অন্তহীন💜 পর্ব-১৪ ১৫

0
2718

#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৪+১৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

বেলকনির গ্রিলের ফাঁকে এক ফালি সোনারাঙা সোনালী রোদ্দুর এসে পড়েছে নবিনা কিশোরীর চোখে মুখে। কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া অগোছালো চুল গুলো বিকেলের মৃদু বাতাসে উড়ছে।গালে হাত দিয়ে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।অন্তরীক্ষ জুড়ে কাদম্বিনীর মেলা বসেছে।অম্বর আজ তাদের দখলে। স্নিগ্ধ,শান্ত, মনোরম পরিবেশ।মন ভালো করে দেওয়ার মতো আবহাওয়া।তবে এই সুন্দর পরিবেশে ও মন খারাপ কিশোরীর।যখন থেকেই ঘুম ভেঙ্গেছে,জ্বর কমেছে তখন থেকেই মন খারাপি হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেছে তাকে।রোদের তেজ কমে এসেছে। পড়ন্ত বিকেল!চিত্ত জুড়ে গাঢ় অভিমানের অনল জ্বলছে অভিমানী কিশোরীর।নেত্রপল্লব ক্লান্ত,শান্ত।
দু’টো চড়ুই পাখির মান অভিমান চলছে সেই কখন থেকেই।মেয়ে পাখিটা উড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় বসছে।ছেলে পাখিটা গেলে মেয়ে পাখিটা ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলছে। পাশের বাড়ির বেলকনির গ্রিলের উপর বসে থাকা চড়ুই পাখির অভিমান চুপ করে দেখছে অন্য এক অভিমানী মানবী।সেও তো ভীষণ অভিমান করেছে একজনের প্রতি।সে খবর কে রাখে?কেউ না!
মিসেস ইয়াসমিন হাতে করে এক কাপ চা নিয়ে আসলেন চৈতির কাছে।
চৈতি এক পলক মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে আবারো সেই পাখি দুটোর দিকে নজর রাখলো।

মিসেস ইয়াসমিন চৈতির পাশে মোড়া টেনে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে গলায় হাত দিয়ে তাপমাত্রা অনুভব করার চেষ্টা করলেন।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।কমেনি এখনো।

মিসেস ইয়াসমিন চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে মলিন কন্ঠে বললেন,
“চা টা খেয়ে নে মা।ভালো লাগবে।”

ডানে বামে মাথা নেড়ে বাঁধ সাধলো চৈতি।জ্বরের কারণে বিষাদ মুখ।সব কিছু তেতো লাগছে। ভালো লাগছে না কিছুই।শরীরের সাথে সাথে মনের ও অসুখ দেখা দিয়েছে যে!

মিসেস ইয়াসমিন জোর করলেন না। চৈতির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই চড়ুই পাখি গুলোর দিকে তাকালেন। হাসলেন তিনি। চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় শুধালেন,
“অভিমান জমেছে?”

অধীর আগ্রহ নিয়ে এই কথা শোনার জন্যই যেনো বসে ছিল চৈতি।কন্ঠে চাপা অভিমান নিয়ে বললো,
“আমাকে একটু জানিয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হতো?”

মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে জবাব দিলেন,
“তুই ঘুমিয়ে ছিলি।জ্বরের জন্য তাকাতেও পারছিলি না।১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল।”

“তাই বলে একটু বলে যেতে পারলেন না?একটু ডেকে দিলেন না কেন আমায়?”
অভিমানে গাল ফুলালো চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন দেখলেন,স্পষ্ঠই দেখলেন,নেত্রপল্লব থেকে দু ফোঁটা পানি ঝরে পড়তে। গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“আমি ডাকতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু প্রহন বাঁধ সাধে।
কথা বাড়ালো না চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন এর মুঠোফোন টা সেই কখন থেকে বেজে বেজে ক্লান্ত হচ্ছে। মোবাইলের রিং টোন এর শব্দে চরম বিরক্ত হলেন রেদোয়ান চৌধুরী।বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা উপন্যাস”চোখে আমার তৃষ্ণা” বইটি খুব মনোযোগ দিয়েই পড়ছিলেন।অবসর সময় কাটানোর জন্য বই পড়া একটি সুন্দর উপায়। বাস্তবতা ছেড়ে কল্পনায় ডুবে যাওয়া এক অন্যরকম অনুভুতি। রেদোয়ান চৌধুরী হাঁক ছাড়লেন।
“ইয়াসমিন, তোমার কল আসছে।”

