#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৬
#স্নিগ্ধা_আফরিন
রাস্তা পার হয়ে প্রহন চৈতির কাছে আসতেই প্রহনের উদ্দেশ্যে চৈতির একটাই প্রশ্ন,”আব্বু কেমন আছে?”
মেয়েটার চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠেছে। চিন্তিত সে। প্রহন মৃদু হেসে বলে,”জ্ঞান ফিরেছে। ভালো আছে।
আলহামদুলিল্লাহ।”
.
আদিত্যের প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে প্রকৃতি। জৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময়। চৌধুরী ভিলা সুনসান। দুপুর ৩টা বাজে। কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্ত শরীর টা এলিয়ে দিল বিছানায়।মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। বাতাস গুলো গায়ে লাগতেই ঘুমে চোখ বুজে আসছে চৈতির। রান্না ঘর থেকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে রুমে এসে চৈতি কে শুয়ে থাকতে দেখে ডাক দেয় প্রহন।
“চৈতি উঠো।ফ্রেশ হয়ে ঠান্ডা শরবত খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”
পিট পিট করে চোখ মেলে প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। প্রহন হাতে গ্লাস নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এত কেয়ার দেখে নিজেকেই নিজের হিংসা হয় চৈতির।এতটা ভালোবাসা,যত্ন পাওয়ার যোগ্য সে নয়।মনে মনে এটাই চিন্তা করে চৈতি।এইতো কিছুক্ষণ আগেই কী সুন্দর সিনেমার প্রেমিক এর মতো করে রাস্তা পার করে নিয়ে এলো।আপন মনে হাসলো চৈতি। মানুষ টা একটু বেশিই ভালো।
আলসেমির পরীরা এসে চেপে ধরেছে চৈতি কে।সাথে তন্দ্রা পরী ও।এক চোখ বন্ধ করে আরেক চোখ মেলে প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললো,”একটু ঘুমাই?উঠতে ইচ্ছে করছে না।”
প্রহন কিছু বললো না।এক পলক চৈতির দিকে তাকিয়ে হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বিছানায় শুয়ে থাকা চৈতির হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল বিছানায়। চৈতি আবারো শুয়ে পড়তে চাইলে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ঠোঁট ফুলিয়ে প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। প্রহন চোখের ইশারায় বললো,”ফ্রেশ হয়ে নাও।”
চৈতি প্রহনের বুকে একটা কিল মেরে বললো,”অসহ্য। অসভ্য লোক একটা।”
অগত্য চৈতি কে ফ্রেশ হতে যেতেই হয়। প্রহন মৃদু হেসে পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে ব্যালকনির দিকে চলে গেল।
“হ্যালো আম্মু, আব্বুর এখন কী অবস্থা? আগের চেয়ে ভালো আছে তো?”
“হুম আগের চেয়ে অনেক টা ভালো। আলহামদুলিল্লাহ।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়েছো?”
“হুম খাইয়েছি।”
“তুমি খেয়েছো?আর চৈতির আব্বু আম্মু ভাইয়েরা?”
“খেয়েছি।চলে গেছেন উনারা। আমি পাঠিয়ে দিয়েছি।বাড়ি রুপা সিফা একা।রুপা এমনিতেই অসুস্থ।”
“ওহ আচ্ছা। ভালো করেছো। আমি একটু পর আসবো।”
“এখন আসতে হবে না। চৈতি কে নিয়ে আসছিস স্কুল থেকে?”
“এই তো কিছুক্ষণ আগেই নিয়ে আসলাম।”
“আমি সকালে রান্না করে রেখে এসেছি। চৈতি কে নিয়ে খেয়ে নিস।আর শোন, চৈতি রোদ থেকে এসেছে,এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দিস। তোর জন্য ও।যা গরম পড়েছে আজ।”
মিসেস ইয়াসমিন এর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলো প্রহন। কথা শেষে পেছনে ফিরতেই দেখলো চৈতি এক হাতে তোয়ালে আরেক হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রহন বিস্ময় নিয়ে দেখলো চৈতি কে। মিনিট দশেক এর মধ্যে মেয়েটা গোসল করে ফেলেছে।
“এত জলদি গোসল করে ফেললা যে? তোমার তো আবার ঘন্টা খানেক সময় লাগে।”
“সব সময় ঘন্টা খানেক সময় লাগে না।”
চৈতি প্রহনের হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বললো,”চুল মুছে দিন।আলসেমি লাগে আমার। আপনি আমার কাছে যত দিন আছেন গোসলের পর আমার চুলের পানি মুছিয়ে দেওয়ার কাজটা ও আপনার।মনে রাখবেন সব সময়।”
প্রহন চৈতির চুল মুছতে মুছতে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”তোমার ভেজা চুল মুছার কামলা নাকি আমি? বেতন কত দাও মাসে?”
