাবনা আসলেও এই ভাবনা আসলো না, যে কিছু কিছু মুহূর্তের ছোট খাটো কষ্ট জীবনের চলার পথে আরো বড় কষ্ট কেউ তুচ্ছ করে তোলে।

আজ আবার বিয়ে বাড়ীতে যেতে হবে। কিন্তু রেদোয়ান চৌধুরীর শরীর টা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। বুকের ব্যথাটা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। এই মাসে চেকআপ করানোর কথা ছিল। কিন্তু চার দিকের এত ঝামেলার মধ্যে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা। রেদোয়ান চৌধুরী কে নিয়ে হসপিটালে যায় প্রহন। মিসেস ইয়াসমিনের মনটা ভালো নাই। অবশ্য ভালো থাকার কথা ও না।যেখানে তার জীবন সঙ্গী সুস্থ নেই সেখানে তাঁর ভালো থাকার প্রশ্নই উঠে না। বছরের পর বছর কোনো পশুর সাথে থাকলেও মায়া হয়। সেখানে রেদোয়ান চৌধুরী একজন মানুষ।২৯ বছরের বিবাহিত জীবনে এই মানুষটি কে বড্ড বেশি ভালোবাসে ফেলেছেন তিনি।।বড্ড বেশি!

চৈতি রুমে বসে ছিল। ভালো লাগছে না। হঠাৎ কী মনে করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাথায় কাপড় দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে ভাবলো বাড়িটা ঘুরে দেখা যাক। পায়ের মধ্যে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার জন্য ব্যথা নেই।তবে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। তবু ও বাড়িটা ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলো না চৈতি।খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। এই রুম থেকে ঐ রুমে।
বাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে চৈতির একটাই কথা মাথায় এলো।
“এত বড় বাড়ি অথচ মানুষই নেই। এতো বড় বাড়ি বানানোর কী দরকার ছিল? অদ্ভুত!”

___________
রৌদ্রতপ্ত অন্তরীক্ষ তখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।দিনমনি অস্ত যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।এই অপারহ্ন কে অনেকে গোধূলি কয়।সাঁঝবেলা আসার সময় হচ্ছে।দিনমনি ডুবে গেলেই সে তার আধিপত্য বিস্তার করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে।অম্বর জুড়ে তুলোরাশিদের ছড়াছড়ি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছে চৈতি।
হাতে এক কাপ চা নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায় প্রহন।
তার উপস্থিতি টের পেয়ে ও কোনো রকম প্রক্রিয়া করে না কিশোরী।
প্রহন চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দেয়।
কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নিজ থেকেই কথা বলে,
“কী হয়েছে পিচ্চির?মন খারাপ কেন?”

উত্তর দিলো না চৈতি। আগের নেয় আকাশ পানে চেয়ে রইলো। ইচ্ছে করেই গরম চা মুখের ভেতর নিয়ে নেয় প্রহন। অতিরিক্ত গরমে জিহ্বা পুড়ে যায়।সহ্য করতে না পেরে ফেলে দেয় প্রহন। কিছুটা চা গিয়ে পড়ে চৈতির হাতে। ঘাবড়ে উঠে সে।
কন্ঠে চাপা ক্ষোভ রেখেই প্রহনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“পাগল আপনি?এত গরম চা কেউ এক গালে খায়? জিহ্বা পুড়ে যায় নি তো?”

চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে এক টান মেরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় প্রহন।
প্রহনের এহেন কান্ডে বুকের মাঝে ধক করে উঠলো চৈতির। হৃদয় জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
প্রহন চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের নেয় কন্ঠে বলে উঠে,
“তোমার সলাজ গাঢ় অভিমান আমার বুকের ভেতরে এর চেয়েও বেশি অনলে জ্বলে পুড়ে ছারখার করে দেয়। বুঝতে পারো না তুমি?”