রেদোয়ান চৌধুরীর কন্ঠ শুনে মিসেস ইয়াসমিন উঠে দাঁড়ালেন। চায়ের কাপ টা হাতে নিয়েই চলে গেলেন রুমে। বিছানার উপর থেকে মোবাইল টা হাতে নিতে নিতে কড়া গলায় রেদোয়ান চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“পাশেই তো ছিল মোবাইল টা।হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করলে কী এমন ক্ষতি হতো শুনি?বইয়ের ভেতরে ঢুকে গেছে একে বারে।বুড়ো বয়সে এসেও এত কীসের উপন্যাস পড়তে হয় বুঝিনা আমি।”

বাজতে বাজতে নিভৃত হয়ে গেল চারপাশ। কোনো প্রকার শব্দ নেই। রেদোয়ান চৌধুরীর কোনো টু শব্দটি ও নেই। তিনি তার মতো ব্যস্ত। কল্পনার জগতে!
মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বললেন,
“কাকে কী বলছি? উনি তো এখন এই বাস্তবেই নেই।”

মিসেস ইয়াসমিন ফের চলে গেলেন চৈতির কাছে।হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যন্ত্রটা ঝংকার দিয়ে বেজে উঠলো।সময় অপচয় না করেই একবার রিং হতেই কল রিসিভ করলেন মিসেস ইয়াসমিন।
ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বিচিলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“পিচ্চির শরীর কেমন আছে আম্মু?”

“জ্বর পুরোপুরি কমেনি এখনো।”

“ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।কী করছে এখন?”

“অভিমান করে বসে আছে।”

মায়ের কাথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো প্রহন।এটা ভেবে চিত্ত জুড়ে ভালো লাগায় ছেয়ে গেল যে,
‘অভীমান করেছে।’
অভিমান তো মানুষ সেই মানুষটির প্রতিই করে যাকে মানুষ আপন ভাবে।অল্প সময়ের মধ্যেই যে কারো আপন হতে পেরেছে এটা ভেবেই শান্তি লাগছে প্রহনের।

“চৈতি কে মোবাইল দিচ্ছি। কথা বলে অভিমান ভাঙ্গা।”

“এক মিনিট। আমি ভিডিও কল দিচ্ছি।”

মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললেন “আচ্ছা।”

কয়েক এক সেকেন্ড পরেই ভিডিও কল দেয় প্রহন। মিসেস ইয়াসমিন ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে চৈতি কে দেখালেন।আনন জুড়ে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট।গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।লাউড স্পিকার অন করে দিলেন মিসেস ইয়াসমিন।
চৈতি কে দেখে মোবাইলের ওপাশ থেকে দুষ্টুমি কন্ঠে প্রহন বলে উঠলো,
“কীরে পিচ্চি, কেমন আছো?”

হঠাৎ প্রহনের কন্ঠস্বর শুনে চকিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো চৈতি। মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে থাকা প্রহনের হাসি মুখ দেখেই বুকের বা পাশে চিন চিনে ব্যাথা অনুভব হলো।
চোখ ফিরিয়ে নিলো চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন চৈতির মুখ বরাবর দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে মোবাইল টা রেখে চলে যেতে যেতে বললেন,
“ঐযে দূরের চড়ুই পাখি গুলোর মতো এখন বউয়ের অভিমান ভাঙ্গাও। আমি গেলাম।”

অবাক দৃষ্টিতে মিসেস ইয়াসমিন এর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে চৈতি। মোবাইল টা না রেখে গেলেও হতো। অদ্ভুত!
ভুলেও মোবাইলের স্ক্রিনে সরাসরি তাকালো না চৈতি। অভিমান জমেছে। ভীষণ অভিমান!

কানে হাত দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে চৈতির দিকে তাকিয়ে সরি বললো প্রহন।
“পিচ্চি সরি। তুমি অসুস্থ তার উপর সারা রাত ছটফট করে সকালের দিকে ঘুমিয়ে ছিলে তাই আর ডাকিনি তোমায়।”
আড় চোখে প্রহনের দিকে এক বার তাকালো চৈতি। মুখের হাবভাব পরিবর্তন হলো না। আগের নেয় উদাসীন।

“পিচ্চি,জ্বর কমেছে? শরীর কেমন আছে?খেয়ে ছিলে দুপুরে? ঔষধ খেয়েছো?”