চৈতি শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললো,”মাসে নাই টাকার বেতন।”
প্রহন চৈতির চুল মুছচে এবং খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চৈতির শরবত খাওয়া দেখছে। হঠাৎ চৈতির চুলে টান মারতেই ব্যাথায় আহ করে উঠলো চৈতি।
প্রহন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”তোমাকে শরবত খেতে দিয়েছি।চা খেতে না। এখন যদি তিন ঢোকে শরবত না গিলছো তাহলে তোমার মাথার একটা চুল ও থাকবে না কিন্তু।”
প্রহন কথা গুলো শুনে চোখ মুখ খিঁচে শরবত গুলো শেষ করলো চৈতি। প্রহনের কাছ থেকে সরে এসে বললো,”দিন দিন বেশি বকা দিচ্ছেন আমাকে। খুব বেড়ে গেছেন। আব্বু সুস্থ হয়ে নিক তারপর আপনার নামে নালিশ করবো।”
চৈতির কথা শুনে হাসলো প্রহন। মুচকি হেসেই বললো,”আচ্ছা যত খুশি নালিশ করো। এখন একটু খাবার বেড়ে এখানে নিয়ে চলে আসো। আমি গোসল টা করে নি।”
চৈতি যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে পেছন থেকে প্রহন আবারো ডাক দিয়ে বললো,”শুনো…”
চৈতি পেছনে ফিরে তাকায়। প্রহন মুচকি হেসে বললো,”এক প্লেটে নিয়ে এসো।”
চৈতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। প্রহন ও গোসল করার জন্য কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। হসপিটালের ভ্যাপসা একটা গন্ধ জেনো গায়ে লেগে আছে এখনো। সাথে জৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরম ফ্রী।
এই গরমে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল মানেই শান্তি।
রান্না ঘর থেকে এক প্লেটেই খাবার নিয়ে রুমে এলো চৈতি। ভাগ্যে ভালো যে সময় টা এখন দিন।রাত হলে এত বড় বাড়িতে তাও মাত্র দুজন মানুষ,তাকে যদি রাতে খাবার আনতে বলা হতো জীবনেও আনতে রাজি হতো না সে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রহন। বিছানার উপর চৈতি কে বসে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো।
তার কথা মতো এক প্লেটেই খাবার নিয়ে এসেছে।
নিজের হাতে চৈতি কে খাইয়ে দেয় প্রহন। সাথে নিজেও খেয়ে নেয়। বাইরের তাপমাত্রা কিছুটা কমলে সন্ধ্যার দিকে হসপিটালে যাওয়ার কথা বললেন মিসেস ইয়াসমিন।এই রোদের মধ্যে এখন হসপিটালে যাওয়ার দরকার নেই।
বিছানায় প্রহনের পাশেই শুয়ে ছিল চৈতি।আর চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিল প্রহন। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোন টা অনর্গল বেজেই চলেছে সেই কখন থেকে।হাত বাড়িয়ে মোবাইল টা নেয় প্রহন।স্ক্রিনে সিইও স্যারের নাম্বার।
কিছুটা বিরক্ত হলো প্রহন।কল রিসিভ করে সালাম দিয়ে কুশোল বিনিময় করে নিলো। কিন্তু সিইও স্যারের কন্ঠটা কেমন গম্ভীর শোনা যাচ্ছে।সব প্রশ্নের উত্তর কেমন যেন ত্যাড়া ভাবে দিচ্ছেন। এই যেমন,
“ভালো আছেন স্যার?”
বললে তিনি অপর প্রান্ত থেকে বলছেন,”ভালো থাকি আর না থাকি তাতে কি আসে যায়?”
প্রহন বুঝলো ব্যাপার টা সিরিয়াস।এই টাকলা নিশ্চিত রেগে আছে। সিইও স্যার কে টাকলা বলার একটা বিশেষ কারণ হচ্ছে তার মাথার মাঝখানে চুল নাই।
সিইও স্যার কে ঠান্ডা করার জন্য বললো,”স্যার আমার আব্বু ভীষণ অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি আছেন।”
সিইও স্যার ঠান্ডা হলেন না।বরং আরো এক ধাপ রেগে গেলেন। রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,”ফাজলামি করার জায়গা পাও না তুমি?মা হাসপাতালে ভর্তি তো বাবা হাসপাতালে ভর্তি। একটা কাজ করো তোমার চাকরী টা করারই দরকার নাই। তুমি বরং তোমার বাবা মায়ের জন্য হাসপাতালের নার্স কে বিয়ে করে তাদের নিয়েই থাকো।”
“দেখুন স্যার, আমি সত্যি বলছি। আমি দরকার হলে আপনাকে হসপিটালের নাম, কেবিন নাম্বার, আমার আব্বুর নাম সহ সব ধরনের ডিটেলস পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি খোঁজ খবর নিয়ে দেখেন।”
“ওকে ডান। তুমি বরং তোমার পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসো। তোমাকে ফ্যামেলি কোয়াটার দেওয়া হবে।”
“হ্যালো,হ্যালো স্যার শুনতে পারছি না কীছু।হ্যালো,হ্যালো,কী নেট প্রবলেম। ধুর।”
বলেই কল কেটে দিলো প্রহন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। চৈতি হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
নেট প্রবলেম এর অজুহাতে কল কেটে দেওয়ার ব্যাপারটা দারুন লেগেছে তার।
প্রহন চৈতির দিকে ভ্রু কুঁচকে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটা হাসলে তার চোখ গুলো ও হাসে। প্রহনের ভয় হয় তা দেখে।হাসলে যাদের চোখ ও হাসে তারা নাকি বেশি দিন বাঁচে না। তার বড় বোনের ও এমন হতো।মা বলতে শুনেছে সে।যদি ও এই সব আজগুবি কথায় সে বিশ্বাস করে না।তার পর ও মনের ভেতর কেমন যেন উশখুশ করে।
প্রহন চৈতি কে ধমকের স্বরে বলে,”হাসি থামও চৈতি।এত হাসির কি আছে?”
হঠাৎ প্রহনের ধমক শুনে চুপসে যায় চৈতি।হাসির মাঝে আচমকা এই ধমকটা হজম হলো না। চৈতির মন খারাপ দেখে নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত হলো প্রহন। শুধু শুধু মেয়েটার মন খারাপ করে দেওয়া টা একদম উচিত হয়নি।
এখন নিশ্চয় অভীমানে গা ভাসাবে।মেয়েটা বড্ড অভীমানি!
#চলবে,,,