অন্তহীন💜 পর্ব-৩৫

0
1865

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

প্রভাতের বিশুদ্ধ হাওয়ায় হেলেদুলে পড়ছে গাছের পাতা।শীতল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছেন মিসেস ইয়াসমিন।চোখ দুটো ফুলে আছে।লাল ও কিছু টা।রাতে ঘুম হয়নি তার উপর কান্না করেছেন সারা রাত। পূর্ব দিগন্তে আদিত্য কে এখনো দেখা যাচ্ছে না।ভোরের আলো ফুটেছে কিছুক্ষণ আগে।
হসপিটালের করিডোরে পাইচারী করছে প্রহন। রাতের শেষ দিকে চোখ লেগে এসেছিল। ঘন্টা খানেক পর তন্দ্রা ভাব কেটে গেল।
রেদোয়ান চৌধুরীর জ্ঞান ফিরেছে কিনা জানতে পারছে না।
সারা রাতে চৈতির কিছুটা ঘুম হয়েছে আবার ভেঙ্গেছে।
এত অশান্তির মধ্যে শান্তির ঘুম ঘুমানো যায় না।
শোয়া থেকে উঠে মা কে খুঁজতে লাগলো চৈতি। কিন্তু পুরো রুমে সে একা।
নামাজ পড়তে উঠে গেছে মনে করে সে আর খুঁজলো না। উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিতে চলে গেল।

“এত সকালে ছাদে কি করছেন আপা?”
কারো গলা শুনে চমকে পিছনে তাকান মিসেস ইয়াসমিন।জুইনাদা দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”নামাজ পড়েই এলাম কিছুক্ষণ আগে।। ভালো লাগ ছিল না।”
মিসেস ইয়াসমিন এর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন জুনাইদা। কথা না বাড়িয়ে বললো,”নাস্তা তো বানাতে হবে। আপনি যদি আমাকে জিনিস গুলো দেখিয়ে দিতেন সুবিধা হতো আর কি।”
“সে কি আপনি কেন নাস্তা বানাবেন আমি যাচ্ছি বানিয়ে নিবো।”
জুনাইদা কাপট রাগ দেখিয়ে বললেন,”হয়েছে আপনাকে বানাতে হবে না আজ। আমি জানি আপনার মনে শান্তি নেই।তার পর ও আপনাকে কাজ করতে দিতে পারি না।”
মিসেস ইয়াসমিন মৃদু হাসলেন। অনেক গুলো বছর পর কেউ তাকে বুঝলো।একটু হলেও বুঝলো।
মিসেস ইয়াসমিন কে সাথে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল জুনাইদা। রান্না ঘরে এসে দেখেন চৈতি চায়ের পানি বসিয়েছে। বিয়ের পর এই প্রথম নিজের হাতে কিছু বানাতে রান্না ঘরে এসেছে।এই অসময়ে কিছু না করা টা কে বিবেকে সায় দিচ্ছে না।তাই তো নামাজ পড়ে এক মিনিট ও দেরি না করে রান্না ঘরে চলে এলো।
চৈতি কে কাজ করতে দেখে মনে মনে খুশি হলেন জুনাইদা। মেয়ে বুঝতে শিখেছে পরিস্থিতি।বড় হয়ে গেছে যে।
.
রেদোয়ান চৌধুরীর জ্ঞান ফিরেছে। বাবার ডান হাতটা ধরে বেডের পাশে বসে আছে প্রহন।চিত্ত জুড়ে বয়ে যাচ্ছে খুশির দমকা হাওয়া। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করে মাকে জানিয়ে দিলো।বাবা আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ আছে।
মিসেস ইয়াসমিন এর বুকের উপর থেকে যেন বড় কোনো পাথর সরে গেল। আল্লাহ তার কথা শুনেছে দেখে এক বেলা এতিম শিশুদের খাওয়ানোর নিয়ত করলেন তিনি। রেদোয়ান চৌধুরী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে তাকে নিয়ে এক সাথে এতিম শিশুদের খাবার পরিবেশন করবেন। বুকের ভেতর যে অশান্তি টা ছিল তা চলে গেছে প্রহনের কথা শুনে।
আজ আবার চৈতির পরীক্ষা আছে।ঘড়িতে তখন সময় সকাল আটটা। মিসেস ইয়াসমিন চৈতিকে জোর করে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন।যেতে না চাইলেও শুনলেন না মিসেস ইয়াসমিন। চৈতি কে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়ার পর সরদার সাহেব,জুনাইদা আর সজীব সাদিক এর সাথে হাসপাতালে চলে গেলেন রেদোয়ান চৌধুরীর সাথে দেখা করতে। লোকটাকে তিনি আচ্ছা মতন বকে দিবে বলে মনে মনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন মিসেস ইয়াসমিন।সব কিছুতেই মানুষটার বাড়া বাড়ি। বুকের ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল তা যদি একটা বার বলতো তাহলে আজ এই ভয়াবহ দিন দেখতে হতো না। গতকাল রাত থেকে সকাল পর্যন্ত যে কীসের উপর বেঁচে ছিলেন তিনি তা শুধু মহান সৃষ্টিকর্তা আর মিসেস ইয়াসমিন জানেন।
.
“আমাকে তুমি কেন বললে না আব্বু যে তোমার শরীর প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেছে।মাকে ও তো বলতে পারতে তোমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তুমি জানো তোমার এই অবস্থা দেখে আমি নিজেই ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছিলাম।”
রেদোয়ান চৌধুরী কোনো সাড়া দিলেন না প্রহনের কথায়।ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন শুধু।পাশ থেকে ডাক্তার বলে উঠলেন,”পেশেন্ট কে দিয়ে এখন কোনো কথা বলানোর চেষ্টা না করাই উচিত।সবে তো জ্ঞান ফিরেছে। কিছুক্ষণ সময় যাক।নিজে থেকেই কথা বলবে। আপনি বরং সকালের নাস্তা টা করে আসুন।আর পেশেন্ট এর জন্য কিছু ফল নিয়ে আসুন।”
ডাক্তারের কথায় সায় দেয় প্রহন।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এক পলক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