প্রত্যত্তর করে না চৈতি।
“ও পিচ্চি এত অভিমান কোথা থেকে আসে বলো তো? পিচ্চি একটা মেয়ের এত অভিমান?”

“আপনার সাথে কথা নেই আমার।”
কন্ঠে রাগ।

“এত অভিমান করতে নেই মেয়ে। অভিমানের পাল্লা ভারী হতে দিলে যে দূরত্ব তৈরি হয়।সেকি তুমি জানো না পিচ্চি?”

মুঠোফোনের স্ক্রিনে নেত্র জোড়া আবদ্ধ করলো চৈতি। সেখানে ভেসে আছে সেই পরিচিত বদন খানি।অধর জুড়ে লেপ্টে আছে নজর কাড়া হাসি। হাওয়া মিঠাইয়ের মতো নীরবে নিভৃতে গলে গেল অভিমানের পাহাড়।
জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। পিঠের মেরুদন্ড সোজা করে বসে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে দুর্বল শরীরে।অসুখ যেনো জেঁকে বসেছে। শরীরে অসুখ, মনের অসুখ,একটা মানুষকে কাছ থেকে দেখতে চাওয়ার তীব্র অসুখ।

চৈতির দৃষ্টি এলোমেলো হতে দেখে ঘাবড়ে গেল প্রহন।
“পিচ্চি,মাকে ডাক দাও।”

কথা বের হবার আগেই কন্ঠ নালিতে তা আটকে গেল।বসা অবস্থায় দুর্বল শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।অপর প্রান্তে বসে থাকা মানব থমকে গেল।চাইলেও ধরতে পারলো না অবচেতন কিশোরীর শরীর খানি। নিজের বাহু ডরে আগলে নিতে পারলো না।

কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ছুটে আসেন মিসেস ইয়াসমিন।
জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা চৈতি কে দেখে কিছুক্ষণ এর জন্য থমকে যান মিসেস ইয়াসমিন।
মোবাইল এর ওপাশ থেকে প্রহন চিৎকার করে বলছে,
“আম্মু পিচ্চির চোখে মুখে পানির ঝাপটা দাও।”

মিসেস ইয়াসমিন রুমের ভেতরে রাখা জগ থেকে পানি নিয়ে দ্রুত চৈতির কাছে চলে গেলেন। চৈতির মাথা নিজের কোলের উপর রেখে চৈতির চোখে মুখে পানি দিলেন।
দুই হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরলো প্রহন।উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। অপরাধী কন্ঠে বিড় বিড় করছে,
“সব দোষ আমার। অবেলার বৃষ্টিতে মেয়েটাকে না ভেজালেও পারতাম। আজ আমার জন্য এত অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

চৈতির গায়ে হাত দিতে পারছেন না মিসেস ইয়াসমিন। ঝলসে যাচ্ছে যেনো।এত তাপমাত্রা বেড়েছে শরীরের। পানির জগ থেকে হাতের মধ্যে পানি নিয়ে চৈতির চোখে মুখে ঝাপটা দিলেন।
এক বার, দুই বার, কয়েক বার দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরলো চৈতির।দেহে প্রান ফিরে আসে মিসেস ইয়াসমিন এর।ধরে ধরে চৈতি কে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলেন।
বেলকনি থেকে মোবাইল টা নিয়ে প্রহন কে বললেন,
“সব ঠিক আছে। চিন্তা করতে হবে না। দুপুরে না খাওয়ার জন্য শরীর বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।”

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহন।”আমার সব দোষ। মেয়েটা যে এতো অভিমানী বুঝতেই পারিনি। বোঝা উচিত ছিল আমার।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও এখনি।আর যদি ওর যেতে বেশি কষ্ট হয় তাহলে ডাক্তার আঙ্কেল কে ফোন করে বলে দাও।চলে আসতে।ওরে কিছু খাইয়ে দাও।ডাক পড়েছে আমার।সি ও স্যার ডাকছেন।পরে কল করবো।”
কথা গুলো বলার দেরি হলেও লাইন কাটতে এক সেকেন্ড ও দেরী হয়নি প্রহনের।

মিসেস ইয়াসমিন মোবাইল টা চৈতির বালিশের পাশে রেখে চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“খাবার আনছি, অল্প হলেও খেতে হবে। একদিনের জ্বরেই শরীর কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে দেখেছিস?এত অভিমান করলে হবে?”

