অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-৮

0
2181

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০৮

আজ বাড়ি ফিরতে হবে। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নিয়েছি। বাবা মা দুজনে আপুর শ্বশুড় শাশুড়ির সাথে কথার ঝুলি পাকাচ্ছে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। অবনী এতোক্ষণ ধরে তার দুঃখ গুলো প্রকাশ করেছিলো। মেয়েটার ভারী মন খারাপ। ওর বাণী মতে আমি চলে গেলে ও কার সাথে এতো বক বক করবে। কাকে নিয়ে ও দুষ্টুমি করবে। বেচারী খুব দুঃখ প্রকাশ করলো। আমারও কষ্ট হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ গুলো কত্ত আপন হয়ে উঠলো। কিন্তু এখন যেতে হবে। যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

“যাওয়াটা কি অত্যন্তই জরুরি?” হঠাৎ কারো আহত কণ্ঠস্বরে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করলাম। পাশ ফিরে দেখলাম অরিদ্র দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখটা একদম অন্ধকার মলিন তার মুখশ্রী। কিছু বলার পূর্বেই লজ্জায় মিশিয়ে গেলাম। গতকালের কাণ্ড মাথায় চেপে বসলো। ওই ঘটনার পর থেকে তার সামনে যাই নি আমি। তিনি আবার বললেন, আপনার কি যেতেই হবে?

আমি বললাম, তা যাবো না?

সে বললো, না যাবেন না।

তার অভিমানী সুর। আমি বললাম, কিন্তু যেতে হবে।

সে হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না।

আমি বললাম, ধন্যবাদ অরিদ্র।

সে সন্দিহান কণ্ঠে বললো, ধন্যবাদ কেন?

আমি বললাম, এমনিতেই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

সে আমার দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো, কিন্তু কারণটা কি?

আমি বললাম, আমার বাবাকে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

সে বললো, তাই? আমি কি করেছি এতে?

আমি বললাম, যাই করেছেন। অনেক ধন্যবাদ।

সে বললো, ধন্যবাদে কোন কাজ হচ্ছে না। আমার অন্য কিছু চাই।

অবাক হলাম। কি চাই তার? আমার কাছে কি এমন আছে যা তার চাই? আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, কি?

সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। বললো, এদিকে আসুন।

আমি বুঝতে পারলাম না সে কি চাচ্ছে। বললাম, কোথায়?

সে বললো, আগে আসুন।

সে আমায় আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। এরপর বললেন, আমি চাই এই মুখটায় যাতে সবসময় হাসির রেখা ফুটে থাকে। আমায় কথা দিতে হবে এই চোখ দুটো থেকে আর কখনো জল যাতে না ঝরে।

বেশ অবাক হলাম। মানুষটা সত্যিই অদ্ভুত!

______________

ছেলের আকস্মিক পরিবর্তনে বড্ড ভাবনায় পড়ে গেলেন সুলাইমান সরদার। হঠাৎ শুভ্রের এহেন পরিবর্তনে খুব বিরক্ত তিনি। তার উপর পায়েলের কাছ থেকে গত রাতের কাহিনী শোনার পর মহাশয়ের চোখ কপালে। তার এতো সুন্দর পরিকল্পনায় কি ছেলেটা দল ঢেলে দিবে? এতো দিনের সাজানো গোছানো তার সব আয়োজন কি বিফলে যাবে? নাহ আর ভাবতে পারছে না সে। এতো ভাবনা বিড়ম্বনা শেষে ছেলেকে ডাকতে ব্যস্ত হলেন মহাশয়। দুই তিন বার হাঁক ছাড়লের ছেলের দর্শন মিলে তার। চোখের চশমাটা আলতো হাতে খুলে সামনের রুমালটা দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে ছেলেকে জিজ্ঞাস করলেন,

কেমন আছো তুমি?

শুভ্রের উত্তর দিতে সময় ব্যয় হলো না। চট জলদি বলে ফেললো, সেটা দিয়ে তোমার কি প্রয়োজন? তোমার কাজ তো হয়ে গেছে‌। তুমি ভালো থাকো।

ছেলের এমন উত্তরে আরো বেশি বিরক্ত হলেন সুলাইমান সরদার। নিজের রাগটা দমিয়ে রেখে বললেন, তোমার ব্যাপারে কি শুনলাম শুভ্র কি হচ্ছে এসব?

শুভ্র আগের মতোই দায়সারা ভাবে বললো, কি শুনেছো আবার কোন পাপ করলাম আমি?এক পাপে তো জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার কি হলো?

সুলাইমান মহোদয় এবার প্রচণ্ড বিরক্ত। এতো বড় দামড়া ছেলেকে কি সব ভেঙে বলতে হবে? নিজের রাগটা চেপে বললেন, তুমি বউ মার সাথে এমন আচরণ করেছো কেন?

শুভ্র বললো, বউ মা?? ওকে তো কবেই ছেড়ে দিয়েছি। তোমার কথাতেই তো ছেড়ে দিলাম। সব শেষ করে দিলাম। আবার ওর সাথে কি করবো? ওর সাথে যা করেছি তাতে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য আমি না। এরপর ওকে আর কষ্ট দিতে চাই না‌। ও যেমন আছে ভালো থাকুক।

সুলাইমান মহোদয় এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, আমি পায়েলের কথা বলেছি।

শুভ্র বললো, দেখো বাবা আমি ওকে বিয়ে করি নি। সো সে আমার বউ না‌। দ্বিতীয় বার আর এই কথাটা বলবে না।

মহাশয়ের মেজাজ এবার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো। হুংকার দিয়ে বললেন, কি হয়েছে তোমার? কি বলছো এসব? পাগল হয়ে গেছো নাকি?

