অপেক্ষার প্রহর পর্ব-৫

0
761

অপেক্ষার প্রহর(পর্ব- ৫)
“আপা কি করিস?” মিলা রান্নাঘরে পাকোড়া ভাজছিল। শওকত সাহেব পাকোড়া খেতে চেয়েছেন।
“কবিতা আবৃত্তি করছি।দেখতেই পারছিস পাকোড়া বানাচ্ছি আবার জিজ্ঞেস করছিস আপা কি করিস?”
“আনিলাদের ইস্কুলে নাকি বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হবে। তা ও যে গানটা সিলেক্ট করেছে সেটা তো গাইতেই পারছে না ঠিকমতো।”
“গাইতে পারছে না চেষ্টা করবে ভাল গাওয়ার। অনুষ্ঠান তো আর কালকেই হচ্ছেনা।”
“কেন জোর করছিস শুধু শুধু একটা ছোট বাচ্চার উপর। মাত্র আট বছর বয়স।”
“ওয়ার্ল্ড এর সবচেয়ে কম বয়সী প্রোগ্রামারের বয়স কত জানিস? সাত বছর। টিভিতে ছোটদের মিউজিক প্রোগ্রামগুলি দেখিস না? কত ছোট ছোট বাচ্চা কত কঠিন কঠিন গান অবলীলায় গেয়ে যাচ্ছে। সেই তুলনায় এই গানতো অনেক সহজ।” মিলার সাথে গানের ব্যাপারে তর্ক করে লাভ নেই। গানের অ আ ক খ জানে না, অথচ ভাব করে গানের উপর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বসে আছে।
“তোর ব্যাপারটা কি বলতো? তুই কি রাশেদকে ফোন করিস না?” রাশেদ মিলার দেবর। মিলার একটা সূক্ষ ইচ্ছে শিলার সাথে রাশেদের বিয়ে হোক।রাশেদ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স এ গ্র্যাজুয়েশান করেছে।একটা বড় কন্সট্রাকশান কম্পানিতে চাকরি করে। মিলা শিলাকে বলেছিল, “শোন তোর দুলাভাইদের মেলা প্রপার্টি। রাশেদের রোজগারও খারাপ না। তারপর আবার ঘরে বসে কি সব ডিজাইনের কাজ করে। সেখান থেকেও ভাল ইনকাম হয়। এত টাকা পয়সা পরের বাড়ির মেয়ে ভোগ করবে কেন? রাশেদকে পটিয়ে একবার যদি বিয়েটা করতে পারিস তাহলে দেখবি ঘরের টাকা ঘরেই থাকবে।”
শিলার রাশেদকে তেমন পছন্দ না।খুব বেশি প্র্যাকটিকাল টাইপের মানুষ। মিলার শ্বশুরবাড়িতে একদিন কথা হচ্ছিল, “রাশেদ ভাই কেমন আছেন? শুনলাম আপনি নাকি ঘরে বাইরে সেইরকম দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন।”
“ঘরে বাইরে দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছি মানে?”
“এই চাকরি করছেন আবার ঘরে বসে ডিজাইন করছেন। ভালই ইনকাম করছেন নাকি।”
“কে বলল, ভাবি? আরে ডিজাইন করে কি তেমন রোজগার করা যায়? মানুষজন নকসার ইঞ্চি ইঞ্চি হিসাব নিবে, কিন্তু টাকাপয়সা দিবে না।অনেক পরিচিত আছে টাকাই দিতে চায় না।” শিলা চুপ করে শুনছে। রাশেদ বলেই যাচ্ছে, “অনেকে যা টাকা দিবে বলে শেষ পর্যন্ত তাও দেয় না। এজন্যই মানুষকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। আমি তো আমার বাবা-মা ছাড়া এই পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস করিনা।”
“বিয়ে করলে বউকেও বিশ্বাস করবেন না?”
