অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-১০

0
1906

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১০

কিন্তু হঠাৎই থেমে গেলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে অপর পক্ষও বিদ্যমান। আমার অনুমান শক্তিকে সত্য প্রমাণিত করে অপর পক্ষ বলে উঠলো, থামলেন কেন ইশারা? গাইতে থাকুন। ভারি মিষ্টি গান তো আপনি!

তাকে দেখা না জানি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। আমি কি স্বপ্নে ঘুরপাক খাচ্ছি? আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অরিদ্র। তিনি সশরীরে উপস্থিত! উনি কখন আসলো? কি করে? বিকেলে না কথা হলো কই একবারও তো বললো না। বারান্দার কপাটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। আমার মাথা ঘুরার উপক্রম‌। এই লোক কখন যে কি করে। সত্যিই অদ্ভুত!

“থামলেন কেন? আবার শুরু করুন। বেশ ভালোই তো লাগছিলো। অপূর্ব কণ্ঠস্বর।”

তার কথায় আমার ধ্যান ফিরলো। ভাবনার সাগর থেকে বিরতি নিয়ে তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লাম।

“আপনি কখন আসলেন?”

“যখন আপনি মনের সুখে গান গাইতে শুরু করেছেন ঠিক তখন।”

“বলেন নি কেন আপনি আসবেন?”

“কেন বললে কি স্পেশাল কিছু রেডি করতেন। কোন সারপ্রাইজ?”

“আপনিই তো বড় সারপ্রাইজ। বলা নেই কওয়া নেই হুট হাট চলে আসলেন!”

কেন আসা বুঝি বারণ? ভারি অন্যায় করে ফেলেছি তো তাহলে!

এই লোক আস্ত একটা বদ। আমার কথার উল্টো উত্তর দিবে। তার এহেন উত্তরে আমার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে।

“না না আমি কি তা বলেছি নাকি? আসা অন্যায় কেন হবে? আপনি যখন খুশি তখন আসতে পারেন।”

আমার বাণী তার কানে পৌঁছাতেই সে তার স্বস্থান পরিবর্তন করে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। হাই তুলে বললো,

“ঠিকই তো আমার শ্বশুড় বাড়ি আমি যখন খুশি তখন আসবো। এতে কার কি?”

আমার অক্ষি কুঠুরি থেকে অক্ষিযুগল বেরিয়ে আসার উপক্রম। তার শ্বশুড় বাড়ি মানে? লোকটার কি মাথা টাথা গেছে নাকি? তার দিকে দৃষ্টি স্থাপনে বুঝতে পারলাম ঘটনার সমীক্ষে সেও বিস্মিত। তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই আমি চট জলদি বলে ফেললাম,

“আপনার শ্বশুড় বাড়ি মানে?”

“আসলে ভাইয়ের শ্বশুড় বাড়ি। ছোট থেকেই বলি ভাইয়ের যা তা আমার তাই এটাও বলে ফেলেছি।”

আমি চাপা হাসি দিয়ে বললাম, “ওহ্ বুঝেছি কখনো কখনো এমন হয়। আরো অনেক কিছু মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়‌। মানে মুখ ফোসকে বেরিয়ে যায়। এরকম হয়ই নো প্রবলেম।”

আমার ধীরে সুস্থে বলা কথাটা হজম করতে তার সময় লাগে নি। আমি যে তাদের বাড়িতে থাকা অবস্থায় সেদিনের কথাটাকে ইঙ্গিত দিয়েছি সে তা ভালোই বুঝেছে। তার মুখটা চুপসে গেছে। শান্ত স্থির ভাবে বললো, “সেদিনের ওটা মিস্টেক ছিলো।”

‘আপনি ইদানিং ভুল বেশি করেন আপনার কি মনে হচ্ছে ডাক্তার?’

আমার কথায় সে বিসম খেলো। মনে মনে নিজেকে বাহবা দিতে লাগলাম। এই প্রথম তাকে ভালো ভাবে জব্দ করতে পেরেছি‌। সে নিরুত্তর।

‘আপনি কি একা এসেছেন ডাক্তার?’

‘আপনার আপাও আছে।’

‘আপু এসেছে!!!! আগে বলবেন না।’

‘জ্বি। কিন্তু আপনি হঠাৎ আমাকে “ডাক্তার” বলে সম্বোধন করলেন? ব্যাপার কি?’

‘বা রে ডাক্তার কে কি মুচি বলবো নাকি?’

আমার কথায় সে আরেক দফা বিস্ময়ে পৌঁছালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আপনার আপা কয়েকদিন ধরে এখানে আসার জন্য জেদ ধরেছে। ভাইয়া তো বাহিরে চলে গিয়েছে। খুব জেদ নিয়ে আছেন তিনি। এই অবস্থায় বেশি স্ট্রেজ নেওয়া ঠিক না। তাই বাধ্য হয়ে সব ফেলে আমাকেই নিয়ে আসতে হলো।’

‘এই অবস্থায় মানে?’

আপনি জানেন না?

তার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করলাম, কি জানি না?

তাকে অনেকটা অবাক দেখাচ্ছে। আমি কি এমন করেছি যে তাকে অবাক হতে হলো? আর ঘটনাটাই বা কি?

সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, আপনি খালা মণি হচ্ছেন ইশারা!

এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলাম। কি বললো সে? আমাদের মাঝেও একটা পুঁচকে আসবে? ছোট ছানা!
আমাদের মাঝে আরেকজন আসবে? ভাবতেই অবাক লাগছে। এতো খুশি কোথায় রাখবো আমি? কিন্তু মুহূর্তেই অভিমান আমায় চেপে ধরলো। এতো খুশির খবরটা আমায় এতো দেরিতে দিলো। আমাকে বললো না? আপু তো একটা বারও বললো না। মুখটায় বিষন্নতার ছায়া বয়ে গেলো। মুখ ফুলিয়ে তার সামনে থেকে চলে গেলাম। পিছন থেকে অনেক বার আমায় ডাকলেন অরিদ্র। আমি তাতে সায় না দিয়ে চলে আসলাম।

‘তোমায় একটা নজর দেখার জন্য এতো দূরে ছুটে আসা। তোমায় দেখার তৃষ্ণা নিবারণে এতো দূরত্ব কেন বলো তো? আমার কাছাকাছি থাকতে পারো না? সারাক্ষণ তোমাকে দেখবো! কবে পারবো? আমি কি সত্যিই সেই সুযোগ পাবো? আমায় দিবে সেই সুযোগ? আমার অপেক্ষার অবসান কি কখনো ঘটবে? জানো তুমি চলে আসার পর কোথাও মন বসাতে পারি না। না বাসায় না হাসপাতালে। আমার সব জায়গায় শূন্যতা। এক ভয়াবহ শূন্যতা। ইশুবতীর শূন্যতা! সবসময় তোমার মুখটাই সামনে ভাসে। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য আমার কত আকুলতা! কি করে তোমায় দেখবো, কবে দেখবো!কত হাহাকার ছিলো আমার মাঝে! নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছিলো। অবশ্য এই শূন্যতা আগেও আমায় ছিঁড়ে খেয়েছে। কিন্তু কি জানো এই শূন্যতা ইদানিং বড্ড বেশি যন্ত্রনা দিচ্ছে। আমি আবারও খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছি! নিজেকে সামলানো আমার জন্য বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে তো এতোটা তোমাতে ডুবে থাকতাম না! এখন একটু বেশিই হচ্ছে। জানি না কেন এমন হচ্ছে। আমার ইশুবতীতে বার বার মগ্ন আমি। আমি আমার ইশুবতীতে গভীর ভাবে আসক্ত। এই আসক্তি মাদক থেকেও কঠিনতর। বড্ড যন্ত্রনাদায়ক এই আসক্তি। প্রতিটা মুহূর্তই আমি এই আসক্তিতে আসক্ত। এই আসক্তির ছোঁয়া থেকে মুক্তি পাওয়া বড্ড কঠিন কাজ। এই জন্মে হয়তো আমি তা পারবো না। তোমাতে মত্ত আমি! এখন খুব রাগ হচ্ছে তোমার তাই না? আমার ইশুবতী যে রেগে গেলো! সরি ভাবি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো আর আমি বলে সব মাটি করে ফেলেছি। তাও অবশ্য ঠিক করেছি। না বললে কি আর আমার ইশু রাঙা চেহারাটা দেখতে পেতাম? রেগে গেলে তোমায় টমেটোর মতো লাল লাগে। একদম একটা লাল টকটকে টমেটো। একটু রেগে থাকো। লাল আভায় রাঙানো ইশুবতী দেখতে কেমন তাও না হয় দেখে নেই!’

নিজের মনের আকুতি গুলো একা একাই আওরাতে লাগলো অরিদ্র‌। তার শূন্যতা কি পাবে পূর্ণতা?

মুখ ফুলিয়ে ড্রইং রুমে এসে পড়লাম। আপু বসে আছে সোফায় সাথে মা বাবাও বিদ্যমান। সবাই বেশ প্রফুল্ল হয়ে মত বিনিময়ে ব্যস্ত। তার মানে তারাও জেনে ফেলেছে ব্যাপারটা? আমি একাই জানতাম না? আরেক রাশ অভিমান আমায় চেপে ধরলো। মুখ ফুলিয়ে গিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। আপু আমায় দেখে বললো, ‘কেমন আছিস ইশা? এতোক্ষণ কোথায় ছিলি হু?’

আমি কিছু বললাম না‌। আজ আপুর সাথে কথা বলবো না বলে ঠিক করলাম। মনে মনে খুশি কিন্তু না জানানোর বেদনায় আমি ব্যাথিত। আপু আমার কাছে এসে বসলো। আমাকে জড়িয়ে বললো, ‘মুখ ফুলিয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে তোর?’

আমি নিরুত্তর বসে রইলাম।

‘জানিস তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে! শুনলে তুই খুশিতে লাফ দিবি।’

আমি তাও কিছু বললাম না।

‘আচ্ছা আমার বোনটার রাগ ভাঙিয়ে দিচ্ছি। খুশির খরবটা হলো তুই….’

‘সে আগেই জেনে গেছে। আর সবার শেষে জেনেছে বলে মুখটাকে পেঁচার মতো করে রেখেছে। আর অপরাধের শাস্তি হিসেবে তোমার সাথে কথা বলবে না বলে পণ করেছে। তাই না ইশারা?’

কুর্ণকহরে কথা গুলো প্রবেশ করতেই ফুঁসে উঠলাম। আমাকে পেঁচার মতো লাগছে? এর একটা শাস্তি তো তার প্রাপ্যই।

‘ও কি করে জানালো অরিদ্র?’

আমি চট করেই বললাম, ‘তোমার দেবরই বলেছে। এ ও বলেছে তুমি ইচ্ছে করেই সবার শেষে আমাকে বলেছো। আর তোমার সাথে যাতে কথা না বলি তাও ওনারই পরামর্শ।’

আমার কথায় আকাশ সম বিস্ময় তার চেহারায় নেমে এলো। আপুর রাগী দৃষ্টি দেখতেই মনে মনে খই ফুটতে শুরু হলো। আমাকে পেঁচা বলার অপরাধের শাস্তি এটাই।

চলবে…..

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here