রেদোয়ান চৌধুরী কে দেখে মুচকি হাসলেন মিসেস ইয়াসমিন। তার মানুষ টা এখন ও তার কাছেই আছে। ভাবতেই তো ভালো লাগে। শান্তি তে ভরে উঠে মন।
রেদোয়ান চৌধুরী ধীর কন্ঠে বললেন,”মরতে মরতে ও বেঁচে গেলাম ইয়াসমিন। তোমার সাথে বই নিয়ে ঝগড়া করার জন্য।”
মিসেস ইয়াসমিন কান্না করে দিলেন। রেদোয়ান চৌধুরী কে কিছুটা ধমকের স্বরে বললেন,”একদম উল্টা পাল্টা কথা বলবা না তুমি। আমি আর আমার ছেলে মেয়েরা জানি তুমি ছাড়া আমরা কতটা অসহায়।আমরা না থাকলেও তোমার কিচ্ছু যায় আসে না। তোমার তো বই আছে। কিন্তু আমাদের তো তুমিই ভরসা।”
“তোমরা ছাড়া আমি বই দিয়ে কী করবো?তোমরা ছাড়া যে আমি ভীষণ একা।মরে গেলে একা হয়ে যাবো দেখে আল্লাহ আমাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
এমন সময় প্রহন হাতে পলিথিনে করে ফল নিয়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,”শুরু হয়ে গেছে না তোমাদের বই নিয়ে ঝগড়া? এই দুটো বুড়ো বুড়ি কে নিয়ে আমি আর পারলাম না।”
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”আমি স্যুপ রান্না করে নিয়ে এসেছি। ওটা খাইয়ে দিলেই তো হবে।”
“ভালো করেছো। আমি আরো তোমাকে ফোন করে বলতাম সেই কথা।”