“কেন করব? ও আমার জন্য কি করবে যে ওর জন্য আমার বিশ্বাসের দরজা খুলে রাখতে হবে।”
“একটা মেয়ে তার পুরো পৃথিবী ছেড়ে শুধুমাত্র আপনার ভরসায় আপনার কাছে আসবে। তারপরও বলবেন সে আপনার জন্য কিছু করেনি। আপনি তাকে বিশ্বাস করতে পারবেন না?” রাশেদ আর কিছু বলেনি সেদিন।
“তোর দেবর কে আমার পছন্দ না আপা। আর তোদের বাসায় গেলে তোর শাশুড়ি আমার দিকে কেমন আড়চোখে তাকায়, গম্ভীর হয়ে। মনে হয় ভদ্রমহিলা আমায় পছন্দ করেন না।”
“সেজন্যই তো বললাম মাঝে মাঝে রাশেদকে ফোন দে। ওর সাথে ভাব কর।তুই ডাক্তার, ও ইঞ্জিনিয়ার দুইজনে ভাল মিলবে, ভাল রোজগার করবি। এত পড়াশুনা করে কি লাভ, যদি এসব কথাই না ঢুকাতে পারিস মাথায়। বেশি দেরী করলে আমও যাবে ছালাও যাবে। রাশেদকে ইদানীং দেখছি ঘরের দরজা বন্ধ করে কার সাথে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে। যে বান্দাকে রাতে খাবারের জন্য ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে যেতাম সেই বান্দা এখন রাত ১০ টার মধ্যে খাওয়া- দাওয়া করে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। আগে পিয়াসকে (মিলার ছেলে) নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুমাত। এখন আর পিয়াসকে নিজের রুমে এলাউ করে না।জিজ্ঞেস করলে বলে ডিজাইনের কাজ করছি। আমি নিশ্চিত কোন মেয়ের সাথে ইটিস পিটিস চলছে।”
“তাহলে তো তোর মিশন শেষ।আমারও আর ফোন করার তাড়া নেই। একি দুই পিরিচে পাকোড়া বাড়ছিস কেন?”
“বাবা বলল পাশের বাসায় কে যেন এসেছে। তাকে এক পিরিচ দিয়ে আসতে। কে এসেছে রে?”
“নতুন ভাড়াটে। ছেলে একা আছে। মা আর ভাই আসবে গ্রাম থেকে।”
“কেমন দেখতে? ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়ার?”
“উনি একজন মানুষ আর দেখতে মোটামুটি। কিন্তু আমি বুজতে পারছি না বাবা এসব কি শুরু করেছে। আমাদের বাসায় যা কিছু বানানো হবে সব কি ঐ বাসায় দিতে হবে নাকি?” শিলার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
শফিকের বাসার দরজা খোলার পর একটা অপরিচিত ছেলেকে দেখে শিলা ঘাবড়ে গেল। “শফিক সাহেব নেই?”
“ও আপনি।” পেছন থকে শফিক জবাব দিল। সুদীপ্ত বসার ঘরে চলে গেল। শফিক দরজায় এসে দাঁড়াল।
শিলা শফিকের হাতে পাকোড়ার পিরিচ দিয়ে বলল, “বাবা পাঠিয়েছেন। বুজতে পারছি না আপনি বাবার উপর কি জাদু করেছেন।”
“আমিও বুজতে পারছি না যে জাদুর আছর আপনার উপর পড়ার কথা সেটা আপনার উপর না পড়ে আপনার বাবার উপর পড়ছে কেন।”
শিলা অবাক হয়ে গেল। কোন কথা না বলে পেছন ফিরে চলে এল। মনে মনে গাল দিতে লাগল, “অসভ্য, ইতর, বদমাইশ কোথাকার।”
শফিক সুদীপ্তর সামনে পাকোড়া দিয়ে বলল, “নে, পাকোড়া খা।”
“মেয়েটা কে রে? বেশ দেখতে কিন্তু।”
“কিসের বেশ দেখতে। চোখগুলো কুমিরের মত, নাক চ্যাপ্টা। মনে হয় ছোটবেলায় কেউ ঘুসি মেরে নাক-মুখ থেবড়ে দিয়েছে।”
“কুমিরের চোখ দেখতে কেমন?”