#চলবে,,,,,,
#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন

কানের পাশ দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেলো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ খেলে গেল। পলকহীন চোখে প্রহনের দিকে তাকিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে চৈতি। প্রহনের দৃষ্টি আটকে আছে নবিনা কিশোরীর চোখে।
চৈতির কোমর ছেড়ে দিল প্রহন। গ্রিলের বাইরে দূর আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। চৈতি নড়েচড়ে উঠলো। প্রহন কে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেল। চৈতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো প্রহন।মনে মনে বললো,”বউ আমার লজ্জাময়ী। লজ্জা পেয়ে চলে গেল।”

সে দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ বৃষ্টির আগমন। চারদিক তিমির রুপে সেজে উঠে।শো শো করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বাতাসের তোড়ে জানালার পর্দা গুলো উড়ে উড়ে এলোমেলো হচ্ছে নিজের মতো।লোড সেডিং হয়।বাড়ির ভেতর জুড়ে তমস্রীর আধিপত্য।অম্বর তখন কালো মেঘেদের দখলে।মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় প্রহনের রুম স্বল্প সময়ের জন্য আলোকিত হয়ে উঠে।
মোবাইল এর ফ্লাশ লাইটের আলোয় বেলকনির দরজা রুমের জানলা বন্ধ করে দেয় প্রহন। হঠাৎ আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে চরম বিরক্ত সে।
আগামীকাল ঢাকায় ফিরে যাবে। একটু শান্তি তে যাওয়া আর হবে বলে মনে হচ্ছে না। বাইরে যে ভাবে বাতাস বইছে দেখা যাবে রাস্তায় গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে। ছুটির দিন শেষ।চলে যেতে হবে প্রিয় পরিবার ছেড়ে।ব্যস্ত হতে হবে দেশের কাজে। দেশের জন্য নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়াই যে সেনাবাহিনীদের কাজ।
গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে প্রহন।
বিছানায় বসা চৈতির দিকে এগিয়ে যায় প্রহন। মেঘের গর্জনে থেমে থেমে কেঁপে উঠছে মেয়েটা। চোখ মুখ খিঁচে দুই হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে। চৈতির ভীতু মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে প্রহন।
“সেনাবাহিনীর বউ হয়ে সামান্য মেঘের গর্জনে এত ভয় পেলে চলবে পিচ্চি?”

চোখ মেলে তাকায় চৈতি। মিনমিনে গলায় বলে,
“বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। ছোট থেকেই ভীষণ ভয় পাই আমি।”

“তুমি আবার বড় হলে কখন?এখনো তো ছোটই আছো।”

প্রহনের কথা শুনে গাল ফুলিয়ে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় অভিমানী কিশোরী।
বাইরে এখন আর বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে শহরের প্রতিটি অলিগলি।ন্ চৈতির পাশে গিয়ে বসলো প্রহন।ধীর কন্ঠে বললো,
“ওয়েদারটা রোমান্টিক আছে। এই ওয়েদার একটা বউ ডিজার্ভ করে।”

প্রহনের দিকে ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় চৈতি।বড্ড অসভ্য মানুষ তো।বউ থাকতে বলে বউ ডিজার্ভ করে?
কন্ঠে রাগ রেখে চৈতি প্রহনের উদ্দেশ্য বললো,
“আমি আপনার কী হই?”

প্রহন ঠোঁট কামড়ে হাসে।
“তুমি? তুমি তো আমার পিচ্চি বউ।”

“তাহলে আবার বউ চাচ্ছেন কেন? কয়টা বিয়ে করতে চান আপনি?”

ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে প্রহন তার পিচ্চি বউয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়,
“আরো তিন টা বিয়ে করবো।চারটা বিয়ে করার তো অনুমতি আছেই।”

প্রহনের কথা শুনে চৈতি রেগে গিয়ে বললো,
“আমি মেয়ে খুঁজে দিবো আপনি বিয়ে করিয়েন।”

প্রহন হাসলো। কোনো উত্তর দিলো না। চৈতির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার সাথে এই অবেলার বৃষ্টিতে ভিজবে পিচ্চি পেত্নী? হয়তো অনেক দিন আমাকে কাছ থেকে দেখার ও সুযোগ হয়ে উঠবে না।”

“চৈতি, চৈতি, চৈতি বুঝছেন?আমার নাম চৈতি। পিচ্চি পেত্নী এটা আবার কীসের নাম?”