শুভ্র তার বাবার দিকে চেয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ পাগল হয়েছি আমি‌। জীবনটা আমার বিষাক্ত লাগছে। তুমি বাবা হয়ে আমার ভালো চাও নি চেয়েছো ক্ষমতা হয়েছো লোভী নিয়েছো ছেলের ভালো থাকা কেড়ে দিয়েছো তাকে দিশেহারা করে। আমি এখন পাগল!

উক্ত বাণী বাবার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো শুভ্র। সুলাইমান মহোদয় চেয়ারের উপর ঠাঁয় বসে রইলেন।

___________________________

পূর্ব গগনে হলদেটে লাল রঙের অরুণ ভেসে বেড়াচ্ছে। মিষ্টি রৌদ্রতাপে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য লীলা ফুটে উঠেছে। বেশ রমরমা পরিবেশ। সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি দেড় ঘণ্টা হলো। রুম্পিতার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু মহারানীর আসার কোন নাম নেই। রুম্পিতা আমার ছোট বেলার বান্ধুবী। কোন অংশে আমার বোন থেকে কম নয় ও। সবটা সময় আমায় সাহস জুগিয়েছে সে। শুভ্র সাথে পরিচয়ের প্রতিটা মূহুর্তই আমাকে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সে। কিন্তু আমার চঞ্চল মন কিছুতেই তাতে সায় দেয় নি। সায় দিয়েছে সেই মিষ্টি কথাগুলোকে। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে আজ সব মিথ্যে!

সময় আরো পেড়িয়ে যাচ্ছে। আমার মেজাজ এখন চুড়ান্ত পর্যায়ে। অন্য সময় হলে বাড়ি যেয়ে খবর করে দিয়ে আসতাম। কিন্তু এখন তো তা সম্ভব না। আমি চাইলেও সম্ভব না। আর যাই হোক মানুষের চোখের দৃষ্টি তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না। আমি চাই না আমার অতীত দিয়ে দ্বিতীয়বার কোন কটুক্তি হোক। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হবো। আমার জগৎকে আমি আবারও আমার অবলীলায় সাজিয়ে নিবো। দাঁতে রোদ বাঁধিয়ে এলেন মহারানী। চোখ মুখ খেয়াল করে বুঝতে পারলাম ঘুম থেকে উঠেই দৌড় দিয়েছে। এতো বেলা অব্দি ঘুমোনো? বড্ড বদলে গেছে রুম্পিতা। আমি মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ও এসে বললো, সরি একটু ঘুমাচ্ছিলাম রে।

আমি বললাম, আসবি না বললেই পারতি। এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলি কেন? এর কোনো মানে হয় রুম্পি!

রুম্পিতা বললো, আমি সরি। আর কখনো হবে না। এই যে কানে ধরছি।

আমি হেসে ফেললাম। রুম্পিতা আমায় জরিয়ে ধরলো। আমি কিছু বললাম না। দুজনে হাঁটতে লাগলাম। রুম্পিতা বললো, কেমন আছিস?

আমি বললাম, ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস?

আমি ভালোই আছি।

আমি মুচকি হেসে বললাম, কি অবস্থা এখন তোর?

এই তো ভালোই। তোর?

তা তো জানিসই। আবার জিজ্ঞেস করছিস?

রুম্পি আমায় বললো, এখনো এগুলো নিয়ে পড়ে থাকবি? তোর জীবনটা কি শেষ রে ইশা? নিজেকে কেন শেষ করে দিচ্ছিস?

আমি বললাম, না একদমই না। আমার জীবন কেন শেষ হবে? আমি আবার সব নতুন করে শুরু করবো। আমার জীবন হবে শেষ থেকে শুরু!

রুম্পিতা হেসে আমায় বললো, পড়াশোনাটা তো বাদ দিলি। ভর্তি হয়ে তো আর সামনে এগোলি না‌। এখন কি করবি?

আমি বললাম, বাবাকে বলেছি। বাবা বলেছে ভার্সিটিতে যাবে।

রুম্পি বললো, তুই সত্যিই আবার…???

আমি বললাম, হ্যাঁ আবারও পড়াশোনা করবো। আমি সামনে এগোবো। আমাকে দেখিয়েই দিতে হবে আমি কোন অংশে কম না রে।

রুম্পিতা আমায় জড়িয়ে ধরলো। বললো, আমার জানু কোন অংশেই কম না এটা আমি জানি। আই লাভ ইউ কলিজা।

আমি বললাম, হয়েছে চল।

দুজনে কথা বলতে বলতেই সামনে এগিয়ে চললাম। রুম্পির থামার কোন নাম নেই। অনেক দিনের জমানো কথাগুলো সে গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। আমিও শুনে যাচ্ছি। কিন্তু হঠাৎই রুম্পি থমকে দাঁড়ালো। আমি বললাম, কি রে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন??

রুম্পি আমায় অবাক করে দিয়ে বললো, সামনে তাকিয়ে দেখ শুভ্র ভাইয়া!

আমি সামনে চোখ ফেরাতেই দেখলাম সেই ব্যক্তিটিকে। সাথে সাথেই চোখে মুখে নেমে পড়লো এক রাশ ঘৃণা! ঘৃণা করি আমি এই ব্যক্তিটিকে!

চলবে…….

(রিচেক হয় নি। অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এখন থেকে নিয়মিত গল্প দিবো ইনশাআল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here