রেদোয়ান চৌধুরী কে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেওয়ার পর মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের উদ্দেশ্যে বললেন,”চৈতি আজ একা একা স্কুলে গেছে। তুই ওকে গিয়ে নিয়ে আসিস। মেয়েটা যেতে চাচ্ছিলো না। আমি জোর করে পাঠিয়েছি। পরীক্ষা ছিল তাই।”

প্রহনের ফোনে কল আসায় সে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”আচ্ছা।”

সকালে রোদ থাকলেও দুপুরের দিকে আকাশ মেঘলা হয়ে এলো। ক্লাসে গাল ফুলিয়ে বসে ছিল চৈতি। দৃষ্টি তার বাইরের বিশাল মাঠে। কোনো রকম পরীক্ষা টা দিয়েছে সে।মন শুধু ছুটে যেতে চাচ্ছে হাসপাতালে। মনের গভীর থেকে খুব করে চাচ্ছে সে যেন সব কিছু আগের মতো হয়ে যায়।বিপদ আপদ একদম ভালো লাগে না।সুখে ভরা সংসার গুলোতেই যেন বিপদ এসে কড়া নাড়ে।সুখে আর থাকতে দেয় না।
নতুন স্কুলে চৈতির একজন ভালো বান্ধবী হলো। মেয়েটার নাম মনিকা। চৈতি কে উদাসীন ভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,”কী হয়েছে তোর চৈতি?মন খারাপ?”
চৈতি বাইরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মনিকার দিকে তাকালো। ঠোঁট উল্টে বললো,”আমার আব্বু অনেক অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি ভালো লাগছে না কিছু।”
মনিকার অজানা চৈতি যে বিবাহিত।সে ভেবে নিয়েছে যে হয়তো চৈতি তার নিজের বাবার কথাই বলেছে।
সে চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,”তাহলে তুই এক কাজ কর,স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যা।”
মনিকার কথায় রাজি হলো চৈতি। কিন্তু পরে মনে পড়লো সব গুলো ক্লাস না করলে প্রহন বকা দিবে সাথে মিসেস ইয়াসমিন ও।তাই আবারো মন খারাপ হয়ে গেল তার।বামে ডানে মাথা নেড়ে বললো,”নারে মনি,যাবো না।সব ক্লাস না করে গেলে কপালে শনি আছে।”

এই রোদ তো এই ধূসর মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে অন্তরীক্ষ।মেঘ সূর্যের এমন লুকোচুরি খেলা দেখতে মন্দ লাগছে না চৈতির।স্কুল ছুটি হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রহনের জন্য অপেক্ষা করছে সে। সকালে আসার সময় মিসেস ইয়াসমিন বলে ছিলেন প্রহন নিতে আসবে। পাঠাবেন তিনি প্রহন কে। চৈতি ও তাই অধির আগ্রহে প্রহনের পথ চেয়ে আছে।আজ সারাদিন এ একটা বারের জন্য ও দেখা হয়নি মানুষ টার সাথে।অথচ যাকে দেখে তার প্রত্যেকটা দিনের শুরু হয়।রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা চেনা মুখটা চোখের সামনে পড়তেই অধর জুড়ে বয়ে গেলো হাসির রেখা। প্রহন কে দেখে চৈতি রাস্তা পার হতে গেলে প্রহন রাস্তার উপাশ থেকেই চিল্লিয়ে বললো,”তুমি ওখানেই থাকো চৈতি। আমি আসছি তো।”

কিশোরীর অবচেতন চিত্ত তখন বার বার বলে উঠছিল,”আপনার কাছে যাওয়ার তর সইছে না আমার।”

চলবে,,,,
(অসুস্থ ছিলাম ভীষণ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here