“শুনো,শুনো,শুনো, তোমার যত সুন্দরই নাম থাকুক না কেন আমি তোমাকে পিচ্চি বলেই ডাকবো।বুঝছো পিচ্চি? এখন চলো অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজতে।”

চৈতি কিছু বলার আগেই প্রহন চৈতির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ছাদের দিকে।
বৃষ্টি যে তার ভীষণ পছন্দের।আর সেই বৃষ্টি বিলাস যদি হয় প্রিয় মানুষটার সাথে তাহলে আর কোনো কথাই নেই।অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া দিয়ে যায় হৃদয়ে।
বৃষ্টির পানি শরীরে পড়তে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। চৈতি কে ছাদের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে তার সরাসরি দাঁড়ায় প্রহন। বৃষ্টির পানি অঝোর ধারায় ঝড়ছে। মেঘেরাও যেনো মন প্রাণ উজাড় করে বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছে শহর জুড়ে।ভিজে একাকার দুজন মানব,মানবি। অন্ধকারের মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ভিজে একাকার হয়ে যাওয়া কিশোরীর দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল প্রহন।
চৈতি এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। বৃষ্টিতে ভিজি বলেই সত্যি সত্যি ছাদের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে ভেজাতে লাগলো? অদ্ভুত তো!

বেশ অনেক দিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে আনন্দিত কিশোরী। বৃষ্টির পানি দুই হাতের মধ্যে জমিয়ে রেখে তা প্রহনের মুখের দিকে ছুঁড়ে মেরে খিল খিল করে হেসে উঠলো চৈতি।ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো দেখে প্রহন আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো,
“অন্ধকারই শ্রেয় এখন।আলো দিও না আল্লাহ। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।”

বৃষ্টির শব্দ, সাথে কিশোরীর হাসির খিল খিল শব্দে মুখরিত চার পাশ।জুনাইদা কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে দিতেন না। সামান্য ভিজলেও ভীষণ বকতেন, জ্বর উঠবে বলে।

পায়ে যে ব্যান্ডেজ করা আছে সেই কথা একদম মাথায় নেই দুজনের। লাফালাফি করতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যেতে নিলে আগলে নেয় প্রহন।কানের পিছে অবাধ্য চুল গুলো গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
“সাবধানে পিচ্চি। বৃষ্টি ভালোবাসো বুঝতে পারছি।তাই বলে এই ভাবে লাফালাফি করো না অন্ধকারে।ব্যথা পাবে।”

ছাদের লাইট জ্বলে উঠে। রাস্তার পাশের ল্যামপোস্ট গুলো ও জ্বলে উঠলো। বৃষ্টির গতি কমেছে যে।মন খারাপ হলো চৈতির।আরো কিছুক্ষণ ঝুম বৃষ্টি হলে কী এমন ক্ষতি হতো?
প্রহনের দিকে নেত্র জোড়া নিবিদ্ধ হতেই শিউরে উঠলো চৈতি। সামনের চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। মুখের মধ্যে বিন্দু বিন্দু পানির কনা। ঘোর লাগা চাহনি।ঢোক গিললো চৈতি। প্রহন কে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে যেতে নিলে চৈতির কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় নেশাক্ত প্রেমিক পুরুষ।
হৃদয় স্পন্দন প্রক্রিয়া পাল্টে গেল কিশোরীর।স্পন্দনের গতি বেড়ে গেল কয়েক গুণ। প্রহনের এই ধারালো চাহনির সাথে পরিচিত নয় চৈতি।দম আটকে আটকে আসছে।
আবারো বৃষ্টি নামলো। ঝুম বৃষ্টি!লোড সেডিং হলো।চার দিক আঁধারে ছেয়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় প্রহনের দৃষ্টি গেল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীর গোলাপি অধরে।
অধর জোড়া ছুঁয়ে দেওয়ার মারাত্মক নেশায় আসক্ত হয়ে উঠেছে নেশাক্ত মানব।আনন খানি এগিয়ে নিয়ে যেতেই টনক নড়লো। মস্তিষ্ক ধিক্কার জানিয়ে বলছে,
“এমন করিস না প্রহন। সঠিক সময় আসেনি।অন্যায় হবে এতে। ভীষণ অন্যায়!”