ক্লান্ত দৃষ্টিতে মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে চেয়ে আছে চৈতি। এই ভীষণ জ্বরে সব পুড়ছে। শরীর,মন,আত্মা সব পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন অস্থির লাগছে বুঝতে পারছে না কিশোরীর অবচেতন চিত্ত।
“বিরহ অনলে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে গোটা মানুষটাই।সে কথা বুঝবে কখন নবীনা কিশোরীর নরম কোমল হৃদয় খানি?”

চলবে,,,,,
#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

গোধূলির মেহেদীরাঙা অন্তরীক্ষ পরিযায়ী পাখিদের দখলে। সায়াহ্নের প্রহর ঘনিয়ে এসেছে।ব্যস্ত নগরীর কোলোহল বেড়ে গেছে। গাড়ির বিরক্তিকর হর্নের শব্দে মুখরিত চার পাশ।ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত যে যার মতো।
বিশাল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিরিবিলি এক জায়গায় হাঁটুতে কনুই রেখে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে প্রহন। নিজের উপর চরম বিরক্ত সে। মেয়েটা কে একটু বলে আসলে কী এমন ক্ষতি হতো? পরক্ষনেই মন বলে উঠে,
“অসুস্থ ছিল তো। সারারাত ছটফট করে সকালের দিকে ঘুমিয়ে ছিল।কী করে এই অসুস্থ মেয়েকে জাগিয়ে দিতাম আর?”বিষন্ন অবস্থায় হঠাৎ আনমনে হেসে ফেললো প্রহন। একটা কথা মনে পড়তেই এক ঝাঁক ভালো লাগা এসে ছুঁয়ে গেলো। গভীর নিদ্রায় মগ্ন কিশোরীর কপালে অধর ছুঁয়ে দেওয়ার কথা যে প্রহন ছাড়া কেউ জানে না। সেই নিদ্রাময়ী ও না।
বিয়ে করতে না করতেই মেয়েটার প্রতি একটা আলাদা অদৃশ্য টান কোথা থেকে চলে এলো বুঝতে পারে না প্রহন।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।সিও স্যার এর সাথে দেখা হয়েছে। কথা ও হয়েছে। মানুষ টা যথেষ্ট ভালো। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এর মতো রাগী না।যদিও
প্রহনের সাথে কখনো রেগে কথা বলেনি তবুও তাকে ভালো লাগে না প্রহন এর।
.
রেদোয়ান চৌধুরী সন্ধ্যার পর ডাক্তার নিয়ে আসেন। বিছানার সাথে মিশে আছে চৈতির দেহ। উঠে দাঁড়ানোর ও শক্তি নেই তার শরীরের মধ্যে। সরদার সাহেব বিকেলে ফোন করলে মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে জুনাইদা কে নিয়ে রেদোয়ান চৌধুরীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মিসেস ইয়াসমিন চৈতির মাথায় পানি ঢেলে মাথা মুছিয়ে বালিশের উপর শুইয়ে দিলেন।
জ্বরে একে বারে ঘায়েল হয়ে গেছে মেয়েটা।ডাক্তার চৈতির শারীরিক অবস্থা দেখে স্যালাইন পুশ করে দেন। শরীর একে বারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। থার্মোমিটারে শরীরের তাপমাত্রা মাপলে তা ১০৪ ডিগ্রির ঘরে গিয়ে থামে। ঔষধ লিখে দিয়ে ডাক্তার বিদায় নিলেন। রেদোয়ান চৌধুরী মিসেস ইয়াসমিন কে চৈতির পাশে থাকতে বলে ডাক্তার কে এগিয়ে দিয়ে ফার্মেসি থেকে ঔষধ নিয়ে আসবেন জানিয়ে চলে যান।
মিসেস ইয়াসমিন এর ফোন বেজে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেন প্রহন ভিডিও কল দিয়েছে। মিসেস ইয়াসমিন কল রিসিভ করতে না করতেই চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“চৈতি কেমন আছে আম্মু?জ্বর কমেছে ওর?”