“তুই পাকোড়া খা, আমি চা নিয়ে আসছি।”
চা নিয়ে এসে শফিক দেখল সুদীপ্ত টিভির দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। টিভিতে অস্ট্রেলিয়া- নিউজিল্যান্ড এর পুরনো একটা ম্যাচ চলছে। তবে সুদীপ্তর সেদিকে মনোযোগ আছে বলে মনে হল না।
“কিরে খাচ্ছিস না যে?” সুদীপ্ত একটা পাকোড়া হাতে তুলে নিল।
“ইয়াসমিন কেমন আছে?”
“সকালে তো ভালই দেখলাম। এখন কেমন আছে জানিনা।”
“কেন? সারাদিনে কথা হয়নি ফোনে? তুই ফোন দেসনি?”
“সকালবেলা ঝগড়া হয়েছে।দোকান থেকে কি জানি আনতে বলেছিল, আনতে ভুলে গেছি। তাতেই ম্যাডাম রেগে টঙ।”
“বিবাহবার্ষিকীর দিন ঝগড়া করলি?”সুদীপ্ত অবাক হয়ে শফিকের দিকে তাকাল। বিয়ের দিনের কথা ও একদমই ভুলে গিয়েছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, “ও তো আমাকে একবার ফোন করে মনে করিয়ে দিতে পারতো। সবসময় ছেলেরাই কেন মনে রাখবে এই ব্যাপারগুলো, ছেলেরাই কেন প্রথম উইশ করবে, সারপ্রাইজ দিবে। মেয়েরা যতই আধুনিক হয় না কেন দেখবি কিছু কিছু ব্যাপারে বড্ড সেকেলে।”
শফিক হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিল। সুদীপ্ত-ইয়াসমিন দুইজনকেই শফিক খুব পছন্দ করে। ইয়াসমিনও শফিককে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে।শফিককে ভাইজান বলে ডাকে।

“তোর বাসাটা কিন্তু বেশ হয়েছে। নেক্সট টাইম বাড়ি গেলে বলিস আমি আর ইয়াসমিন এসে দুইদিন থেকে যাব তোর বাসায়।”
“তোরা তো এখনও এসে থাকতে পারিস।”
“আমরা কপত-কপোতী প্রেম করব, তুই মাঝখানে কাবাব মে হাড্ডি হবি কেন?”
“বিয়ের এত বছর পরও এত প্রেম থাকে?”
“ আমাদের বিয়ের তিন বছর শেষ হল, তিরিশ বছর না যে প্রেম উবে যাবে।”
“তুই কিন্তু মিরপুরের এদিকে বাসা নিতে পারিস। তোর অফিস তো গুলশানে। এখান থেকে গুলশান যাওয়া এখন সহজ।”
“তা নেয়া যায়। কিন্তু মার বাসা যে মগবাজার। একসাথে না থাকি, কাছাকাছি তো থাকতে পারি।”
“আন্টি কেমন আছে? কথা হয়? তুই বাসায় যাস না?”