মন বললো,
“ও তোর জন্য হালাল প্রহন।একটা চুম্বনে কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু না!”

মন ও মস্তিষ্কের দ্বিমতে মস্তিষ্ককে আজ আশকারা দিলো প্রহন। ছেড়ে দিল চৈতির কোমর।সরে গেল দূরে। কিছুক্ষণ আগেই যতটা না কাছে ছিল তার চেয়েও অধিক দূরত্বে নিজেকে আড়াল করতে চাইলো।

চৈতির দেহে যেনো প্রান ফিরে এলো।বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে এক পলক প্রহনের দিকে তাকিয়ে ছুটে গেলো রুমে।

দুই হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরলো প্রহন।”কী করতে যাচ্ছিলাম আমি? সামান্য একটা ভুলে মেয়েটার জীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়তো।”

রুমে এসে চৈতি ভেজা কাপড় বদলে নিলো। প্রহনের তখনকার কান্ডে শরীর হিম শীতল হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে ও এত ঠান্ডা শরীর ছিল না যতটা না এখন আছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে প্রহন ও রুমে ফিরে এলো। বিছানার ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে চৈতি। বৃষ্টি থেমে গেছে। পরিবেশ এখন শান্ত শীতল।এত গরমের মধ্যে এই বৃষ্টিটা রহমতের ছিল।

তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে ওয়াস রুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রহন। বিছানায় বসে থাকা চৈতির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“কাভার্ড থেকে আমার গুছানো ড্রেস গুলো বের করে বিছানায় রাখো পিচ্চি।”

বাধ্য মেয়ের মত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চৈতি। পায়ের ব্যান্ডেজ ভিজে যাওয়ায় ফেলে দিয়েছে।কাঁটা জায়গায় পানি ও লেগেছে ইচ্ছে মতো।পা বাড়াতেই শব্দ করে উঠলো চৈতি।
কাঁটা জায়গায় চাপ পড়তেই রক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।
পা ধরে বিছানায় বসে পড়লো চৈতি।
প্রহন দ্রুত এগিয়ে এসে চৈতির পা ধরে রক্ত মুছে দিতে বললো,
“ইশশশ আমার ভুলেই পায়ের ব্যথা বেড়ে গেলো। সরি পিচ্চি। আমার মাথায় ছিল না যে তোমার পা কেটে গেছে।”
প্রহনের কন্ঠে অপরাধ।
__________
সেদিন রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে চৈতির। ঘুমের মধ্যে জ্বরের ঘোরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে প্রহন কে। চৈতির গায়ের তাপমাত্রায় প্রহনের মনে হচ্ছিলো সে নিজেই পুড়ে যাচ্ছে।
সেই প্রথম,মা বাবা ছাড়া অন্য কারো জন্য বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে পারে সে।কারন চৈতি যে তার প্রিয় মানুষের একজন হয়ে উঠছে। শুধু প্রিয় বললে ভুল হবে।অতিপ্রিয় একজন!
প্রহন রাত জেগে চৈতির মাথায় জল পট্টি দিতে ব্যস্ত। মধ্যে রাতে জ্বরের ঘোরে প্রহনের দিকে চোখ মেলে তাকায় চৈতি।
চৈতির সেই চাহনি দেখে স্বামী নামক প্রেমিক পুরুষের অবাধ্য মন বলে উঠে,
“তোমার এই জ্বরের ঘোরের চাহনিতে যে কত মায়া তুমি তা জানো না মেয়ে। তোমার এই মায়ার চাহনিতে যে লেখা আছে আমার মৃত্যু।”

#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here