মিসেস ইয়াসমিন হতাশ কন্ঠে প্রত্যত্তর করলেন,
“নারে বাবা। মেয়েটার শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে।ডাক্তার স্যালাইন দিয়ে গেছেন। ঘুমিয়ে আছে চৈতি।”

প্রহন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। চাইলে ও সে কিছুই করতে পারছে না। খারাপ লাগা এসে ছুঁয়ে গেছে তার মন, শরীর,আত্মাকে।শত শত মাইল দূরে তার প্রিয়সী তার বিরহে জ্বলে পুড়ে মরছে।অথচ ব্যার্থ প্রেমিক দূর থেকেই ছটফট করে মরছে।প্রিয়সীর এই অসুস্থতা তার উপরে ও প্রভাব ফেলেছে ভীষণ।

মোবাইল এর ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে মিসেস ইয়াসমিন ঘুমন্ত চৈতিকে দেখালেন। ভিডিও কলে চুপ করে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই প্রহনের।

নিস্তেজ,নিষ্প্রান,চৈতন্যহীন,নিঃসড়, চৈতি কে দেখে ভালো লাগছে না তার।মন চাচ্ছে উড়ে যেতে তার চঞ্চলা হরিণীর কাছে। কিন্তু, এই একটা কিন্তুর জন্য অন্তহীন অপেক্ষা করতে হবে। প্রহন লাইন কেটে দিল।এই অবস্থায় মেয়েটা কে দেখতে ইচ্ছে করছে না।চিত্ত জুড়ে খারাপ লাগার বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

সরদার সাহেব আর জুনাইদা এসে পৌঁছেছেন কিছুক্ষণ আগেই। মেয়ের এমন অসুখ দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো সরদার সাহেব এর।কতো আদরের মেয়ে। সেই মেয়ের এমন অবস্থায় প্রতিটি বাবাই ভেঙ্গে পড়বেন। সরদার সাহেব চৈতির মাথার পাশে গিয়ে বসলেন।আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন। জ্বর কমেছে।পিট পিট করে চোখ মেলে তাকায় চৈতি।জ্বরের ঘোরে সে যেনো প্রহন কে দেখতে পাচ্ছে।
বিড় বিড় করে বলছে,
“আপনি আপনার উপর ভীষণ অভিমান করেছি ক্যাপটেন সাহেব। ভীষণ অভিমান!”
বিড় বিড় করে বলা কথা অসুস্থ চৈতির মাঝেই হারিয়ে গেল।কারো কর্ণপাত হয়নি অভিমানী কিশোরীর অভিমানে ভরা কথা গুলো।

সরদার সাহেব আদুরে গলায় মেয়েকে ডাকলেন,
“আম্মা, বেশি খারাপ লাগছে?এত জ্বর কী করে উঠলো আম্মা?”

চোখ পিটপিট করে বাবার দিকে তাকালো চৈতি। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে সে। সরদার সাহেব বুঝতে না পেরে চৈতির মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শোনার চেষ্টা করেন মেয়ের কথা।
“আপনি আমাকে কেন বলে গেলেন না?” এই একটা কথাই বার বার করে বলছে চৈতি। মেয়ের কথার কিছুই বুঝলেন না সরদার সাহেব।
রেদোয়ান চৌধুরী ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরে সরদার সাহেব আর জুনাইদা কে দেখে অপরাধী কন্ঠে বললেন,
“দুঃখিত ভাইয়া, আমরা আপনার আদরের কন্যার সঠিক খেয়াল রাখতে পারিনি। আমাদের মাফ করবেন। নতুন জায়গায় মেয়েটা মানিয়ে নিতে না পেরে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো।”

সরদার সাহেব রেদোয়ান চৌধুরীর এমন ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন।কয়েটা মেয়ের শ্বশুর এই ভাবে বলতে পারে? তার মেয়ে যে ভাগ্যবতী।এত ভালো মানুষ গুলো কে জীবনে পেয়েছে।
সরদার সাহেব রেদোয়ান চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরে বললেন,”আমার মেয়ে সহজে অসুস্থ হয় না। একবার অসুস্থ হলে একে বারে ঘায়েল হয়ে বিছানার সাথে লেগে যায়। ছোট থেকেই এরকম ও।”