“ভালই আছে মোটামুটি। না বাসায় যাইনা। তবে ফোনে কথা হয় প্রায়ই।মাঝে মাঝে কোন রেস্টুরেন্টে দেখা করি মা-ছেলে। মানুষজন প্রেমিকা বা বউকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যায়, আর আমি মাকে নিয়ে যাই।তবে সেটা কমই হয়। কিছুক্ষণ থাকার পরই মা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।” ইয়াসমিনকে বিয়ে করার অপরাধে তিন বছর আগে ঘর ছাড়তে হয় সুদীপ্তর। শফিক সবই জানে।
“তুই কি কোন কিছু নিয়ে টেনশান করছিস?” সুদীপ্তকে বড্ড আনমনে মনে হচ্ছে শফিকের।
“টেনশান হবে না? বিয়ের সময় শেয়ারগুলো বিক্রি করলাম আর পুরান ঢাকার ঐ কাপড়ের ব্যবসা থেকে বাকি টাকাটা পেলাম। এরপর বাসা নেয়া, ঘরের জিনিসপত্র কেনা বাবদ টাকার দরকার ছিল। এর ওর কাছ থেকে ধার করলাম,অফিস থেকে লোন করলাম। আস্তে আস্তে সবগুলো ঋণ শোধ করে উঠলাম, এখন আবার বাচ্চার খরচ সামনে। একটা বাচ্চা হওয়া মানে তো আর চারটিখানি কথা না।”
“বাচ্চা?”
“ইয়াসমিন প্রেগন্যান্ট।”
“ইয়াসমিন প্রেগন্যান্ট? শালা বাপ হবি বলিসনি তো। কতদিন হল?” গর্ভরোধের ব্যাপার-স্যাপার সুদীপ্ত ইয়াসমিনের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। এমনিতেই ওদের বিয়েটা অনেক তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। সুদীপ্তর পরিবার আজ পর্যন্ত এই বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি। নতুন করে আর কাউকে এর মধ্যে জড়াতে চাচ্ছিল না সুদীপ্ত। বাচ্চাটা পেটে আসার পর ঘাবড়ে যায় সুদীপ্ত। ইয়াসমিনই জিদ ধরেছিল, “আল্লাহপাক সবাইকে সন্তান দেন না। আমাদের দিয়েছেন। তার মানে তিনি চাইছেন এই বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসুক। তুমি আর না করোনা প্লিজ।” কঠিন যুক্তি।আল্লাহপাক চাইলে তো সুদীপ্ত আর না করতে পারে না। আসুক বাচ্চা পৃথিবীতে। তবে সুদীপ্তর ধারণা ইয়াসমিনের ও ইচ্ছে ছিল বাচ্চা নেওয়ার। ইয়াসমিন কি তার একাকীত্ব দূর করার জন্যই বাচ্চা নিতে চাচ্ছে?
“পাঁচ মাস। তোর সাথে তো দেখাই হল তিন মাস পর। কি করে বলব?”
সুদীপ্ত শফিকের মাকে কিডনি দিয়েছে। শফিক সবসময় চেয়ে এসেছে সুদীপ্তর জন্য কিছু করার। বাচ্চার খরচের ভয় সুদীপ্তকে করতে দিতে চায়না শফিক। “চিন্তা করছিস কেন? এখনও তো দেরী আছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”
সুদীপ্ত উঠল। “যাই আজকে। তোদের এদিকে তো আবার মেট্রো রেলের কাজ চলছে। রাস্তা কাটা, রাস্তায় জ্যাম হবে, অনেকক্ষণ লাগবে সেগুনবাগিচা যেতে।”
“সেগুনবাগিচা কেন? তোর বাসা না আরামবাগ?”
“আগের বাসা তো ছেড়ে দিয়েছি। প্রায় দুই মাস হল। আগের বাসার বাড়িওয়ালার ছেলেটা অসভ্যতা করেছিল ইয়াসমিনের সাথে।আর এখনকার বাসা থেকে ইয়াসমিনের হাসপাতালটাও কাছেই।”
“কি বলছিস এসব? কোন ক্ষতি করেনি তো?”
“না, সেরকম কিছু করতে পারেনি।গেলাম রে।পরে দেখা হবে।”
শফিক উঠে সুদীপ্তর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, “ইয়াসমিনের খেয়াল রাখিস আর নিজেরও খেয়াল রাখিস।আর টাকা-পয়সা নিয়ে একদম চিন্তা করিস না। দেখিস একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” যেভাবেই হোক শফিককে মাতৃঋণ শোধ করতে হবে। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here