সেদিন রাতে শরীর ঘামিয়ে সব জ্বর চলে গেল চৈতির শরীর ছেড়ে।ক্যানেলার টা হাত থেকে খুলে ফেলে ছিলেন রেদোয়ান চৌধুরী। গভীর নিশুতি শর্বরে ছেয়ে গেছে। রাত জাগা পাখিদের ডাক ভেসে আসছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মানুষ জনের কথার শব্দ নেই।সবাই নিদ্রায় মশগুল হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা টুং টুং আওয়াজ করে জানান দিচ্ছে রাত ২টা বেজেছে।
মিসেস ইয়াসমিন এর মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল এর রিংটোন এর শব্দ বেশ জোরেই শোনা যাচ্ছে। তন্দ্রা ভাব কেটে গেল মিসেস ইয়াসমিন এর। কিছুক্ষণ আগেই দু চোখের পাতা এক করে ছিলেন।এত জোরে মোবাইল এর রিংটোন এর আওয়াজ কানে যেতেই ঘুম ভাঙ্গল চৈতির। মোবাইল হাতে নিয়ে প্রহন এর নাম্বার দেখে দ্রুত কল রিসিভ করে চৈতির হাতে মোবাইল দিয়ে বললেন,”তোর চিন্তায় আমার ছেলেটার ঘুম হচ্ছে না। কথা বলে ঘুমাতে বল।ওর আবার সকাল সকাল উঠতে হয়।”
চুলে খোঁপা করে বসা থেকে উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন মিসেস ইয়াসমিন।জল তেষ্টা পেয়েছে খুব। জগের মধ্যে জল নেই।হাতে জগ নিয়ে ডাইনিং টেবিলের ও দিকে চলে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন।

কাঁপা কাঁপা হাতে কানের কাছে মোবাইল ধরলো চৈতি।
“আম্মু, পিচ্চি ঠিক আছে?জ্বর কমেছে?”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর পায় না প্রহন। চিন্তায় কপালের ভাজ গাঢ় হলো।
“কী হলো? কথা বলছো না কেন?”

কোনো জবাব নেই।রেগে গেলো প্রহন।রাগি কন্ঠে চিল্লিয়ে বললো,”আর আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। আমি কিন্তু এখনি চলে যাবো। চাকরি গেলে যাক।”

“ঘুমাননি কেন এখানো?”
অনেক অপেক্ষার পর প্রিয়সীর কন্ঠস্বর শুনে কলিজায় পানি আসলো প্রহন এর।এক নিমিষেই হারিয়ে গেল সব রাগ।”পিচ্চি ঠিক আছো তুমি?জ্বর কমেছে? সুস্থ হয়েছো?শুনো না আমি আর কখনো তোমাকে বৃষ্টিতে ভিজাবো না। তুমি চাইলে ও কখনো ভিজতে দিবো না।”

ঘুমে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না চৈতি। বিছানায় শুয়ে কানের কাছে মোবাইল রেখেই আস্তে আস্তে বললো,”ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি ঠিক আছি।”

সারাদিন এর এত খারাপ লাগা যেন এই মাঝ রাতে ভালো লাগা হয়ে গেছে। মিসেস ইয়াসমিন রুমে এসে দেখেন কানের কাছে মোবাইল পড়ে আছে আর চৈতি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হাসলেন এই দুই জনের কান্ড দেখে।এত দ্রুত এরা এত আপন হয়ে উঠবে ভাবেননি তিনি। মোবাইল নিয়ে প্রহনের উদ্দেশ্যে আদেশি কন্ঠে বলেন,
“বউ এর জন্য আর চিন্তা করতে হবে না। আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। তুমি ও ঘুমাও। সকালে ফ্রী হয়ে ফোন করে কথা বলে নিও।”

ওপাশ থেকে একটা ছোট্ট উত্তর এলো,”আচ্ছা।”
লাইন কেটে গেল। চৈতির রুমের আলো নিভে গেল। চারদিক আবারো আলোহীন হয়ে গেল। শুধু দূরের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পোস্ট গুলোর আলো রয়ে গেল। পথচারী কে পথ দেখানোর জন্য।এই নিশিতেও যে নিশাচররা ঘুরে বেড়ায়।

বালিশের উপর মাথা রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন। মিটি মিটি হাসছে সে। এমন উন্মাদ কখনোই ছিল না যে ছেলে আজ সেই ছেলের মধ্যে কত পার্থক্য।একটা মানুষ কে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার নামই হয় তো ভালোবাসা।
সেদিন রাতে কেউ একজন নীরবে বলে উঠে,
“আমি কার পথে তে ছুটে চলি,যেন কার মায়াতে বাঁধা পড়েছে জীবন যে!ডুবে মরছি সেই মোহতে।”

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here